ভিজে রকেট
একেবারে আক্ষরিক সর্বহারা বলা যায়। সঙ্গে একটা ব্যাগ অবধি নেই, মুখে আঘাতের চিহ্ন, আচমকা বহু বহু বছর পরে বউয়ের দরজায় কড়া নাড়ছে। বউ আর শাশুড়ি কেউই তাকে ঢুকতে দিতেই চায় না, চেঁচায়: হঠাৎ তুমি এখানে কেন। লোকটা হাতে-পায়ে ধরে কদিনের জন্য থাকতে চায়, এর মধ্যেই সে ঠিক একটা কাজ দেখে নেবে, তাছাড়া বাড়িতে একজন পুরুষমানুষেরও তো দরকার, বাইরের বাগানটা তো আগাছায় অ্যাক্কেবারে ছেয়ে গেছে এহেহে। কাজ খুঁজতে গিয়ে অবশ্য সে আতান্তরে, ১৭ বছর কোনও কাজ করেনি কেন, তার উত্তরে স্বল্প ইয়ে-মানে-হেঁহে বাগিয়ে সুবিধে হল না দেখে সত্যিটাই বলে, সে অ্যাদ্দিন পর্নোগ্রাফিক ছবিতে অভিনয় করত। তার নাম সার্চ করে দেখতে পারো গুগলে, অবশ্য নামের পর এক্সএক্সএক্স লিখতে হবে। এই শুনে টেক্সাসে কেউই তাকে কাজ দিতে রাজি হয় না, অগত্যা আগে সে চুপিচুপি ড্রাগ বেচার যে কাজ করত, তাতেই ফের জুতে যায়। পাশের বাড়ির ছেলেটার সঙ্গেও আলাপ হয়, সেও কিস্যু করে না সারাদিন., একে নিয়ে গাড়ি করে বেড়ায়, আর এর পর্নোগ্রাফির গল্প, বহু মেয়েকে চুটিয়ে সঙ্গমের গল্প তারিয়ে তারিয়ে শোনে। ছবিটা আসলে তাদের নিয়ে, যারা কিচ্ছু করে না, কোনওদিন কিচ্ছু করতে পারবে সে আশাও যাদের নেই, যারা সারাদিন বসে টিভি দ্যাখে আর ড্রাগ পেলে মজাসে ফোঁকে, আর এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, কখনও দোকানে, কখনও স্ট্রিপ ক্লাবে। সঁ বেকার নামে এই পরিচালক সমাজের ধারে পড়ে থাকা মানুষষদের নিয়ে ছবি করতে ভালবাসেন, ‘রেড রকেট’ ছবি (২০২১, চিত্রনাট্য সঁ বেকার ও ক্রিস বেরগোশ) এদেরই নিয়ে, তবে এটাকে তিনি বেঁধেছেন কমেডির চালে, এখানে নায়কের নিরন্তর চালবাজি আর দেখানেপনা তাকে মাইডিয়ার এবং হাস্যকর করে তোলে।
নায়কের চরিত্রটির নাম মাইকি সেবার, সে একটু ভেবেচিন্তে একদিন তার বউকে বলে একটু সেক্স হবে নাকি, এবং টুক করে একটা ওষুধ খেয়ে নিয়ে চমৎকার যৌনতা করে, আর তারপর একদিন ঝগড়াঝাঁটির পর একমাসের বাড়িভাড়া পুরোটাই সে দিয়ে দেয়, ফল বউয়ের বিছানায় তার স্থান হয় (অ্যাদ্দিন শুচ্ছিল সোফায়)। এদিকে মাইকি প্রেমে পড়েছে একটি ডোনাট-দোকানের কর্মী ১৭ বছর বয়সি মেয়ের, তাকে সে বলেছে অসুস্থ মায়ের সেবা করার জন্যে এখানে চলে এসেছে, এমনিতে হলিউডে তার রমরমা কাজ। মেয়েটি যখন তাকে বাড়িতে নামিয়ে দিতে চায় তার গাড়ি করে, মাইকি সম্পন্ন পাড়ায় একটা বড়লোক বাড়ির সামনে নামে, তারপর মেয়েটি চলে যেতে সেখান থেকে কেটে পড়ে। মেয়েটিরই সাহায্যে ওই দোকানে আসা নির্মাণকর্মীদের কাছে ড্রাগ বেচে তার ভালই রোজগার হয়। এদিকে পাশের বাড়ির ছেলে লন-এর সঙ্গে একদিন মল-এ বেড়াতে গিয়ে যখন সে দ্যাখে লন একটা মিলিটারি উর্দি পরে নিজেকে প্রাক্তন যোদ্ধা বলে পরিচয় দিচ্ছে আর জিনিসপত্তর কেনার ক্ষেত্রে সুবিধে নেওয়ার চেষ্টা করছে, ফেরার পথে মাইকি তাকে বেদম গাল দেয়। ছিছি, এ ধরনের ভণ্ডামি করলে সে কোনো সম্পর্কই রাখবে না লন-এর সঙ্গে। অবশ্য না রেখে উপায় নেই, কারণ লন-ই তার একমাত্র বন্ধু, তাকেই সে নতুন বান্ধবীর প্রেমের এবং অবশ্যই যৌনতার গল্প শোনায়। বান্ধবী বুদ্ধিমান, সে বুঝে ফেলেছে মাইকি পর্নোগ্রাফিক ছবি করত, মাইকি তাতে প্রথমটা দমে গেলেও, পরে মেয়েটিকে বারেবারে উসকে দেয় এই বলে যে তার মধ্যে পর্নো-নায়িকা হওয়ার দুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে, মেয়েটি রাজি হলেই সে কেরিয়ার গড়তে সাহায্য করবে এবং অচিরে মেয়েটি তারকা হবে। আর লন-কে বলে, কীভাবে মেয়েটি তারকা হয়ে গেলে তার প্রযোজনা-সংস্থা (যা সে অচিরে খুলবে) লাভে লাল হয়ে যাবে।
গল্পটা অনেক অপদার্থ আর তাদের স্বপ্নের, নিরুপায় এবং তাদের বিভিন্ন অবলম্বনের। মাইকি তার প্রকাণ্ড যৌন ক্ষমতার বড়াই করে বেড়ায়, কিন্তু তাকে সঙ্গমের আগে ট্যাবলেট গিলতে হয়। সে বলে সে তার ছবিগুলোর নায়ক ছিল কিন্তু নতুন বান্ধবী তার ছবিগুলো দেখে ফেলেছে এবং বলে দৃশ্যগুলো তো নায়িকারই, তুমি সেখানে বহু পুরুষের মধ্যে একজন, তাহলে তোমার কেরামতি কোথায়। বড়লোকের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামার সরল ছলনা অবধি ঘুচে যায়, যখন বাড়ি থেকে রাইফেল হাতে এক মহিলা বেরিয়ে আসে আর বলে পরেরবার দেখলে গুলি চালাবে। মাইকির বউয়ের অন্য একটা সম্পর্ক থেকে একটা ছেলে আছে, তাকে তার বাবা রেখে দিয়েছে, সেই সন্তানের হেফাজতের জন্য সে লড়ছে, এদিকে মাইকি সে ব্যাপারে তাকে একটবার জিজ্ঞেস অবধি করে না, দুজনে মিলে থিতু দাম্পত্যের কথা আদালতে বলে ছেলেটিকে বাড়ি নিয়ে আসার বন্দোবস্ত তো দূরের কথা। তবু বউ একবার প্রস্তাবটা দেয়, মাইকি তাকে যা-তা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যখন নতুন বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটাবার জন্যে মাইকি দিনদুয়েক বাড়ি ফেরে না, বউ রেগে দেওয়ালে ছুড়ে জিনিসপত্র ভাঙে, মাইকি তাকে ধরে ঘরের কোনায় ঠুসে দেয় এবং বলে একেবারে চুপ করে থাকতে, কারণ তার এখন টাকা আছে এবং সে বাড়ির দায়িত্ব দিচ্ছে, তখন শাশুড়ি মেয়েকে অপমানিত হতে দেখেও দরজা বন্ধ করে দেয়, রোজগেরে পুরুষমানুষকে কী আর বলা চলে। এইসবের মধ্যে ট্রাম্পের ক্যাম্পেন চলতে থাকে, তাঁর দলের স্লোগান (আমেরিকাকে পুনর্বার মহৎ বানাবার) উঁচুতে লেখা থাকে এবং তাঁর বক্তৃতা টিভির পর্দায় রনরন করে।
এই ধরনের ছবির সবচেয়ে বড় আধুনিক সম্পদ হল একেবারে নিরাভরণ অভিনয়, এবং ক্যামেরা ও আলো ও ধ্বনির কাজের স্বেচ্ছায় নিজেদের ঢেকে ফেলা। মনে হয় যেন একটা তথ্যচিত্র দেখছি। কোনও অন্দরসজ্জা, শটের কম্পোজিশনের কোনও পরিকল্পনা, কোনও ধ্বনি ও আবহের কারসাজি যেন নেই। যেন কোনও পরিচালক নেই, এ শুধু বাস্তবের কয়েকটা টুকরো আমাদের সামনে কেউ ফেলে দিয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বহু ছবিই এখন এভাবে হয়, পুরোটাই হাতে-ধরা ক্যামেরায়, ঝাঁকুনি হচ্ছে তা হোকগে এই মনোভাবে, এবং ফ্রেমে ঠিক কী কী দেখা যাবে তা নিয়ে শুচিবায়ু ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে। শুটিং সেটে না হয়ে হয় সত্যিকারের বাড়িতে বা দোকানে। আবহসংগীত প্রায় থাকে না বললেই চলে। দেওয়ালে বিস্তর ছ্যাৎলা। নায়ক-নায়িকা প্যান্তাখ্যাচাং জামাকাপড় পরে, তাদের বেডকভার কোঁচকানো, গাড়ি নোংরা, এদের সংলাপ হয় একদম অ-সাজানো, যেন অ-রচিত। এবং এই আটপৌরে-পনাই ছবিগুলোকে একেবারে সত্যের চৌকাঠে এনে দেয়। এই পরিচালক আইফোনেও ছবি তুলেছেন, সেখানে রূপান্তরকামী যৌনকর্মীরা রাস্তার মোড়ে দাঁড়ায়, সিগনালে গাড়ি থামলে মক্কেল ধরে ও গাড়ির মধ্যে ঢুকে তাদের তৃপ্ত করে। ছবির অনেকটাই রাস্তায় ও দিনের আলোয় তোলা, তাই ফোনে তোলার সুবিধেও হয়েছে। কেরিয়ার জুড়েই, এই পরিচালকের মধ্যে বেপরোয়াপোনাটা বোনা এবং যে লোকটার বাড়ি নেই, যে লোকটাকে জোচ্চুরি করে খেতে হয়, যে ছ’বছরের মেয়েটাকে দেখার কেউ নেই, যে বেশ্যাকে সারা সমাজ দুচ্ছাই করছে, এদের সবার কথা বলার একটা গরজ আছে। সেই গরজের তীব্রতার সঙ্গে, এই অলঙ্কারহীনতা মানিয়ে যায়। বেশ করব ফোনেই সিনেমা তুলব, তোরা দামি ক্যামেরা কায়দা করে বসিয়ে সাজানো ছবি করগে যা, এইটা বলার রোয়াব আছে। আর তার পিছনে একটা বড় কারণ হল, এই লোকগুলোর কথা এই মুহূর্তেই বলে ফেলতে হবে, কারণ তা জরুরি— এই তাগিদ থেকে জরির কাজ প্রত্যাখ্যানের একটা সাহসও জন্মায়।
‘রেড রকেট’-এর অশ্লীল মানে হল কুকুরের উচ্ছ্রিত যৌনাঙ্গ। এক পর্নোগ্রাফি-তারকার জীবন নিয়ে ছবি বলে এই নাম। আর তার জীবনের রকেটটি কোনওদিনই উড়ান দেয় না, এই হল ছবির কাহিনি। গেড়া থেকেই ছবিতে কমেডির ধাঁচ দেখলেও আমরা বুঝতেই পেরেছিলাম, মাইকির কোনও পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হবে না, এবং যেমন সে এই বাড়িতে ঢুকেছিল অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে, তেমনই অচ্ছুতের মতো তাকে ছুড়ে ফেলা হবে। তা হয়ও। কিন্তু এর মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটে। মাইকিরই তাড়াহুড়োয় বিরাট গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা লন যখন গ্রেফতার হয় ও সারা দেশ জুড়ে তার নামে নিন্দে শুরু হয়, সে মাইকিকে বিপদে না ফেলে একা নিজের গাড়ে পুরো দায় নিয়ে নেয়, তার সঙ্গে যে মাইকি গাড়িতে ছিল সেটা উল্লেখ অবধি করে না। যে লন সারাজীবন একজন সর্বৈব হেরো, জিনিস সস্তায় পাওযার জন্যে যে মিথ্যে উর্দি গায়ে চাপায়, যার প্রেমের দৌড় বন্ধুর অ্যাডভেঞ্চার শুনে বাহবা আওড়ানো অবধি, সে বন্ধুকে ভালবেসে এবং তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে চরম দণ্ড অবধি নিতে প্রস্তুত থাকে। মাইকি অবশ্য বন্ধুর চরিত্রের এই মহত্ত্ব বোঝে না, সে পরিত্রাণ পাওয়ার আনন্দে আকাশের দিকে হাতজোড় করে ভগবানকে ধন্যবাদ দিতে ও নাচতে ব্যস্ত। লন-এর বাবার বিষণ্ণ মুখ দেখে সে নাচের মাঝখানে থমকে যায়। তারপরেই একটি গোছা ফুল নিয়ে হাঁটু গেড়ে তার প্রেমিকাকে নিবেদনের দৃশ্যে কৌতুক তৈরি করা হয় অভিনব উপায়ে। পাশ দিয়ে একটা ট্রেন যায়। খুব শব্দ করে আর হর্ন দিতে দিতে। ফলে মাইকি কী বলচে, ভাল করে শোনা যায় না। বান্ধবীর উত্তরও। তাদের দুবার দুবার করে চেঁচিয়ে সব কথা বলতে হয়। বান্ধবী এক সময় জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আমায় প্রোপোজ করছ? মাইকি বলে, না, তুমি আমার সঙ্গে কাল লস অ্যাঞ্জেলেস চলো, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে। অতি ফিসফিসিয়ে বলার যোগ্য সূক্ষ্ম ও কোমল একটা প্রায়-বিবাহপ্রস্তাহকে যে শুধু রেললাইনের নৈকট্যের ফলে প্রহসনে পরিণত করা যায়, এ এক দুরন্ত ভাবনা।
এ ধরনের ছবি সাধারণত ঘটনার ঘনঘটার উপর নির্ভর করে না, বরং মানুষের জীবনের ঘটনাহীনতাকেই বারবার উপস্থাপিত করে। এই ছবিতে কিন্তু বহু ঘটনা আছে। এবং সাসপেন্স। মাইকির নতুন প্রেম আবিষ্কৃত হবে কি না, বা মাইকির মিথ্যাচার নতুন প্রেমিকার দ্বারা আবিষ্কৃত হবে কি না, গাড়ি দুর্ঘটনার দায় মাইকির ঘাড়ে পড়বে কি না, এবং শেষ অবধি মাইকির অ্যাদ্দিনের উপার্জিত টাকা যখন মাইকির বউয়ের সাহায্যে ড্রাগ-পান্ডারা বাজেয়াপ্ত করে নেয়, তখন সে আগের মতোই কপর্দকশূন্য হযে টেক্সাস ও সিনেমাটা থেকে প্রস্থান করবে কি না। এমনকি সেই টাকা উদ্ধার করতে মাইকি রাত্রের টেক্সাসের রাস্তায় সম্পূর্ণ নগ্ন হযে দৌড়ে ড্রাগ-ব্যবসার মূল অধিনায়িকার বাড়িতে অবধি পৌঁছয় এবং করাঘাত করে। তাই রসবোধ এবং উত্তেজনায় জমজমাট ছবি, আর তার সমাজ-দৃষ্টিও কম নয়। বাস্তব-লেপা আঙ্গিক আর হুবহু জীবন-কাটিং অভিনয়ে ছবি জ্বলজ্বল করতে থাকে।