ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বাংলা ব্যাকরণের সহজপাঠ


    রূপক মিশ্র (September 30, 2023)
     

    ক্লাস টেন। প্রি-টেস্টের খাতা দেখানো চলছে। সেদিনের বিষয় : বাংলা। ক্লাসশুরুর ঘণ্টা পড়ামাত্র মাস্টারমশাই রুমে ঢুকলেন। গায়ে হাল্কা ইঁটরঙা পাঞ্জাবি। পরনে সরু পাড়ের ধুতি। কাঁধে খাতাভরতি ব্যাগ। ছাত্রদের পেট গুরুগুরু। বুক দুরুদুরু। না জানি কী নম্বর জুটবে! লজ্জায় পড়ে যাব না তো? আদৌ পাশ করব তো? স্যার যে মোটেও দরাজহস্ত নন। ব্যাকরণের ভুল, অশুদ্ধ বানান, দুর্বল বাক্যগঠন তিনি কোনোভাবে বরদাস্ত করেন না। বেঠিক উত্তরে সপাটে গোল্লা। উপরন্তু ধেয়ে আসে তীক্ষ্ণ শ্লেষ।

    শুরু হল খাতা দেওয়ার পালা। স্যার নাম ধরে ডাকছেন। আর কম্পিত পায়ে ছাত্ররা একে-একে এসে খাতা নিয়ে অন্ধকার মুখে বেঞ্চে গিয়ে বসছে। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা, আশিস দও কে? আশিস দও কি আজ এসেছে?’ক্লাসরুম থমথমে এই প্রশ্নে। এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আশিস দও বলে তো কেউ নেই! স্যার কি নাম বলতে ভুল করছেন? না কি অন্য কোনও ক্লাসের খাতা চলে এসেছে? নানান সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে যখন, তখন ডায়াসের চেয়ার থেকে সংশ্লিষ্ট রোল নম্বর উচ্চারিত হল। আর হওয়ামাত্র কাঁচুমাচু মুখে উঠে দাঁড়াল এক ছাত্র।

    ‘নাম কী?’
    ‘আজ্ঞে, আশিস।’
    ‘আশিস কী?’
    ‘আজ্ঞে, আশিস দত্ত।’
    ‘তা বাবা আশিস, মাথায় মাত্রা না দিলে কি সেটা ‘ত্ত’ হয়? না ‘ও’ হয়? বার বার ‘আশিস দও’ বলে কি আমি খুব ভুল কিছু করেছি?’ চাপা রসিকতা-মেশানো মন্দ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলেন স্যার।

    এমনই ছিলেন হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনের বাংলার মাস্টারমশাই বামনদেববাবু। বামনদেব চক্রবর্তী। আপাদমস্তক নিয়মানুবর্তী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, ছাত্রদরদি শিক্ষক। হাওড়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে বাংলার ঘরে-ঘরে তাঁর নাম ছড়িয়েছে অবশ্য মাস্টারমশাই নয়— পুস্তকপ্রণেতা হিসেবে। মুখে-মুখে-ফেরা বইয়ের নাম ‘উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ’। ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ বইপাড়ার আনাচে-কানাচে আজও হটকেকের মতো বিক্রি হয়। আদতে নবম ও দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের কথা মাথায় রেখে লেখা। যদিও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসা চাকরিপ্রার্থী থেকে শুরু করে ব্যাকরণ-নড়বড়ে শিক্ষক— সন্ধি-সমাসের গোলকধাঁধায় খাবি খেলে সক্কলের অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে এই প্রবাদপ্রতিম বই। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ (‘বাণী-বিচিত্রা’, ‘সাহিত্য-সোপান’ ইত্যাদি) সমাদৃত হলেও, শিক্ষক-লেখকের জনপ্রিয় পরিচিতিটি তৈরি করেছে ‘উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ’-ই।

    বামনদেব চক্রবর্তীর জন্ম ১৯২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর। জন্মস্থান হাওড়ার আমতার নিকটবর্তী গ্রাম বাজেপ্রতাপপুর। ছেলেবেলায় গ্রামেরই একটি স্কুলে লেখাপড়া শুরু। ক্লাস সিক্সে বৃত্তি পরীক্ষায় হাওড়া জেলায় প্রথম স্থান অর্জন। এর সুবাদে জেলা স্কুলে সরাসরি ভরতির সুযোগ পেয়ে তিনি শহরে চলে আসেন। ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাশ। নাম লেখান রিপন কলেজে। তিন বছর বাদে অনার্স-সহ গ্র্যাজুয়েশন পাস করেন। সেই সময়ে হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক ছিলেন সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য। তিনি সদ্য-গ্র্যাজুয়েট, মেধাবী তরুণ বামনদেবকে স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানান। প্রায় ছ-বছর প্রাথমিক শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অবশেষে ১৯৫০ সালে হাইস্কুলের সহ-শিক্ষক পদে উন্নীত হন। ১৯৮৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বামনদেববাবু বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক ছিলেন।

    যদিও নিছক ছাত্র পড়ানোর সীমানায় তাঁর জীবন আটকে ছিল না। ছেলেবেলা থেকে যাত্রা দেখার দুরন্ত ঝোঁক। গ্রামান্তরে আসর বসলে ছুটে যেতেন। খুঁটিয়ে দেখতেন অভিনয়। বয়স বাড়লে গোপন শখ নতুন করে জেগে ওঠে। একদিন কাজের ফাঁকে চলে যান চিৎপুর। খোঁজ পান বিখ্যাত যাত্রা দল ‘শিবদুর্গা অপেরা’-র। অপেরায় যোগ দিয়ে গ্রামেগঞ্জে যাত্রা করতে বেড়িয়ে পড়তেন। ততদিনে নাটক নিয়েও বাড়তি আগ্রহ জন্মেছে। উত্তর কলকাতার রঙমহলে পেশাদারি থিয়েটারে শুরু করেছেন অভিনয়। যে-ধারা বজায় ছিল ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক চাপ ও দায়িত্ব বাড়তে থাকায় বামনদেব পেশাদারি বৃত্তে নিজেকে গুটিয়ে আনেন।

    শিক্ষক হিসেবে তিনি মোটেও গতে বাঁধা বাংলার স্যার ছিলেন না। হয়তো সেকারণেই পরীক্ষার খাতা দেখানো তাঁর কাছে নিছক আনুষ্ঠানিকতা হয়ে ওঠেনি কখনওই। হাতে উত্তরপত্র তুলে দেওয়ার সময়ে বামনদেববাবু প্রত্যেককে আলাদা করে তাদের ভুলত্রুটি বোঝাতেন। শুধু সাদা নয়, নানান রঙের চক থাকত তাঁর হাতে। তারপর অধ্যায়ের পর অধ্যায়জুড়ে স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ছক-চার্ট-টীকা-সূত্রে আলোকিত হয়ে উঠত ব্ল্যাকবোর্ড। দুরূহ বহুব্রীহি থেকে প্যাঁচালো প্রত্যয়— সব কিছু নিমেষে জলের মতো তরল! ব্যাকরণের নিয়মতান্ত্রিক দুর্গে বিনা আয়াসে ঢুকে পড়ার ব্যবস্থা করে দিতেন যিনি, তিনিই কিনা খড়গহস্ত হয়ে উঠতেন সামান্য নিয়মভঙ্গে। কালীকুণ্ডু লেন থেকে কাসুন্দিয়া শিবতলা পর্যন্ত নিয়মিত রিকশা চড়ে স্কুলে যাতায়াত। তীক্ষ্ণ নজর থাকত রাস্তায়। কেউ অসভ্যতা করলে ক্লাসে ঢুকে সাজা দিতেন। প্রধান শিক্ষক না হয়েও গোটা স্কুলের অনুশাসনরক্ষার ভার যেন স্বেচ্ছায় নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন! চুপিসারে, সন্তর্পণে স্কুল-করিডরে হাঁটাচলা করতেন তিনি। তাঁর উপস্থিতি আগাম টের পাওয়া যেত না। হাতেনাতে কারও কোনও কুকর্ম ধরে ফেললে আর রক্ষে নেই! যদিও মজা করে ছদ্মগম্ভীর গলায় নিঃশব্দগতির গোপন রহস্যটি জানাতে ভুলতেন না, ‘তোদের জন্য বিশেষ কায়দায় জুতো বানিয়েছি। যাতে হাঁটাচলা করলে কোনও শব্দ না হয়।’

    বাইরে থেকে আপাত-কঠিন মনে হলেও বামনদেব চক্রবর্তী ছিলেন আক্ষরিক অর্থে ছাত্র-অন্ত-প্রাণ শিক্ষক। যার প্রমাণ মিলত যে-কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে। পড়ুয়াদের হাত খুলে খাওয়ানোয় তিনি কসুর করতেন না। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। হইহই করে নেমে পড়তেন নাটক মঞ্চস্থ করতে। বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর নির্দেশনায় পরিবেশিত রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’ গল্পের নাট্যরূপায়ণ তৎকালীন ছাত্রদের স্মৃতিতে আজও সজীব।

    বামনদেব চক্রবর্তী শিক্ষকতাকে বিদ্যালয়ের পরিসর ছাড়িয়ে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন এমন কিছু করতে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা শুধু সূত্র আর নিয়ম শিখবে না; বরং, ভুলত্রুটি শুধরে ভাষাজ্ঞানকে আরও অটুট, নিশ্ছিদ্র করতে পারবে। কিন্তু এর উপায়? অনেক ভাবনাচিন্তার পর মাথায় আসে একটিই নাম— বই! একমাত্র বই-ই পারে তাঁর উদ্দেশ্যকে বিস্তার দিতে। কিন্তু তার মুদ্রণ, বিপণনের জন্য তো স্থায়ী ঠিকানা দরকার। সেই কারণে ১৯৬২ সালে বইপাড়ায় খুলে ফেলেন আস্ত প্রকাশনা। নাম দেন ‘অক্ষয় মালঞ্চ’। সেখান থেকেই ছেপে বেরোয় বিখ্যাত বই ‘উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ’। বর্তমানে বামনদেববাবুর পুত্র শ্রী কুঙ্কুম চক্রবর্তী প্রকাশনাকে দক্ষ হাতে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

    শিক্ষক হিসেবে তিনি মোটেও গতে বাঁধা বাংলার স্যার ছিলেন না। হয়তো সেকারণেই পরীক্ষার খাতা দেখানো তাঁর কাছে নিছক আনুষ্ঠানিকতা হয়ে ওঠেনি কখনওই। হাতে উত্তরপত্র তুলে দেওয়ার সময়ে বামনদেববাবু প্রত্যেককে আলাদা করে তাদের ভুলত্রুটি বোঝাতেন। শুধু সাদা নয়, নানান রঙের চক থাকত তাঁর হাতে। তারপর অধ্যায়ের পর অধ্যায়জুড়ে স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ছক-চার্ট-টীকা-সূত্রে আলোকিত হয়ে উঠত ব্ল্যাকবোর্ড।

    এ তো গেল ব্যক্তি বামনদেবের কথা। আমরা যারা পরবর্তী প্রজন্মের, যারা শিক্ষক বামনদেব চক্রবর্তীর ক্লাস করিনি, তাদের কাছে তিনি বইয়ের পাতায় উপস্থিত। এবং বেশ জ্যান্তভাবেই উপস্থিত। কেন বলছি এ-কথা? যেখানে বিষয়টা স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ, নৈর্ব্যক্তিকতা আর নিয়মনিষ্ঠাই যার দুই গুরুত্বপূর্ণ আলম্বন, সেখানে রচয়িতাকে প্রত্যক্ষভাবে পাওয়ার খুব একটা উপায় থাকে কি? এই সংগত প্রশ্নের সংগত জবাব দিয়েছেন স্বয়ং বামনদেব চক্রবর্তী। দিয়েছেন বইয়ের পাতায়-পাতায় শিক্ষক এবং গ্রন্থপ্রণেতা হিসেবে হাত ধরাধরি করে হেঁটে। স্রেফ সংজ্ঞা, তারপর ব্যাখ্যা, তারপর উদাহরণ দিয়ে আর পাঁচটা বাজারচলতি বইয়ের কায়দায় তিনি কাজ সারেননি। নিয়মিত ক্লাস নেওয়া এক শিক্ষক, খাতা দেখে ভুল খুঁজে সংশোধনে উদগ্রীব এক শিক্ষক গড়পড়ুয়ার নাড়ির হদিশটি পেয়েছিলেন। জানতেন, মহৎ যে ধন= মহাধন (কর্মধারয়) আর মহতের ধন= মহৎধন (তৎপুরুষ) তাদের গুলিয়ে যায়। তাই ‘মহাধন’-এর সঠিক ব্যাসবাক্যটি লিখেই প্রথম বন্ধনীর ভেতর জানাতে ভোলেন না, ‘কিন্তু মহতের ধন= মহৎধন (তৎপুরুষ)।’

    ‘সে তার যার= সেতার।’ এ তো সবাই ‘লিখবে’। কিন্তু যারা ‘টার্গেট রিডার’ তারা সবাই কি ব্যাসবাক্যের আদত মানেখানা ‘বুঝতে’ পারল? গ্রামের কোনও স্কুলের এক ছাত্র, হয়তো হাতে ধরে ব্যাকরণ শেখানোর মতো শিক্ষক পায়নি সে, কিংবা পেলেও ক্লাসের বরাদ্দ সময়েও তো থাকে সিলেবাস-শেষের তাড়া… তার কাছে যে ব্যাসবাক্যের অস্যার্থ যে-তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল! এর জন্যই আঁধারমানিক বামনদেব আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি কী করলেন? না, সমাসকে ভেঙে দেখালেন এভাবে :

    ‘সে(তিন= ফারসি) তারযার= সেতার।’

    বিশদ ব্যাখ্যার পথে না হেঁটেও কী অনায়াসে সমাস আলোকিত হয়ে উঠল! জনপ্রিয় লব্জ ‘টিএলএম’ বা ‘টিচিং-লার্নিং মেটেরিয়াল’ দিয়ে ক্লাস পরিচালনার এর চাইতে উৎকৃষ্ট নমুনা, তাও আবার বইয়ের পাতায় দেখানো, কীভাবে সম্ভব! এ যেন চক-ডাস্টার হাতে দাঁড়ানো স্যারের সামনে বসে ক্লাস করা। বিষয়নিপুণ শিক্ষক তো এভাবেই অব্যর্থ ইঙ্গিতমাত্র দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড সাজিয়ে তোলেন। ‘সে’ এখানে ফারসি শব্দ, যার অর্থ তিন, সেখান থেকে উদ্ভূত সমস্তপদ ‘সেতার’— গোটা বক্তব্য ধরা থাকল যৎসামান্য স্পেসে।

    আরেকটি চমৎকার উদাহরণ ‘গুণিসমাজ’-এর ব্যাসবাক্য। সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস। সকলের জানা। কিন্তু বামনদেব গুণীর সমাজ= গুণিসমাজ লিখে ব্র্যাকেটে জুড়ে দিলেন সতর্কবার্তা— ‘(বানানটি লক্ষ করো)’। ঠিকই তো! একটানা পড়তে-পড়তে চোখ-পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। হ্রস্ব-ই আর দীর্ঘ-ই সমস্যমান পদ ও সমস্তপদে যে বদলে যাচ্ছে! বামনদেব জানেন, পরীক্ষায় প্রত্যেক ব্যাচের ছেলেরা এই ভুলটি করে বসে। সাধারণ ভুল। তাই সতর্ক সাবধানবাণী বন্ধনীর আড়ালে তর্জনী নাড়ায়।

    শুধুই সমাস নয়। প্রতি অধ্যায়ে বহুবর্ণ চক হাতে শিক্ষক বামনদেবের অদৃশ্য উপস্থিতি আমি নিতান্তই নাদান পাঠক-ছাত্র হিসেবে টের পাই। ধরা যাক, ‘বিভক্তি’-র কথা। শূন্যবিভক্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লেখা হল, ‘যে শব্দবিভক্তিচিহ্নটি শব্দে যুক্ত হইয়া শব্দটিকে পদে পরিণত করিয়া নিজে অপ্রকাশিত থাকে তাহাকে শূন্যবিভক্তি বলা হয়।’ এরপর খানকতক উদাহরণ দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু ওই যে, বামনদেব পড়ুয়ার নাড়ির গতি চেনেন। শূন্যবিভক্তির কথা ক্লাসে বলার সময়ে বেশ কিছু জিজ্ঞাসু, বিভ্রান্ত মুখ তাঁর নজরে এসেছিল নিশ্চিত। সংজ্ঞার বাচ্যার্থ বুঝলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে যারা ছিল ঘোরতর সন্দিহান। তাই তাদের-ই প্রতিনিধি, গ্রামবাংলার স্কুলের সমস্ত মুখচোরা ছেলেমেয়ে, যারা হয়তো উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে লজ্জা পায়, তাদের প্রবোধ দেওয়ার ভঙ্গিতে লিখে দেন, ‘পদে পদে শব্দবিভক্তির ধাক্কা সামলাইতে সামলাইতে বাক্যের গতি বড়োই শ্লথ হইয়া পড়ে। শূন্যবিভক্তি সেই জড়তা হইতে বাক্যকে মুক্তি দেয়। ফলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় এবং ভাষার গতিশক্তিও বৃদ্ধি পায়।’ একই কৌশলে ধ্বনিপরিবর্তনের ধরতাই দিতে গিয়ে জানাতে ভোলেন না এই বদলের নিহিত সত্য আর বিজ্ঞান। সরল, সুস্পষ্ট ভাষায় বামনদেব বলেন, ‘… কিন্তু বাংলার মতো এমন পেলব দেশের ভাষা বলিয়া বাংলাভাষার প্রাণেও যে সেই পেলবতা আর মধুরতা মিশানো রহিয়াছে। কঠিনকে সহজ ও জটিলকে সরল করাই সে ভাষার প্রাণের সাধনা।অতীতের বিধিনিষেধের গণ্ডিকে আঁকড়াইয়া সে মৃতবৎ পড়িয়া থাকে নাই। প্রাণের আবেগ তাহাকে সম্মুখে চলিবার প্রেরণা দিয়াছে।… ফলে নিত্যনবীনতার স্পর্শে সে ভাষার শুধু ধ্বনি পরিবর্তনই নয়, রূপেরও পরিবর্তন ঘটিয়াছে, এখনও ঘটিতেছে।’ এটুকু পড়ার পর ব্যাকরণ আর শিং উঁচিয়ে ভয় দেখাতে আসে না। ভাষাকে ভালোবাসতে শেখায়। মমত্ব জাগিয়ে তোলে।

    ঋণস্বীকার: শ্রীসন্দীপ বাগ

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook