কার স্বর কার ঘর
বানানো বুদ্ধি বা ‘এ-আই’ এসে বড়-বড় গায়ক-গায়িকার গলা ব্যবহার করে নানা নতুন গান তৈরি করে ছড়িয়ে দেবে এবং ভয়াবহ ডামাডোল ঘটবে ভেবে যারা এখন তটস্থ, এবং এ-কাণ্ডের আভাসমাত্র দেখলেই মামলা করে তা মুহূর্তে মুড়িয়ে দিতে তৎপর, তাদের একেবারে উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে পপ-গায়িকা গ্রাইমস বললেন, আমার গলা যদি কেউ হুবহু ক্লোন করে এ-আই’এর সাহায্যে নতুন গান বানাতে পারেন, করুন না। শুধু আমাকে আদ্ধেক রয়্যালটি দিলেই হল। তিনি বলেছেন, তিনি প্রযুক্তির গিনিপিগ হতে রাজি, এবং তিনি বিশ্বাস করেন, শেষ অবধি আমরা একটা কপিরাইট-মুক্ত পৃথিবীর দিকেই যাত্রা করছি।
যে-কোনও শিল্পী তাঁর সৃষ্টি নিয়ে আলট্রা-স্পর্শকাতর, এবং তাঁর নিজস্ব শৈলী বা স্বর বা রূপ অন্যে গেঁড়িয়ে দিলে বেদনাহত। যদি একজনের লেখা উপন্যাস অন্যে নিজের নামে চালায়, বা কারও নামই না দিয়ে, শুধু উপন্যাসটাকে সর্বত্র প্রচার করে দেয়, তাহলে স্রষ্টা আকুলিবিকুলি ছটফট করবেন, কারণ সৃষ্টির সঙ্গে অহং-তৃপ্তির যোগ ওতপ্রোত। আমি একটা সিনেমা করলাম, তা সবাই দেখল এবং প্রশংসা করল, কিন্তু জানলই না ওটা আমার করা— এ হল শিল্পীর এক্সএক্সএল দুঃস্বপ্ন। তারপর তো অবশ্যই আসে এই সৃষ্টির সাফল্যের লভ্যাংশ পাওয়ার দাবি। শিল্পীদের সৃষ্টি যাতে বিনা অনুমতিতে ব্যবহৃত না হতে পারে, তার প্রতি নজর রাখার জন্য, এবং শিল্পীদের প্রাপ্য স্বীকৃতি ও পয়সা-ভাগ আদায় করার জন্য কত্ত সংগঠন তৈরি হয়েছে-হচ্ছে। কপিরাইট-বখেড়া নিয়ে সান্ধ্য-আসরে গজগজ করে তারপর মদগ্রহণ, বহু শিল্পীর অভ্যাস। এবং চারপাশের সবাই হ্যাঁ-বাচক মাথাই নাড়েন, কারণ এ তো স্বতঃসিদ্ধ, একজন তাঁর প্রতিভা ও সাধনা মিশিয়ে ভিনধাঁচের ব্যাপার তৈরি করবেন, আর তার স্বত্ব চাইবেন না?
কিন্তু এমন শিল্পীও থাকেন, যাঁরা শিল্পটা সৃষ্টি করে ও তার প্রচার নিশ্চিত করেই খুশি। এর মধ্যে তাঁর নিজের ভূমিকা কীর্তিত হল কি না, তা নিয়ে ভাবনাই নেই। মহাভারতের মধ্যে যাঁরা নিজের লেখা ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা জানতেন এ-কাণ্ড ব্যাসদেবের নামেই প্রচারিত হবে, এবং ভাল হলে (নিজের রচনা ভাল— এছাড়া কোনও বিশ্বাস সাধারণত শিল্পীর মনে উপবেশন করে না) ব্যাসদেব পূর্ণ কৃতিত্ব পাবেন। তবু তাঁরা নিরভিমান নিবেদনে, লেখাটি মহাকাব্যে প্রবিষ্ট করেছেন ও ধীরে অন্তরালে চলে গেছেন। তাঁদের মনোভাব হল, আমার কথাটা তো থাকল রে বাবা, সেটাই কি যথেষ্ট নয়? এমন গায়ক নিশ্চয়ই আছেন, যখন ফোন পেয়েছেন: ‘আপনার গান যতবার টিভি-রেডিও-ইউটিউবে প্রচারিত হবে, ততবার যাতে পয়সা পান, আমরা ব্যবস্থা করব, আপনি এই সংগঠনের সদস্য হোন’, তখন উত্তর দিয়েছেন, ‘আমার গান ছড়িয়ে পড়লে আমি তাতেই খুশি, এর জন্যে খামকা পয়সা চাইব কেন?’ নাম চাই না, টাকা চাই না, আমার আর্ট-টা থাকুক, এদিকে ওদিকে যাক, বহু মানুষ তার স্বাদ গ্রহণ করুক, যদি কারও ভাল লাগে তাহলেই তা সার্থক: এই ভাবনাও আছে; আবার, নামটা অবশ্যই আমার থাকুক, কারণ এটা আমি তৈরি করেছি, কিন্তু প্রচার নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, যত খুশি লোক এটাকে নিয়ে যা ইচ্ছে করুক, অংশ কেটে নিক, প্যারডি করুক, অন্য ছাঁচে ফেলে নিরীক্ষা করুক, নিজের তৈরি কোরাস ঢুকিয়ে দিক, বহু মত ও চিন্তা এসে এর স্রোতে মিশে যাক— এ-ভাবনাও আছে। ‘@COPYLEFT ALL WRONGS RESERVED’ বাক্য আমরা ১৯৭৬-এ পেয়েছি।
কিন্তু এমন ভাবনা কি আছে: অন্য লোক শিল্প করে আমার নামে চালিয়ে দিক, আমার তাতে আপত্তি নেই? গ্রাইমস যা বলছেন, তা এরকমই অদ্ভুতধর্মী। তিনি গাইলেনই না, এমন গান তাঁর গলার স্যাম্পল ব্যবহার করে তৈরি করে দিল একটা যন্ত্র, এবং সেই গান প্রাথমিক ভাবে তাঁর নামেই প্রতিষ্ঠা পেল (কারণ সবাই তো আগে গলা শুনে ভাববে তাঁর গাওয়া, পরে হয়তো জানতে পারবে ওটা এ-আই নির্মিত), তাতে তিনি দিব্য সম্মত। শিল্পীর নিজত্ব তাহলে থাকল কোথায়? শিল্পীর মূল অভিমান: তিনি একক, একমাত্র। প্রকৃত শিল্পীর কলারটা নিজের কাছে তোলা থাকে একটাই থিমে, ভাই, আমি এমন সাংঘাতিক মৌলিক যে আরেকটি আমি আর এ-বসুন্ধরায় হতিছে না। এ-আই এসে যে সন্ত্রাস-থাবাটি তুলেছে, তাতে লেখা: শিল্পীর মৌলিকতা বলে কিসু নেই, তাঁর স্রেফ কয়েকটা মুদ্রাদোষ, নির্দিষ্ট বিন্যাস-ধরন, পুনরাবৃত্তির অভ্যাস আছে, এগুলোর মিশেলকে তোমরা স্বকীয়তা বলছ, তাঁর সমস্ত রচনা খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখলে বুঝলে ওগুলোও অবিকল নকল করা যায়, এবং এমন লেখা লিখে দেওয়া যায় যা পড়লেই মনে হবে ইনি লিখেছেন, এমন গান তৈরি করা যায় যা শুনলেই মনে হবে উনি গেয়েছেন। ফলে এ-আই বনাম মানুষ সংঘাতে, শিল্পীর আসল ঝামেলা হল, ও যদি আমার মতোই লিখে দেয়, তাহলে আমি বলে বেড়াব কী করে যে আমার মতো ভূ-ভারতে আর কেউ হতে পারে না? গ্রাইমস যা বলছেন, তা সম্প্রসারণ করলে দাঁড়ায়, এমনটা হলে তাঁর আপত্তি নেই, তাঁর মতো হোক না গাদা গাদা যেন-গ্রাইমস, প্রায়-গ্রাইমস, এমনকি কোনও-তফাত-নেই-যমজ-গ্রাইমস (গঙ্গাসাগর মেলায় ছাড়াছাড়ি হযেছিল), তবে রয়্যালটিটার অর্ধেক চাই। হয়তো উনি ভাবছেন, এ-আই তার পাঁয়তারা কষুক না, আমার গানগুলো তো রইলই। অর্থাৎ আমিও থাকলাম তুমিও থাকলে, আমাকে ভাঙিয়ে খেয়ে কুছু বখরা দাও, তাইলেই হল। জিনিসটা যে গুলিয়ে যেতে পারে: কোনটার স্রষ্টা মানুষ-গ্রাইমস আর কোনটার এ-আই-তুতো গ্রাইমস, এবং মানুষ যে এর বাহাদুরি/নিন্দে ওর ঘাড়ে চাপাতে পারে ক্রমাগত, শিল্পবিচারটাই বিপন্ন হতে পারে, এ হয়তো মাথায় ঢুকছে না। গ্রাইমসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তাহলে একটা সাম্প্রদায়িক বা হিংস্র গান তৈরি করে যদি এ-আই তাঁর হুবহু গলায় তা গাইয়ে দেয়, তখন কী হবে? এবার তাঁকে একটু সন্ত্রস্ত লেগেছে, বলেছেন, হ্যাঁ বাবা, তা বলে নাৎসি সঙ্গীত তৈরি করে দিও না আমার স্বর ব্যবহার করে। কিন্তু সঙ্গে জুড়েছেন: নীতিগত ভাবে, তাঁর এ-আই কে সহকারী ভাবতে বাধা নেই। বলেছেন, এ-আই মানুষকে সরিয়ে শিল্পজগৎ অধিকার করে নিতে পারে, তাই প্রজাতি হিসেবে মানুষের আলোচনা করা উচিত, শিল্পে এ-আই’এর ভূমিকা বিষয়ে।
এ-আই অবিলম্বে কাব্য লিখবে, গান তৈরি করবে, সিনেমা বানাবে— এ নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই, এবং সেগুলোর কয়েকটা প্রকাণ্ড ভাল হবে, অনেকগুলোই যথেষ্ট চলনসই হবে, তখন এ-বিতর্কও জাগবে: ক্লান্তির দাস ও মনোযোগ-ছ্যাড়ানো মানুষ-জাতটার চেয়ে যন্ত্রনির্ভর শিল্প অনেক ভাল কি না। এমন মতামত ভাসবে: একটা-আধটা মানুষ আর বেশিটা এ-আই দিয়েই শিল্পবিশ্ব শাসিত হোক, কারণ তাতে সামগ্রিক মানটা অনেক উন্নত থাকে। কিন্তু সে হল মানুষের সৃষ্টির কোয়ালিটি বনাম এ-আইয়ের সৃষ্টির গুণমানের তরবারিযুদ্ধ। গ্রাইমস যা বলছেন, সেখানে ঝামেলাটা অন্যত্র। উহাতে ন্যায়গত খিচখিচ বর্তমান। তিনি তাঁর সৃষ্টির একটা প্রধান উপাদান এ-আই’কে ধার দিয়ে বলছেন, যা ইচ্ছে করো। এই ধার দেওয়ার সিদ্ধান্ত কি শিল্পীজনোচিত? যেখানে শিল্প-প্রতিভার মূল বৈশিষ্ট্যই হল: তা ধার নেওয়া (বা দেওয়া) যায় না? আমি যদি সত্যজিৎ রায়ের একটা ছবির সব চরিত্রকে নিয়ে আরেকটা ছবি বানাই, তাকে কি আর সত্যজিতের ছবি বলতে পারি? এমনকি সত্যজিৎ যদি এ-কাজ করার অনুমতিও দিয়ে দেন, তারপরেও সেটাকে আমি সত্যজিতের বলে চালাতে পারি না, সেখানে চুক্তিতে বাধবে না, কিন্তু শিল্পের ধর্মে বাধবে। এমনিতেই তো গ্রাইমসের ‘নীতি’টার গলদ হল: এ-আই’এর সঙ্গে মিলে একটা লোক আর্ট তৈরি করল, আর এ-আই সেই লোকটার একটা শিল্প-উপাদান ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে পুরোপুরি নিজের মতো আর্ট বানিয়ে ফেলল— এ দুটো এক নয়। প্রথমটায় এ-আই অবশ্যই শিল্প-সহকারী, কিন্তু দ্বিতীয়টায় সে চতুর বেনিয়া। সে মূল ধনটা নিচ্ছে ক-বাবুর, তারপর নিজের মতো করে তাঁর হ্যানোত্যানো টুকে একটা শিল্প বানিয়ে, আবার বাজারে ছাড়ছে ক-বাবুর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার ওপর ভর করে। মানে, প্রচার ও রোজগার হবে ক-বাবুর ভরসায়, এদিকে শিল্পের আত্মা প্রতিষ্ঠা করবে সে নিজে, ক-বাবু সে-সম্পর্কে অনবহিত। গলাটা সে নেবে গ্রাইমসের, কিন্তু গানটা বানাবে নিজে, গ্রাইমস তার কিচ্ছুটি জানবেন না।
এই তর্কে এ-আই’কে কেউ হেঁকে বলতেই পারে, তুমি নিজে যত খুশি শিল্প করো না বাপু, মুরোদ থাকলে জিতে নাও তুখড় ট্রফি ও টিআরপি, কিন্তু অন্যের স্বর অন্যের মুখ অন্যের তুলিটান নিচ্ছ কোন অধিকারে? এ-আই ঠিক রবীন্দ্রনাথের ধরনে লিখতে পারলে তা নিয়ে আমরা বিস্ময় কৌতুক উল্লাস সমীহ প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু এ-আই সেই স্টাইলে একটা বই লিখে ‘রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন’ বলে চালিয়ে দিলে তা হবে তঞ্চকতা, আর ‘রবীন্দ্রনাথ এবং আমি মিলে লিখলেম’ বললে তা নিয়েও ঝঞ্ঝাট পাকবে, এমনকী রবীন্দ্রনাথের সম্মতি থাকলেও ঝঞ্ঝাট পাকবে, কারণ তাতে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নেই, এবং সুতরাং, তাঁর ভাবনাটা নেই। এক শিল্পীর স্টাইলটা তাঁর অসামান্য বাহন, কিন্তু শেষ অবধি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, তাঁর ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গিটাই শিল্পটাকে জিতিয়ে নিয়ে যায় (বা বেশিদিন জিতে থাকবে কি না তা ঠিক করে)। যে-শিল্পীর শিল্পে শৈলীটাই প্রধান, এবং তাঁর মতে সেটাই তাঁর সৃষ্টির বিষয়, তাঁর শৈলীর নকলেও এ-আই নিজে কাজকর্ম করে সেটাকে তাঁর নামে চালাতে পারে না, কারণ তিনি তো বলে দেননি, এই নির্দিষ্ট সৃষ্টিতে তাঁর শৈলী কোনখানটা কেমন প্রযুক্ত হবে, অন্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই সিদ্ধান্তটাই আসল। গ্রাইমস কীভাবে গান করেন তা এ-আই প্রাণপণ বুঝলেও, এই গানটা গ্রাইমস ঠিক কোনভাবে গাইতেন, কোন শব্দে কোমন জোর দিতেন, কোন লাইনে কেমন গলা খেলাতেন, তার সিদ্ধান্ত গ্রাইমস নিলে, তবেই তা গ্রাইমসের গান। নচেৎ নয়। গ্রাইমস নিজে বললেও নয়।
যদি গ্রাইমস-এর মতো কোনও শিল্পী তাঁর কোনও শিল্প-উপাদান ব্যবহারের ঢালাও অনুমতি কৃত্রিম-বুদ্ধিমানকে দিয়ে দেন, তা তাঁর ব্যাপার। এ তাঁর ব্যক্তিগত লাভ বা হ্যাপার আখ্যান। কিন্তু সেই প্রেরণায় অন্যের আদলে শিল্প বানিয়ে তা শিল্পীর নামে আংশিক বা পুরোপুরি চালাবার অধিকার একটা দামড়া রোবটের (বা স্লিমস্য স্লিম মাইক্রোচিপের) হাতে চলে যেতে পারে না। গ্রাইমস-এর এ-আই-প্রীতি চমৎকার এবং আত্ম-গিনিপিগ-বৃত্তিও ত্যাগ-মহিমা-সমুজ্জ্বল, কিন্তু শিল্পী যদি বলেন আমার লেখাটা অন্যে লিখে দিলে বা গানটা অন্যে গেয়ে দিলে আপত্তি নেই, তাহলে তা শিল্পের অপমান, শিল্পীর আত্মমর্যাদার অপমান, কারণ তা শিল্পের গোড়ার প্রবৃত্তি ধ’রে এবং শিল্পবৃত্তিটার গোড়া ধ’রে টান মারে।