ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি : পর্ব ১৮


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (October 4, 2023)
     

    কাউন্ট ও কেরানি

    এল কন্ডে’, মানে ‘দ্য কাউন্ট’ (চিত্রনাট্য: পাবলো লারাইন ও গুইলেরমো ক্যালডেরন, পরিচালনা: পাবলো লারাইন, ২০২৩), একটা অন্য গোছের ভ্যাম্পায়ার-ফিল্ম, যা চিলির দোর্দণ্ডপ্রতাপ ও ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী অগুস্তো পিনোশে-কে একজন ২৫০ বছরের বয়সি ভ্যাম্পায়ার হিসেবে কল্পনা করে। সাদা-কালো  ছবিতে, প্রায়ই দেখা যায় জেনারেলকে রাত্রে উর্দি পরে উড়তে, এবং সাধারণ মানুষের টুঁটি মুচড়ে তাদের রক্ত খেতে, বা হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিতে, যদিও পরে বোঝা যায়, ওই উড়ন্ত লোকটি উনি নন, ওঁরই প্রিয় ভৃত্য (যে ওঁর সব কাজেই মুগ্ধ এবং যাকে উনি কামড়ে রক্ত খেয়ে ভ্যাম্পায়ার— অর্থাৎ অমর শয়তান— করে নিয়েছেন)। সত্যি বলতে জেনারেলের আর নতুন রক্ত পান করার ও অনেকদিন বাঁচার ইচ্ছে নেই, মন খুবই খারাপ, কারণ তাঁকে ‘চোর’ বলা হয়েছে। কোটি কোটি টাকা তিনি চিলির বিভিন্ন সংস্থা থেকে সরিয়েছেন বটে, কিন্তু যে-দেশটা গোটাটাই তাঁর, তা থেকে সম্পদ তুলে নিলে তাকে কি চুরি বলা যায়? জেনারেলের পরিবারের অন্যরা (স্ত্রী ও সন্তানেরা) চাইছে তিনি যেন দ্রুত মারা যান এবং সম্পত্তি তারা পায়, কিন্তু ভ্যাম্পায়ার তো এমনি মারা যেতে পারে না, তাই তারা এক সন্ন্যাসিনীকে এনেছে, যে কিনা গণিত-পারদর্শী এবং সম্পত্তির হিসেব কষে দেবে, কিন্তু আসলে তার কাজ হল অপশক্তির বিনাশ, সিধে কথা, সে পিনোশেকে নিকেশ করবে। শেষ অবধি অবশ্য সে তা পারে না, উল্টে পিনোশে তার সঙ্গে যৌনতা করেন এবং তার গলা কামড়ে তাকে ভ্যাম্পায়ার করে দেন, কিন্তু প্রিয়ভৃত্য ঠিকই গিলোটিনে মেয়েটির মুণ্ডচ্ছেদ করে। এবং পিনোশের পরিবারের সবার সাক্ষাৎকার নিয়ে মেয়েটি তাদের কুকর্মের যে ফাইলটি তৈরি করছিল তা গাপ করে দেয়। এই ভৃত্যও নিহত হয় অবশ্য পিনোশের হাতে, এমনকী শেষে দেখা যায় পিনোশে হচ্ছেন মার্গারেট থ্যাচার-এর সন্তান, এবং ছবির গোড়া থেকে আমরা যে ব্রিটিশ উচ্চারণে নেপথ্যকণ্ঠ শুনছি তা মার্গারেটেরই, কিন্তু এইসব ইতিউতি চমক বাদ দিলে, ছবিটায় বিরাট একটা টান নেই। একটা পুরনো প্রাসাদের বেসমেন্টে বিচ্ছিরি একটা মিক্সারে হৃৎপিন্ড থেকে স্মুদি তৈরি করে খাওয়ার অভ্যাস ভ্যাম্পায়ারের ঝকঝকেপনাকে বেশ বিপর্যস্ত করলেও, এই খুঁটিনাটি-অন্যরকমত্বের বাইরে কাহিনির বা স্টাইলের কোনও বৈচিত্র না থাকায় ছবিটা দেখতে ভাল লাগে না। বহু ইতিহাসকে দুমড়ে মিশিয়ে স্বৈরাচারের এক মানচিত্র তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে, পিনোশে সেই ফরাসি বিপ্লবের সময়ও ছিলেন, মারি আঁতোয়ানেতের গিলোটিন-মৃত্যু দেখেছেন, সেই গিলোটিন থেকে রক্ত চেটেছেন এবং সেই মাথাটা এখনও জমিয়ে রেখেছেন— সবই বেশ অদ্ভুত, কিন্তু স্বৈরাচারীকে সরাসরি আক্ষরিক রক্তচোষা দেগে দেওয়ার বাইরে, ছবি বেশ ক্লান্তিকর। কমেডি বা স্যাটায়ারের একটা দায় থাকে হাস্যরস উসকে দেওয়ার, মাঝেমাঝেই অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটিয়ে লোককে একটু চাগিয়ে তোলার, এ ছবিতে তেমন কিছু নেই, বোধহয় পরিচালক ভেবেছেন এতবড় শয়তানকে ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে দিলুম, ওয়াঃ, এই আইডিয়াতেই মাত। 

    যে প্রায় গোটা ছবি জুড়ে ভাল করে নড়ে না, চড়ে না, কাউকে মারে না, কাটে না, কোনও তাড়নায় ছোটে না বা হাঁটে না, সে শেষ দৃশ্যে দিব্যি দুটো লোককে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেয়। তার ভাবনা পরিষ্কার: হয় আমার কথা শুনে চলো, নয় মরো। যা ফ্যাসিজমের এক-লাইনের সারাৎসার।

    বরং এই পরিচালকেরই বেশ ক’বছর আগের এক ছবির কথা মনে পড়ে, ‘পোস্ট মর্টেম’ (চিত্রনাট্য: পাবলো লারাইন ও মেতেও ইরিবারেন, পরিচালনা: পাবলো লারাইন, ২০১০), যেখানে নায়ক মারিও একজন মর্গের টাইপিস্ট, যার কাজ ডাক্তার মৃতদেহ দেখে ময়না তদন্তের যে-বিবরণটা বলছেন, তা টুকে নেওয়া। তার বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িতেই থাকে এক ক্যাবারে-নর্তকী, ন্যান্সি, যার প্রতি মারিও-র লোভ। মারিও এমন একাচোরা আড়ষ্ট পুঁয়ে-পাওয়া টাইপ লোক, তার যে প্রাণ আছে এটুকুও ভাল বোঝা যায় না। কিছুটা চলন্ত মৃতদেহই মনে হয়। অবশ্য ন্যান্সির সঙ্গে সে গ্রিনরুমে গিয়ে দেখা করে, এবং পরে রেস্তরাঁয় গিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু ন্যান্সি পাত্তা দেয় না। ন্যান্সির বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং হয়, তার ভাই ও বাবা সেই পার্টির সমর্থক। একদিন সামরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়, বাথরুমে মারিও যখন চান করছে, তখন তার উল্টোদিকের বাড়ি প্রকাণ্ড তছনছ করা হয়, সেখানকার লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, যদিও কিছু দেখানো হয় না, কিন্তু ধ্বনিতে দর্শক সবটাই বুঝতে পারে। মারিও কিস্যুই বুঝতে পারে না। চান সেরে বাইরে বেরিয়ে উল্টোদিকের বাড়ির অবস্থা দেখতে পায়, সেখানে গিয়ে একটা আহত কুকুরকে বার করে আনে, তার আঘাতে স্টিচ করে দেয়। মর্গে গিয়ে দ্যাখে, গাদা গাদা বডি আসছে, সবকটার ময়না তদন্ত হবে, লরিতে করে লাশ আসার পর তাকেই স্তূপ করে টেনে নিয়ে যেতে হয়, এক সময় এক সৈন্য তাকে অভিনন্দনও জানায়, কারণ সে এখন চিলির খোদ সৈন্যবাহিনীর হয়ে কাজ করছে। মর্গের হেড-ডাক্তার এবং তাঁর সহকারী মেয়েটির সঙ্গে মারিও-ও যায়, সদ্যমৃত প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আইয়েন্দে-র শবদেহের ময়না তদন্ত করতে। হেড-ডাক্তার যখন বলছেন, বন্দুকের গুলিটা কীভাবে প্রেসিডেন্টের মাথা ও মুখকে ছিন্নভিন্ন করেছে, মারিও টাইপ করতে থাকে, কিন্তু ইলেকট্রিক টাইপ-মেশিনে তার অভ্যাস না থাকায়, খুব সুবিধে করতে পারে না। তখন অন্য একজনকে টাইপ করতে বসানো হয়, মারিও শুধু দাঁড়িয়ে দ্যাখে, ডাক্তার বলছেন, পয়েন্ট-ব্ল্যাংক-রেঞ্জ থেকে এই গুলি প্রেসিডেন্ট সম্ভবত নিজে নিজেকে করেছেন, অর্থাৎ এটা আত্মহত্যা। মারিও তা বিশ্বাস করে না অবশ্য। সে কুকুরটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে কুকুরটা হঠাৎ লাফিয়ে ন্যান্সিদের বাড়িতে ঢুকে যায়, মারিও পেছন-পেছন গিয়ে দেখতে পায়, বাড়ির বাইরে একটা কুঠুরি-মতো জায়গায়, ন্যান্সি লুকিয়ে। ন্যান্সি যখন মারিও-কে বলে তার বাবা ও দাদার সন্ধান এনে দিতে, মারিও জানায়, সে এখন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে, এসব সে পারবে বোধহয়। এক সময়, মারিও ন্যান্সিকে তার প্রস্তাবের কথা মনে করিয়ে দেয়। একবার খাবার এনে দিয়ে ন্যান্সির জামাকাপড় ধরে টানাটানি করে। স্পষ্টই বোঝা যায়, সে ন্যান্সিকে ধরিয়ে দেবে না, এবং খেতে দেবে, এবং তার বাপ-দাদার খবর আনার চেষ্টা করবে, ন্যান্সির শরীরভোগের অধিকার পেলে— তবেই। ন্যান্সি রাজি হয়। একবার এসে মারিও দ্যাখে, ন্যান্সি তার প্রেমিকের সঙ্গে ওই কুঠুরিতে রয়েছে। দুজনের জন্যই মারিও যখন খাবার আনে, ন্যান্সি খুব যান্ত্রিকভাবে মারিওর খাজনা মেটায় (মারিওকে হস্তমৈথুন করে দেয়), তারপর একটু বিদ্রুপের হাসি হেসে তাকে সিগারেট আনতে বলে। মারিও এবার ওদের কুঠুরির সামনে অসংখ্য আসবাব জড়ো করতে থাকে এবং ওদের বেরোবার পথ আটকে দেয়।

    ‘পোস্ট মর্টেম’ (২০১০)

    ‘এল কন্ডে’ একটা ব্যঙ্গাত্মক ছবি এবং ঝকঝকে সাদা-কালো, ‘পোস্ট মর্টেম’ ট্র্যাজেডি এবং ইচ্ছে করে খুব ম্যাটম্যাটে রঙে তোলা। শুটিং-এর সময় এমনভাবে আলো করা হয়েছে, এত পুরনো লেন্স ব্যবহার করা হয়েছে, ছবিটা দেখলে মনে হয় কেউ তার মধ্যে থেকে সব আলো সব রং শুষে নিয়েছে। প্রথম যখন ন্যান্সি মারিও-র বাড়িতে আসে, খাবার টেবিলে বসে প্রথমে ন্যান্সি কাঁদতে শুরু করে এবং তারপর মারিও-ও কাঁদতে থাকে, সে প্রায় হাসির দৃশ্য, আবার বেদনারও, কারণ এই সমাজে কী করে ওরা থাকবে বুঝতে পারছে না। প্রায় অমনই দমবন্ধ গোটা সিনেমাটার আবহ। একদম প্রথম শটে, একটা ট্যাংকের নীচের অংশটাকে দেখি আমরা, রাস্তা দিয়ে তার চাকা চলেছে। সেই চাকা রাস্তার সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তো বটেই, এই সিনেমাটার সব আলোকেও, ঔজ্জ্বল্যকেও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। নায়কের মধ্যে যেমন আমরা প্রায় কোনওকিছুরই প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই না, যেন তার স্বাভাবিক আবেগগুলোও ক্ষয়ে শুকিয়ে মর্গের দেওয়ালে মিশে গেছে। হাসপাতালে এক সময় সে যখন মৃতদেহের স্তূপ টানছে, একটা মৃতদেহ নড়ে ওঠে ও সাহায্য চায়। মারিও ডাক্তারের সহকারী মহিলার সাহায্যে, সেই গুলি-খেয়েও-বেঁচে-থাকা তরুণকে এক নার্সের কাছে দিয়ে আসে। তার পরে এক দৃশ্যে, সহকারী মহিলাটি আর্তনাদ করতে থাকে, কারণ সিঁড়িভর্তি মৃতদেহের স্তূপে এবার সে সেই তরুণকে তো দেখছেই, সঙ্গে সেই নার্সটিও পড়ে আছে। মহিলা চিৎকার করে বলে, আমি ওকে বাঁচিয়েছিলাম, এরা আবার ওকে মেরে ফেলেছে, এই নার্সের সঙ্গে একটু আগে কথা বললাম, তাকেও মেরেছে! শুনে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন কয়েকটা গুলি চালায়। সবাই চুপ করে যায়। এ সময়েও মারিওর  মুখে আমরা বিশেষ অভিব্যক্তি দেখি না। সে সাধারণ মানুষের প্রতিভূ, যারা চান করার সময় তাদের অনবধানে দেশের সরকারের পতন ঘটে যায় ও স্বৈরাচার কায়েম হয়। যারা টাইপ করতে বসে বটে, কিন্তু ভাল করে নিজের কাজটা জানে না। তবে শেষ দৃশ্যে বোঝা যায়, সেও কতখানি ফ্যাসিস্ট। সে যেই বোঝে তার প্রেয়সী এবার বাঁচার জন্য তার ওপর নির্ভরশীল, অমনি সে বিনিময়ে যৌনতার শর্ত চাপিয়ে দেয়, এবং পরে ন্যান্সি অন্য পুরুষের সঙ্গে থাকছে দেখে, মুহূর্তে তাদের মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। যে প্রায় গোটা ছবি জুড়ে ভাল করে নড়ে না, চড়ে না, কাউকে মারে না, কাটে না, কোনও তাড়নায় ছোটে না বা হাঁটে না, সে শেষ দৃশ্যে দিব্যি দুটো লোককে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেয়। তার ভাবনা পরিষ্কার: হয় আমার কথা শুনে চলো, নয় মরো। যা ফ্যাসিজমের এক-লাইনের সারাৎসার। ছবির গোড়ার দিকের একটা দৃশ্যে মারিও ও ন্যান্সির গাড়ি একটা কমিউনিস্ট পার্টির মিছিলে আটকে যায়। ন্যান্সি তার বন্ধুর অনুরোধে নেমে গিয়ে মিছিলে যোগ দিলেও, মারিও বিপন্ন মুখে গাড়িতেই বসে থাকে। একটা দেশের লোকজন যখন শুধু ভাল করে সাবান ঘষে ঘষে চান করতে আর ‘আমি বাবা কোনওকিছুতে শামিল হব না’ ভাবতে ও দায় এড়াতে ব্যস্ত থাকে, তখনই কি সেই দেশে স্বৈরাচার গজিয়ে ওঠে ও থিতু হয়? সেই দেশের সাধারণ মানুষ কি প্রকারান্তরে শুধু ফ্যাসিস্ট-সমর্থক নয়, নিজেরাও ফ্যাসিস্ট?

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook