দরদ ও চেষ্টা
দুই বন্ধু, ১৩ বছর বয়স, একসঙ্গে স্কুলে যায় এবং অনেক সময়েই একজনের বাড়িতেই দুজনে খায়-দায়-শোয়, একজনের ঘুম না এলে অন্যজন ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে। মিডল স্কুল সবে শুরু হয়েছে, স্কুলে গিয়ে তারা পাশাপাশি বসে, কখনও এ-ওর কাঁধে মাথা রাখে, পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসে। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে তাদের সমকামী বলে খ্যাপাতে শুরু করে। কয়েকটি মেয়ে এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, এই, তোদের মধ্যে কি সম্পর্ক আছে? একটি ছেলে টিফিনের সময়ে সবার সামনে এদের একজনকে বলে, কী রে, মুখটা গোমড়া কেন, তোর কি পিরিয়ড চলছে? এক বন্ধু এই শুনে বন্ধুর বাড়ি রাত কাটাবার সময়ও এবার আলাদা শুতে চায়, আইস-হকি খেলায় নাম লেখায়, কারণ সে সবার সঙ্গে মিশতে চায়, কোণঠাসা বা পরিত্যক্ত বা ব্যঙ্গ-পাত্র হয়ে থাকতে চায় না। সে তার এতদিনকার প্রাণের বন্ধুকে তেমন আর পাত্তা দেয় না, বরং একজন সর্দার টাইপ ছেলের (খ্যাপনদারদের একজন) সঙ্গে বেশি মেশে, আইস-হকির ড্রেসিংরুমে যেসব আলোচনা হয় (কে বড় ফুটবল খেলোয়াড়) তাতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে, ‘পুরুষালি’ হাসিঠাট্টায় মন দেয়, যেমন সবাই জার্সি খুলে একজনেকে সটাসট পেটাবার চেষ্টা। রোজ একসঙ্গে ওরা সাইকেলে স্কুলে আসত, কিন্তু এ আগেই চলে আসে। অন্য বন্ধুটি যখন জিজ্ঞেস করে, কেন আগে চলে এলি, এ বলে, আরে আগে উঠে পড়েছিলাম, চলে এসেছি, রাগ করছিস কেন। অন্য বন্ধুটি কেঁদে ফ্যালে, রাগে দুঃখে, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর একদিন অন্য বন্ধুটি আত্মহত্যা করে। এই ছেলেটি তীব্র অপরাধবোধে ভোগে, কাউকে কিছুই বলতে পারে না। এক সময়ে আর না পেরে বন্ধুর মাকে বলে, আমার জন্যেই ও এটা করেছে, আমিই দোষী। মা প্রথমে কেঁদে ফেলে বলেন গাড়ি থেকে নেমে যাও, কিন্তু পরে তাকে জড়িয়ে ধরেন। মোটামুটি এই হচ্ছে গল্প। তোলা হয়েছে খুব ঘনিষ্ঠ ও চোখ-জুড়োনো ক্যামেরা-কাজে, আর ধীর, চুপচাপ ও দরদি ছবিটি দর্শককে ধরে রাখে অনেকক্ষণ। পুরস্কার পাওয়া ও উচ্চপ্রশংসিত ছবি ‘ক্লোজ’ (পরিচালনা লুকাস ধোন্ত, ২০২২) দেখতে ভীষণ ভাল লাগে, কিন্তু শেষ অবধি তার বিরাট একটা আবেদন নেই। মানে, সময়ে সময়ে গলা ধরে আসে ঠিকই, কিন্তু ছবি শেষ হওয়ার পর বহুদিন ধরে বারবার দৃশ্যাংশ মনে পড়ে না।
লক্ষণীয় দুটো ব্যাপার। এক হল, এই দুই নায়ক সমকামী কি না, এরা নিজেরা কেউই জানে না। হয়তো এদের একজন সমকামী, হয়তো দুজনেই। আবার হয়তো কেউই না। তাই এটা সমকামী প্রেমের ছবি, না নয়, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কিন্তু প্রেমের ছবি, নিবিড় সখ্যের ছবি, তা বলা যাবে। আর, এই ছবি আসলে ‘সমাজ কেমন করে প্রেমকে খুন করে’ বিষয়ক। একজন সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হযে উঠতে চাইল বলেই প্রিয়তমকে প্রত্যাখ্যান করল। তার প্রতি ভালবাসা কমে গেছে বলে নয়, তাকে কোনও কারণে অন্যরকম মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করেছে বলে নয়, এমনকী নতুন একজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে বলেও নয়। কিন্তু ১৩ বছর বয়সের একজন ছেলে স্বাভাবিক ভাবেই সকলের কাছে গৃহীত হতে চায়, এবং সেইজন্য চমৎকার এক ‘পুরুষ’ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়। সে ফুটবল খেলতে একেবারেই পারে না, কিন্তু ক্রমে খুব উৎসাহ নিয়ে খেলতে শুরু করে। আইস-হকি তার ভাল লাগে না, পড়েও যায় বারবার, কিন্তু তা খেলায় তার প্রবল মনোযোগ ও চেষ্টা। এই যে সমাজ ‘উচিত’, ‘স্বাভাবিক’ ও ‘প্রশংসার্হ’র নিরন্তর নৃশংস ফাঁদ পেতে রেখেছে, তাতে এই ছেলেটি আটকে যায়, এবং প্রচলিত খোপে ঢোকার তাড়ায়, তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও আনন্দময় সম্পর্কটিকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। অন্য বন্ধুটি, একটু শিল্পী গোছের, বাজনা বাজায়, সে স্কুলের এই খ্যাপানিতে খুব একটা টলে না। কিন্তু বন্ধুর বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারে না। নিজের প্রাণটি নিয়ে নেয়, তার উতরোল অভিমানের স্বাক্ষর হিসেবে।
১৩ বছরের ছেলের সহপাঠীরা যে বিশেষ হিংস্র তা নয়, কিন্তু তারা তাদের বয়সোচিত রকমের নিষ্ঠুর, কখনও ছেলেটিকে মেয়ে বলে খ্যাপাচ্ছে, কখনও টিফিনের সময়ে খেলতে খেলতে ইচ্ছে করে ধাক্কা মারছে। কারণ ছেলেকে তো আর মেয়ে হতে দেওয়া যায় না, অন্তত ছেলেটি মেয়েলি হলে তাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া যায় না। যে-বন্ধুটি দূরে সরে গেল এবং তারপরে অপরাধবোধে পুড়ল, সে বন্ধুর মা’র কাছে তাঁর ছেলের মতোই ছিল, তিনি যখন সন্তানের মৃত্যুর কিছুদিন পরে আইস-হকি মাঠে ওর সঙ্গে কথা বলতে আসেন, সে প্রথমটা চোখের দিকে তাকাতেই পারছিল না। পরে মা যখন কথা বলেন, বোঝা যায়, তিনি যেন এই ছেলেটিকে কিছুটা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। ছেলেটি তাই কিছু বলে উঠতে পারে না। ওদের পরিবারের সঙ্গে খেতে খেতে, এই ছেলেটির দাদার কাছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুনতে শুনতে, মৃত বন্ধুর বাবাটি কেঁদে ফ্যালেন (কারণ তাঁর সন্তানের তো আর কোনওদিন ভবিষ্যৎ রচিত হবে না)। এ বোঝে কী অপরিসীম বেদনা নিয়ে এঁরা বাঁচছেন। কিন্তু শেষে বন্ধুর মা’র কাছে দোষ স্বীকার করতে পেরে ছেলেটির বুক থেকে একটা ভার নেমে যায়। এই শেষ ব্যাপারগুলো গল্পের পক্ষে জরুরি, কিন্তু পেলব কাব্যিক কান্না-বর্ডার-দেওয়া ঘটনা প্রচুর ছবিতে প্রচুর হয়েছে, আমাদের তার চেয়ে বেশি মনে থাকে এ-ছবিতে আসল ভিলেন হল সমাজ এবং তার ভয়বাহ ছাঁচে ফেলার মেশিন: যা প্রায় মানুষের জন্মানোর মুহূর্ত থেকেই তাকে ‘অন্যরকম’কে খ্যাপাতে শেখায় এবং যে খ্যাপানি খাচ্ছে তাকে বাঁচার জন্য অন্যত্ব ছাড়তে ও ছাঁচের লাইনে দৌড়ে দাঁড়াতে প্রণোদিত করে।
ক্রিস্তফ অনর-এর ছবি ‘উইন্টার বয়’ (২০২২) এক সমকামী ১৭ বছরের কিশোরকে নিয়ে, যার বাবা মারা যান অ্যাক্সিডেন্টে, কিন্তু সে সন্দেহ করে তা সুইসাইডও হতে পারে, কারণ বাবা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি সুখী নন। তার মা আর তার দাদা এবং সে মিলে এই প্রবল দুঃখের সঙ্গে লড়তে চেষ্টা করে। এবং সে ঠিক করে তার মনকে ভাববার অবকাশ না দিয়ে, এবার তার স্বভাবের বিপরীত কাজকর্মই করবে। দাদার সঙ্গে সে কদিনের জন্যে প্যারিস আসে, আসার আগে তার প্রায়-প্রেমিকের সঙ্গে সঙ্গম সেরে আসে, কিন্তু ঠিক করে, সে এবার থেকে আর প্রেম বা দায়বদ্ধ সম্পর্কে ঢুকবে না, একা হবে। গোড়ার দিকে বেশ চোখা সংলাপ দিয়ে শুরু হয়, সংলাপ মানে স্বগতোক্তি, বা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শককে বলা কথা, ‘আমার নাম লুকা, আর আমার জীবন হয়ে উঠেছে একটা বন্য জন্তু, যার দিকে আমি এগিয়ে গেলে সে আমাকে কামড়ে দেয়। আমার সব চিন্তাগুলো আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়, আমি কিছুই আর চিনতে পারি না।’ কিংবা যখন বাবা মারা গেছে সদ্য জেনে সে বাড়িভর্তি আত্মীয়কে যথাবিধি হাসি ও ‘কেমন আছ’ দিয়ে স্বাগত জানায়, এমনকী ঠাকুর্দা ও ঠাম্মাকে, এবং নিজের মনেই বলে এঁদের কী করে এই মুহূর্তে সে ‘কেমন আছ’ জিজ্ঞেস করতে পারল— দর্শকের মনে হয় খুব তীব্র আত্মসত্যের উন্মোচন এ-ছবিতে ঘটবে। কিন্তু সে-চেষ্টা থাকলেও, কখনও দানা বাঁধে না। দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর ছবিতে সামান্য রাজনৈতিক আলোচনাও হয়, আবার ছেলেটি যখন প্যারিস গিয়ে চার্চে ঢুকে পাদ্রিকে জিজ্ঞেস করে রেজারেকশন কাকে বলে, তিনি বলেন ওর মানে হয়তো বেঁচে থাকার সাহস সংগ্রহ। ছেলেটি হট করে, কোনও ভালবাসা ছাড়া, স্রেফ যৌনতার জন্য এক কিশোরের সঙ্গে শোয় (কিন্তু সেই কিশোরকে বলে, আর দেখা করতে চায় না, কারণ সে তো যাবে তার একাকিত্বের দিকে ও কোমল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে) আবার দাদার রুমমেট কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের (সেও সমকামী) প্রতিও খুব আকৃষ্ট হয়। মোটামুটি ভাবে দুঃখ আর সমকাম জুড়ে যে ক’টা চলতি ছাঁচ আছে, মানে, সমকামী আকর্ষণ, অন্যকে প্রত্যাখ্যান, নিজে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, আবার শোক ভুলতে নীতিহীন হয়ে অনর্গল শরীরী আনন্দ বা আত্মনিগ্রহের দিকে ঝাঁপ— তার সব ক’টাতেই টিক দেওয়ার চেষ্টা আছে ছবিটায়।
নিষ্ঠুরতা আছে, আত্মগ্লানিও। মা যখন ছেলেকে বলে, তোর যে কোনও গোপন কথা আমায় বলতে পারিস, ছেলে বলে, তোমার কোনও গোপন কথা বলার নেই? মা বলেন, কী বলতে চাইছিস? ছেলে বলে: বাবা সোজা রাস্তায় আসতে গিয়ে হঠাৎ ট্রাকে ধাক্কা মেরে দিল? এটা বাবা ইচ্ছে করে করেনি তো? মা তখন তাকে চড় মারেন। আবার বাবার সমাধিতে গিয়ে সে বলে, বাবা, আমি জানি, আমি বোঝার আগে তুমি বুঝেছিলে যে আমি সমকামী, তোমার সেদিনের হতাশ মুখ এখনও দেখতে পাই। তার দাদা বলে, এসব আজগুবি কথা কেন বলছিস, বাবা তোকে সবটা মিলিয়েই পুরোপুরি ভালবাসত। পরিবারের সকলেই জানে ছেলেটি সমকামী, কারও তাতে আপত্তি নেই, এটা ছবিতে কোনো সংকট আনতে পারছে না বলেই বোধহয় ছেলেটির আছাড়িপিছাড়ি বিষাদের চোটে বিপদ ডেকে আনার চেষ্টা করা হয়। অথচ ছেলেটি তার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল না, এ কথা ছেলেটিরই বয়ানে ছবির গোড়াতেই বলা আছে। ছেলেটি থাকতও হস্টেলে।
একদিন, দাদার রুমমেটকে ঈর্ষান্বিত করে তোলার জন্যই সে দাদার ফাঁকা বাড়িতে এক প্রবীণের সঙ্গে শোয়, প্রবীণটি টাকা দিলে সে গ্রহণও করে, যদিও তাদের সঙ্গম বাধা পায় দাদা হুট করে এসে পড়ায়। দাদা ভাইকে মারে এবং গ্রামে মায়ের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। তারপর ছেলেটি এক সময়ে কব্জির শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, এবং প্রতিজ্ঞা করে সে আর কখনও কথা বলবে না। ভগবানকে এই প্রতিশ্রুতি দেয়। এই যে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে প্রায় সাহিত্যের ভাষায় নিজের মন উন্মুক্ত করতে চাওয়া, এবং ভগবানের কাছে নীরবতার শপথ— এসব প্রায়ই বার্গম্যানের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু শুধু কারও কাছ থেকে আংশিক সম্পদ ধার নিলেই তো হল না, তীব্রতাটা আর প্রাণটাও তো ধার নিতে হবে। ছবিটা ক্লিশে-ক্লিষ্ট ও কৃত্রিম মনে হয়, দাদাটি ভাইকে একটা শুধু দুরন্ত কথা বলে, যার মানে হল, এই যে তুই বাবার শোক ভুলতে যা-ইচ্ছে তা-ই করছিস, এখানে তুই আসলে বাবার মৃত্যু থেকে নিজের একটা ফায়দা তুলে নিতে চাইছিস। একদম ঠিক। এভাবে সেয়ানা মাতালরা অন্যকে গালাগাল দিয়ে পরে বাতলায়, তখন তো জ্ঞানে ছিলুম না, কিছু মনে করিস না মাইরি। আবার ছেলেটি যখন কথা বন্ধ করে দেয়, তার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে এসে দাদার রুমমেট বলে, এই নিজে কথা না বলাটা খুব সুবিধেজনক, কারণ অন্যের ঘাড়ে কথা বলার দায়িত্বটা পুরোপুরি চাপিয়ে দেওয়া যায়। এই ছবিতেও চেষ্টা হযেছে, দর্শকের ঘাড়ে একটি দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার, ছবিটি তার ভাল লাগতে হবে। কারণ, সাধারণত ভাল-লাগা ছবিতে যা-কিছু ঘটে, এখানে তার কিছু জড়ো করতেই তো বাকি নেই। সমকাম, যৌনতা, ‘এই জীবন লইয়া কী করিব’ দ্বিধা, আত্মহত্যার চেষ্টা, কথা বলতে নারাজ হওয়া, শেষে দাদার রুমমেট প্যারিস থেকে দেখা করতে এসেছিল বলে খুশিতে রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে কিছুক্ষণ দৌড়নো ও ফিরে মায়ের সঙ্গে কথা বলে ওঠা। মিটে গেল। মাও এতদিন পর সন্তান আবার জীবনে ফিরছে দেখে, নিজেও কিছুটা জীবনের দিকে ফিরে দাঁড়ান, মৃত স্বামীকে বলেন, এতদিন আমি তোমার ওপর খুব রেগে ছিলাম, আজ তোমাকে মিস করছি। আর ছেলেটি দাদার রুমমেটের গাওয়া একটি গান গিটার বাজিয়ে গায় ও ভিডিও করে তার ফোনে পাঠায়। অত শোকেও যে একবার শুনে গানটা তুলে নিয়েছিল, এই যা সান্ত্বনার।