মণিপুর আর
মণিপুরে মহিলাদের নিগ্রহকারীরা গ্রেফতার হতে শুরু হল, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, পুলিশ খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। তাই? কত দ্রুত? সুপ্রিম কোর্ট যেই বলেছে, ‘সরকার না পদক্ষেপ নিলে আমরা নেব’, তার পাঁচ মিনিটের মধ্যে একজন গ্রেফতার। আদালত একথা কবে বলেছে? নারীদের বিবস্ত্র করে ঘোরানো হচ্ছে, নিগ্রহ করা হচ্ছে— এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরে। ভিডিও ভাইরাল কবে হয়েছে? ঘটনা ঘটার ৭৫ দিন পরে। তার মানে পুলিশ ‘খুব তাড়াতাড়ি’ গ্রেফতার কবে করল? ঘটনা ঘটার প্রায় ৭৫ দিন পাঁচ মিনিট পরে। এদিকে ঘটনা চুপিচুপি ঘটে যায়নি। ৪ মে হাজারের ওপর লোক এসে ন’খানা গ্রাম আক্রমণ করেছে, তছনছ করেছে, সব বাড়ি থেকে জিনিস লুঠপাট করেছে, বাড়িগুলো ধ্বংস করেছে, গৃহপালিত পশুদের খুন করেছে, তারপর কয়েকজনকে লুকোনো অবস্থা থেকে খুঁজে বের করে তাঁদের নিয়ে এসেছে, তাঁরা কোনওমতে একটা পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়লে তাঁদের সেখান থেকে টেনে বের করেছে, তারপর সেই দলের (তিনজন মহিলা, দুজন পুরুষ— তাঁরা এক মহিলার বাবা ও ভাই) মহিলাদের উলঙ্গ করা শুরু হয়েছে। এক মহিলার বাবা ও ভাই বাধা দিতে গেলে তাঁদের খুন করেছে। তারপর সেই তরুণীকে গণধর্ষণ করেছে। (সেই মহিলা অবশ্য এখন নিখোঁজ। হয়তো লজ্জায় সামনে আসবেন না ঠিক করেছেন। বা আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে যা জানা যায়নি।) অন্য মহিলাদের নগ্ন করে হাঁটানো হয়েছে, শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে। তাহলে পুলিশ তো সবটা জানে। তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে লোককে খুন করা হল, মহিলাদের ন্যাংটো করে ঘোরানো হল, নিগ্রহ করা হল, গণধর্ষণ করা হল, আর পুলিশ ঘটনার কথা জানতে পারল দু’মাস পরে, এ তো হতে পারে না। তাহলে ‘suo motu’ বা ‘স্বতঃপ্রবৃত্ত’ পদক্ষেপ নিতে এতটা দেরি হল কেন? একজন নিগৃহীতা মহিলা এবং তাঁর স্বামী ১৪ দিন হেঁটে (ঘুরপথে, কারণ তাঁরা ভয় পেয়েছিলেন চালু পথে যেতে) থানায় পৌঁছে এফআইআর করেন, ১৮ মে। যদি ধরে নিই ‘যতক্ষণ না নিগ্রহের যথাযথ অভিযোগ জমা পড়ছে ততক্ষণ পদক্ষেপ নেব না’ এরকম নীতিতে প্রশাসন চলছে (যে-নীতি কদর্য ও অমানবিক, কারণ যদি পুলিশ জানতে পারে ন’খানা গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে বা দশখানা লোককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে বা পাঁচটা বাচ্চাকে পুঁতে দেওয়া হয়েছে— কিন্তু কেউ অভিযোগ না জানান— তাহলে অন্যায়ের প্রতিকার হবে না? যে-কোনও ভয়াবহ অপরাধের বিচার করার আগে বগলে একটি এফআইআর গুঁজে নিয়ে যেতে হবে এই বাধ্যতা থাকা মানে তো নিজের ফাঁকিবাজির, দয়িত্বহীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা), তাহলেও তো ১৮ তারিখ থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় গ্রেফতার করতে নামা উচিত ছিল। তাহলে এতদিন কিচ্ছু করা হল না কেন? আর যেই না ভিডিও ভাইরাল হল ও সারাদেশ জুড়ে ছিছিক্কার পড়ে গেল, আর সর্বোচ্চ আদালত অবধি তীব্র বকুনি দিল, তক্ষুনি গ্রেফতার সম্ভব হয়ে গেল? তার মানে এদেশে কোনও অন্যায় তখনই অন্যায়, যখন তার ভিডিওটা লোকে দেখতে পাচ্ছে, কারণ তখন স্পষ্ট একটা সাক্ষ্য থাকছে যে ঘটনাটা ঘটেছে বটে, এবং অস্বীকার করার কোনও সম্ভাবনা থাকছে না? যখন সামাজিক মাধ্যম উত্তাল হয়ে উঠছে এবং সাধারণ মানুষের প্রকাণ্ড ঘৃণা আছড়ে পড়ছে? তখন নিন্দে এড়াতে তড়িঘড়ি সুশাসক সাজতে হচ্ছে? এই তবে সরকারের ন্যায়পরায়ণতার ফর্মা? ‘স্বতঃ’ই তার মানে বিচারের প্রবৃত্তি জাগছে না, জাগছে সহস্র ঠেলা খেয়ে ও দায়ে পড়ে?
এই ঠেলার নাম বাবাজি, কারণ সামাজিক মাধ্যমের নাম বাবাজিরও বাবা। সামাজিক মাধ্যম আর মোবাইলের নেশা নিয়ে প্রবল সমালোচনা চলে, তা সঙ্গতও, কারণ একটা গোটা দেশ ঘাড় হেঁট করে অষ্টপ্রহর মোবাইলে গুঁজে গেলে ব্যাপার সুবিধের নয় এবং জীবন কাকে বলে তা ফেসবুক থেকে পড়ে নেওয়ার অভ্যাসও এখনও আমাদের কাছে খুব স্বাগত নয়। কিন্তু মানতেই হবে, শাসকের পেল্লায় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই ‘ভাইরাল’ কাণ্ড। মোবাইল আসার আগে হাতে হাতে এমন ছোট ক্যামেরার চল ছিল না, সোশ্যাল মিডিয়া আসার আগে সেই ক্যামেরায় তোলা ছবি সব্বাই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখে ফেলার সম্ভাবনা ছিল না। তাই প্রযুক্তির বাঁকবদল এসে সাধারণ মানুষের হাতে একটা বিপুল অস্ত্র তুলে দিয়েছে। আগে অপরাধ দুর্ঘটনা অনাচার চেপে দেওয়া সহজ ছিল, আর যদি-বা কেউ খুব চিৎকার চেঁচামেচি করত, তা লিখিত ভাবে করত। ‘জালিয়ানওয়ালা বাগ-এ একটা ভয়ংকর নারকীয় হত্যাকাণ্ড হয়েছে’— এই বাক্যটা পড়ার যে অভিঘাত, সেই হত্যাকাণ্ডের কয়েক সেকেন্ডের একটা ক্লিপিং-এর অভিঘাতও তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি। কারণ চোখের সামনে বর্বর গুলি চালানো ও নিরস্ত্র মানুষের লুটিয়ে পড়া দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের পতনের একটা বড় কারণ ছিল সিঙ্গুরে পুলিশ-কর্তৃক বেদম প্রহারের কয়েকটা ছবি টিভিতে স্পষ্ট দেখা যাওয়া। মণিপুরের নিগ্রহের ঘটনাকে আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও, ‘ধুর এরকম কিছু ঘটেনি’ বা ‘যতটা বলছে ততটা ঘটেনি’ বলে তাৎপর্যহীনতার খোপে চেলে দেওয়া সহজ ছিল। কিন্তু এখন এই ধরনের যে-কোনও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের দ্বিগুণ স্পিডে, এবং সরকার চেষ্টা করেও ফুটেজ মুছে দিতে পারে না। কারও না কারও কাছে থেকেই যায়। তাই চোখের সামনে যখন দেখা যায় এই পৈশাচিক কাণ্ড ঘটেছে, মানুষ ফুঁসে ওঠে, এক সময়ে সরকারের পান্ডাকে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে হয়, কিংবা ভাব দেখাতে হয় যেন এইবার চেষ্টা চলছে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার। কিছুতেই বুক ফুলিয়ে ঘোরা যায় না, পুরোটাই ‘বিরোধীদের অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়ে। এইখানে আধুনিক প্রযুক্তির জয়। বহু নালিশ, যা হয়তো গৃহীতই হত না আগে, বা জানাই যেত না কোনখানে দায়ের করতে হবে, বা সাহসই হত না গিয়ে নালিশ করে ওঠার— এখন সামাজিক মাধ্যমে তা লিখে দেওয়া চলে বলে দেওয়া চলে। অনেক বেনোজলও ঢোকে, নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতে এই মঞ্চের গুরুত্বটা কমে যায় না। শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ফলে নতুন করে অপরাধীর বিচার করা হয়েছে— এ-উদাহরণও আছে, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানোর ফলে মণিপুরেরও অপরাধীদের কিছুটা বিচার হয়তো হবে। গাদা গাদা দোষ থাক, শুধু এই অন্যায়গুলোকে প্রত্যক্ষ ভাবে হাজির করে বা নালিশগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরে, যে-কোনও অত্যাচারিতের নালিশ জানাবার একটা বিকল্প আদালত তৈরি করে দিয়ে, সামাজিক মাধ্যম উদ্দাম উপকার করেছে।
আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয়: সব মানুষের মোবাইলে সব কিছু রেকর্ড করে রাখার প্রবণতা। রেস্তরাঁয় গেলে ছবি তুলছে, মধুচন্দ্রিমায় গেলে তুলছে, পার্কে চুপ করে বসে থাকলেও তুলছে। সিনারি তুলছে, দুর্গাপুজো তুলছে, মিছিল তুলছে, হত্যা তুলছে, ধর্ষণ তুলছে। এ-জিনিস উদ্ভট ও ব্যঙ্গযোগ্য, কিন্তু অন্যায়ের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা খুব কার্যকরী। কেউ খুন করল আর পাশের লোক তার ছবি তুলে রাখল, এবার খুনের সাক্ষ্যটা স্পষ্ট। ‘যা-ই অপরাধ করো না কেন, ভগবান সব দেখছেন’— এরকম একটা কথা খুব প্রচারিত। আগে সিনেমা বা নাটকে ধর্ষিতা হওয়ার আগে নারীরা বলতও, ‘একজন কিন্তু দেখছেন।’ অর্থাৎ তিনি আজ নয় কাল বিচার করবেন। এখন ভগবানের প্রক্সি দিয়ে, কোনও মোবাইল, কোনও সিসিটিভি সমস্তটা দেখছে। তা একটা ভয়াবহ নজরদারির সংস্কৃতি খুলে দিয়েছে, রাষ্ট্রের সর্বজাগ্রত নিরীক্ষণকামের দাপটে মানুষের ব্যক্তিগত পরিসর বলে কিচ্ছু আর রইল না— তা ঠিক, কিন্তু একইসঙ্গে অপরাধ করে পালানো এখন শক্ত। প্রেমিকার মৃতদেহ হাপিশ করতে গেলেও কোনও-না-কোনও সিসিটিভি-তে বস্তা হাতে দেখা যাবে, অটিস্টিক বালককে স্পিচ থেরাপি শেখাতে গিয়ে চড় ও ঘুষি মারলেও সিসিটিভি-তে তার ছবি উঠে যাবে। মজার জন্যই হয়তো নারী-নিগ্রহের কিংবা দলিতের মুখে প্রস্রাবের ছবি মোবাইলে হুবহু তুলে রাখা হয়, কিন্তু তা বেরিয়ে পড়লে ছড়িয়ে পড়লে দেশের নগ্ন চিত্রও সামনে আসে। এইদিক থেকে সর্বস্ব নথিবদ্ধ করে রাখার উৎকট স্বভাব, ন্যায়ের কাজে লেগে যাচ্ছে।
মেয়েদের শরীরের ওপর অত্যাচার করে ক্ষমতা জাহির করার, দখলের চিহ্ন খোদাইয়ের অভ্যাস পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার বহুকালের। সমাজতাত্ত্বিকরা নিশ্চয় মণিপুরের ঘটনার ক্ষেত্রে সেই দিকেও আঙুল তুলবেন। এখানে নারীদের অপমান করে ওই গ্রামকে শিক্ষা দেওয়া হল, বোঝানো হল, তোমাদের জায়গা আমাদের দখলে। সমীকরণটা হল: নারীকে চূড়ান্ত অত্যাচার করব, তাঁরা কাকুতিমিনতি করবেন, যন্ত্রণায় ছটফট করবেন, আর সেই কুকাজের মাধ্যমে আমি একটা সম্প্রদায়কে শাস্তি দেব, একটা অঞ্চলকে শাস্তি দেব। যেভাবে জমিতে পতাকা পোঁতা হয়, সেভাবে নারীতে পুরুষের ধর্ষক লিঙ্গ প্রোথিত হয়। এই প্রবণতা মুছতে গেলে যে শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার চাই, তা এদেশে আশা করা বাতুলতা, বোধহয় গোটা পৃথিবীতেই এই অভ্যাস যে-কোনও যুদ্ধ দাঙ্গা হাঙ্গামায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রবণতা রগড়ে ধুতে হয়তো অন্য স্তরের পরিকল্পনা, কর্মশালা চাই, শিল্পে বহু বৈপ্লবিক কাজ চাই, আশ্চর্য আন্দোলন চাই। এদেশে লোকে অন্যায় হলে শুধু এ-ওর ঘাড়ে দোষ চাপানোর খেলা খ্যালে, সংকটের মূলে গিয়ে মনোভঙ্গি উন্মোচনের প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে। দায়টা বিজেপির না তৃণমূলের, সিপিএমের না কংগ্রেসের— এই শুধু প্রশ্ন, আর কাদা ছোড়াটা তার উত্তর। ক্ষমতাবানদের বিবেক-জাগরণ যেখানে ভিডিও-সাপেক্ষ, সেখানে সমস্যার গভীরে যাওয়ার ও খতিয়ে ভাবার অনুশীলনটার প্রত্যাশা অবাস্তব। তবু প্রশ্নগুলো ভাইরাল হলে, অন্তত অংশ-ভাইরাল হলেও, হয়তো কোনওদিন ভাবাভাবির অভ্যাস গজাবে, একটা বর্বর দেশ কিছুটা সভ্যতার দিকে হেলবে, যেমন এখন ধিক্কারের বন্যায় কিঞ্চিৎ অপরাধবোধের দিকে টলেছে।