নওজোয়ান সংঘ। অমল স্যার শ্রেণি সংগ্রামের ক্লাস নিতে এসেছে। হ্যান্ডলুমের ঝোলা ব্যাগে মোচড়ানো লেটারপ্রেসের ছোট-ছোট হলুদ বই। রুগ্ন হরফ। হ্যানয় থেকে সুকর্ণ, হিংসা আর ক্ষমতায়নের হতভম্ব বর্ণনা স্যারের ব্যাগে, ভেজা বিস্ফোরকের মতো ছাপা অক্ষর একটা কড়া রোদের অপেক্ষায় আছে। ‘আনন্দপ্রতিম হাসিখুশি নমশূদ্রর স্বপ্ন হল রাজার জন্য যুদ্ধ এবং দেশের জন্য অন্যের ফেলে রাখা কাজ শেষ করা’— দারুণ বলেন অমল স্যার, না বুঝলেও শুনতে ইচ্ছে করে। আজ রবিবার। খানিকটা রাগ করার দিন। নিম-কাঁঠালের দুরন্ত হাওয়া, রান্নাঘর থেকে রোদের মধ্যে মাখামাখি খাসির মাংসের দারচিনি-লবঙ্গগন্ধ মাতাল করে দিচ্ছে পাড়া। আমের অম্বলে পুড়ছে সর্ষে, কালো জিরা। ঠান্ডা হচ্ছে ডেচকির ভাত। বাড়ছে ছুটির দিনের খিদে। চিলের ভয়ে দুপুরে কাকেরা টিনের চাল ছেড়ে বেল গাছে। নওজোয়ানের কর্মশালায় প্রান্ত মানুষের ঘুরে দাঁড়াবার গল্প নিয়ে অমল আসে, মাসে একবার।
এক-এক করে আসছে সবাই। তপন-স্বপন এসে গেছে। এসেছে সুধাময়ের মেয়ে বুরন। চায়ের কেটলি ঘুরছে মাটির কাপে। সতরঞ্চি ভরাতে শুরু করেছে লোক। একটু পরে সুধাময়। একার হাতে ধরে রেখেছে নওজোয়ান। কঠিন কাজ। পাড়ার পুজো কংগ্রেসের হাতে। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে— মধূবাবুর নানাবিধ দেশপ্রেমের গান। সুভাষচন্দ্র, দেশবন্ধু, অগাস্টেরর কুচকাওয়াজ। শুধু লেনিন আর যৌথখামার দিয়ে সংগঠন করা মুশকিল। আনা হয়েছে শেকল ভাঙার গান। চে, ভিয়েতনাম। ব্যক্তি গৌরবের সাথে সংস্কৃতি আর শরীর নির্মাণ, এই দুই আশ্চর্য মাদক একসাথে মিশিয়ে সুধাময় তৈরি করেছে নওজোয়ান। বাহু-সৌষ্ঠব, স্বাস্থ্য ও সাহস নিশ্চিন্ত করবে শান্তিপ্রিয় ও স্বনির্ভর জনপদ। সুধাময় কষ্ট করে গড়ে তুলতে চায় একটা সুখী নেশন। তপন-স্বপন রাস্তা দিয়ে হাঁটলে সবাই ভাবে এ-পাড়ায় ভাল কিছু হচ্ছে। গাট্টাগোট্টা, পিঠের ওপর দানা-দানা মাংসে অতিবৃষ্টির ঢেউ, বুকের ওপর ঝুলছে দুটো নম্র কড়াই, উন্নত তবু শির। নওজোয়ানের ব্যায়াম-সূর্য। কী অপূর্ব শরীর, অনেকটা অপরাজেয়। শুধু কলোনির নয়, এরা বাংলার শৌর্যবীর্য, নির্ভীক। নেমন্তন্নবাড়ির দই-মিষ্টি খায় না। মিষ্টি স্বভাব। সবাই ভালবাসে, ভয় করে। আর মনে হয় দাঙ্গা হবে না। ওরা ভাল মানবীর ছেলে!
এসেছে ইলেকট্রিসিটি। এসেছে প্রতিরোধের নাটক। নওজোয়ান থিয়েটার করে, বছরে দু’বার। না-মিশলে মনে হয় একটু গোলমেলে কিন্তু সাম্যবিধুর, সাম্রাজ্যবাদ-কে ধিক্কার দেওয়া, উচ্চারণে ভালো, ট্যারাব্যাঁকা প্রশ্ন করে এমন ক’জন নিয়ে নাটকের দল। এরা ফুটবল খেলে না, মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। কখনও রতন ঘোষ, কখনও চেকভ। ম্যানতমারা ব্যায়ামবীরদের খাটো চোখে দেখে পরিচয় বোস। ইতিমধ্যে কয়েকটা অন্ত্যমিলের কবিতাও লিখেছে পরিচয়। কাকা ইপটা করে, টাইম আর স্পেস নিয়ে কাজ করছে অনেক দিন। পড়ে ফেলেছে স্তানিস্লাভস্কির নাট্যজীবন। পরিচয় জেনেছে যে, প্রতিবাদের ভাষা শুধু নাটকের শরীর থেকেই মানুষকে আন্দোলনের ফুলকি দেয়।
এই সংঘে আরও আছে প্রীতিকর একটা আকাঙ্ক্ষা— পুনর্বাসন। পেতে হবে দু’কাঠা জমির দলিল। সরকারের থেকে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদের উদ্বাস্তু প্যাকেজ, ভালো রেশন দোকান, বড় রাস্তায় একটা কংক্রিট কালভার্ট আর একটি বালিকা বিদ্যালয়। নোয়াখালির কাটাকাটির পর এখানে ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষৌরজীবী, ঘরামি ও কুলাক— সবাইকে নিয়ে সুধাময় স্বপ্ন দেখে চতুর্বর্ণ চুরমার করে গড়ে উঠছে ইকুয়াল সমাজ। এই স্বপ্নে বিশ্বাসের আঁচ হয়ে লেগে আছে অমল মাস্টার।
অনুদানের হলুদ বালব, উঠোনে আঁধার। ক্লাবঘরে অমল বলতে শুরু করেছে জাগরণের গল্প, ভলগার ক্ষেত মজুররা কীভাবে ফিরে পেল সম্মানের যাপন; কঙ্গোর রবার বাগানে নিরন্ন কালো মানুষেরা মধ্যরাতে গড়ে তুলছে ভূমিপুত্রের সশস্ত্র স্বেচ্ছাসৈনিক। বলছে আমাদের ভাগিদারি চাই। পরিচয় বিশ্বাস করে ফ্যাক্টরির সাবান, বৃষ্টির জল, খেজুর গুড়, এপ্রিলের হাওয়া আর ভোরের কলতলায় কলোনির সবার অধিকার সমান। পরিচয় এই লড়াইয়ে নাটককেই হাতিয়ার করতে চায়।
কয়েক বছর হল পার্টি ভাগ হয়ে গেছে। স্বাধীন কলোনি অনেকে কষ্ট করে আটকে দিয়েছে ভাঙনের জল। ক্লাবে যারা ছিল, সবাই কমিউনিস্ট রয়ে গেছে। আর ভাগাভাগি নয়। বরিশালকে বাদ দিয়ে ফরিদপুর, কুমিল্লা আর নোয়াখালি মিলে কেরোসিনের লাইনে সবাই একসাথে দাঁড়ায়। অস্থায়ী স্বাস্থ্য ছাউনিতে কলেরার টিকা নিতে স্বজনপোষণের সেরকম বড় অভিযোগ শোনা যায়নি। শান্তি, মৈত্রী, প্রগতি, হেমাঙ্গের গান আর রোবসনের অনুবাদের সুরে, সব কিছু না হলেও, কিছু-কিছু জয় করার তীব্র বাসনা কলোনির এক নিরুপম ইচ্ছে হয়ে আছে। এই ইচ্ছের সাঁঝবাতি সুধাময়ের নওজোয়ান। এখানে ধূমপান নিষেধ, জুতো বাইরে রাখো এবং মেয়েদের মেম্বার করা যাবে না। শুধু শনিবার দুপুরে অকশন ব্রিজ। সন্ধ্যায় শ্রেণি সংগ্রাম। ডাম্বেল, কেটলি বল, লোহার রড, পাঁচ কিলো, দশ কিলো। লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাইসেপ-দুপুর চিলের মতো ভাসে। ক্লাব-পুকুরে মুখ বুজে ডুবে আছে আকাশ। জলের গভীরে উড়ছে এক ঝাঁক কালো চড়ুই।
কালীপুজোর পর নওজোয়ানের অ্যানুয়াল ফাংশন। প্রথমে ছেলেরা দেখাবে গত ছ-মাসে শরীর কীভাবে সাদরে গড়ে তুলেছে। মঞ্চে সুধাময়ের জনস্বাস্থ্য আর পেশি সন্ত্রাসের সুন্দর মুখ অবাক মাসি-কাকিমাদের ষান্মাসিক কলরবে একটা নতুন মাত্রা এনে দেয়। বাড়ির বাইরে পুরুষমানুষ শরীর নিয়ে এত আধ্যাত্মিক হয় না। তারপর পরিচয়ের নাটক। টানটান অবহেলার গল্প। খুব কাঁদতে হয়। স্বাধীন কলোনি নাটক দেখার পর ভুলে যায় তাদের নিজেদের না-পাওয়ার জর্জর ইতিহাস। উলটে ওরা ভাবে, কীভাবে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়! মাঝি-মাল্লারা কবে নদীর আক্রোশে পড়বে; ভূমিহীনদের হাত থেকে চলে যাচ্ছে ডালের বাটি, ধানশীষ; ধুলোর গ্রামে চাষিবউকে কেন যে লাথি মারছে থানার সাব-ইন্সপেক্টর; অখাদ্যের আগুনে চাই হয়ে যাচ্ছে দিনমজুরের খিদে। সরকার চাইলে কি পারে না কয়লাখনিগুলো সংস্কার করে শ্রমিকের জীবন বাঁচাতে! পরিচয় চেয়েছিল বহুবার, সুধাকাকার সাথে যাবে নিপীড়িতদের সঙ্গে একটু আলাপ করতে। কিন্তু সুধাময় নেয়নি। খাদির পাঞ্জাবি পরে, মানুষকে বুঝতে, দূর গ্রামে সুধাময় একা চলে যেত। এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে, গোলসি বা রায়গঞ্জ।
অধিকারের বোধ এখানে ঝিঁঝির কূজনের মতো গাছতলা ভরিয়ে রাখে। এতগুলো মানুষের কথা ভেবে সদর দরজায় খিল তোলার আগেই পেঁচা এসে যায় অন্ধ আমড়া গাছে। তবু সকাল লালচে হবার আগেই জল তুলতে বেরিয়ে পরে ভোরের কলোনি। সবাই ভুলে গেছে ছেচল্লিশের উৎখাত। ভুলে গেছে কালোজাম গাছের নীচে শেষ নিশ্বাসের পর শায়িত-রক্তাক্ত আলোয়ান, বাবা সুরেন্দ্রমোহন। পালিত হাঁসের দল যদি অস্থির হইচই না করত, জানতেও পারা যেত না যে হত্যার পর ওঁর সম্মানে রক্তাক্ত কাপড় সরিয়ে মলমলের ধুতি আর সাদা ফতুয়া পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মাথার কাছে এক মালসা খই। হিংসার মুখ কত মানবিক! যদিও সেদিন লেবু গাছে ফুল ছিল না, একটি চিন্তিত কাঠবেড়াল ছিল। লাল কর্ণকীট পটল মাচার দিকে নির্ভয় হাঁটছিল। লক্ষ্মীপূর্ণিমার উনুন থেকে নারকেলের, তিলের বাতাস তখনও ছাই হয়ে যায়নি।
এবার চা-বাগানের শোষণ নিয়ে পরিচয়ের নতুন নাটক। অমল স্যার বলেছিল, ‘বাদ দে, অন্য কিছু কর! সাদা-কালো রগচটা নাটকের দিন পৃথিবীতে শেষ হয়ে গেছে। আরও অনেক গভীরে যেতে হবে।’ আজকাল অমল স্যারের কথার আগুন মাঝে মাঝে নিভে যাচ্ছে। নিজের ভাষণকেই কীরকম সন্দেহ করেন! সুধাময় কাকা বোঝাতেন বিক্রি হয়ে যাবার আগে মানুষ তার অর্জিত বোধকে লোহার শিকল বলে ভাবে। অমল স্যারকে কি কংগ্রেস কিনে নেবে? নিক, তবু তিনি একটাই লোক যে পরিচয়ের জন্য নতুন জানালা খুলে দেয়। যা কিছু গৃহীত, তাকে পরিহাস করতে শেখায়।
আর মাস তিনেক বাকি, প্রচুর রিহার্সাল দরকার। তপন-স্বপন এসে গেছে। স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ডাম্বেল তুলছে তপন, ডান হাতে কুড়ি আর বাম হাতে আরও কুড়ি বার। ঊরুর মাসল-এর ওপর কাজ করে যাচ্ছে দুর্দান্ত স্বপন। চিনির দানার মতো ওর পিঠে ঘাম উঠছে ছোট-ছোট। পরিচয়রা ক্যারেক্টার অ্যানালিসিস করছে, পাশের ঘরে। গমগম করছে নওজোয়ান। পরিচয় বড় কিছু ভাবছে, নিজের প্রোডাকশন! এবার প্রথম বাইরের মেয়েরা আসবে। দুটি মহিলা চরিত্র আছে। স্বামী যখন ওভারটাইম করে, একজন পাহাড়ের কুলিটোলার নিভন্ত উনুনের সামনে বসে বেদনার গান গায়। আরেকজন ছেলের টাইফয়েডের ওষুধ কিনতে বাগানের ম্যানেজারের কুপ্রস্তাবে না করে না। কিন্তু যেদিন ম্যানেজার স্বামীকে থাপ্পড় মারে, কৃষ্ণবর্ণের শীর্ণ সেই যুবতী তার মুখোশ খুলে দেয়। সাঁওতালি বাংলা বলতে হবে। দরকার ইন্টেলিজেন্ট অভিনয়, প্রচুর লেয়ার আছে। পরিচয়ের নাট্যগুরু ইউবিআই-তে অফিস-নাটক ডাইরেকশন দেয় আর পুরীর হলিডে হোম দেখাশোনা করে। দুজন দারুণ মেয়ে পাঠাবে। মেয়েরা রাজি হয়ে গেছে। ওরা ভালো কাজ, নতুন কিছু খুঁজছে। কয়েকটা সিন পড়ে ওরা স্তম্ভিত!
তপন-স্বপন এবার তাক লাগিয়ে দেবার কথা ভাবছে। ক্রিয়েটিভ কোরিওগ্রাফি অফ মাসল। এই ইংরেজি ওরা শিখেছে বুরনের নাচের ইস্কুল থেকে। শরীর আসলে মহামায়া। শক্তি আসলে ভালবাসার করুণাময় রূপ। কনসেপ্টটা বেশ ভাল। চায়কোভস্কি-র ‘সোয়ান লেক’ থেকে কিছু পিস বাজবে আর দুজনে ছন্দোবদ্ধ কিন্তু খণ্ড শরীর দিয়ে সম্প্রীতির গল্প বলবে। পরিচয় যদিও বলেছে, ‘কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, এটা জটিল কল্পনা। পাড়ার মহিলারা আনন্দ পাবে না। তোদের এক্সপ্রেশন তো তোদের বডি। বরং তেল আর মধু মেখে বডি দেখা, লোকে নেবে।’ উপেক্ষায় হেসেছে স্বপন। এরা শরীর বোঝে না! যা হোক, ভাল খবর, ব্যায়ামের দল প্রোগ্রাম শেষ হওয়া অব্দি একটা করে সেদ্ধ ডিম পাবে। এখন প্রোটিন দরকার। নাটকের জন্য যত খুশি গরম চা। ফ্রি। বোর্ড অ্যাপ্রুভ করেছে। স্বপনের রং ফর্সা, এক জোড়া গ্লসি সবুজ নেংটি অর্ডার দিয়েছে। সময় কম, পায়ের লোম তুলতে শুরু করে দিয়েছে।
অমল স্যার এসেছে, কীরকম চলছে নাটকের মার-মোচড় একটু ঝালিয়ে দেখে নেবে। সকাল-সকাল। মিলনের চায়ের দোকান। পরিচয়ের বড় ভরসা অমল। অনেকক্ষণ ধরে এই নাটক কী অ্যাচিভ করতে চাইছে, পরিচয় নানা ভাবে বোঝাতে চাইছে। কোথাও যেন উৎসাহ হারিয়েছেন স্যার। ওঁর মুখের ভাষায় পরিচয় আনন্দ পাচ্ছে না। ‘সাঁওতাল পাড়ায় কেন গেছিস? এত আর্ট-আর্ট করে হল্লা করিস না। শিল্প কোনও বড় রকম চেঞ্জ আনতে পারে না। কিছু পালটাবার ক্ষমতা নেই।’ অমল স্যার মাঝে মাঝে ফিল্টার ছাড়া ক্যাপস্টান, দেশলাইয়ের বাক্সে টোকা মারছেন। ‘ঠিক আছে, ভেবেছিস যখন! ভালোই তো, কলোনির লোক চা-বাগানের একটা রিয়ালিস্টিক ছবি পাবে। শেষমেশ সবার গল্প আছে। গল্পই ক্ষমতার উৎস। বন্দুকের নল নয়। বল, যত পারিস। আমাদের বলা গল্পগুলো রেললাইনের ওপার থেকে খুঁজে আনা জলা ডোবার, জুট কলের— এগুলো থাকবে না। আমাদের গল্পরা খুব সাধারণ। রোজকার স্বার্থের, আবেগের, ইচ্ছের, কষ্টের গল্প। মাঝে মাঝে মঞ্চে বা সদনে ছাড়া প্রান্ত মানুষের কোনও গ্রাহক নেই।’ ‘স্যার, ওমলেট বলি?’ ‘পেয়াজ কুঁচিয়ে দিতে বলিস। রিটায়ার বুড়োরা আসবে আমাদের অভিনন্দন জানাতে। সংখ্যাগরিষ্ঠর লাভ ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়। মুষ্টিমেয়র গরিমা আর পুষ্টির জন্য আমাদের আর্টের কারবার করতেই হবে।’ পরিচয় ভয় পেতে থাকে। আজ বোধহয় ও চেঞ্জ হয়ে যাবে, যা ও কখনও হতে চায় না। স্যার বিরক্ত? আজকের স্যারের ভাষা কীরকম অবিশ্বাসীর মতো শোনাচ্ছে। না কি এ-সপ্তাহে উনি কোনও নির্জলা তর্ক করেননি! এক-এক দিন হয়, অমল ক্যাপস্টানের ধোঁয়ার মতো সংশয় আর ক্ষোভ ওড়াতে থাকে। এক গ্রাস সিগারেটের ধোঁয়া পরিচয়ের মুখ ভরিয়ে দেয়। পরিচয় কাশতে শুরু করে। যদিও স্যার মেয়েচরিত্র দুটো শেষ অব্দি আরেকটু ঘষেমেজে ইম্প্রুভ করেছে।
নাটকের ছেলেরা দুপুর-দুপর বসে পড়েছে। সবার হাতে সংলাপ আর সিচুয়েশন। একটা রিক্সা এসে থামল। বুলবুলি, পরমা নামল। এক গাদা হাঁস ওদের ঘিরে ধরল। ঘামের অপরিচিত গন্ধে হাঁসেরা অবিশ্বাসের ডাক দিতে শুরু করল। নওজোয়ানে ঢুকেই একটা ছোট অনাদরের বাগান। ফুল এখনও ফোটেনি জবায়। মাঝে মাঝে ঘাস। ঘাসের ওপর মাটি মাখা ভাটার ইট সাপের মতো বেঁকে ঢুকে গেছে ব্যায়ামের ঘরে। ক্লাবের নোটিশ বোর্ড। মরচের জাল দিয়ে ঢাকা। সামনে দাঁড়িয়ে পরমা। দুটি বিনুনিতে লাল কচ্ছপের ক্লিপ। ভেজা মাটির গন্ধ লাগে ওর নাকে। উঁকি দেয়, ভেতরে দেওয়ালে বিরাট দুটো ছবি, সাহেব বডি বিল্ডার। হাতের গুলি চিরে বেরিয়ে আসছে ধমনি, চামড়ার নীচে পাক খাওয়া হাই-টেনশন ইলেকট্রিক তার, নাভি অব্দি নেমে গেছে। একটা চমৎকার নতুন পরিবেশ। গরমের ছুটিতে ইস্কুলের ভ্রমণ কাগজে লেখা জেলার সাবডিভিশনের দুপুর মনে হচ্ছে। লোহার বল, জংধরা লোহার চাকা। শুকনো নারকেল দড়ি। কাচ-ভাঙা আলমারিতে পিতলের ট্রফি। ভয় করছে বুলবুলির। ভেতর থেকে আসছে হালকা কথাবার্তা। ছেঁড়া কলাপাতার বিস্তৃত আলোছায়া দেওয়াল থেকে আয়নায়। শো-শো করে চায়ের জল ফুটছে। ছোট টেবিলের ওপর সোভিয়েত দেশ। ছেলেদের আঁশটে গন্ধ। গান্ধীজি আর লেনিনের মাঝখানে সাদাকালোয় লৌহমানব নীলমনি দাস। দেওয়ালে চুন-সুরকি দিয়ে লেখা ‘আমরা গড়ি শক্তিশালী বাংলা। ঝান্ডা উঁচা রহে হামারা।’ ফ্রেম নেই, ধুলোয় ভরে গেছে দেওয়ালের কার্ল মার্কস।
‘আছেন?’ বড় চোখ করে বুলবুলি। ওর নাকছাবিতে রোদ পড়েনি।। পরমার দিকে তাকায়। বেরিয়ে আসে এক ঝাঁক সাধারণ ছেলে।
দুটো ঘরের মাঝে দরজা বন্ধ, একটা ছোট জানালা। পাল্লা নেই। তপনের ইন্টারেস্ট নেই ওখানে নাট্য কোম্পানি কী করছে। একটা-একটা করে জামার বোতাম খুলছে। নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে ওর মনখারাপ হয়ে যায়। ঝুলে যাচ্ছে শরীর। আর নয়, এবার মনযোগ দিয়ে মাসল ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে।
একটা-দুটো জোকস সবে শুরু হয়েছে। সুতরাং হেসে ওঠে বুলবুলি। কার গলা? আগে তো শুনিনি! তপন বুঝতে চেষ্টা করে। জামার বোতাম আটকে নেয়। জানলা দিয়ে মাথা উঁচিয়ে দেখে দুটো কলকাতার শাড়ি। এরা কারা! নাটকের ঘরে ঢোকে। আলাপ হল, বুলবুলি আর পরমা। পরমা তপনের বিরাট শরীরে চোখ রাখতে চাইছে না। স্বপনও এসেছে। ভালই লাগল কেশতেলের গন্ধ আর ফিকে ল্যাভেন্ডার। চা হল দু’বার। ওরা কণিকার গান ভালবাসে। তপন-স্বপন কখনও কণিকা শোনেনি। কাচের ডিশ, তপন দুটো সেদ্ধ ডিম নিয়ে এল। অসম্ভব লজ্জা, বুলবুলি কিছুতেই খাবে না। হাফবয়েল। উষ্ণ লাভার মতো বেরিয়ে আস্তে চাইছে অস্ফুট কুসুম। সাদা অংশে ফাটল ধরেছে। ভেতরে কাঁচা হলুদ টলোমলো। গরম বাষ্প বেরিয়ে আসছে। স্বপন একটা চামচ দিল। ডিমটা গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। পরিচয় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ধরুন, ধরুন।’ অসহায় পরমা বিপন্ন প্রশ্ন করে, ‘খেতেই হবে?’ ‘প্লিজ দিদি।’ এই সমস্বর বুলবুলিকে একটু দুর্বল করে দেয়। বুলবুলি আর কাউকে অসম্মান করতে চায় না। শ্যামবর্ণ ক্লিষ্ট আঙুল, ধীরে ডিমটা মুখে তুলে একটা লাজুক কামড় দেয়। ঠোঁট ভিজে, ঝুলে পড়ে আঠালো কুসুম। নাকছাবি ঢেকে গেছে ডিমের হলুদে। কোনও রকমে গিলতে গিয়ে শাড়িতে পরে যায়। নাট্যকর্মীরা হাততালি দিয়ে ঢেকে দিল বুলবুলির স্নায়ু বিপর্যয়। অনেকদিন বাদে একটা ভাল দিন কাটল। তবে অসম্ভব অসম্মানের ভয়ে কুঁচকে গেল তপন-স্বপন। মেয়েদের সামনে ব্যায়াম করবে কীভাবে?
নওজোয়ানে বিভাজনের সকাল। পাখিরা খাবার আনতে ঝিল পার করে উড়ে গেছে। ক্লাব-পুকুরে কাঁচা বাসের ঘাটলা, একটা পানকৌড়ি জল থেকে খুঁজে যাচ্ছে মাছ। তপন-স্বপন আর তাদের নব্য অনুচর গর্জন শরীরচর্চা শুরু করেছে। গর্জনের হাফপ্যান্ট, খালি গা। পরিচয়ের কানে গেছে যে মেয়েদের নিয়ে ক্লাবে নাটক করা যাবে না। সুধাময় ব্যাপারটা মানতে পারছে না। মেয়েদের সামনে নাকি ছেলেদের নেংটি পরে থাকতে হচ্ছে। ছেলেদের এমন একটা বিড়ম্বনায় ফেলে দেওয়া ঠিক হয়নি। বেপাড়ার মেয়েদের সামনে শরীরের আরাধনা সামাজিক নয়। ধ্যানভঙ্গের উস্কানি মার্জনা করা যায় না।
খালি গায়ের তপন, স্বপন আর গর্জন। তপন সবে নব্বই তুলেছে। দম নিচ্ছে ফুসফুস ভরে। এক টানে তুলে ফেলবে মাথার ওপর। তুলেছে। জাস্ট আরেকটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাটিতে ফেলবে। হই হই করে ঢুকে পড়ল নাটকের দল। স্বপন গামছা দিয়ে বুক ঢেকে ফেলল। বুলবুলির চোখে খয়েরি গগলস। ঠোঁটে ম্যাচিং লিপস্টিক। তর্জনী দিয়ে গগল্স সেট করে নিল। বিধান সরণি থেকে কেনা সেন্টের গন্ধে তপন আর সামলাতে না পেরে প্রায় নিজের পায়ের ওপর ফেলে দিল নব্বই কিলো। ভাল মনের মেয়ে পরমা আজও তপনের বুকে ছায়াপথের মতো শানিত খাঁজ দেখতে চাইল না। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল তপন-স্বপন। ওদের বডিতে যেন কেউ পাপ লেপে দিল। পরিচয় থামাবার চেষ্টা করল। ‘আরে দাঁড়া, যাস না। লাগেনি তো?’
পরিচয় বুঝতে পারছে ব্যাপারটা ভাল দিকে যাচ্ছে না। একটা সিন হয়তো রিহার্স করা যেতে পারে। ‘আমরা শুরু করি।’ গর্জনের আজ একশোটা ডন দিতেই হবে, পঞ্চাশ করে দু’বার। অমনোযোগী গর্জন শুরু করে ডন। দরজার ফাঁক দিয়ে পারমিতা দেখতে থাকে সুপুষ্ট ওঠা-নামা, গর্জনের অর্ধেক ভেজা কৃষ্ণবর্ণ শরীর। তার সামান্য ছায়া পড়েছে মাটিতে। পরিচয় ডাকে : ‘পারমিতা আমরা একটু কাজে ফিরে আসি!’
গর্জনের মনে হল ওকে কেউ গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। প্রত্যেকটা ডনের আগে-পরে ওর লজ্জ্বা আর ভয় বাড়তে থাকল। মনে হল ওকে ছোট করা হচ্ছে। ওর পেশি থেকে সাহস চলে যাচ্ছে। হঠাৎ দরজায় একটা লাথি দিয়ে গর্জন বেরিয়ে গেল। কাঁপতে-কাঁপতে দরজা আরেকবার চিৎকার করে থেমে গেল। পরিচয়ের মনখারাপ হতে থাকে। সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এই নাটক কি হবে? ওর প্রথম লিখিত প্রয়াস! মেয়েদের মুখে সন্দেহের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পারমিতা জানিয়ে দেয় এভাবে অপমান করলে এই নাটকে আর থাকতে পারবে না। অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করে কলোনিতে এসেছে। ওরা শুনেছিল স্বাধীন কলোনিতে একটা কালচারাল স্পেস আছে। কিন্তু এখানে নাটকের সন্মান নেই।
সারাদিন কথা চালাচালি, ফিসফাস। ঘন-ঘন মিটিং করছে অমল। নতুন একটা রিহার্সালের জায়গা খুঁজছে। সবাই প্রশ্ন করে যাচ্ছে, ‘কী হচ্ছে বল তো!’ কারো যেন জানা নেই। একটা লজ্জার গল্প রাতারাতি উঠোন থেকে চা লাঠি-বিস্কুটের দোকান অব্দি চলে গেছে। পরিচয়রা ঠিক করেছে, নো কম্প্রোমাইজ। সুধাময় আর ঝুঁকি নিতে চায় না। তমলুকে ছিল কৃষক সম্মেলনে। ট্রেনে করে বয়ে আনা মফস্সলের ধুলো এখনও ওর মাথায় কাঁকর হয়ে আছে। টলটল করছে জল। পুকুরে কাঁচা বাঁশের ঘাটলায় চিন্তিত সুধাময়, নিজের ছায়া দেখে জলে। গুড়াকু দিয়ে দাঁত মেজে যাচ্ছে। পুকুরের এপার থেকে দেখা যায় নওজোয়ানের টিনের সাইন বোর্ড। শত্রু-মিত্র ভাগ করার সময় এসেছে। এখনও অনেক কাজ। বাঁশ ঘাটে অপলক, নওজোয়ানের প্রতিষ্টাতা সুধাময় মেঘের মতো ভাসে ক্লাব-পুকুরে। নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। দাঁত ঘষে যায়। মাঝে মাঝে খয়েরি ছাপ ফেলে জলে। রোদের তাপ ওর শরীর গরম করতে থাকে। চার্চিল কীভাবে এই ক্রাইসিস ম্যানেজ করত। স্টালিন নাকি ঠান্ডা লোহার মতো কঠিন ছিলেন। সটান সিদ্ধান্ত নিতেন। সবার থেকে শেখার আছে, নিভৃতে। দ্বিতীয় লিডারশিপ কি উঠে আসছে? নওজোয়ান একদিন অন্যের হয়ে যাবে? বসন্ত রোগের মতো এক অসুখ আসছে নওজোয়ানে। বিদ্রোহের অসুখ, অমলের ছড়ানো বীজাণু। বুড়ো আঙুল দিয়ে মাড়ির ভেতরে গুড়াকু আরেকটু জোরে ঘষে দেয়, মাথা চিন চিন করে ওঠে। চালকল, দোকানদার, মাছের ব্যাপারী সমবেত শ্রমজীবীরা কি আবার ভাগ হয়ে যাবে! আশ্চর্য ব্যায়ামাগার, হেরে যাওয়া মানুষেরা গান-বাজনা, নাটক করা— দরকারে থানা ঘেরাও, হরতাল, মিউনিসিপালিটিতে ধর্না, কারখানার গেটে অফিসারদের চড়-থাপ্পড়— নওজোয়ান না থাকলে সমবেত প্রতিবাদ সম্ভব নয়। মানুষের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। বড় স্বার্থে আরও মেঠো, প্রাকটিক্যাল হতে হবে। সংখ্যায় গরিষ্ঠ হওয়া একান্ত জরুরি। কনকনে ব্যথার দাঁত ফেলে দিতে হবে। একটা বড় হাই তুলে সুধাময় টের পেল ওর মুখের ভেতরটা মন ভালো করা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
রাতে ক্লাবের আলো জ্বলছে। বাইরে স্বল্প জোনাকি। গেটের কাছে শুকনো বাঁশে একটা লিকলিকে টিউবলাইট। উৎসবের মেজাজ। টিউবের ছায়া ক্লাব-পুকুরের জলে সাপের মতো কিলবিল করছে। পুকুরপাড়ে একটা ভ্যানগাড়ি, তাতে ঝান্ডার তেলতেলে একগুচ্ছ লাঠি। জল থেকে পাড়ে উঠে এসেছে কচু গাছ, পাতার গায়ে কোনও এক মহিমা লেগে আছে। নওজোয়ানে বিশেষ মিটিং। বিকল্প হিসেবে ডেকরেটরের হ্যাজ্যাক রাখা আছে। যারা এখন আর নওজোয়ানে আসে না, সুধাময় সবাইকে জোগাড় করে নিয়ে এসেছে। দুটো করে ছানার সন্দেশ, কাগজের প্লেটে। অবসরের বুড়োরা, ইস্কুলের বিভা দিদিমণি, মহিলা সমিতির সোনামনিদি, বাজার ব্যবসায়ী সমিতির চেয়ারম্যান সবাই এসেছে। আছেন সর্বজনগৃহীত কুমুদরঞ্জন, কীর্তনীয়া ব্রজবাসী, রিক্সা ইউনিয়নের নান্টু নন্দী। পরিচয় বেশ ঘাবড়ে গেল নান্টুকে দেখে। কলোনির সমস্ত হিংসার পেছনে নান্টুর প্রত্যক্ষ হাত না থাকলে সেটা হবে না।
পরিচয় আর অমলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল যে, ওরা সাবোটাজ করছে, যাতে ধসে যায় শরীর উৎসব। নওজোয়ানে আস্থা রাখা জনমানসকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। কানে-কানে ছড়িয়ে গেল একটা বিষাক্ত ষড়যন্ত্রে কলোনির ঐতিহ্য ছত্রখান হতে চলেছে। যা খুশি তাই করছে কিছু বহিরাগত। অনেক তর্ক হল, কটু কথা হল। পরিচয়ের দল চিৎকার করে জানান দিল, নাটকে মেয়েরা থাকলে সমাজের প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরা যায়। খুব তাড়াতাড়ি বোঝা গেল, সুধাময় যা চাইছে, সেটাই হতে চলেছে। সমষ্টির কলরবে নাকচ হয়ে গেল নওজোয়ানের রিহার্সাল। অমল মেজাজ হারাল। ওর ঝাঁজালো প্রত্যয়ী যুক্তি কেউ মন দিয়ে শুনল না, বরং একটু বিরক্তই হল। বেশি পেকো! এত কীসের কথা বহিরাগত! একজন মহিলা চেঁচিয়ে উঠল, ‘পিছা-মাইরা।’ শান্ত, সুধাময় সোনামনি দিদিকে সভার হাল ধরতে অনুরোধ করল। সোনামনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল, সরস্বতী, দুর্গা কিংবা মাতঙ্গিনীর অভিনয় করুক মেয়েরা, অসুবিধে নেই। ভবিষ্যতে যদি নাটকের জন্য আলাদা ঘর পাওয়া যায়, রিহার্সাল হতে পারে। কিন্তু ব্যায়ামের সময়ে ছেলেদের বিভ্রান্ত করে কিছু করা যাবে না। ‘অমলবাবু, আপনি সভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। কী করতে চাইছেন, কাকে সমর্থন করছেন?’ তপন-স্বপন হাততালি দিয়ে উঠলো। সঙ্গে-সঙ্গে অভিনন্দন, সমস্ত হাত একজোট হয়ে ঢাকের কাঠির মতো বেজে উঠল। অমলের মুখ আরও কালো হয়ে গেল। নান্টু গর্জন করে উঠল : ‘সুধাময় মিত্তির, লাল সেলাম!’
অসমান, দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল নওজোয়ান।
রিহার্সাল বন্ধ। তবু মেয়েরা এসেছে। পাড়ার তরকা-রুটির দোকানে আড্ডা মারছে। বুলবুলি জানিয়ে দিল বস্তাপচা ধারণা নিয়ে থাকা এইসব সনাতনী ফিউডালদের বিরুদ্ধে ওরাও প্রতিবাদে সামিল হবে, পিছিয়ে যাবার কোনও চান্স নেই। লাল পতাকার নীচে এরা এক-একটা ভাড়। আমাদের পতাকা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পরিচয় কিছুটা ভীত। কিন্তু দারুণ সাহস পাচ্ছে যে একটা আদর্শগত সমর্থন বেশ জোরালো হচ্ছে। সন্ধের পর ওদের মিটিং আছে। একটু-একটু করে শক্ত হচ্ছে চোয়াল।
পুকুরে পাশের রাস্তায় একটা ইয়েজদির মোটর বাইক বার বার ঘুরে যাচ্ছে। বাইকে ক্রিকেটের টুপি পড়া দুজন লোক। আজও টিউবলাইট জ্বলছে নওজোয়ানের গেটে। তবু পুকুরের জলে অন্ধকার, হালকা ঢেউ ভেঙে দিচ্ছে নিয়ন টিউব। উড়ন্ত পোকায় ঘিরে ফেলেছে আলো। জলের মধ্যে গ্রহ-নক্ষত্রর মতো ঘুরছে। কয়েকটা অচেনা লোক ক্লাবের ভেতর। সব চুপচাপ। দূর থেকে, কখনও হালকা, কখনও গাঢ় ভাসছে গান : বিন্দিয়া চমকেগি, চুড়ি থনকেগি। সামান্য বাতাস, কচুপাতা নড়ে উঠল। গাছের ভেতর থেকে জলঢোঁড়া শান্ত এগিয়ে যাচ্ছে এঁকেবেঁকে। হঠাৎ একটা গোঙানি। দাপাদাপি, ঝপাৎ করে পুকুরে কী একটা পড়ল। ডেকে উঠল একটা কুকুর। একফোঁটা বৃষ্টির শব্দ করে জলঢোঁড়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ডুবে গেল পুকুরে। চাপা শব্দে মিলিয়ে গেল মোটরবাইক। পরিচয়, সঙ্গে কয়েকজন ছেলে; হাতে বাঁশ, শাবল, দৌড়ে ছুটে গেলো নওজোয়ানের দিকে। বাঁশের দুই বাড়িতে চৌচির হয়ে গেল লাইট। দুমড়েমুচড়ে পুকুরে ছুড়ে মারা হল নওজোয়ানের সাইনবোর্ড। সবাই ধরাধরি করে একজনকে নিয়ে গেল। লোকটাকে মারাত্মকভাবে পেটানো হয়েছে।
আরও একটা দিন চলে গেল। নওজোয়ানে নাকি আগুন লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। মহিলারা আটকে দিয়েছে। আরও অনেক গুঞ্জনে শ্বাসরোধী হয়ে উঠছে পাড়া। কাগজে খবর বেরিয়েছে, গোষ্ঠী-সংঘর্ষে অমল স্যার গুরুতর আহত। সুধাময়ের স্টেটমেন্ট ছিল : জনৈক অমল বণিক (ভুল পদবি ছাপা হয়) বচসায় জড়িয়ে পড়লে কে বা কারা তাকে নিগৃহীত করে। স্বাধীন কলোনি এর ধিক্কার এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছে।
পরমা, বুলবুলি জানিয়ে দিল এই পলিটিক্স ওরা নেই। গুড বাই। তপন-স্বপন মিউচুয়াল করতে এসেছিল। হাত মিলিয়ে গেছে। পরিচয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে গেছে যে, ওদের কাছে শরীর এক মন্দির, গায়ে যেন কোনও আঁচড় না পরে। ওরা ব্যস্ত থাকতে চায় শুধু শরীরের সাধনায়। নো ক্যাচাল।
বুনিয়াদি স্কুলের পেছনে ছোট্ট ঘর, সবে বানানো। বাঁশ আর বেড়ার নতুন গন্ধ। সেই গন্ধ চাপিয়ে উঠছে বড়-বড় গোটা আলুভাজার ঘ্রাণ। তেল ফুটছে, জ্বলন্ত উনুন। একটা এলপি রেকর্ড বাজছে। ‘এসো মুক্ত করো, মুক্ত করো অন্ধকারের এই দ্বার।’ টিনের নৌকোর ভিতরে কেজি-কেজি লাল মাংস, হাড়গোড়, মেটে। অমল একটা টুলের ওপর। বাঁ-হাতে প্লাস্টার। কপাল থেকে ঝুলে আছে তুলো, শুকনো বেনজিন। প্রায় বুজে যাওয়া চোখের নীচে কালো জামের মতো বিরাট ফোস্কা, ফুলে আছে। ঠোঁটে সেলাই। বোতল থেকে ঢালছে সরিষার তেল, নিজের হাতে। গোটা-গোটা অর্ধেক পেঁয়াজ। লঙ্কা, হলুদে, ছ্যাঁচানো আদায় গানের মানে আরও পরিষ্কার বেরিয়ে আসছে। ছোটখাটো একটা ভিড়। বাটাম আর ইলেকট্রক তার। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। রাতে লাইট লাগবে। অমল এত মাংস কোনওদিন দেখেনি এক সাথে। একটা আনন্দের গন্ধ ক্রমে তীব্র হচ্ছে।
পরিচয়রা বেড়ার ঘরে একটা সাইনবোর্ডে পেরেক মারছে : নিউ নওজোয়ান সংঘ।
হোমিওপ্যাথ শ্রদ্ধানন্দ, পরনে লুঙ্গি, হাতে রোল করা নিউজ পেপার। অনেকক্ষন অমলকে লক্ষ রাখছিল। একটু কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কমরেড, পরশু নাকি আমাদের পার্টি ভাগ হয়ে গেছে!’
‘ওটা একচুয়েলি গত সপ্তাহে হয়েছে।’
‘আপনি ভাল আছেন এখন?’
‘বেটার। আজ রাতে কিন্তু নিশ্চই আসবেন। ভাল ভাবে বাঁচতে হবে আমাদের।’
‘অবশ্যই, স্বপরিবারে। ওরা এত অসভ্য, বলছে রাশিয়ার টাকায় নাকি খাসির মাংস হচ্ছে।’
‘যারা মানিক পড়েনি, সুকান্ত চেনে না, যাদের রবীন্দ্রনাথের ভয়ে বই খোলে না তারা মানুষকে বাঁচার পথে দেখাবে! আমরা বাবার টাকায় অন্ধকারের সব দরজাগুলো ভেঙে ফেলছি।’
‘ভাঙুন, ভাঙুন, দেখা হবে রাতে।’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র