আমরা ও কামড়া
ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর ওটিটি-প্ল্যাটফর্মদের বললেন, অনুষ্ঠানে যেন দেশের সমষ্টিগত বিবেকের প্রতিফলন হয়। যেন সব বয়সের লোক দেখে সুস্থ আনন্দ পায়। এবং যেন সৃষ্টিগত স্বাধীনতার নামে এমন কিছু না করা হয় যা ভারতীয় সংস্কৃতির পক্ষে অপমানজনক। বা অত্যন্ত অশ্লীল। এছাড়া ওটিটি-কে যেন ব্যবহার না করা হয় ভয়াবহ আদর্শের প্রচার বা সেসব মতামতের প্রতি পক্ষপাত গড়ে তোলার কারণে।
কথার সুর অচেনা নয়। ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’, ‘সুস্থ বিনোদন’, ‘সমষ্টিগত বিবেক’ কথাগুলোর খুব মানে নেই, থাকলেও এত ঝাপসা, যে-কোনও অর্থে এগুলোর ব্যবহার করা যায়। এখানে আসলে যা বলা হল: যেন এমন কিচ্ছু দেখানোর কথা কল্পনাও না করা হয়, যা সরকারের পছন্দ নয়, শাসক দলের পছন্দ নয়। দেখালে, টুঁটি টিপে দেব। ‘যেন ভারতীয় সংস্কৃতির অপমান না হয়’— এ হুংকার আমরা সহস্রবার শুনেছি, কখনও সম্পূর্ণ বিপরীত কারণেও। কেউ ভাবতে পারে, হিন্দুত্বের অপমানেই ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বাধিক অপমান, কেউ ভাবতে পারে একটি ধর্মের বাড়াবাড়ি তোল্লাই-ই হল ভারতীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় অপমান। কেউ ভাবতে পারে, ‘গরুর প্রস্রাব খাওয়া ভাল’, বা ‘গণেশের মাথায় প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছিল’— এ কথা বলাই ভারতীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে অপমান, কেউ ভাবতে পারে বেদ উপনিষদের পর পৃথিবী একটুও এগিয়েছে— এ কথা ভাবাই ভারতীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় অপমান। ভারতীয় সংস্কৃতির বহু রকম বহু ধরন বহু স্তর বহু বাঁক, একসময় মেয়েরা ব্লাউজ পরলে তাদের পেটানো হত এখন ব্লাউজ না পরলে গাল দেওয়া হয়, কোনও মন্দিরে সমবেত মৈথুনের উৎকীর্ণ ছবি দেখতেও লোকে যায় আবার কোনও মন্দিরে রজস্বলা নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে, তাই বিশাল বিস্তৃত শাখার কোন খাঁজটা ধরে কে ঝুলছে বোঝা দায়। সেই জন্যই ‘এখানে ভারতের সংস্কৃতির অপমান হল’ বলে চিৎকার করে ওঠা প্রায় সকলের পক্ষেই সুসম্ভব, ওই লব্জ তাই যুগে যুগে সব শাসক দলই প্রয়োগ করেছে। বিজেপিকে একা দোষ দিয়ে লাভ নেই, যে কোনও শাসক দলই চোখ রাঙিয়ে চিরকাল বলেছে তাদের মনোমত না হলে তারা সেই বিনোদনকে কান মুলে ক্লাসের বাইরে বার করে ছাড়বে। ‘সৃষ্টিগত স্বাধীনতা’ বা ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ বা ‘বাকস্বাধীনতা’ কেউ পছন্দ করে না, একটা রাজনৈতিক দলও না, সব দলই স্পর্শকাতর ও পাঁড়-কুচুটে।
চিন এখন একটা আইন সংশোধন করে ফরমান আনতে চাইছে: এমন কোনও পোশাক পরা যাবে না বা চিহ্ন ধারণ করা যাবে না, যাতে চিনা জাতির সত্তার অপমান হয়, বা চিনা জনগণের আবেগে আঘাত লাগে। ১৯৮০-র দশকে চিনে ইস্কুলে বা কারখানায় নীতি-পুলিশ ঘুরত, কারও পায়ের কাছে বড় ঘের-দেওয়া জিনস দেখলে কাঁচি বাগিয়ে কেটে দিত, পুরুষমানুষের লম্বা চুল দেখলেও কাঁচি কচকচাত। কোনও কোনও সরকারি বাড়িতে লম্বাচুলো পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, এমনকী গয়নাগাঁটি পরা বা মেক-আপ লাগানো মেয়েদেরও। এবার সেসব বন্দোবস্তও ফেরত আসতে পারে, যদি সরকার মনে করে তা ‘চিনা জনগণের আবেগে আঘাত করছে।’ এখন অবশ্য কাঁচিবাজির হুমকি দেওয়া হয়নি, বলা হয়েছে জরিমানার কথা (৬৮০ ডলার অবধি) অথবা অন্তত ১৫ দিন জেল। আসল ব্যাপা়র হল, এ ধরনের চাট্টি বায়বীয় বাক্যবিন্যাসের ক্রাচে ভর করে যে কোনও অপছন্দের লোককেই যখন-তখন গ্রেফতার করা যায়। কোন পোশাক চিনা জনগণের আবেগে আঘাত করছে তা তো আর ভোট নিয়ে ঠিক হবে না, ওর আসল মানে, সবাই জানে, সরকারের আবেগ। যেমন বিরোধীকে ধোলাই দিয়ে বলতে হয় জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পিটিয়েছে। হয়তো পেয়াদা এসে বলল, আপনার টাই-টা আমাদের আবেগে আঘাত করছে, অথবা, ওড়নার রংটা যেন পাশ্চাত্যগন্ধী, তা আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী, আমাদের সত্তায় ফোঁড়া গজাচ্ছে, হাজতে চলুন। আবার যেদিন টাই পরলেন না, সেদিন সেই অভাবটাই ধাঁ করে আবেগে গাঁট্টা মেরে বসল। চিনে কেউ সরকারবিরোধী বা প্রতিবাদী শিল্প-ফিল্প করলে সে মাঝেমাঝে হুউশ হাপিশ হয়ে যায়, তাই ওইদিকটা মোটামুটি ম্যানেজ করাই আছে। এবার আঁটুনিটা সাড়ে-বজ্র করতে জামাপ্যান্টের কাট, চুলের ছাঁট, সানগ্লাসের ফাঁট, উল্কির ডাঁট, জুতোর ঠাটে নজর-ক্যামেরা সেঁটে দাও। চিনে কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছে, এরপর কি আমরা ইরান বা আফগানিস্তান নিয়ে হাসাহাসি করতে পারব?
কেউই পারবে না, কারণ গাদা গাদা দেশে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কাঁটাকীর্ণ-বকলশ পরানোর প্রক্রিয়া চলছে, কেউ ধীরে এগোচ্ছে কেউ দ্রুত, কেউ সভ্যতার তোয়াক্কা না করে ‘অ্যাই, মেয়েরা কাল থেকে পার্কে যাবে না’ হেঁকে দিচ্ছে, কেউ সামান্য চোখের চামড়া রেখে ‘আমাদের ঐতিহ্য যেন টোল না খায়’ মার্কা ধোঁয়াটে বাক্য হাঁকড়াচ্ছে। আশ্চর্য, এই পৃথিবীতেই সামাজিক মাধ্যমে বাকস্বাধীনতার হদ্দমুদ্দ সার্কাস বনবনায়মান, স্বাধীনতা সেখানে প্রায়ই স্বেচ্ছাচার যথেচ্ছাচার লঙ্কার আচারে বিস্ফারিত ও বিস্ফোরিত, এবং কোনও সন্দেহই নেই যে এই ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ টুইটার ইনস্টাগ্রামই এখন মেনস্ট্রিম, তার চারপাশেই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ধন্য। তাহলে, যেখানে যে কোনও মানুষ যে কোনও মত জোর দিয়ে (এবং খিস্তি দিয়ে) প্রকাশ করতে পারছে, সেখানে প্রকৃত সমাজে চাবুক চালাবার অনুশাসন-গিঁট্টু অবধারিত টাইট হচ্ছে কেমনে? এতে অবশ্য সন্দেহই নেই, সামাজিক মাধ্যমেও সেন্সরবাবুর খাঁড়া ওই ওই নামল, ইতিমধ্যেই নিয়মকানুন এসে গেছে, তুমি দেশবিরোধী জাতিবিরোধী কাণ্ডাকাণ্ড করলে হাতকড়া, কিন্তু এখনও তো জাগ্রত আছে দেশে দেশে জনগণের খ্যাঁকানি ও ক্ষোভ? না কি রাষ্ট্র মুচকি মেরে বলছে, যদ্দিন জেলখানার ভয় নেই তদ্দিন এট্টু উড়ে নাও বাছা, তারপর গারদে গিয়ে লপসি গিললে সে ঢেঁকুরে ফেসবুক ফুটুড্ডুম। ‘গৃহযুদ্ধ’ সিনেমায় এই গোছের সংলাপ ছিল, আমাদের সুখদুঃখগুলো বড় বড় কোম্পানির দাবার চালের ঘুঁটিমাত্র। হয়তো আমাদের স্বাধীনতা বা নিজদর্শন-উপস্থাপন, কিংবা চিন্তক হিসেবে অহং উদযাপন আর কিছুই নয়, প্রকৃত ক্ষমতা-সেন্টারের সামান্য ছাড় দেওয়া রশির বশে কয়েক ইঞ্চি বাড়তি জগিং, সুতোয়-বাঁধা ফড়িংয়ের ডানা-কেরদানি। চিনে এখনও তো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লেখা যাচ্ছে, ‘চিনের ইতিহাসে, যতবার সরকার চুলের ছাঁট আর পোশাক-আশাকের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে, ততবার খারাপ সময় এসেছে।’ এতে হয়তো চিনা সরকার মুচকি হাসবে, পরে মোজায় ফুটো থাকার ছুতোয় ওই লোকটাকে ধরবে, কিংবা আরও পরিণতমনস্ক নিষ্ঠুর হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাঁতরাতে দেবে কিন্তু বাস্তবে নির্জলা করে দেবে তার ঘর-বাহির, বা হয়তো শেষ অবধি অনুশাসনটা আনবেই না বাতিল করে দেবে কিন্তু খতিয়ে দেখে রাখছে কারা কারা সরকারের বিরুদ্ধে গাল পাড়ার ধক রাখে।
বারবার লোফালুফি করে পচে যাওয়া প্রশ্ন: দুনিয়া জুড়ে এ চেঙ্গিজ-দর্শন কি জিতবেই? যে দেশ ধর্মবাজ-অধ্যুষিত, বা উগ্র রাজনৈতিক দর্শনের ফলে থাপ্পড়পন্থী, সেখানে তো দেখা যাচ্ছেই তীব্র অত্যাচার। সারা পৃথিবীকে কাঁচকলা দেখিয়ে কেউ যুদ্ধ অবধি দাপিয়ে করছে, ধিক্কার-টিক্কার জানানোর বেশি অন্যেরা খুব কিছু শানাতে পারছে না। এমনকী যেখানে ব্যালট বা ইভিএমএ ঠিক হয় কারা এবার টাকা মারবে ও প্রজা প্যাঁদাবে, সেখানেও হুবহু গপ্পো। তার মানে হুট করে অনেকগুলো শাসক বুঝে গেল যে পৃথিবীতে আসলে গণতন্ত্র এসে কভু থেবড়ে বসেনি, মানুষকে যত পেটাবে সে তত হাতজোড় করে থাকবে, এবং কোনওদিন কোনও বিদ্রোহই ফলবতী হওয়ার সম্ভাবনা নেই? প্রায় ইতিহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, গোটা পৃথিবীর সমঝদারির স্রোতের উল্টোদিকে গোড়ালি পুঁতে এই সাইনবোর্ড ঝলকানোর আত্মবিশ্বাস তারা পেল কোত্থেকে? ভোটের ওপর নির্ভরশীল দেশে মানুষের গলা ও কলম মুচড়ে, শুধু চাঁদে গাড়ি নামাবার কীর্তি দেখিয়ে জিতে যাওয়ার স্ট্র্যাটেজিকে তারা নিশ্চিত চ্যাম্পিয়ন ভাবছে কোন বুদ্ধিতে? তবে কি আমাদের সহস্র-সমাদৃত কোটেশন, ‘কিছু লোককে সবদিনের জন্য বোকা বানানো যায়, সব লোককে কিছুদিনের জন্যে বোকা বানানো যায়, কিন্তু সব লোককে সবদিনের জন্য বোকা বানানো যায় না’, আব্রাহাম লিঙ্কনের যে-বাণী এককালে পশ্চিমবঙ্গের কলেজের ও কারখানার গেটে গেটে আবৃত্ত ও পুনরাবৃত্ত হয়েছে, তা কেবল কায়দাবাজি-রঞ্জিত? সব লোককে চিরদিনের জন্য দিব্যি হ্যাট হ্যাট বলে পিঠে ছপটি মারতে মারতে তাড়িয়ে বেড়ানো যায়? এবং তারা লাগ-লাগ-খুশি হয়ে ন্যাজ নাড়াতে নাড়াতে প্রভুর ছুড়ে দেওয়া ঘাস চিবোয় ও সিনেমা হল-এ জাতীয় সংগীতের সময় কাঁকালের ব্যথা সামলে ঠিইক উঠে দাঁড়ায়?