ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ: পর্ব ১


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (November 21, 2023)
     

    ১২ নভেম্বর

    সাদা মেঝের লম্বা একটা হলঘর। পশ্চিম দেওয়াল জুড়ে সারি সারি জানলা। তিনতলার আকাশের  নীচে জোয়ার-ভাঁটা খেলে যাওয়া গঙ্গা। পুবদিকের দেওয়ালের জানলাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে কাঠের ফ্রেমে কাচ দেওয়া বাহারি দরজা। এইরকম একটা ঘরের একপাশে রাখা কাঠের একটা মস্ত লম্বা ইজেল। তেপায়া এবং ফোল্ডিং। তার কাছেই মাটিতে সাজানো থরে থরে ঢাকনা দেওয়া ছোট ছোট টিনের কৌটো। বিদেশ থেকে আনানো গুঁড়ো রং— আর্থ কালার। কিছু রং জলে মিশিয়ে, গুলে রাখা পাথরের বাটিতে। কালো পাথরের সুদৃশ্য হাঁড়িতে রাখা গোছা গোছা তুলি। তামার ঘটিতে স্প্যাচুলা জাতীয় আরও কিছু সরঞ্জাম। তার পাশেই ছোট বড় মাপে, নিজের হাতে কাঠ কুঁদে বানানো জল রাখার দু-দুটো কাঠের গামলা। মস্ত দুটি ট্রাঙ্কে সুন্দর করে মাপে মাপে সাজানো কাগজে মোড়া ছবি, যেগুলো জলরঙে আঁকা। আর তেলরঙের-গুলোর কয়েকটা দেওয়ালে টাঙানো হলেও বেশিরভাগই একপাশে থাক করে দাঁড় করিয়ে রাখা। সিঁড়ির দিকে একটা দরজা ছাড়াও, পুব দেওয়ালে আরও যে দুটি শৌখিন কাচের দরজা, সেখান দিয়ে বেরলেই ঘর লাগোয়া টানা বারান্দা, যেখানে পুবের রোদে সকাল হয়। সেই বারান্দাটাও ভারী কাঠের ফ্রেমে, সাদা কাচের নক্সায় বানানো দুটি পারটিশান দিয়ে দু’পাশে ভাগ করা। ঘরের মধ্যে মাটিতে গদি পাতা বিছানার আশেপাশেই তামার থালায় রাখা কত কী যে টুকিটাকি! প্লাগ-পয়েন্টে লাগানো হিটার, রুপোর চায়ের পট এবং কিছু সিরামিকের কাপ একটা কাঠের বারকোশে। এটাও তাঁর নিজের হাতে বানানো। নিজস্ব নিয়মে ওই ঘরটায় তিনি তাঁর মতো করে থাকেন। তবে আজ তিনি মারা যাচ্ছেন, এক ঘর লোকের সামনে। এমন মৃত্যু-দৃশ্য খুবই অভিনব এবং নাটকীয়ও বটে। গত তিন দিন ধরে একটু একটু করে মারা যাচ্ছেন তিনি। ওই ঘরটা তাই সব সময় জেগে আছে উৎকর্ণ হয়ে। লোকজনে ভরা কিন্তু সকলেই কথা বলছে ফিস ফিস করে। এটাই বোধহয় মৃত্যু-প্রস্তুতি।     

    কালীপুজোর সকালে বাথরুমে অসুস্থ হয়ে পড়লে আর উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। খবর পেয়ে পেল্লায় চতুঃশাল সাবেক বাড়িটার পাশের অংশ থেকে ছুটে এল ভাইপোরা। ধরাধরি করে তুলে এনে শুইয়ে দিল, তাঁর স্টুডিয়ো ঘরেই, সেই মেঝেতে পাতা গদির বিছানায়। পুজোর ছুটির শেষটুকু বাকি ছিল বলে স্ত্রী ও মেয়েরা কলকাতায় ফিরে যায়নি। আর ছিলেন সত্তর পার করা বিধবা মা। ডাক্তার আসাতে জানা গেল যে, এটাও হার্ট অ্যাটাক যা বছর কয়েক আগে আর একবার হয়েছিল। হুড়মুড় করে লোক আসছে। এ ঘরটার সিঁড়ির দরজা সব সময় খোলা থাকলেও, কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না। দু-একজন যারা আসত, তারাও তাঁর অনুমতি পেলে তবেই। আজ সব অবাধ। কেউ আসছে মারা গিয়েছেন ধরে নিয়ে; কেউ শেষ দেখা দেখতে। মাটিতে পাতা গদি, যার ওপর  একটা হরিণের চামড়া বিছিয়ে বসে থাকতেন প্রতিদিন, মস্ত তাকিয়ায় হেলান দিয়ে, সেখানেই শুইয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। তামাটে রঙের মেদহীন সুঠাম শরীর। নায়কোচিত অপূর্ব সৌষ্ঠব, নির্লোম দেহ। দাড়ি-গোঁফ কামানো, কান ঢেকে ঈষৎ লম্বা জুলফিতে, ব্যাক ব্রাশ করা চুল। এ বাড়ির সব পুরুষদের মতোই ঘন ভ্রু, মধ্যিখানে জোড়া। বড় বড় তীব্র চোখ দুটি আজ ক্লান্তিতে ম্লান এবং আধবোজা। নিঃশ্বাসের কষ্টে বুকটা ওঠানামা করছে হাপরের মতো। পাড়ার ডাক্তার এসে  ইন্‌জেকশান দিলেন। একটা কাঠের পাটাতন এনে, তাতেই হেলানের ব্যবস্থা করে আধশোয়া করে রাখা হল তাঁর শরীর। তাঁর বয়স্ক কাকা দাদাদের সামনে ক্রমেই ঝিমিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। সকলে ভাবল, একটু ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। শুধু তিনিই বুঝলেন যে মৃত্যু আসন্ন। সব কিছু একটু সামলে গেলে, মৃদু স্বরে স্ত্রীকে কাছে ডাকলেন তিনি। আড়ষ্ট স্ত্রীর হাতটা আলতো ছুঁয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বড়জোর দু থেকে তিনদিন, তারপরই তুমি স্বাধীন এবং মুক্ত।’

    বিকেলের দিকে এলেন তাঁর দুই জ্ঞাতিভাই এবং মধ্যম শ্যালিকার বর; এঁরা তিনজনেই কলকাতার নামী হাসপাতালের ডাক্তার। নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ গুনগুন করলেও কেউই মুখ ফুটে বললেন না যে, সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। কলকাতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব না হলেও, অন্তত বাড়ির কাছাকাছি কোথাও। হয়তো তাঁর অকুলান আর্থিক সঙ্গতির কথা ভেবেই। এ ব্যাপারে নির্বাক তাঁর স্ত্রীও। উন্মাদের মতো উতলা ভাব দেখা গেল, অন্য একটি ভাড়া বাড়িতে, কাছেই থাকা কুসুম নামে মহিলাটির আচরণে। এই মানুষটিকে জড়িয়ে, কুসুম বিষয়ে কিছু গল্প আছে। সেগুলি যে কুৎসা এমন নয়, বরং কিছুটা বেদনাবহ এবং বিচিত্র। মধ্যবয়সি দোহারা চেহারার কুসুম, বেলার দিকে এসেই ঝপ করে বসে পড়লেন তাঁর মাথার কাছে। সঙ্গে করে আনা হাতপাখাটি দিয়ে হাওয়া করতে শুরু করলেন তাঁকে। সেই বাতাসে জুড়িয়েই কি ঘুম এল তাঁর বন্ধ করে রাখা চোখে! তাঁর স্ত্রী ও মায়ের দিকে তাকিয়ে, মৃদু স্বরে কুসুম বললেন, ‘তোমরা দুটি খেয়ে নাও, আমি এখানে আছি।’ ঘরটা খালি হয়ে যেতেই, তাঁর কপালে হাত রাখলেন কুসুম। চোখ বন্ধ করেই নিজের ঝিমিয়ে পড়া ডানহাতটি ধীরে ধীরে তুলে, তিনি তা রাখলেন তাঁর কপালে রাখা কুসুমের সেই হাতের ওপর। দুজনেরই গাল বেয়ে ঝরে পড়তে লাগল অঝোর অশ্রু।

    জমজমাট কালীপুজো। চারিদিকে পটকা ফাটছে। নিয়নের আলো পছন্দ নয় বলে চিরকালই এ বাড়িতে বাল্‌ব জ্বলে। চল্লিশ পাওয়ারের খান চারেক আলোতেও এত বড় ঘরটা আজ বড় বেশি ম্লান লাগছে। তার কারণ হয়তো বাড়ির বাইরে রোশনাই— দীপাবলির আলো। ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো হচ্ছে। দীপান্বিতা। বাজি ফাটার শব্দে মিশে যাচ্ছে শাঁখের আওয়াজ। এ বাড়িতেও তো পুজো হত। কিন্তু এ বছর তার আয়োজন হয়নি। মাথার ওপর পাঁইপাঁই করে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যান আর গঙ্গার দিকে অতগুলো খোলা জানলা দিয়ে ধেয়ে আসা বাতাসেও তিনি ঘামছেন। খালি গায়ে শুয়ে আছেন; নিম্নাঙ্গে চন্দন রঙের ভাগলপুরি সিল্কের লুঙ্গি। এটাই তাঁর ঘরের পোশাক।   

    পাশের ঘরে দুই মেয়ে। তাদের ঠাকুমার কাছে শুয়েছে। এতক্ষণ ছেলের মাথার কাছে বসে সমানেই হাতপাখা টেনেছেন তিনি। চোখ জলে উপচে এলেও ঘুম আটকাচ্ছে কই! অথচ ঘুমের মধ্যেই যেন জেগে জেগে দেখছেন, তাঁর খোকা একাই হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে শ্মশানের দিকে। শ্মশান আর কত দূরে! বাড়ি থেকে বেরিয়ে, মাঠের মধ্যে দিয়ে গেলে বড়জোর মিনিট দু’য়েক হবে।

    জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে একা দেখতে লাগল, ফুল সাজানো খাটে শুইয়ে তার বাবাকে নিয়ে শবযাত্রা— বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা শ্মশানের দিকে। আর কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকার ছাদ থেকে সে দেখতে পাবে চিতার আগুন, এই লকলকে আগুনই তাকে আলো দেবে কৈশোর পার করতে করতে সারাটা জীবন।

    এক রাত কাটল। মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে। সকাল এসেছে তার নিয়মে, পুবের আকাশে আলো  ছড়াতে ছড়াতে। বিধবা মেজদিদি এসে হাল ধরেছেন সংসারের। ওই গদিরই একপাশে ঘুমিয়ে আছেন স্ত্রী। চল্লিশ হতে এখনও বাকি, আর এক বছর। ফুলের মতো সুন্দর আর নরম। তাঁর হাতটি লুটিয়ে আছে স্ত্রীর কাঁধের কাছে। মা এসে ডেকে দিয়ে গেলেন। চা হয়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী অন্য ঘরে গিয়ে রাতের কাপড় ছেড়ে এসে, চামচে করে চা খাইয়ে দিলেন তাঁকে। কতকাল পরে দুজনে মিলে এক বিছানায় শোয়া এবং একসঙ্গে সকালের চা। যদিও তাঁদের কথা ফুরিয়ে গেছে আজ কয়েক বছর হল। বেডপ্যান নেওয়া এবং গা মোছানো শেষ হলে লম্বা হয়ে শুতে চাইলেন তিনি। পিঠের দিকের পাটাতন সরিয়ে তাঁকে শুইয়ে দিলেন স্ত্রী। তাঁর দীর্ঘ শরীর বিছিয়ে গেল গদির ওপর। চোখ বন্ধ করেই আজ তিনি অনেক কথা বলছেন। দুই মেয়েকে কাছে ডেকে আদর করলেন; বললেন, ‘মায়ের কথা শুনে চলবে, ছবি আঁকা ছাড়বে না।’ বেলা বাড়তেই শুরু হল লোকের ভিড়। আজ তিনি একাই সরব, বাকিরা সবাই স্তব্ধ। ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলি তাঁর স্ত্রী ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারছেন না। কালী… কালী বলে উঠতেই সকলে যখন ভাবছেন যে দেবীকে স্মরণ করছেন তিনি, স্ত্রী বুঝতে পারছেন যে, আসলে তিনি দায়ী করছেন স্ত্রীর গুণমুগ্ধ কালীসাধন-কেই। কলকাতার বাসায় যে লোকটি তাঁর স্ত্রীর ওপরের ফ্ল্যাটেই থাকে। আসলে তারা থাকে দুই বন্ধু মিলে। দুজনেই অবিবাহিত এবং প্রায় যুবক-ই, আর দুজনেই সরকারি চাকুরে। এদের নিয়ে বিস্তর গপ্পো। আপাতত সেটা তোলাই থাক। কালীসাধনের সাহস হয়নি কলকাতা থেকে এই শহরতলিতে, তাঁকে দেখতে আসার। তবে অন্যজন মানে গীতিময় এসে গেছে বিকেলের আগেই। ইন্‌জেকশনের বাহুল্যে তাঁর বাঁ দিকের বাহুটি ফুলে উঠেছে। কাচের বোতলে গরম জল ভরে তোয়ালে মুড়িয়ে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেঁক দিচ্ছে তাঁর বছর বারোর বড় মেয়ে। স্ত্রীর নির্দেশে তাকে সরিয়ে সেঁক দিতে এগিয়ে এল গীতিময়। কিছুক্ষণ পরেই তিনি বললেন, ‘সরিয়ে নাও, জ্বালা করছে।’ তোয়ালে মোড়া গরম জলের বোতলটি সরাতেই দেখা গেল যে, তাঁর বাহুর চামড়া পুড়ে ঝলসে গেছে। উপস্থিত সকলে যখন এ দেখে স্তম্ভিত, পাশে বসা ছটফটে বড় মেয়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দিল গীতিময়ের গালে। ‘ভারি অসভ্য মেয়ে তো’— বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সেই গীতিময়। সেদিন বেরিয়ে গেলেও, পরে অবশ্য তাঁর স্ত্রীর জীবনে বেশ জাঁকিয়েই ফিরে এসেছিল গীতিময়— বছরের পর বছর একসঙ্গে, এক ফ্ল্যাটে থাকতে। সে আবার আরেক গপ্পো।

    সন্ধের দিকে এলেন সুবিমল। তাঁর আর এক জ্ঞাতি ভাই। হাতুড়ে ডাক্তার। থাকেন পূর্ণিয়ায়। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রূপবান এক পুরুষ। ডাক্তারদের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই শুরু করে দিলেন নিজস্ব চিকিৎসা। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে থেকেও কোনও আপত্তি জানালেন না তিনি; তাঁর উচ্চশিক্ষিত, শহরে বসবাসকারী স্ত্রীও সম্মত হলেন সুবিমলের হাতুড়ে চিকিৎসায়। আধো জাগরণে তিনি বুঝলেন যে, সুবিমল আর তাঁর স্ত্রী গুনগুন করে চলেছেন অপার মুগ্ধতায়। এই সুবিমলও প্রথমে  মনে মনে এবং পরে প্রকাশ্যে প্রেমপ্রার্থী ছিল তাঁর স্ত্রীর। সারারাত ধরে তাঁর শরীরে চারিয়ে দেওয়া হতে থাকল ওষুধ নামে কী একটা তরল; দেখতে দেখতে তাঁর পা দুটি ফুলে উঠে পুরোপুরি অবশ  হয়ে গেল। আসন্ন মৃত্যু আরও নিশ্চিত হয়ে ঘিরে ধরল তাঁকে। ভোরবেলা থেকে এতটাই ঝিমিয়ে পড়লেন যে, সকলে ভাবল সুবিমলের ইন্‌জেকশনে যা হোক একটু ঘুমোতে পারলেন তিনি।

    ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে মৃত্যু, তবু আরও এক রাতের আয়ু পেয়েছেন তিনি। রাত কাবার হতেই বাড়ি বাড়ি শাঁখ বাজছে। আজ ভাইফোঁটা। মাস খানেক হল তাঁর বাল্যবিধবা বড়দিদি আবার নিখোঁজ। গভীর বিষাদে ডুবে গেলেই এমনটা হয়। তবে খোঁজখবর করে ফিরিয়েও আনা হয়েছে বার বার; সুস্থ হয়েই তিনি যথারীতি ফিরে যান বোলপুরে, তাঁর কাজের জায়গায়। সেটা একটা আবাসিক ইশকুল। মেজদিদি ঘরে এসে ফোঁটা দিলেন শয্যাশায়ী ভাইকে। কলকাতা থেকে তাঁর ছোটবোন এসেছে কি না জানতে, বার বার চোখ খুলে তাকাচ্ছিলেন সিঁড়ির দরজার দিকে। কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকলেন পাড়াতেই থাকা জ্ঞাতিবোন রমা। বাবু হয়ে বসে, তাঁর মাথাটা নিজের কোলের ওপর তুলে, শিশির মেশানো চন্দনের ফোঁটা দিলেন কপালে। মিছরি ভেজানো এক চামচ ডাবের জল ঢেলে দিলেন তাঁর আধখোলা মুখে। তাঁর স্ত্রী এসে মাথাটা সামান্য উচু করে ধরলে, প্রণাম করলেন রমা। পায়ের পাতাদুটি ভিজে ভিজে হয়ে গেল, রমার উচ্ছ্বসিত কান্নায়। স্তিমিত স্বরে স্ত্রীকে বললেন, ‘রমাকে শান্ত কর।’ শেষবেলায় এসে পৌঁছলেন তাঁর সেই প্রিয় ছোটবোন। ওই দিনই তাঁর নাতনির মুখে-প্রসাদেরও দিন পড়েছিল; সব সেরে আসতে গিয়ে তাই প্রায় বিকেল হয়ে গেল। বোন এসেছে জেনেও কোনও ভাবান্তর ঘটল না তাঁর নিরুত্তাপ মুখে। এর মধ্যেই ঘর লাগোয়া পাশের বারান্দায় আসন পেতে তাঁর দুই ভাইকে ফোঁটা দিচ্ছেন স্ত্রী। বাকি দুই ভাই অন্য প্রদেশে, তাই তাঁদের নামে দেওয়ালে ফোঁটা দিয়েছেন। অল্প দূরত্বেই তাঁর বাপের বাড়ি, বাবা-মা-ভাইবোন নিয়ে সম্পন্ন পরিবার। আঠারো বছরের ছোটভাই রাগে ফুঁসতে লাগল, ভাইফোঁটার আয়োজন করাতে। কান্না এবং চাপা কথায় দিন গড়াল রাতের দিকে। পায়ের ফোলা কমলো না, বলও ফিরে এল না শরীরে। চোখ বন্ধ করে নীরবে জেগে আছেন তিনি।

    আজ আর কোনও উৎসব নেই। ঘর জুড়ে শুধু মৃত্যু-প্রতীক্ষা। চোখ বন্ধ করেই তিনি বললেন, ‘দরজা ছেড়ে দাঁড়াও। ওদের আসতে দাও আমার কাছে।’ অথচ সেখানে কেউ নেই। বেলা হতেই ভিড় হতে শুরু করেছে। মাথার কাছে বৃদ্ধ কাকা আর বিধবা মা-কাকিমার দল। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকলেন এক বিধবা কাকিমাকে, বললেন, ‘মিনু খাব, দাও’, আদুল গায়ের আঁচল সরিয়ে তাঁর মুখের কাছে ঝুঁকে এলেন কাকিমা। লজ্জা পেয়ে মুখ ঘোরালেন স্ত্রী। এমন শেষ ইচ্ছে আর কেউ কখনও জানিয়েছে কি! বেলা দু’টো। মেজদিদি তাঁর স্ত্রীকে ভেতরে ডেকে নিয়ে ভাতের ওপর বেশি করে মাছ বেড়ে দিয়ে খেতে দিলেন। মাথাটা বালিশ থেকে নামিয়ে কোলে তুলে নিলেন তাঁর মা; কপালে ছুইয়ে দিলেন বাড়ির মন্দির থেকে আনা গৃহদেবতা রাধাকান্তের চরণ-তুলসী। সকলে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে বসে থাকলেও, বারান্দার জানলা থেকে তাঁকে দেখছেন শ্বশুরমশাই। সারা জীবনের রাগ-বিদ্বেষ এই শেষ সময়তেও বজায় রইল। তাঁর শেষ নিঃশ্বাস পড়ার আগে অবধি ও-ঘরের বাইরেই রইলেন শ্বশুরমশাই। আর এক জ্ঞাতিভাইকে কাছে ডেকে মৃদু স্বরে বললেন, ‘মাকে দেখিস।’ সেই ভাই জানতে চাইলেন, ‘আর মেয়ে দুজন?’ বললেন, ‘ওদের তো মা আছে।’ বড় মেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল বাবার মুখে জল দিতে বলায়; কোনও রকমে জলটুকু দিয়েই সে পালিয়ে গেল অন্য ঘরে। আট বছরের ছোট মেয়ে ভয় পেয়ে জড়িয়ে থাকল মাকে। পাড়ায় থাকা সেই ডাক্তার ভাই এসে ইন্‌জেকশান দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করাতে তিনি বললেন, ‘থাক। আমি আর বড়জোর পনেরো মিনিট।’ ইশারায় স্ত্রীকে বললেন পায়ের দিকে গিয়ে বসতে। তারপর থেকে অপলক চেয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে। তাঁর আন্দাজ প্রায় সঠিকই ছিল। পনেরো মিনিটের বদলে কুড়ি মিনিট পরে, ধীরে ধীরে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। পশ্চিমের জানলায় তখন জোয়ারে ভাসা গঙ্গা আর পালতোলা নৌকোর সারি।

    নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি আর কপালে চন্দন পরিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল তাঁকে; মাথার দু’পাশে সাজানো রং, তুলি ও ফুলের আয়োজনে স্টুডিয়ো ঘর খালি করে, একতলায় নামিয়ে এনে হরিধ্বনি দিয়ে শুরু হল শ্মশানযাত্রা। কেউ না বুঝুক, তাঁর বড় মেয়ে বুঝেছিল এর অনেক আগেই যে, তাদের বাবা একা হেঁটে চলে গেছেন শ্মশানের দিকে। বাবার মুখাগ্নি করার ভয়ে, তিনতলার উত্তরমুখো ছোট ঘরটার দরজায় খিল দিয়ে সে লুকিয়েছে নিজেকে। জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে একা দেখতে লাগল, ফুল সাজানো খাটে শুইয়ে তার বাবাকে নিয়ে শবযাত্রা— বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা শ্মশানের দিকে। আর কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকার ছাদ থেকে সে দেখতে পাবে চিতার আগুন, এই লকলকে আগুনই তাকে আলো দেবে কৈশোর পার করতে করতে সারাটা জীবন।

    — আমি রুনা। কুসুমের মেয়ে। তাঁর বড় মেয়ের বন্ধু হিসেবে, গত তিনদিন ধরে এ বাড়িতেই আছি। আমার বন্ধু সুগন্ধা এখন খুবই ঘেঁটে আছে দেখে, আমিই এ সব লিখে রাখলাম। আরও হয়তো কেউ কেউ এ ভাবেই লিখে রাখছে। সে সব পরে জানা যাবে।   

     ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook