এই লেখা লিখতে বসার কিছুদিন আগেই প্যালেস্টাইনের ভয়ানক পরিস্থিতির বিষয়ে দুটি নতুন খবর আমাদের কাছে সম্ভবত পৌঁছে গিয়েছে। প্রথম খবর, গাজা স্ট্রিপের আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে ইজরায়েলি সেনা হামলা চালিয়ে প্রায় পাঁচশোজন নিরস্ত্র মানুষকে খুন করেছেন, এবং আমেরিকার প্রথম সারির খবরের চ্যানেলে বেদজালেল তালিহাজ নামে এক ইজরায়েলি সৈনিক এসে সগর্বে জানিয়েছেন, ‘আমাদের লড়াই কেবল হামাসের বিরুদ্ধে নয়, প্যালেস্টাইনের সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে।’ এ-কথা শুনেও ওই সুশীল খবরের চ্যানেলের কোনও সাংবাদিক ওই সৈনিককে সন্ত্রাসবাদী বলেননি। কী ভাবে বলবেন? হামাসের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছেন যে ওই বীরপুরুষ!
দ্বিতীয় খবর, প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলি আক্রমণ বন্ধ করার বিনিময়ে প্যালেস্টাইনে আটকে পড়া ইজরায়েলি ইহুদিদের নিরাপদে ঘরে ফিরতে দেবার একটি পারস্পরিক সমাধান জাতিসংঘে (United Nations) চুক্তি হিসেবে পেশ করেছিলেন রাশিয়ার প্রতিনিধিরা। সমর্থন জানিয়েছিল চিন এবং আরবের কিছু দেশ। কিন্তু ব্রাজিল, ঘানা এবং সুইৎজারল্যান্ড-সহ কিছু দেশ এই ভোটদানে বিরত থাকে, এবং আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ইউনাইটেড কিংডম (UK) সরাসরি প্রস্তাবটি খারিজ করে দেয়। কারণ, এ-প্রস্তাবে যে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী হামাস বাহিনীকে সরাসরি আগ্রাসী বলে নিন্দা করা হয়নি, এ নিয়ে তাঁদের বড়ই আপত্তি। ‘দুষ্টু প্যালেস্টাইনের’ হাতে নির্যাতিত ইজরায়েলিরা নিরাপদ থাকলেন কি না, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এঁদের কাছে হয়ে উঠল হামাস বনাম ইজরায়েল, উত্তম বনাম অধমের আন্তর্জাতিক ন্যারেটিভ বজায় রাখা। এদিকে নিরাপত্তা পরিষদে (Security Council) কোনও সংকল্প নিতে হলে অন্তত ন’টি ভোট লাগে। তাই প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে যায়।
ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের সমস্যা নিয়ে আধুনিক দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, কেন প্রকৃত রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমাধানের চেয়েও উত্তম অধমের ন্যারেটিভ টিকিয়ে রাখতে চাওয়ায় কোনও নতুনত্ব নেই। বরং এইভাবেই দশকের পর দশক ‘বর্বর প্যালেস্টাইনের হাতে আক্রান্ত বেচারা ইজরায়েল’ আমাদের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে গিলিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এবং পাশ্চাত্য মিত্রদের সহযোগিতায় ইজরায়েল প্যালেস্টাইনে গণহত্যা চালিয়ে যেতে পারছে। আসলে ক্ষমতাবানদের গণহত্যা আমাদের কাছে কিছুদিন পরে ‘স্বাভাবিক’ হয়ে যায়, বরং মার খেতে খেতে একদিন দুর্বলের পাল্টা মার দেওয়ার আকস্মিকতায় আমরা ভদ্রসমাজের লোকেরা একটু সন্ত্রাস সন্ত্রাস গন্ধ পাই বইকি। উত্তমের বাঁচার জন্য বাসস্থানের অধিকার বনাম অধমের অবিচারের এই ন্যারেটিভ আমরা ইতিহাসে আগেও দেখেছি, ‘লেবেনস্রাউমের’ নামে। লেবেনস্রাউম কথাটি জার্মান, এবং এর অর্থ ‘বাসস্থান’। ইজরায়েলের জায়োনিজম (Zionism) বা ইহুদি মৌলবাদ কী ভাবে এককালের পরম শত্রু নাৎসিদের থেকে এই ন্যারেটিভটি ধার করে নিয়েছে, তার ইঙ্গিত এই প্রবন্ধে একটু হলেও দেবার চেষ্টা করব। তবে তার আগে দরকার এই ন্যারেটিভটি কী ভাবে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে, তার কথা বলা।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, এই ন্যারেটিভের আলোচনায় ইজরায়েল বনাম প্যালেস্টাইনের দীর্ঘ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মকেন্দ্রিক ইতিহাস নিয়ে আমি খুব বেশি কথা লিখব না। এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত, আমরা যে-যুগে বাস করি, সেখানে ঐতিহাসিক তথ্য বা দৃষ্টিভঙ্গির থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় আলেখ্য বা বিশ্বাস। নাট্যকার স্টিভ টেশিখ যে আমাদের এই যুগকে সেই ১৯৯২ সালেই চিহ্নিত করেছিলেন ‘উত্তর-সত্যের’ (post-truth) যুগ হিসেবে, সত্যের প্রতি সে-যুগের তাচ্ছিল্য এখন মহামারির আকার ধারণ করেছে। ফলে, ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের প্রকৃত ইতিহাস চর্চার চেয়েও আমার মতে এ মুহূর্তের বেশি প্রয়োজন এইটা বোঝা, কী ঔদ্ধত্যের সঙ্গে একটি বিকৃত ন্যারেটিভ বা আলেখ্য আমাদের সোনামুখে গিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের দীর্ঘ ইতিহাসের কথাও যদি তুলি, সে-নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে বহু লেখালিখি, বহু তর্ক-বিতর্ক-আলোচনা এবং মতবিরোধ চলেছে। সেসব তর্কে অংশগ্রহণ করেছেন বহু পণ্ডিত মানুষেরাই, এবং তাঁদের পরিবেশিত তথ্যের পুনর্কথন আমার পক্ষে ধৃষ্টতাই হবে। তা ছাড়া এই ইতিহাসের আলোচনা সচরাচর তেমন ফলপ্রসূ হয় না, কারণ ভূমধ্যসাগরের তীরে ওই জমিটুকু নিয়ে এক পক্ষ ইতিহাস সাক্ষী রেখে দাবি জানালে অপর পক্ষ সঙ্গে সঙ্গেই আরও তিনটি পাল্টা দাবি নিয়ে হাজির হয়।
এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ২০০৬ সালের ‘খোসলা কা ঘোসলা’ নামে সিনেমাটির কথা। সে-সিনেমায় কমল খোসলা নামে এক গোবেচারা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সারাজীবনের জমানো টাকা দিয়ে একটি জমি কিনেছেন, বাড়ি বানাবেন বলে। কিন্তু একদিন সেই জমি দেখতে গিয়ে তিনি টের পান, কিষণ খুরানা নামে এক ধনী ব্যবসায়ী বেআইনিভাবে তাঁর জমি দখল করে বসে আছেন। খোসলা জমির দলিল নিয়ে খুরানার কাছে গেলে খুরানা হো হো করে হেসে বলে ওঠেন, ‘খোসলা সাহেব, আপনি কী দলিল দেখাচ্ছেন? আপনি একটা কাগজ দেখাবেন, আমি আপনাকে তিনটে কাগজ দেখিয়ে দেব। পারবেন আমার সঙ্গে?’ অনুপম খের অভিনীত খোসলার জায়গায় প্যালেস্টাইন এবং বোমন ইরানি অভিনীত খুরানার জায়গায় ইজরায়েলকে কল্পনা করে সিনেমাটি আর একবার দেখে নিলেই আমরা পরিস্থিতিটার একটু আন্দাজ পাব। অতএব লুইস ক্যারলের অ্যালিসের মতো ওই খরগোশের গর্তটিতে লাফ দিলে এই প্রবন্ধ আর শেষ হবার নয়।
এতে অবশ্য অনেকেই অভিযোগ করতে পারেন, ইতিহাসের প্রতি দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যাচ্ছি। দক্ষিণ আফ্রিকান বিনোদনশিল্পী ট্রেভর নোয়া এ-বিষয়ে মোক্ষম কথা বলেছেন— ‘ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের সংঘর্ষে একজন কোন পক্ষ নেবেন, সেটা বুঝতে গেলে বোঝা দরকার সেই মানুষটির জন্য এই সংঘর্ষের ইতিহাসটা কোথায় শুরু হচ্ছে।’ কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অতএব দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার অভিযোগের বিরোধিতায় বলে রাখা ভাল, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এই দুই দেশের ইতিহাস শুরু হচ্ছে ১৯১৭ সালের ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে প্যালেস্টাইনে একটি ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ গড়ে তোলার সঙ্কল্পের হাত ধরে। প্রাচীন ইহুদি পুরাণে এবং বাইবেলে ইজরায়েলের রাজত্বের বিবরণ আছে কি না, তা আমার মতে আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের চর্চার আখরে বেমানান। কারণ, আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের একটি ধর্মীয় পুস্তকে কাল্পনিক কোনও ঈশ্বর একদল মানুষকে একটি বিশেষ জায়গায় ঘর বানানোর অনুমতি দিচ্ছেন কী দিচ্ছেন না, আমার মূল্যবোধে এ-দাবির বিশেষ দাম নেই। হ্যাঁ, এই মতের বিরোধিতা অনেকেরই থাকবে, তাঁরা বলবেন পৃথিবীতে বহু দেশ, বহু রাজ্য, বহু সাম্রাজ্যই ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে নয়, বরং ঐশ্বরিক আশীর্বাদ বা পৌরাণিক অধিকারের ভিত্তিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে-বিরুদ্ধমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই বলছি, আমাদের আগে বেছে নিতে হবে আমরা ইতিহাস এবং বাস্তব নিয়ে কথা বলতে চাই, না কল্পনা এবং রূপকথা নিয়ে। এ-বিষয়ে আমার প্রিয় সাংবাদিক ক্রিস্টফার হিচেন্সের বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। ২০০২ সালের একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘জেরুজালেমের উপর ইজরায়েলের অধিকার আছে, তা আপনি মানেন কি?’ তিনি সহজাত স্পষ্টবাদিতায় উত্তর দেন, ‘আমি বিশ্বাস করি ধর্মগ্রন্থের নামে যদি নিউ ইয়র্কের কোনও ইহুদির জেরুজালেমের উপর অধিকার থাকে, তবে জেরুজালেমে গত তিনশো বছর ধরে যে মুসলমান আরব পরিবার বাস করছেন, তাঁদেরও অধিকার আছে।’
এই ধর্মীয় অধিকারের নামে বাসস্থান তৈরি করতে চাওয়াকে তাও মান্যতা দেওয়া যেত, যদি ইজরায়েল সৃষ্টির আদিপর্বে ইহুদি জায়নিস্টরা সৎভাবে তাঁদের এই ধর্মীয় অধিকারকে কায়েম করতে চেষ্টা করতেন। তার বদলে আমরা বিগত প্রায় একশো বছর ধরে যা দেখতে পেয়েছি, তা হচ্ছে ধর্মীয় পরিচিতির ফায়দা তুলে নিকৃষ্টতম আইডেন্টিটি পলিটিক্স (identity politics), এবং ক্রমাগত ব্যাড ফেথ (bad faith) রাজনৈতিক পলিসির সাহায্যে প্রতিশ্রুতিভঙ্গ। হিচেন্স ওই ২০০২ সালের সাক্ষাৎকারেই বলছেন, ‘দুনিয়ার প্রত্যেকটি রাষ্ট্র একটি বিষয়ে একেবারে নিখুঁতভাবে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দেন; নিজের রাষ্ট্রের সীমানা কোথায়। ইজরায়েল কোনও দিন তা জানায়নি, এবং এই না জানানোর ফলে যে-ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে এবং তার ফলে যত রক্তপাত হয়েছে, তা আধুনিক বিশ্ব রাজনীতিতে প্রায় নজিরবিহীন।’ এই ধোঁয়াশা সৃষ্টি করার সুচতুর প্রক্রিয়াই ইজরায়েলের রাজনীতির মুখ্য ধারক ও বাহক। এই একটি বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষের (border dispute) থেকে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন পরিস্থিতিটি আলাদা। পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘ সমস্যার কারণ এই যে, দুটি রাষ্ট্রের কাছেই কাশ্মীরের সীমান্তের পরিষ্কার নির্ধারণ রয়েছে, কিন্তু সেই নির্ধারণের বিষয়ে তাঁরা একমত নন। ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনী সফরে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের মধ্যে প্রবল মেক্সিকো-বিদ্বেষ তৈরি করতে পেরেছিলেন এই বলে যে, আমেরিকার নির্ধারিত সীমান্ত পেরিয়ে মেক্সিকানরা দেশে অনুপ্রবেশ করছে। কিন্তু ইজরায়েল দশকের পর দশক তার নিজের সীমান্ত ঠিক কোথায়, সেই প্রশ্নের উত্তরে ‘ইহুদিদের পবিত্র ভূমি’ (Jewish Homeland) গোত্রের ভাসা ভাসা কথা বলে এড়িয়ে গিয়েছে, এবং ক্রমাগতই সীমান্ত বাড়াতে বাড়াতে উপনিবেশ কায়েম করেছে প্যালেস্টাইনের জমির উপর। ‘ইজরায়েল তার সীমান্ত লঙ্ঘন করছে’— এ-আপত্তি তোলাই যায়নি, কারণ ইজরায়েলের সীমান্ত কোথায় তা ইজরায়েল নিজেই জানায় না।
এই ভাসা-ভাসা ‘বাসস্থান’ নিয়ে রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা, এবং তার ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশের জমিতে যেমন খুশি অনুপ্রবেশ ঘটানো এবং দখলদারি,— আগেও আমরা দেখেছি নাৎসি জার্মানির ইতিহাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, ইউরোপ জুড়ে ইহুদি নিধনের আগে, এমনকী জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে নির্বাচিত হবারও আগে আমরা অ্যাডল্ফ হিটলারের নানা লেখায় এবং ভাষণে এর ইঙ্গিত পেয়েছি। উনবিংশ শতাব্দীর কিছু দর্শনকে ব্যবহার করে তিনি সৃষ্টি করেন প্যান-জার্মানি (pan-Germany) তত্ত্বের। এই তত্ত্ব অনুযায়ী জার্মান জাতি ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তাদের জমি কেড়ে নিয়ে তাদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল, তার একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে নির্বিচারে ‘সমস্ত জার্মানিক জাতির মানুষদের’ জন্য একটি নতুন সাম্রাজ্য স্থাপন করা। ইউরোপে যেখানেই জার্মানিক জাতির ইতিহাস রয়েছে, সেখানেই অন্য জাতির মানুষকে হয় উচ্ছেদ করে, নয় ধ্বংস করে সেই জায়গাটিকে বানাতে হবে শুদ্ধ জার্মান জাতির বাসস্থান।
মজার কথা এই, যে ইউরোপের ঠিক কোন কোন জায়গার উপর জার্মান জাতির অধিকার আছে, তা হিটলার বা তাঁর পার্টি কোনও দিন খোলাখুলি ভাবে বলেননি। ফলে তাঁর হাতে ফিনল্যান্ড থেকে শুরু করে ইংল্যান্ড (এই দুই দেশেই প্রাচীনকালে ‘জার্মানিক’ সভ্যতার বসবাস ছিল), সর্বত্রই নাৎসি বাহিনী পাঠানোর একটি মোক্ষম রাজনৈতিক যুক্তি ছিল। জার্মানির এই বাসস্থান বা ‘লেবেনস্রাউম’ যুক্তির উদ্দেশ্যই ছিল ড্রাং নাখ ওস্টন (drang nach osten) নামে একটি সামরিক নীতির সৃষ্টি করা, যার অর্থ ‘পূর্বদিকে অভিযান।’ হিটলারের সাম্রাজ্যের কল্পনায় তাঁর বিশুদ্ধ জার্মান বাহিনীর পুবদিকের দেশগুলিকে একের পর এক এমন জব্দ করার কথা ছিল যে, একদিন যেন সেখানে আর কোনও বিশুদ্ধ, নোংরা জাতির মানুষ না থাকে, বা থাকলেও তারা জার্মানদের ক্রীতদাসের কাজ করে। এই স্বপ্ন অবশ্য সফল হয়নি, কারণ সোভিয়েত রাশিয়ার লালফৌজের সামনে জার্মানদের জয়রথ অবশেষে আটকে যায়। কিন্তু সেই অপারেশন বারবারোসা-র পরাজয় পর্যন্ত এই নিরন্তর যুদ্ধযাত্রা সম্ভব হয়েছিল কারণ হিটলার কোনও দিন জানাননি, তাঁর এই অভিযান ঠিক ‘কতটা’ পুবদিকে গিয়ে শান্ত হবে।
আজ ইজরায়েলের সামরিক এবং রাজনৈতিক নীতিতে আমরা এই অনন্ত অভিযানের পূর্বাভাসই দেখছি। বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে যে-ইজরায়েল সংক্রমণের মতো বাড়তে বাড়তে প্যালেস্টাইনকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে, তা আশ্চর্যের নয়, কারণ সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তিতে ইজরায়েলের পাশেই আছে আমেরিকার মত দানবিক শক্তি। আশ্চর্য বরং এই যে মানুষের জনপ্রিয় আবেগে ইজরায়েল ‘এককালের নির্যাতিত ইহুদিরা কী ভাবে একটা চমৎকার দেশ বানাতে পেরেছে’ গল্পটিকে ব্যবহার করে এমন আদরের জায়গা করে নিতে পেরেছে, যে প্যালেস্টাইনে তাদের নিরন্তর সন্ত্রাস ও গণহত্যা এবং নিজের সীমানা নিয়ে ধোঁয়াশা বজায় রেখে লেবেনস্রাউমের রাজনীতি চালিয়ে যাওয়াটা ক্রমাগতই ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য ন্যারেটিভের গল্প দিয়ে।
‘হামাস’ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ঠিক করেছিলাম যে হামাস নিয়ে বেশি কথা বলব না, কারণ তাতে এ-মুহূর্তের জনপ্রিয় বাচ্যে একটি অবান্তর ইস্যুকে আবার গুরুত্বই দেওয়া হয়। তবুও এটুকু মনে করিয়ে দেওয়া ভাল যে, হামাস ইজরায়েলেরই সৃষ্টি। পিএলও-র মতো ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল শক্তি ইজরায়েলের দক্ষিণপন্থী মৌলবাদের খুব বড় শত্রু হতে পারত। অতএব তাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ‘ইজিপশিয়ান ব্রাদারহুড’ ভেঙে মৌলবাদী ইসলামিস্ট দল হামাসকে ইজরায়েল অর্থনৈতিক সাহায্য এবং অস্ত্র যোগায়, ইজরায়েলে ইয়াসির আরাফতের ঘাঁটি ভাঙার জন্য। এ-তত্ত্ব কিন্তু ইজরায়েল-বিরোধীদের গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না, কারণ ইজরায়েলের এককালের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী এবং ধর্মীয় শিক্ষক অ্যাভনার কোহেন নিজেই পরবর্তীকালে জানান, ‘আমার সবচেয়ে বড় আফশোস এই যে, হামাস ইজরায়েলের সৃষ্টি।’ মোসাদ-এর (Mossad) কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্তারাও এ বিষয়ে কোহেনের সঙ্গে একমত। অথচ এই সত্যটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করা সত্ত্বেও আধুনিক গল্প যে হামাসকে জুজু বানিয়ে ইজরায়েলকে ধোয়া তুলসীপাতা সাজায়, সেটাই এই post-truth যুগের সবচেয়ে বড় অসুখ।
যুদ্ধের রাজনীতি নিয়ে কোনও মতপ্রকাশ বলিষ্ঠ হয় যদি সেই দেশে একবার নিজে গিয়ে ভিতরের হাল হকিকত একটু বুঝে নেওয়া যায়। যদিও সে-সুযোগ আমার এখনও হয়নি, আমার বাবার হয়েছে। তাই তাঁর কাছে শোনা একটা ঘটনার কথা বলে শেষ করি।
বাবা ইজরায়েল গেছিলেন সাংবাদিকতার কাজে, ১৯৯৯ সালে। তখন দ্বিতীয় ‘ইন্টিফাডা’ শুরু হবে হবে করছে, ইজরায়েলে প্যালেস্টাইন-বিদ্বেষ তুঙ্গে। একদিন কাজের ফাঁকে বাবাদের দলটাকে ঘোরাতে নিয়ে গিয়েছেন একজন ইজরায়েলি গাইড। শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তাঁর উদ্দেশ্য, ইজরায়েল যে আসলে প্যালেস্টাইনের জমিতে বিংশ শতাব্দীর বহিরাগত নয়, বরং হাজার হাজার বছর আগেও এই ভূমিতে তার অধিকার ছিল, তা বোঝানোই সরকারি গাইডের উদ্দেশ্য। ফলে তিনি মাঝেমধ্যেই ‘ওই দেখুন দু’হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাজ’ বা ‘এটি তিন হাজার বছর আগে ইজরায়েলের স্থাপত্য’ ইত্যাদি বলে দেশের শোভা দেখাচ্ছেন ভারতীয় অতিথিকে। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে যখন অতিথিরা সাগরের উপকূলে একটি জায়গায় পৌঁছেছেন, তখন গাইডমশাই বললেন, ‘দেখুন, ঠিক এইখানেই দু’হাজার বছর আগে ইজরায়েলে এসে নামতেন বিদেশি বণিকেরা, এইখানে জাহাজ ছাড়ত।’
বাবা সরলভাবেই একটি প্রশ্ন করেছিলেন— ‘আচ্ছা, দু’হাজার বছর আগে সমুদ্র কি ঠিক এইখানেই ছিল? কারণ অতদিনে তো সমুদ্রের অবস্থান পালটে যায়।’ কথাটা ঠিক। প্রাচীনকালে আমাদের বাংলার বন্দর তাম্রলিপ্তি ছিল বিশ্ববিখ্যাত। অথচ এখন আধুনিক তমলুকে সমুদ্র কোথায়?
প্রশ্নটা শুনে গাইড নাকি বাবার দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুতভাবে তাকালেন। তারপরে বললেন, ‘আপনার প্রশ্নটি খুব চিন্তাশীল।’ ব্যাস! এইটুকুই। স্পষ্ট বোঝা গেল, গাইড নিজেও জানেন তিনি যা বলছেন সব বানানো, কিন্তু তাও সেটাই বার বার বলে যাওয়া তাঁর দায়িত্ব। পেশাদারি দায়িত্ব, রাজনৈতিক দায়িত্ব।
ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের সমস্যা কবে মিটবে, কী ভাবে মিটবে, বোধহয় কারোরই জানা নেই। কিন্তু এ-মুহূর্তে আমাদের যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে অবান্তর ন্যারেটিভে গা না ভাসিয়ে সত্যের পথে একটু হলেও ফিরে আসা। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের সমস্যাটিকে সংঘর্ষ বলতে আমার বাধে, কারণ সংঘর্ষ ঘটে সমানে সমানে। এ-মুহূর্তে আমরা যা দেখছি, তা আদি এবং অকৃত্রিম অনুপ্রবেশ এবং গণহত্যা। এক সময়ে একটি জাতির মানুষের পূর্বপুরুষদের নাৎসিরা গণহত্যা করেছিলেন বলেই তাঁরা আজীবন victim হিসাবে পরিচিত থাকবেন, আর অন্য জাতির উপর তাঁদের করা গণহত্যাকে গণহত্যা বলা যাবে না— এই ভদ্রলোকি woke সুশীলতা ত্যাগ করে আমরা ‘অস্বস্তিকর সত্য’-টাকে সত্য বলতে শুরু করি, একমাত্র তবেই এ-বিষয়ে সুস্থ আলোচনা সম্ভব।
আর তা না হলে কী হতে পারে, তা জানতে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত পোল্যান্ডের ইতিহাস একটু দেখে নিন।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)