মজা হচ্ছে এই যে, ‘আবাহন’ শব্দটার তিন চতুর্থাংশই হচ্ছে ‘বাহন’। অথচ নাকি দুর্গাপুজোয় সেই বাহনদেরই কদর নেই? এইরকমটাই তো শুনতে পেলাম। অবশ্য এই প্রথম নয়, এমন অভিযোগ সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। অনেকেই বলেন, দুর্গা আর তাঁর ছেলেমেয়েদের বাহনদের আলাদা করে তেমন বড় একটা কেউ পাত্তা দেয় না। হ্যাঁ, ছোটদের শারদীয়া পত্রপত্রিকার মলাটে সেইসব বাহনকে হাসিমুখে দেখা যায় বটে, বা মাঝেমধ্যে গম্ভীর প্রবন্ধে তাদের উল্লেখ চলে আসে, কিন্তু ব্যাস। ওই অবধিই। মা মর্ত্যে এলে তাদেরও যে একটু যত্নআত্তি হবে, এমন চল আমাদের নেই। কথাটা হয়তো সত্যিও।
এখন দেখতে হবে, বাহন কী বা কারা। এ তো সোজা উত্তর। যারা বহন করে নিয়ে যায়, তারাই বাহন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে মা দুর্গা’র সিংহ, কার্তিকের ময়ূর, সরস্বতীর হাঁস, গণেশের ইঁদুর আর লক্ষ্মীর প্যাঁচা, এই হল গিয়ে পাঁচজন বাহন। মহিষকে টেকনিকালি ধরা যাবে না, কেননা মহিষাসুর সেই ছদ্মবেশ ধরে মা দুর্গা’র সঙ্গে মোকাবিলায় নেমেছিলেন, ফলে মহিষ তাঁর বাহন ঠিক নন। তা এই যে পাঁচ বাহন, এদের কাজ কী? কৈলাস থেকে মর্ত পর্যন্ত মা এবং তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা। পাঁচদিন থাকা, তারপর ফের অতদূর ফিরে যাওয়া। এখন এই বিশাল আসা-যাওয়ার একটা বিরাট ধকল তো আছে, নাকি? মাঝে যে-পাঁচটা দিন মর্তে জেট ল্যাগ কাটাতেই চলে যাচ্ছে, সে-দিনগুলোয় ভালমন্দ খাতির যত্ন না পেলে এদের চলবে কী করে? এ তো সত্যিই ভাববার বিষয়।
অন্যান্য বাহনদের ব্যাপারে আমরা কিন্তু এরকম কিপটে বা ভুলোমন নই। আমাদের নিজেদের সব বাহনের কথাই ধরা যাক। যেসব গাড়ি চড়ে আমরা কাছে দূরে বেড়াতে বা কাজে যাই, নিয়মিত তাদের ধোয়ামোছা, তেল ভরা, টায়ারে হাওয়া দেওয়া, বছরে দু’বার সার্ভিসিং, এসব কি ভুলি কখনও? গাড়ি তো গেল একরকম। যেসব উড়োজাহাজ আমাদের নিয়ে হাজার হাজার মাইল উড়ে যায়, আবার অন্যদের নিয়ে ফিরে আসে, তার যত্ন নিতে পুরো টিম নেমে পড়ে। অত দূরের যাত্রার ধকলের পর যত্ন দরকার হয় বইকি! সেখানে খোদ কৈলাস থেকে যারা হেঁটে চলে উড়ে আসছে এত দূর, তাদের খাতিরে এত কমতি কেন?
আমার কেমন যেন মনে হয়, ব্যাপারটা হালে হয়েছে, এমনটা আগে ছিল না। আগে বলতে, আমাদের ছোটবেলায়। সেও কি আর কম কিছু আগে? ইন্টারনেট আসার আগের যুগ মানে তো অন্য পৃথিবী একখানা। আজকের অনেকেই সে-পৃথিবীর কথা ভাবতেই পারবে না। তখন কলকাতার পুজোর এত কেতা ছিল না। গুচ্ছের পুরস্কার এসে পুজোদের থিমের দৌড়ে ছুটিয়ে দেয়নি তখনও। পুজোর একটাই লক্ষ্য ছিল, উৎসব করা। তাই বড় পুজো হোক বা ছোট, মণ্ডপের বা প্রতিমার এমন জাঁকজমক ছিল না। বরং অনেক আটপৌরে, অনেক স্বাভাবিক ছিল সেসব পুজো।
আমার মামার বাড়িতে পুজো হত। এক মাস আগে থেকে সে একেবারে হইহই রইরই ব্যাপার। পাকা মণ্ডপ বাঁধাই থাকত সারা বছর, পুজোর আগে আগে সেখানে কারিগর ঠাকুর গড়তেন। আমরা কচিকাঁচা ভাইবোনেরা রোজ দু’বেলা হাঁ করে দেখতাম, কীভাবে চোখের সামনে ফুটে উঠছেন মা দুর্গা, তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সে এক আলাদা বিস্ময়। কীভাবে খড় মাটির কাঠামোয় রং পোশাক পরে প্রতিমা জেগে ওঠে, সে-জিনিস না দেখলে বোঝা যায় না। তখন দেখতাম, কারিগর কী যত্ন নিয়ে বাহনদের গড়ছেন! আর আমাদেরও সবচাইতে বেশি আগ্রহ থাকত ওই বাহনদের নিয়েই। সিংহের লেজ কি একটু বেশি রোগা রোগা হয়ে গেল? ময়ূরের পেখমটা সামনে থেকে দেখা যাচ্ছে তো? সরস্বতী পুজোর মতো বড়সড় না হলেও, হাঁসকে দেখতে হওয়া চাই সুন্দর। প্যাঁচাকেই একটু যা ভয় পেতাম, অমন গম্ভীর প্রাণী আর দুটো দেখিনি। ইঁদুরের জন্য কষ্ট হত সবচেয়ে বেশি। যতই যত্ন করে তাকে গড়ে তোলো, ওইরকম একজন গণেশদাদা’র পায়ের কাছে তার কি চোখে পড়বার জো আছে? তবে সে যাই হোক না কেন, বাহনদের দিকেও যাতে সকলের নজর যায়, সে-ব্যবস্থা কারিগর মশায়ই করে দিতেন বিলক্ষণ। তখন বাড়ির পুজো দেখতেও এ-পাড়া সে-পাড়া থেকে দালানে লোকজন জড়ো হতেন, তাঁদের অনেকের মুখে ময়ূর বা সিংহের প্রশংসা শুনেছি। দুঃখের হলেও স্বাভাবিক যে, তথাকথিত সৌন্দর্যে এদের দুজনের জুড়ি নেই। ফলে বেশিরভাগ তারিফ এরাই কুড়োত।
বারোয়ারি পুজোগুলোয় সিংহ ছিল প্রবল প্রতাপময়। তখন প্রায় এক ধরনের সিংহই দেখা যেত বারোয়ারি পুজোগুলোয়, তার গায়ের চামড়া সত্যি হয়ে ওঠা প্রায়, চোখ বড়, বিরাট হাঁ, নখ বার করা থাবা সে তুলে রেখেছে অসুরের প্রতি, আর সবচাইতে আকর্ষণীয় ছিল তার কেশররাজি। তার পাশে বাকিরা তো দূর, ময়ূরকেও ম্লান দেখাত। সেই সিংহের যুগও হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেল কবেই!
এখন থিমপুজোর যুগ, সেসব আলোড়নের আলোয় বাহনেরা কেমন যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে গেছে। নেহাত তারা বাধ্য মায়ের সঙ্গে আসতে, নইলে কবেই ধর্নায় বসে যেত, বা মানহানির মামলা করত নিদেনপক্ষে। বিসর্জনের সময়ে এখন তাদের গলায় কেউ একটা মালাও পরায় কি? মনে তো হয় না। অথচ তারা না-থাকলে মা তাঁর ওই ছেলেমেয়েদের নিয়ে এতদূরের মর্তধামে আসবেন কীভাবে? ভেবে দেখবার বিষয় কিন্তু।
একটা কথা বলে শেষ করি। কিছুদিন আগে আমি আর দূর্বা হপ্তা তিনেকের জন্য অস্ট্রেলিয়া গেছিলাম। এয়ারপোর্ট যাবার সময়ে আমাদের গাড়ি করেই গেলাম, সে দিব্যি তরতরিয়ে আমাদের সেলিমপুর টু দমদম ট্রিপ দিয়ে এল। যেদিন ফিরব, সেদিনও তার ঠিক সময়ে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকবার কথা। নেমে দেখি, অন্য এক গাড়ি নিয়ে আমাদের চালক হাজির। দূর্বা’র মাসির গাড়ি। আমরা তো অবাক, নিজেদের গাড়ি থাকতে এ-গাড়ি নিয়ে আসার মানে কী? তখন চালকমশাই বললেন, আমাদের গাড়ি নাকি কিছুতেই চালু হতে চাইছে না। অথচ এমনিতে তার সবই ঠিকঠাক আছে। পরদিন সকালে মেকানিক এনে দেখানো হল। সব দেখেশুনে তিনি জিগ্যেস করলেন, এই কুড়ি দিনে গাড়ি চালু করা হয়েছিল? আমরা বললাম, না, হয়নি। আমরাই তো ছিলাম না, গাড়ি আর চলবে কার জন্যে? বোঝা গেল, তার ব্যাটারি বসে গেছে। বদলাতে হল ব্যাটারি। আর মেকানিক বলে গেলেন, রোজ একবার অন্তত স্টার্ট করবেন গাড়ি, নইলে তার কলকব্জা বসে যায়। ইঞ্জিন যদি গাড়ির হৃদয় হয়, ব্যাটারি নিঃসন্দেহে কলজে। সে-ই যদি বসে যায়, শরীর আর দৌড়য় কেমন করে? এ আসলে বাহনের অভিমান। যত্ন না পেয়ে পড়ে থাকার অভিমান। সব বাহনেরই যত্ন লাগে, আত্তি লাগে। নইলে আমাদের গাড়ির মতো কবে সিংহ, হাঁস, ময়ূর, প্যাঁচা আর ইঁদুরও অভিমান করে চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়বে, বলা যায় না!
ছবি এঁকেছেন দেবাশীষ দেব