সবচেয়ে প্রিয় ছিল 46A। নতুন পাড়ায় অনোখা রাস্তায় অচেনা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে যেই না ভাবছি চিরকালীন আশ্রয় এসপ্ল্যানেডে নিয়ে যাবে কে, যাতে সেঁধিয়ে যেতে পারি হল-এর অন্ধকার আর হলিউডের আলোয়, তখুনি এসে দাঁড়াল 46A, কন্ডাক্টর হাঁকল ‘ধর্মতলা’, আর আমি পেয়ে গেলাম নয়া বন্ধু। পরে দেখি, 46-ও ওই রুট দিয়েই যায়, কিন্তু যেহেতু প্রথম এসেছিল এবং মাথায় একটা বাড়তি ‘A’ লাগিয়ে রেখেছিল, আগের নম্বরটাই জয়ী (সিনেমার পোস্টারে তখন ‘A’ দেখলেই মন শিউরে ওঠে বলে?), তবে যেদিন সাংঘাতিক দেরি করে বেরিয়েছি, L3C-র জন্য প্রাণপণ প্রার্থনা। সে যেত হাওয়ার চেয়েও দ্রুত, অমন একটি ভরপুর মেশিন-টাট্টু আর আবিষ্কৃত হয়নি। কাঁকুড়গাছি থেকে ধর্মতলা ২০ মিনিটে উড়িয়ে একেবারে নিউ এম্পায়ারের ধারেকাছে ঠোঁটে করে নামিয়ে দিত। এ-মিরাকল প্রতিবার, অব্যর্থ। আর S-14 বা S-16 ছিল রাজকীয় বাস। রং আলাদা, বডিও মজবুত। উঠলে নিজেকে বেশ সম্পন্ন মনে হত, অবশ্য বহুত ঘুরিয়ে নিয়ে যেত মাঝেমধ্যে। তা বড়লোকদের একটু নির্ভরশীলকে কষ্ট দেওয়ার অভ্যাস থাকে। মিনিবাসে উঠতে চাইতাম না। প্রথমত জায়গা কম, দ্বিতীয়ত পয়সা বেশি, এবং তৃতীয়ত নম্বর নেই। বাস হবি আর নম্বর থাকবে না, সরাসরি কোথা হতে কোথা লেখা থাকবে, এ কী এটিকেট-হীন রোয়াব? এক-একটা বাসের নম্বরের বাহার দ্যাখ, উত্তর কলকাতার গলতার ঠিকানার ন্যায়। 12C/2, 41/1A, 12 AD, 215A/1, S101/1, DN-2/1। অবশ্য এসব লীলায় মজে L-9’এর কথা ভুললে চলবে না। ছোটবেলার নায়ক। প্রাগৈতিহাসিক স্নেহময় প্রাণী। নড়বড়ে, জবুথবু, কিন্তু বিশালকায়, প্রবল ভরসাময়, আর কাছিম-মুন্ডুটা নিয়ে গদাইলস্করি চালে দিব্যি মজাদার। দোতলায় উঠে গেলে তো দেখতে হবে না। সিংহাসনে বসে সারা শহরটাকে ওপর থেকে অবলোকন করতে করতে যাও, টপ শটে সব কিছুকেই স্পষ্ট ও সমঝ-যোগ্য মনে হয়, এবং বিরাট লম্বা সফরের পর পৌঁছে যাও সিধে মামারবাড়ি। যাচ্ছ পুজোর সময়ে, অতএব দেড়া মজা। পথে এন্তার ঠাকুর দেখা এবং গুনতে গুনতে যাওয়া, তখনও প্রতিমার মুখ ঢেকে প্যান্ডাল করার অসভ্যতা চালু হয়নি। আর মামারবাড়ি থেকে যখন ফিরছি, বিজয়া দশমীর মনখারাপ মেখে? ঢুলতে থাকো অনন্ত দুলন্তি বিছানায়, L-9 তার প্রপিতামহের কোল নিয়ে তৈরি। এছাড়া হস্টেল থেকে আসার পর 212 দেখলে ধড়ে প্রাণ আসত। চূড়ান্ত গাঁইয়া ছিলাম, কিস্যু চিনতাম না, শুধু ওই নম্বরটা দেখলে বুঝতাম, এটা কলেজ থেকে বাড়ি নিয়ে যাবে সিধে। বহুকাল পরে, সল্টলেকে রিহার্সাল থেকে বেরিয়ে হনহনিয়ে স্টপে এসে 215A দেখে অমনই নিশ্চিন্তি, এ নিয়ে যাবে মেট্রো স্টেশনে, সে নিয়ে যাবে বাড়ি। কিছু বাসের নম্বর দেখলেই মেজাজ খিঁচড়ে যেত। 1A। এ তো আত্মম্ভরিতার একেবারে চুড়োন্ত! নিজেকে এক নম্বর, তার ওপর এ-গ্রেড দিয়ে বসে আছে! এবং 2B। কতদিন আগে কে দূর থেকে এ-বাসের দর্শন পেয়ে ‘টুবি অর নট টুবি’ অমোঘ pun করে দিয়ে চলে গেছে, আমি কেন করতে পারিনি মর্মে সে আঘাত বুকে এসে বাজে। এবং 37। কেন, ঠিক বলতে পারব না। বোধহয় দরকারের সময় কক্ষনও পাইনি। কিংবা অঙ্কে অবিকল ৩৭ পেয়েই ফেল করেছিলাম, ঠিক মনে নেই। আর 80-র তো বলিহারি। মাথায় ওই নম্বর সেঁটেছে, আর পিছনেও লিখেছে ‘৮০ বন্ধু আবার দেখা হবে’। ইদানীং এসি দিয়ে শুরু হওয়া নম্বরওলা বাসগুলোকে দেখে ধাঁ। AC-1, AC-2! বাসে আবার এসি, তা এমন নগ্ন আস্ফালন করে বলছে! এমন একটা শহরে, যেখানে অন্যান্য বাসে (এবং রৌদ্রপোড়া রাস্তায়) সবাই দরদরিয়ে গলদঘর্ম হতে হতে নরকযন্ত্রণা পুইয়ে অফিস যাচ্ছে! বুভুক্ষু ভিখিরির দঙ্গলের সামনে দিয়ে বিরিয়ানির রাশীকৃত প্যাকেট নিয়ে যাওয়ার মতো সেমি-নিষ্ঠুর।অন্য কারণেও নম্বর অপছন্দ হয়েছে। প্রথম প্রেমে যখন পড়লাম, মেয়েটি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরত 201-এ। একদিন বহুক্ষণ ধরে ডায়লগ সাজিয়ে, পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, 201 নম্বরটাকে পৃথিবী থেকে মুছে দেব। এই বাসটাকে ব্যান করে দেব। সে অবাক, কেন? বললাম, তোকে নিয়ে চলে যায়। চিড়ে ভিজল বলে মনে হল না। কাব্যিতে তার খুব একটা আকর্ষণ ছিল না। পরের প্রেমে যখন পড়লাম, মেয়েটির বাড়ি যেতাম 47/1-এ চড়ে। ৪৭ আমাদের কাছে স্বাধীনতা, কিন্তু তার ভাই-সংখ্যায় ভেসে দিব্যি স্নিগ্ধ পরাধীনতার দিকে ধেয়ে যেতাম, ঝর্না যেমন বাহিরে ধায়, খুব ভাল করে জানে সে কাহারে চায়। ফিরতামও রাত করে ওতেই, কোনায় বসে, ঘোরের মধ্যে ক্রমাগত মিটিমিটি (মিঠিমিঠি) হাসতে হাসতে। এখনও ওই বাসটাকে দেখলে মাথায় চাপড়ে আদর করতে ইচ্ছে হয়। কম ঘটকালি করেছে?