ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • দিনান্তের পথিক


    ঔষ্ণীক ঘোষ সোম (September 2, 2023)
     

    এ-বছর মার্চের শুরুর দিকের কোনও এক বিকেলবেলার কথা। কিছুদিনের মধ্যেই ভুবনেশ্বর ঘুরতে যাব। ভুবনেশ্বরের অদূরেই কটক শহর, যেখানে ভারতীয় কবিতার জীবন্ত কিংবদন্তি জয়ন্ত মহাপাত্র থাকেন। একবার অন্তত সামনে থেকে ওঁকে দেখবার খুব ইচ্ছে। ফোন করলাম। কলকাতা থেকে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই শুনে শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন। ওই হাসিটাই আসলে ছিল ওঁর অন্দরমহলের দরজা, যা আমার জন্যে তিনি খুলে দিয়েছিলেন। ওই একটা ফোনেই।

    এর ঠিক এক সপ্তাহ বাদে, ভুবনেশ্বরে পৌঁছেই সোজা চলে যাই কটক। হাজার বছরের সেই পুরনো শহর, যার অলিতে-গলিতে ধুলোর গন্ধ। কটক হাইকোর্ট পেরিয়ে নেতাজির পৈতৃক ভিটে বাঁয়ে রেখে পৌঁছাই তিনকোণিয়া বাগিচায়। দেখলাম রিক্সা চালক থেকে শুরু করে রাস্তার আশেপাশের দোকানিরা সবাই জয়ন্ত মহাপাত্রর বাড়ি চেনেন। তাই বাড়ি খুঁজে পেতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। বাড়ির নাম ‘চন্দ্রভাগা’। ঠিক এই নামেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে চলেছেন, যা বর্তমানে ভারতবর্ষে প্রকাশিত হওয়া ইংরেজি সাহিত্য পত্রিকাগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য। শুনেছি মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ হলেও সম্পাদক হিসেবে খুবই কড়া। সে যাই হোক, চন্দ্রভাগা গেট থেকে ঢুকে বাগান পার করে তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম হাসিমুখে বেরিয়ে এসেছেন ৯৪ বছরের এক যুবক। পরনে সাদা ফতুয়া এবং পাজামা। সেদিন প্রায় কয়েক ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে বসে গল্প করার সুযোগ হয়েছিল। কথায়-কথায় উঠে এসেছিল বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, হিন্দুস্তান পার্ক, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন, দস্যু মোহনের গল্প-সহ আরও অনেক কথা। এদিক-ওদিক থেকে খুঁজে এনে দিলেন ‘চন্দ্রভাগা’র বেশ কিছু মূল্যবান সংখ্যা এবং ওঁর একটি গল্পের বই। সেদিনের এইসব গল্পগাছার মধ্যে অনেকটাই হয়েছিল বাংলায়। খুবই চমৎকার বাংলা বলতে পারতেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে জেনেছিলাম যে, তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ বইটি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। আর সেই দিনই জানতে পেরেছিলাম, ইংরেজির পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন ধরে ওড়িয়া ভাষায় কবিতা লিখে চলেছেন।

    জয়ন্ত মহাপাত্র বাড়ি ‘চন্দ্রভাগা’

    ওঁর ইংরেজি সব লেখা পড়া থাকলেও, ওড়িয়া পড়তে না পারার কারণে বাকি লেখাগুলো পড়তে পারছিলাম না। সেই দুঃখ কিছুটা ঘোচালেন কবি দুর্গাপ্রসাদ পান্ডার কন্যা অন্বেষা। ওরই সাহায্যে জয়ন্ত মহাপাত্র-র বেশ কিছু ওড়িয়া কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে ফেললাম ‘যাপনচিত্র’ পত্রিকার জন্য। ওঁর ওড়িয়া কবিতা বাংলায় অনুবাদ করছি শুনে, অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। সম্ভবত এই প্রথমবার ওঁর ওড়িয়া কবিতা বাংলায় অনূদিত হল। আমার অনুবাদের কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার দু-একদিন আগে উনি আমাকে ওঁর একটি সদ্য প্রকাশিত কবিতা পাঠিয়ে বললেন, ‘ঔষ্ণীক, আমার একটা কথা, শুনবে তো? আমার এই কবিতাটা বাংলায় অনুবাদ করতে পারবে? এটা একটু অন্যরকমের লেখা।’ একজন শিশু যেভাবে কাউকে কুণ্ঠাভরে কিছুর জন্য অনুরোধ করে, ওঁর স্বরে সেই সারল্যের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়ে অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলাম সেদিন। ওঁর মতো একজন কিংবদন্তি লেখক আমার মতো একজন নিতান্তই নব্য কলমচিকে এত বিনয়ের সঙ্গে কিছু অনুরোধ করতে পারেন, স্বপ্নেও ভাবিনি। সেদিন ওঁর একটা অন্য দিক আমার সামনে খুলে গেছিল। ওঁর এই অন্যের প্রতি (তা সে ওঁর থেকে যত ছোটই হোক না কেন) শ্রদ্ধাবান হওয়ার শিক্ষা আমার শিরোধার্য হয়ে থাকবে।

    কবি অঞ্জলি দাশের কাছ থেকে একবার শুনেছিলাম, ভুবনেশ্বরের এক কবিতা আসরের গল্প। কোনও এক সাহিত্যসভার আমন্ত্রণে নবনীতা দেবসেন এবং অঞ্জলিদি সেবার ভুবনেশ্বরে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে জয়ন্ত মহাপাত্র তখন কোথাও যাচ্ছিলেন না। কিন্তু তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু নবনীতার সাথে দেখা করবেন না, তাই কখনও হয়! সেই শরীরেই ওঁদের হোটেলে চলে এসেছিলেন। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিলে তাঁদের আলাপচারিতা এবং কবিতা পাঠের আসর। জয়ন্ত মহাপাত্র নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে বিদিশার মাটি স্পর্শ করার অভিজ্ঞতা এবং জীবনানন্দের বনলতা সেনকে কেন্দ্র করে একটি অসাধারণ কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতার কিছু অংশের বঙ্গানুবাদ এখানে পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম—

    ‘সেই সন্ধ্যায়, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে,
    যখন ট্রেন বিদিশা স্টেশনে এসে থামল,
    নবনীতা আর আমি নেমে গিয়ে
    দু-হাতে তুলে নিলাম সেই ভেজা মাটি।
    আমাদের হৃদয় জুড়ে দাবানল জ্বলে ওঠে,
    জীবনানন্দ একদা লিখেছিল বিদিশার কথা।
    বিদিশা ভাসতে ভাসতে তলিয়ে যায়
    হৃদয়ের অতল আলো-ছায়ায়।
    অদম্য পাগলামির সে এক ভালই অজুহাত।
    আমরা দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে,
    অন্তরের অস্থিরতায় বিবশ হয়ে।
    বনলতা সেনের নিখুঁত মায়া
    দীর্ঘ ছায়া পার হয়ে যায়
    আবছা তারারা মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে;
    জীবনের গভীরতার আভাস বাতাস আবৃত করে রাখে।
    এরপর নবনীতা তার বার্থে শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ল।
    সেটা ছিল ১৯৮৫ এর বর্ষা…’

    জয়ন্ত মহাপাত্র ও নবনীতা দেবসেন

    উড়িষ্যা থেকে ফিরে আসার পর ওঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এত স্নেহভরে প্রশ্রয় দিতেন যে কখনও মনে হয়নি ওঁকে বিরক্ত করছি। ওঁর কাছ থেকেই শুনেছিলাম, উনি নাকি চিঠি লিখতে খুব ভালোবাসেন। তাই ওকে একবার বেশ লম্বা একটা চিঠি লিখেছিলাম। সেটা আবার আমার জীবনে লেখা প্রথম এবং এই পর্যন্ত একমাত্র চিঠি। বেশ কিছুদিন পর তার উত্তর এসেছিল মুক্তোর মতো হাতের লেখায়; তিনি ধরে-ধরে আমার নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন ওঁর সদ্য প্রকাশিত ইংরেজি কবিতার বই Noon

    বেশ কিছুদিন আগে একটি ইংরেজি অন্তর্জাল পত্রিকায় আমার অনূদিত শঙ্খ ঘোষের কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। সেই লেখার লিংক ওঁকে পাঠিয়েছিলাম। অসুস্থতা এবং কাজের ফাঁকে তিনি সেগুলো পড়ার সুযোগ পাবেন, সে-আশা করিনি। যদিও-বা পড়েন, আমার মতো এক আনাড়ির কাঁচা হাতের কাজের ভুল-ভ্রান্তিগুলো তিনি যদি বলেন, সে-ই হবে আমার পরম পাওয়া। এমনটাই ভেবেছিলাম। আমার সব অনুমানের দফারফা করে দিয়ে তিনি কিছুদিন বাদে আমায় লিখলেন, ‘এই কবিতাগুলো ‘চন্দ্রভাগা’-তে প্রকাশ করতে চাই।’ চমকে উঠেছিলাম! কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ওঁকে লিখি যে, সেগুলো যেহেতু আগেই প্রকাশিত তাই তার বদলে আমি ওঁকে নতুন আরও কিছু অনুবাদ পাঠাব।চন্দ্রভাগার বিংশতম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় আমার করা শঙ্খবাবুর কবিতার সেই অনুবাদগুলো। সেটাই ওঁর সম্পাদিত শেষ সংখ্যা। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো-বা নিতান্তই স্নেহের বশবর্তী হয়ে তিনি আমার কাজ ছাপতে চাইছেন, কিন্তু পরে উনি যখন অনুবাদের পাশাপাশি বাংলা কবিতাগুলোও দেখতে চাইলেন, তখন বুঝলাম আমার ভাবনায় ভুল ছিল, তিনি তাঁর কাজের সঙ্গে কোনও সমঝোতা করেন না।

    জয়ন্ত মহাপাত্রর সঙ্গে লেখক

    প্রথম দিন ওঁকে দেখেই আমার ক্লান্ত মনে হয়েছিল। এই বয়সে শত কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, সদা হাস্যময় মানুষটা কোথাও যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেন। স্ত্রী-সন্তান-সহ কাছের মানুষদের একে-একে বিদায় নেওয়া তাঁকে হয়তো আরও একাকী করে তুলেছিল। সেই একাকিত্বের ছোঁয়া তার শেষ দিকের কবিতাগুলিতে গভীরভাবে ছায়া ফেলেছে। আমি যবে থেকে ওঁকে দেখছি, মনে হয় মৃত্যুচেতনা সমান্তরালভাবে ওঁর ভেতরে জেগে উঠেছে ততদিনে। দীর্ঘ জীবনের ক্লান্তি সত্ত্বেও সবসময় কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও সেখানে বসে ‘চন্দ্রভাগা’র নতুন সংখ্যার কাজ শেষ করেছেন। হাসপাতালের বেডে বসেই প্রকাশ করেছেন শেষ ওড়িয়া কাব্যগ্রন্থ ‘ঝাঞ্ঝি’। তারপর ভাদ্রের এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধায় দীর্ঘ জীবনের সব রাজ্যপাট ফেলে রেখে তিনি চলে গেছেন সীমান্তের দিকে। যেখানে চন্দ্রভাগা নদী সমুদ্রে গিয়ে মেশে। তিনি তার একটি কবিতায় লিখেছিলেন,

    ‘এই আশ্বিণের অষ্টমীতে
    আমার ৯৫ বছর পূর্ণ হবে।
    হয়তো-বা হবে না।’

    তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হল। আমাদের কাছে পড়ে রইল তাঁর শব্দের বিস্তীর্ণ উপত্যকা এবং এক মহৎ জীবনের উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকারের ধ্বজা আমাদেরই বয়ে নিয়ে যেতে হবে আগামী ভোরের দিকে…

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook