সমালোচনা— ফিল্ম, ‘খুফিয়া’ (২০২৩)
মুখ্য চরিত্র— তাব্বু, ওয়ামিকা গাব্বি, আলি ফজল, আশিষ বিদ্যার্থী প্রমুখ
পরিচালনা— বিশাল ভরদ্বাজ
সাদা বরফ ঢাকা শহরে একটা ঝকঝকে নীল ছাতা নিয়ে একটা ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে আসছে। একটা ছেলে তোতলা কিন্তু মুম্বইয়ের মতো শহরে সে একদম রাজার মতো ঘুরে বেড়ায়। আবার একটা মেয়ের সব বরেরাই একে একে মরে যায় আবার কখনও বা হিংসায় জর্জরিত কাশ্মীরে একটা ছেলের ধৈর্যের সব সীমা শেষ হয়ে যায়। দর্শক নিঃশ্বাস বন্ধ করে, সেই মেয়েটার সেই ছেলেটার গল্পগুলো, নিজেদের গল্প করে নেয়। সিনেমার পর্দায় যখন সেই গল্পগুলো আসে, তখন তারা পপকর্ন খেতেও ভুলে যায়! এটাই বিশাল ভরদ্বাজ-এর ম্যাজিক। তাই ২০২৩য়ে যখন সেই জাদুকর ‘খুফিয়া’ নিয়ে আমাদের জীবনে আসেন, জীবনকে অন্যভাবে দেখার প্রত্যাশা তখন কিন্তু চরমে। কিন্তু জাদুগরের মনে হয় জাদু কাঠিটা কেউ চুরি করে নিয়েছে। স্পাই থ্রিলার ‘খুফিয়া’তে স্পাই আছে অনেক, কিন্তু যা নেই তা হল থ্রিল। দু’ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট আপনি যদি টানা বসে এই সিনেমাটি দেখতে পারেন, এক মুহূর্তও যদি ঝিমুনি না আসে, হয় আপনার কাছে বিশাল ভরদ্বাজ-এর সাত খুন মাফ বা আপনার মোক্ষ লাভ করতে আর মাত্র ১৭ দিন বাকি!
দু’লাইনে আপনাকে যদি ‘খুফিয়া’র গল্পটা কেউ বলে, শুনতে খারাপ লাগবে না, এমনকী হালকা রোমাঞ্চও হতে পারে। লেখক অমর ভূষণ-এর লেখা স্পাই নভেল Escape To Nowhere এর অবলম্বনে বানানো ‘খুফিয়া’ এক ‘র’(R&AW) এজেন্ট-এর গল্প বলে— কারগিল যুদ্ধের পরবর্তীকালে এজেন্ট কৃষ্ণা মেহরা (তাব্বু) কী ভাবে এক দেশদ্রোহী ডাবল-এজেন্ট রবি’র (আলি ফজল) সমস্ত ষড়যন্ত্র ফাঁস করে, তুখোড় আমেরিকান এজেন্টের নাকের সামনে দিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে শাস্তি দেওয়ার জন্য। সেই গল্পে অনেক পাকদন্ডী আছে, আছে সুন্দরী বাংলাদেশি স্পাই, সেই সময়ে সমাজ মেনে নেবে না, এরকম প্রেমও আছে। কিন্তু যেটা নেই তা হল— কেমিস্ট্রি। তাব্বু এবং অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন-এর যে রসায়নের উপর ভিত্তি করে পরিচালক গল্পটিকে একটা আবেগময় বুনট দিতে চেয়েছেন, সে রান্নায় উনি একদম নুন দিতে ভুলে গেছেন! এই জুটির ভালবাসা, বিচ্ছেদ, দুঃখ কোনওটাই মনে দাগ কাটে না। তাব্বু সিনিয়র ‘র’ এজেন্ট হিসাবে সংযত, কিন্তু সেই সংযমের প্রকাশ যদি দর্শকদের কাছে ভাবলেশহীনতা লাগে, তখন তার জীবনের ওঠাপড়ার সঙ্গে নিজেদের সমব্যথী হতে বেশ কষ্ট করতে হয়। বাঁধনের স্ক্রিন প্রেজেন্স অনবদ্য। তবে ওইটুকুই।
রবির চরিত্রে আলি ফজলের মতো অভিনেতাও ভীষণ ভাবলেশহীন। তাই তার দেশদ্রোহিতার কারণে রাগ বা তার উচিত শিক্ষা পাওয়ার পর উল্লাস— কিছুই মনে হয় না।
একমাত্র রবির স্ত্রী চারুর (ওয়ামিকা গাব্বি) সারল্য এবং রবির মা ললিতার (নভীন্দ্র বেহল) কমেডি মিশ্রিত শয়তানি মনে দাগ কাটে। আর মনে থেকে যায় রাহুল রামের ‘ইয়ারা জী’। ঝরঝরে ইংরেজিতে কথা বলে, নেচে কুঁদে গান গেয়ে, পপ-স্পিরিচুয়ালিটি দিয়ে ভক্তদের সম্মোহন করে— তিনি সেইসব বাবাদের রূপায়ণ করেছেন যারা আমাদের ভীষণ চেনা, ফলত উপভোগ্য।
পুরো ছবিটা খুব আবেগহীন ভাবে বানানো। একের পর এক লাশ পড়ে যায়, আমরা শিউরে উঠি না। গল্প নতুন নতুন মোড় নেয়, আমরা দেখার চেষ্টা করি আর কতটা বাকি আছে। শেষ হলে কিচ্ছু মনে না রেখে নিজেদের কাজে ফিরে যাই। খুব হতাশ লাগে, যখন বোঝা যায় সিনেমাটা না হয়েছে স্পাই থ্রিলার, না হয়েছে রিভেঞ্জ স্টোরি, না হয়েছে লাভ স্টোরি। স্পাই থ্রিলারকে ভিত্তি করে একটি লাভ-স্টোরি বানানোই যেত। বিশাল ভরদ্বাজের তূণীরে সে বাণ ছিল। এখনও খোঁজ করলে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। সে সব ছেড়ে তিনি উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোড়া ছোটালেন!
ইদানীং কালে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলির রমরমার কারণে নর্ডিক নোয়ারের একটা ডেডিকেটেড ভক্তকুল তৈরি হয়েছে। এই টিভি শোগুলির বিশেষত্ব হচ্ছে তাদের ঢিমেতাল, ডার্ক গল্প এবং জটিল চরিত্র। স্বনামধন্য পরিচালক তাঁর নিজস্ব জাদুকরি ছেড়ে ‘খুফিয়া’ ছবিটা হয়তো এই শৈলীতে বানাতে চেয়েছেন। কিন্তু অন্ধকার যদি কৌতূহলের বদলে বিরক্তি উৎপাদন করে, ধীরগতির গল্প দেখতে দেখতে যদি বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যায়, তাহলে পরিচালক মশাই, আপনি কি কোনও ভাবে ইরফানকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন?