বসন্ত পঞ্চমী’ কথাটার মধ্যে ঝাঁকিয়ে দিয়ে যাওয়া একখানা ছন্দ যে ছিলই, লেখালেখি শুরু করার আগেই তা টের পেতাম। ছন্দ হয়তো সমস্ত শব্দের মধ্যেই তার ভাগ বসায় শেষমেশ, কিন্তু এই বিশেষ শব্দবন্ধের প্রতি ছন্দেরও দুর্বলতা ছিল নিশ্চয়ই। তাই সে কেবল উচ্চারণ নয়, এমনকী রং আর গন্ধের পসরা সাজিয়েও টের পাওয়াত, ছন্দে মেতে ওঠার সময় এসেছে। সেই বইমেলা-পেরনো আলগা শীতের বাতাস আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে সিলিং ফ্যানের আলতো হাওয়ায়, সেই কুয়াশার ভারী চাদর দেখতে দেখতে হয়ে উঠছে আরাম-রোদের কেদারা, সেই ঝরাপাতার ফুটপাথ কখন যেন সেজে উঠছে কদমফুলের চিহ্নে… এভাবেই বুঝতাম আমরা, তার এসে পড়া। এসে পড়ে আমাদের ঝাঁকিয়ে দিয়ে চলে যাওয়া। সে মানে বসন্ত পঞ্চমী। যার ডাকনাম, সরস্বতী পুজো।
অন্য সব পুজোর চেয়ে সরস্বতী যে আলাদা রকম পুজো চান, বসন্তই সে-কথা বুঝিয়ে দিত বরাবর। ওই সাহসী বাতাসের চুল ওড়ানো বিলাসিতায়, ওই রোদ্দুরের কাঁচা গন্ধে মাতোয়ারা সকালে পুজো কি কেবল পুজো হয়েই থাকতে পারে? সে কি তাকে ঘিরে তারুণ্যের রাংতা চায় না? সে কি চারপাশে চায় না সুসময়ের শামিয়ানা? এ সবই আমরা বুঝতাম মনে মনে, কিন্তু মুখে সাজিয়ে রাখতাম আয়োজনের ব্যস্ততা। যেন পুজোই সব, চাঁদমালা হাতে তার ওই করিডোর দিয়ে ভেসে আসা কিছুই নয়।
করিডোর মানে? কোথাকার করিডোর? কেন? স্কুলের? সরস্বতী পুজো আসছে মানে, তার এক হপ্তা আগে থেকে পুজোর আদত উপচারকেই প্রায় জলাঞ্জলি দেওয়া, যার নাম পড়াশোনা। ক্লাস হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মন চলে যাচ্ছে জানলার বাইরে। নোট নিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু কলম লিখতে চাইছে কারও একজনের নাম, পেনসিলে। যাতে হুট করে মুছে দেওয়া যায়। এইসব বিপদের মধ্যে বসন্ত পঞ্চমী তার ঝলমলে তিথি নিয়ে হাজির হলে দোষ তো আমাদের দেওয়া যায় না। আর ওই ক’টা দিন স্যার-দিদিরাও আমাদের কেমন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন, অন্তত আমাদের স্কুলে তো বটেই। রোদ পড়ে আসতেই শুরু হয়ে যেত পুজোর তোড়জোড়, কবে প্রতিমা আনতে যাওয়া, ভোগে কী কী থাকবে, ফল বাজার কখন হবে, পুরোহিতকে আনতে যাবে কারা, এবারকার শামিয়ানা কীভাবে সাজানো হবে, এইসব চুলচেরা আলোচনায় আমাদের অলীক বিকেলগুলো সন্ধের দিকে গড়িয়ে যেত। আর ওই কাঁচা হলুদ রঙের বয়সে ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে যতই অনিরাপদ দূরত্ব থাক না কেন, এই দিনগুলোয় চকখড়ির সেই অদৃশ্য দাগও মুছে যেত। তাই জোট বেঁধে আলোচনায় থেকে থেকেই দলবদল করত চোখজোড়ারা, তাদের কোনও মিথ্যে বাহানা লাগত না।
হয়তো একজন মনে মনে হাত ধরতে চায় আর একজনের, হয়তো একজন চিরকুট জমা দিতে চায় আর একজনের মুঠোর ডাকবাক্সে, সারা বছর একই স্কুলে থেকেও পারে না সেসব। সরস্বতী তাদের জন্য খুলে দেন এক হপ্তার এই সাহসী করিডোর। যেন তিনি নিজেই পাহারা দেন অলক্ষ্যে, এইসব মিহি বিনিময় যাতে ধরা না পড়ে। আমাদের ছোটবেলায়, এই কারণেই হয়তো, দেবী সরস্বতীকে কেমন মানুষ-মানুষ মনে হত। যিনি পড়াশোনার দেবী হয়েও কড়া নন, বরং প্রশ্রয়প্রবণ। যিনি সঙ্গীতের দেবী হয়েও দুরূহ নন, বরং প্রসাদ সাজাতে সাজাতে দু’এক কলি হিন্দি গান গেয়ে ফেললে রাগ করবেন না। ঠিক এই কারণেই দেবী সরস্বতী ছিলেন আমাদের কাছের জন, আপনার মানুষ। প্রেমিকাকে বলতে না পারি, তাঁর পায়ের কাছে অঙ্ক আর ইতিহাস বই নামাতে নামাতে বিড়বিড় করে বলতেই পারতাম, ‘দেখো মা, ও যেন হ্যাঁ বলে।’
তাই পুজোর আড়ালে প্রচ্ছন্ন প্রেমের আয়োজন চলতেই থাকত ওই সাত দিনে। কাজের ভার সব কেমন যেন আপনা-আপনিই ভেঙে জোড়ায় জোড়ায় ভাগ হয়ে যেত। আমরা যেন জানতাম, ঠিক কারা ফলের দায়িত্ব নেবে, কোন দু’জন যাবে কেটারারের অফিসে, আর কোন যুগলই বা প্রেসে ছুটবে পুজোর কার্ডের প্রুফ দেখতে। তারপর আশপাশের স্কুলে সেই কার্ড বিলির দায়িত্বও কোন জুটির কাঁধে পড়বে, আমরা জানতাম। কেবল জানতাম না, আমাদের মতো বিজোড় সংখ্যাদের কপালে দেবী কী লিখে রেখেছেন।
বহু আগে অলোকরঞ্জন একবার লিখেছিলেন, ‘পাখিটির মাতৃভাষা চেয়ে থাকা’। আমাদেরও ছিল ওই একই ভাষা, যদি চাতক বলে নিজেদের জাহির করি আজ। নব্বইয়ের গোড়ার দিককার পৃথিবীতে চাহনি এত বেশি ফিল্টারের দেখা পায়নি, টাচস্ক্রিন আসেনি, স্পর্শ বলতে ত্বক। তাই আমাদের পুরনো, ভাঁজ খাওয়া সেই পৃথিবীর তাকিয়ে থাকাগুলোও কেমন যেন গোবেচারা ধরনের ছিল, অন্তত আজ তাই মনে হয়। আর সেই তাকিয়ে থাকা সার্থক করে নেওয়ার একটিমাত্র দিন ছিল সরস্বতী পুজোর রোশনাই-সকাল। দেবী খোদ বরাভয়ের লাইসেন্স নিয়ে তাকিয়ে আছেন, কে কাকে আটকাবে আর?
পুজোর আগের দিন রাত অবধি স্কুলে থাকার মজাও ছিল আর এক রকম। সন্ধের পর স্কুলবাড়িটা ঠিক কেমন হয়ে ওঠে, স্কুলের মাঠে ঘন অন্ধকার নেমে এলে কেমন দেখায়, চেনা রোদ্দুরের ক্লাসরুমগুলোয় টিউব জ্বলে উঠলে কীভাবে বদলে যায় তাদের চেহারা, এসবেরই হদিশ মিলত সেই সন্ধের পর। স্যার আর দিদিরাও তখন বন্ধু হয়ে উঠতেন, ছুটির ঘণ্টা তাঁদেরও হাত খুলে দিয়ে যেত যেন। আর একসঙ্গে সকলে সাজানো শুরু হত আগামীকালের পুজোকে। সেই রঙিন ব্যস্ততার মতো ঝলমলে ক্লান্তি আর কখনও দেখিনি। আর এই টুকিটাকি আয়োজনের আড়ালে উঁকি মারত সাহসী এক কল্পনা, যার সঙ্গে হাঁটতে চাই অনেকটা পথ, আগামীকাল সে কেমন সেজে আসবে? সারা বছর তাকে স্কুলপোশাকে দেখবার ফাঁকে এই তো একবেলার ছাড়, অন্য রকম দেখানোর।
যদিও আমরা জানতামই কেমন হবে সব। তাই বসন্তের ঝকঝকে সকালে, অল্প ঠান্ডা হাওয়ার হুমকি উড়িয়ে দিয়ে ফিনফিনে হলুদ পাঞ্জাবি পরে চলে যেতাম স্কুল। স্যার আর দিদিদেরও কী যে অন্য রকম দেখাত এই একটা দিন! বকুনি দেওয়া স্যার বা নিল-ডাউন করানো দিদি যে আসলে একজন বন্ধুই, গোপনে আমাদের সেটা বলে দিয়েছিলেন বাগদেবী খোদ। কিন্তু যে-বন্ধুকে খুঁজছে দু’চোখ, সে কোথায়? এল না কেন এখনও? রোদের তাপ আর হৃৎস্পন্দন যে সমানুপাতিক, বসন্ত পঞ্চমী সেটা বুঝিয়ে ছাড়ত। এদিকে পুরোহিত এসে গেছেন, একটু পরে ডাক পড়বে অঞ্জলির। যদি তার ঠিক পাশটিতে না-ই দাঁড়াতে পারলাম, তাহলে কীসের এত আয়োজন?
আমরা, মানে চিরকালীন বিজোড় সংখ্যারা এইরকম উদ্বেগ নিয়ে যখন বার দশেক স্কুলের বাইরের দরজায় পায়চারি বিছিয়ে ফিরে এসেছি, তখনই প্রবেশ হত তার। একজন অলৌকিক সহপাঠীর, যাকে মনে মনে ‘বান্ধবী’ বলে ডাকলে খুব ভাল লাগত। কেন, কে জানে। আর আমরা যে-যার সম্ভাব্য পরিপূরক সংখ্যার দিকে তাকিয়ে বুঝতাম, চাইলে ‘পূরক’ বাদ দেওয়াই যায়। অন্তত আজকের দিনে সে কেবল পরি হয়েই এসেছে। যে-শাড়ির আঁচল সে বইয়ে দিচ্ছে দুঃসাহসী হাওয়ার টানে, তার রংকেই বলে বাসন্তী, এটা বুঝতে দেরি হত না। বুঝতে দেরি হত না যে, এই একটা দিন তাকে সমস্ত দিক থেকে কী অন্য রকম দেখাচ্ছে! আর এটা বুঝতেও যে, তারই জন্যে এত কিছুর পরেও থমকে ছিল অঞ্জলি।
কোন সেকশন জানি, কী নাম জানি, কোথায় থাকে, সেটাও জানি। কেবল আমার মনের কথা বোঝে কি না, জানি না। তাই স্কুলবারান্দার রোদ্দুর, ক্লাসরুমের ছায়াকে সাক্ষী রেখে যখন অঞ্জলি দিতে দাঁড়াতাম, মনে মনে প্রার্থনা করতাম, মনের কথা যেন তাকে বলতে পারি। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ, প্রেইরি অঞ্চলের জীবনযাত্রা বা অনুশীলন ৭-এর ১৬ নম্বর অঙ্ক তখন হাওয়া হয়ে গেছে কোথায়। বদলে আছি তিনজন। আমি, সে ও দেবী। লজ্জার মাথা খেয়ে তাঁকেই বলছি, কিছু একটা উপায় বাতলাতে। এমন সময়, তৃতীয় বার অঞ্জলির ফুল তার হাতে আর পৌঁছল না। এদিকে পুরোহিত মশাইয়ের মন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। আমি পড়ি-কি-মরি ডালা থেকে ফুলের গুছ ছিনিয়ে এনে তার দিকে দু’হাত ভরে বাড়িয়ে দিলাম। আর সে, খুশি হয়ে, আড়চোখেই একবার তাকাল আমার দিকে। এই যে মহাজাগতিক সংযোগ ঘটে গেল একবার, এ কি হত, সরস্বতী পুজো না এলে? ওই চাহনির ডানায় ভর দিয়েই আরও একখানা শীত পার করে নেওয়া যাবে, এতে সন্দেহ নেই।
আজ এই এত বছর পর লিখতে বসে মনে হচ্ছে, দিনগুলো কত তাড়াতাড়ি সিপিয়া টোন নিয়ে নিল। তখন হাতে হাতে ক্যামেরা ছিল না, তাই আজ পাতায় পাতায় সেসব দিনের ছবি ইচ্ছে করলেই দেখতে পাই না আর। বাসন্তী আঁচলের মোড়কে তার সেই করিডোর ধরে হেঁটে আসার যে-মহাসমারোহ, তেমন রাজকীয় ভাবে প্রেমকেও আর আসতে দেখি না। ট্র্যাফিকের ভিড়ে আটকে গেছে হয়তো, বা নেমে পড়েছে ভুল স্টপেজে। কেবল অতীত-বসন্তের ডালপালা জাগিয়ে এক স্কুলবাড়ি জেগে থাকে মাথার মধ্যে, ম্যাপবিহীন দ্বীপের মতো। আর বসন্ত পঞ্চমীতে তার শরীর সেলাই হয় রাংতায়, প্রেম হবে বলে। জানি না, আজকের সরস্বতী পুজোর গন্ধ বদলে গেছে কি না, তবে এটুকু জানি, পূজা পর্যায়ের পাশেই রাখা আছে প্রেম পর্যায়ের গান। মাঝেমধ্যে গুলিয়ে গেলে, ঠাকুর কিছু মনে করবেন না!