তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বলে শুরু করতে চাই। আমার বিশ্বাস, ঘটনাগুলোর কথা শুনলে পাঠক বুঝতে পারবেন, কোন বিশেষ জিনিসটির সূত্রে তিনটি বাঁধা আছে।
প্রথম ঘটনা: তৃতীয় চন্দ্রায়ন চাঁদের মাটিতে সফলভাবে পদার্পণ করার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আবেগঘন ভাষণ, যে ভাষণে তিনি বুক চিতিয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘জয় জওয়ান! জয় বিজ্ঞান! জয় অনুসন্ধান!’ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলেন শ্রোতারা, মুক্তকন্ঠে সাধুবাদ দিলেন ছাপ্পান্ন-ইঞ্চির সম্রাটকে। বলো, এমন রাজা ক’জন রাজা হয়?
দ্বিতীয় ঘটনা: মূলধারার একটি টিভি চ্যানেলে উৎসবের দিন গিটার হাতে আনন্দ করে একসঙ্গে গান গাইলেন, ফুর্তি করলেন এমন দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যাঁরা সচরাচর খুবই ঝগড়া করে থাকেন। সিপিআই(এম) দলের তরুণ তুর্কি কমরেড শতরূপ ঘোষ এবং, তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রী কুণাল ঘোষ। একদিনের জন্য ঝগড়া ছেড়ে এই ভাব-ভালবাসার জোয়ারে ভেসে গেল কলকাতা।
তৃতীয় ঘটনা: জনশ্রুতিতে নাকি শোনা যায়, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় গাড়িতে যেতে যেতে একদিন দেখলেন, বিরোধী দলের দাপুটে নেতা জ্যোতি বসু রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন তাঁরই বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ সভায় যোগ দিতে। ডক্টর রায় জানলা দিয়ে বললেন, ‘জ্যোতি, গাড়িতে উঠে এসো, কিছু খেয়ে নাও। খালি পেটে তো বিধান রায়ের সঙ্গে লড়তে পারবে না।’ এই কাহিনী শুনে চোখে জল আসে না, এমন ভদ্রলোক কেউ আছেন?
তিনটি ঘটনার মধ্যেই বারবার যে শব্দটি উঠে আসে, সে শব্দটিকে বাঙালি ভদ্রসমাজ ‘রবীন্দ্রনাথ’ বা ‘আমাদের কালচার’ শব্দগুলোর মতোই পবিত্র ভাবেন— সৌজন্য। প্রধানমন্ত্রী না হয় ইসরো-র বাজেট ৮% ছেঁটে বিজ্ঞানের খাত থেকে সরকারি টাকা কমিয়েই দিয়েছেন, তবু সৌজন্য দেখালেন তো? ডক্টর রায় এবং জ্যোতিবাবু একে অপরের রাজনীতিকে দেশের ও দশের পক্ষে মানানসই নয় বলে বিশ্বাস করতেই পারেন, তবু সৌজন্য দেখানোটা কি অস্বাভাবিক?
যারা একটু বেরসিক— অর্থাৎ যারা নাছোড়বান্দার মত বলবেন, ‘হ্যাঁ, অস্বাভাবিক’, তারা অনেকেই এই রাজনীতির সৌজন্যের পিছনে এক প্রকারের ‘সৌজন্যের রাজনীতির’ উপস্থিতির কথা বলবেন। এবং সেই রাজনীতির শিকড়ে চিহ্নিত করবেন নব্যউদার দর্শন বা নিওলিবেরালিজমকে। দক্ষিণপন্থী, অতি-দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী, ইসলামিস্ট, বাম, অতি-বাম, নৈরাজ্যবাদী, মাওবাদী, এমনকি উদারপন্থীরা নিজেরাও এই ‘নিওলিবেরাল’ শব্দটিকে এতবার, এত অর্থে ব্যবহার করেছেন, যে এই শব্দটি নিয়ে একটু কথা না বললে সৌজন্যের রাজনীতির স্বরূপ চেনা দুষ্কর। আমি নিজেও এই শব্দটি যত্রতত্র ব্যবহার করার দোষে দোষী, তাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে শব্দটি নিয়ে খানিক আলোচনা করতে চাইছি।
নিওলিবেরাল শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান (১৯৮১-১৯৮৯) এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের (১৯৭৯-১৯৯০) শাসনকালের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে। নিওলিবেরাল নীতি মূলত মুক্ত বাজার অর্থনীতি (free market economy) এবং মুক্ত বাণিজ্য অর্থনীতির (free trade economy) পাশাপাশি মানুষের স্বতন্ত্রতার একটি বিশেষ সংজ্ঞার উপর জোর দেয়; নিওলিবেরালিজমের মতে সেই মানুষই প্রকৃত অর্থে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন, যার নিজের স্বার্থের (self-interest) নিরিখে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। এই অধিকারের কোনও সীমা নেই— আত্মার মতোই তরবারি তাহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি তাহাকে দগ্ধ করিতে পারে না, জল তাকে আর্দ্র করিতে পারে না! এখানেই নিওলিবেরাল বা নব্যউদার আদর্শ, সাবেকি লিবেরাল বা উদারপন্থী আদর্শের চেয়েও এক কাঠি উপরে। উদারপন্থী নীতি জানায়, মানুষ নিজের ইচ্ছেমত নিজের কাজের ফসলকে (fruit of labour) বাজারে পণ্য (commodity) হিসেবে বেচতে পারবে। নিওলিবেরাল নীতির দাবি, শুধু বাজার নয়— সমস্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি মানসিক ও পারিবারিক স্তরেও মানুষ আসলে নিজেই পণ্য। এবং তার জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তকেই চালিত করছে তার নিজেকে ‘বেচার’ ক্ষমতা, যার পিছনে আছে তার সেলফ-ইন্টারেস্ট। ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে মানুষের স্বতন্ত্রতার কোনও যৌক্তিক কাঠামো নেই। ‘হোমো ইকোনমিকাস’ নামে মানুষের এই স্বার্থকেন্দ্রিক আত্মপরিচিতির মডেলকে নিওলিবেরাল বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করছেন জোসেফ পার্স্কির মতো তাত্ত্বিকেরা।
যে প্রশ্নটি এখানে মাথা চাড়া দেয়, তা এই— মানুষের আত্মপরিচিতির এবং জীবনের প্রত্যেক স্তরে তার কর্মের মূলে যদি ব্যক্তিগত স্বার্থই থাকে, তবে সার্বিক জীবনবোধ বা community life বলতে কী পড়ে থাকবে? এবং সার্বিক জীবনবোধের যে মূল ভাষ্য, অর্থাৎ নীতিবোধ বা morals, তা পুনর্কল্পিত হবে কিসের ভিত্তিতে? নীতিবোধ জিনিসটি জন্ম নেয় সামাজিক পরিসরে, নৈতিক ব্যবহারের মূলে থাকে একে অপরের প্রতি উচিত-অনুচিত ব্যবহারের প্রশ্ন। যে ভাবনায় অপরকে নিয়ে তলিয়ে ভাবার বিশেষ স্থান নেই, সেখানে তবে নীতির প্রকাশ ঘটে কিসের মাধ্যমে?
উত্তরটি লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম— সৌজন্য। আর এই সৌজন্য-ভিত্তিক নীতিবোধের শিকড়ে আছে নীতিবোধকে সার্বিক নয়, বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক রূপে দেখার প্রবণতা।
বস্তুত, নিওলিবেরাল দুনিয়ায় আর পাঁচটা জিনিসের মতোই, মানুষের নৈতিক এবং মানসিক জীবনেও স্বার্থবোধের রাজনীতি বা politics of self-interest তার প্রভাব ফেলে। যার ফলে নৈতিক ব্যবহারের একমাত্র মডেল হিসাবে পড়ে থাকে অন্যের প্রতি সুমিষ্ট, সৌজন্যমূলক ব্যবহার। এই সৌজন্য ভাল-খারাপ বা উত্তম-অধমের গোড়ার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শিকড় নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়, কারণ সার্বিক শিকড় নিয়ে ভাবতে হলে নিজের স্বার্থচেতনাকে খানিকটা হলেও খর্ব করতে হয়। নিওলিবেরাল ব্যক্তি কেবল উত্তম হিসেবে অধমের প্রতি দুটি ভাল কথা বলে একটু হাসতে চায়। ক্যারি টিরাডো ব্রামেন এই সৌজন্যকে বলছেন ‘compensatory niceness’, এবং লিখছেন, ‘নিওলিবেরালিজম অসামাজিক নয়, বরং তার সামাজিকতাটাই একান্ত ব্যক্তিগত। সেখানে সামাজিক চিন্তা বা সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন সীমিত আছে একের অপরের প্রতি মৌখিক সৌজন্যে, অপরের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কোনও অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক বিশ্লেষনে নয়।’
এই ‘মৌখিক সৌজন্যের’ রাজনীতি জন্ম দিয়েছে নীতিবোধের একটি বাহ্যিক মডেলের, সমাজতাত্ত্বিক অ্যালান গিবার্ডের মতে যে মডেল আদতেই খেলো এবং expressivist; এমন মডেলে কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত, তার নির্ণয় মানুষ করেন পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখে নয়, বরং কেমন ব্যবহার করলে তাঁর নিজের আনন্দ হবে তার ভিত্তিতে। এই ধরনের নীতিবোধ কোনোদিন সমাজের গভীর সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজে না, বরং নিপীড়িত বা বঞ্চিত সম্প্রদায়কে একটু তোয়াজ করে সংঘর্ষ এড়ানোর সহজ রাস্তা খোঁজে। ব্রামেন লিখছেন, ‘সমাজের গভীর ক্ষতগুলোর উপর সৌজন্যের রাজনীতি একটি ব্যান্ড-এড মাত্র। তাতে অসুখ সারুক না সারুক, অচলায়তনটি বজায় থাকে।’
সমকালীন রাজনৈতিক বাচ্যে অর্থপূর্ণ আলোচনা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সমালোচনা করার নিষ্ঠা ত্যাগ করে যে সৌজন্যের রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, এবং আমজনতার সেই সৌজন্য চেটেপুটে খাওয়ার যে প্রবণতা, তার মূলে আছে নিওলিবেরাল যুগে নীতিবোধের এই পুনর্কল্পনা। এই দোষে সবচেয়ে বেশি দোষী হয়ত হয়েছেন উদারপন্থী এবং বামপন্থীরা-ই, কারণ দক্ষিণপন্থীদের রাজনৈতিক আদর্শের জায়গায় সৌজন্যের বিশেষ প্রয়োজন নেই। তাত্ত্বিক রবার্ট ফ্যিয়লার লিখছেন, আশির দশকের গোড়া থেকেই মূলধারার লিবেরাল এবং বাম রাজনীতি, দুটিতেই একধরনের বাঁকবদল ঘটে গিয়েছে, যেখানে ‘অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিকাঠামো নিয়ে আন্দোলন’ ছেড়ে রাজনৈতিক কর্মীদের একটি বড় অংশ মেতে উঠেছেন ‘প্রান্তিক সমাজের সঙ্গে প্রতীকী সলিডারিটি-র’ রাজনীতিতে। এমন নয় যে, এঁদের মধ্যে অনেকেই বোঝেন না, যে এই প্রতীকী রাজনীতির কোনও দাম নেই, এবং আদতে সমস্যার সমাধান না খুঁজে এঁরা সমস্যাগুলোকেই পুষে রাখছেন। মুশকিল এই যে, অর্থনীতির বা সমাজের মূলস্তরের সমস্যার সমাধানের যে রাজনীতি, তা সময়সাপেক্ষ এবং গ্ল্যামার-হীন। বরং ভাসা-ভাসা ভাবে নিজেকে ‘অ্যাকটিভিস্ট’ বলে জাহির করে, দিনে চারটি করে গরম গরম কথা বললে লোকের হাততালিও পাওয়া যায়, আবার নিওলিবেরাল শিক্ষা অনুযায়ী এই একান্তই ব্যক্তিগত নীতিবোধের রাজনীতি খুবই জায়েজ। কাজের রাজনীতির থেকে হাততালির রাজনীতির দিকে এই যে সরে আসা, সারা পৃথিবী জুড়ে পপুলিস্ট (populist) নেতাদের উত্থান এই একই প্রবণতার লক্ষণ; এবং এর পিছনে রয়েছে নিওলিবেরাল নীতির শিক্ষা, যে শিক্ষা বাহ্যিকতাকেই পুজো করতে শেখায়।
সৌজন্যের রাজনীতির হাত থেকে কি তবে নিস্তার আছে? সারাদিনের উটকো অকাজ ছেড়ে সত্যিকারের কাজের দিকে কি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আবার ফিরবে? নৈরাশ্যবাদ খুব একটা কাজের জিনিস নয়, তাই আশা রাখি। তবে সময় লাগবে। বছর দশেক আগে এক মাস্টারমশাইয়ের কাছে শোনা একটা কথা দিয়ে শেষ করি, যে কথাটা তিনি আমাদের বলেছিলেন এই কাজের রাজনীতি বনাম হাততালির রাজনীতির তফাত বোঝাতে। তিনি বলেছিলেন, ‘রোজ রোজ পাড়ার মোড়ে স্টেজ থেকে এত লোককে বলতে শুনি, বন্ধুগণ, দেশের আজ বড় দুর্দিন, আসুন আমরা দেশের সেবা করি। একজনকেও বলতে শুনেছিস, বন্ধুগণ, সামনের ঐ নর্দমাটা বহুদিন আবর্জনায় ভরে আছে, বর্ষাকালে জল জমে, আসুন নর্দমাটা সাফ করি? কারণ নর্দমা সাফ করার কথা বললে হাততালি পাওয়া যায় না, দেশের সেবার কথা বললে যায়, যদিও দেশের সেবাটা কীভাবে করব, সেটা কারোর ভাবার ইচ্ছে নেই।’ মাস্টারমশায়ের কথায় একটু লেজুড় জুড়ে আজ বলি— আমার বিশ্বাস একদিন নর্দমা সাফ করার কথা তুললেও অবশেষে হাততালি জুটবে, কিন্তু তার জন্য নর্দমা উপচে পড়ে সবার ঘরে ময়লা জল ঢোকার অবস্থায় পৌঁছোতে হবে।
আশঙ্কা একটাই, ততদিনে দেরি না হয়ে যায়।