একদিন, প্রতিরাত
কাউকে চিনি না এদিকে। আমাকেও কেউ নয়। কয়েকজনকে মাঝে মাঝে দেখি। এক ফলওয়ালা, রোজ সকালে ঠেলাগাড়িতে নানারকম সবজি নিয়ে আসে। চেঁচায় ‘কেলা কেলা’ বলে। হঠাৎ কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া, দোতলার ওপর শুধুই লোহার রড জেগে থাকা, দেখে মনে হয় বোমা পড়েছে, স্বপ্ন-চুরমার ফ্ল্যাটবাড়ির একমাত্র সিকিউরিটি, একটুও নড়ে না, কংক্রিটের পুতুলের মতো বসে থাকে। সারা রাত। তবে দুজন আছে, যাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার একটা ব্যাপার ঘটে। একটা দোকানঘর, নানা ধরনের ধাতুর পুরনো যন্ত্রাংশ, রড, গিয়ার, মোটরের আর্মেচার ঠাসা, এতটাই যে দোকানদার সারাদিন ফুটপাথে বসে থাকে। ওখানে কাউকে কিছু কিনতে দেখিনি। চোখাচোখি হলে বিপদ। ‘কী, সব ঠিক তো?’ চিৎকার করে বলে ওঠে লোকটা। হুমকির মতো শোনায়। আমিও অন্যদিকে তাকিয়ে এক হাত তুলে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ করে কেটে পড়ি। কোনও সত্যিই তো আর সত্যি নয়! আমার সব কিছু ঠিক না ভুল তা কী করে বুঝব? ঝামেলা হলে, ফেঁসে গেলে তবেই লোকের মালুম হয় যে তার হাল খারাপ। আমারও তাই। রাতে ওই দোকানের শাটারের তলা দিয়ে আলো বেরোতে দেখেছি। আর একজন আছে, বয়স বোঝা শক্ত। চায়ের দোকান আছে, খোলে না বললেই চলে। সারাদিন রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়, এদিক-ওদিক। নানারকম রোদ আর ছায়ার সীমানা ধরে। ঘাড়টা সবসময় ডান দিকে কাত করে থাকে। মুখ তোলে না। চোখাচোখির সম্ভাবনা নেই। তার সামনে অন্য কারুর ছায়া পড়লে দু’হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গি করে। তারপর আঙুলগুলো পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে। মনে হয়, যেন ক্ষমা চাইছে। রাতেও সে ঘুরে বেড়ায় ছায়ার খোঁজে। আর একজন, আপাতদৃষ্টিতে ছিটিয়াল। আমি জানি, আসলে তা নয়।
এইমাত্র সে পড়ল আকাশ থেকে। একটা ঢাউস আলখাল্লা। ভেতরে, মানে তলায়, মনে হয় আর কিছু নেই। লোক জমে গেল। লাফাচ্ছে। ঝাঁপাচ্ছে। ডিগবাজি খাচ্ছে। মাথার ফেট্টির বাসা থেকে বেরিয়েছে প্রচুর কাঁটাডাল। ব্রেন থেকে গজিয়েছে নাকি? হাতে অদৃশ্য জাদুলাঠি। একের পর এক খেলা চলছে। একটা কাক তার ঠিক সামনে কালো বিষ্ঠা ফেলে উড়ে গিয়ে ল্যাম্পপোস্টের ওপর রগড় দেখতে বসল। জাদুদণ্ড ছোঁয়াতেই হয়ে গেল সাদা। তুমুল হর্ষধ্বনি উঠল ফুটপাথ, জানলা, বারান্দা থেকে। পয়সা পড়ল কিছু। তুলে নিয়ে হাত ঘোরাতেই হয়ে গেল নোট। একটাও কথা বলছে না। এবারে সে হয়ে গেল লাট্টু। ভূতের লাঠির ওপর বনবন করে ঘুরতে-ঘুরতে শনশনে শব্দের টুকরো ছড়াতে লাগল চারপাশে। এ লোক যে পাগল নয়, আমি বুঝে গেছি আন্দাজ করে এক লাফে সে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। মিথ্যে-মিথ্যে ভয় দেখাল। লাঠি এখন তরোয়াল। আঙুল দিয়ে শান পরীক্ষা করে নিল। তারপর স্লো-মোশনে চালিয়ে দিল আমার গলা লক্ষ্য করে। আমি শুধু সাঁআঁআঁই শব্দটুকু শুনতে পেলাম। গলার কাছে ঠান্ডা বাতাস কাটল। দর্শকদের দেখে বুঝতে পারলাম তারা স্পষ্ট দেখছে ধড় থেকে আমার মাথা আলাদা হয়ে গড়িয়ে চলে গেল। উস্তাদ দৃপ্ত পায়ে সেখানে পৌঁছে, মুন্ডু হাতে তুলে নিয়ে, ফিরে এসে, এক প্যাঁচে আমার গলায় রিসেট করে দিল। আবার প্রচুর টাকা পড়ল। অল্প নিল সে। বাকি নোটগুলো পা দিয়ে ঝেঁটিয়ে রাস্তার ওপরে সদ্য ঝরে পড়া পাতার সঙ্গে মিশিয়ে দিল। তারপর বসল ফুটপাথে, উবু হয়ে। মাথায় দু’হাত রেখে। একেবারে স্থির। খেল খতম। লোকজন আস্তে-আস্তে সরে পড়ল। আমি এগিয়ে গিয়ে তার কানে-কানে বললাম, ‘কথা আছে কিন্তু।’ একবার নিজের গলায় হাত বোলালাম। ভিজে-ভিজে ঠেকছে। ঘামছি। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে, সোজা হেঁটে সে ঢুকে পড়ল এ-পাড়ার একমাত্র রং করা ঘর, ‘সুলভে’। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে এল ড্রেস পালটে। মাথায় গুপী-টুপি। পাঞ্জাবির তলায় ডোরাকাটা পাজামা। পর মুহূর্তে দেখি সে আইচবাড়ির ঝুলবারান্দার তলায়। তারপর সদ্য ঝলসাতে শুরু করা অমলতাস গাছ পেরিয়ে দূরের বিন্দু। আর দেখতে পেলাম না। মনখারাপ হল। একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম। আসলে কিছুই বলতাম না। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম, বললে কী বলতাম!
ছয় বাতির মোড়ে সারাদিন দুনিয়ার সব গাড়ি, ভ্যান, রিকশা পাক খেতে শুরু করে। জ্যাম লেগে থাকে। একটু রাতে, চারখানা জ্বলে। রাস্তায় উড়ন্ত বাদুড়ের মতো ছায়া পড়ে। এর তলায় অনেক কিছু ঘটে। ছিটকে বেরোয় শেয়াল-চোখ বাইক। মশারি টাঙানো সাইকেল ভ্যান ভেসে যায় আধো ঘুমে। রাস্তা রগড়াতে-রগড়াতে আসে রগচটা এক মহিলা। নিজের পেটোয়া কুকুরদের ভাত খাওয়ায়। দূর থেকে সাইন কার্ভে চিৎকার করে অন্যরা। এসবের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল সেই লোক। হেসে বলল, ‘ওরা উল্ফগ্যাং।’ বললাম, ‘পুলের দিকে যাই?’ মাথা নাড়ল। ওই অবধি আমাদের পাড়া। তারপর স্বাধীন পার্ক। আমাদের এলাকায় রাস্তার নাম নেই। যার যেমন খুশি নামে ডাকে। আমাদের সদর দরজার দু’পাশে দু’রকম নম্বর। পুলের ঠিক মাঝখানে কংক্রিটের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘বলো।’ তার মানে একটু সময় আছে। ‘অনেকদিন হয়ে গেল নতুন এসেছি। এদিকটা কীরকম?’ জিজ্ঞেস করায় বলল, ‘যা দেখছ তা নয়। রাজ্য সরকার বেশি ঝামেলা করলে মেট্রোর লাইন তুলে নেবে সেন্ট্রাল গর্মেন্ট। তবে এ-জায়গা ভাল। সময় পেলে দেখাব নাহয়!’ বলে চলে গেল। আমি বিচলিত হলাম না। জানি, আবার ঠিক দেখা হয়ে যাবে। রুটির দোকানের দিকে এগোলাম। টিনের গুমটি। বন্ধ থাকে সারাক্ষণ। ডালার ফাঁকে টাকা গুঁজে টোকা মারলে একটু পরে ওখান দিয়ে গরম রুটি-তরকারি বেরিয়ে আসে। এক জায়গায় লেখা আছে, ‘বুকিং, রিচার্জ হয়। ভাড়ায় সব পাওয়া যায়’, দিনের আলোয় চোখে পড়েছে। আর একটা ব্যাপার আমার নজর এড়ায়নি। একটা মেয়ে, পাড়ার একমাত্র একতলা বাড়ি থেকে সকালে বেরোয়। পিঠে ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে। ফেরে আমার রুটি কেনার সময়। তখন সঙ্গে ব্যাগ থাকে না।
ছিলাম না ক’দিন। ফিরে আমার লোকের খোঁজ করতে লাগলাম। মানে, এদিক-ওদিক নজর রাখছিলাম। বেশ কয়েকদিন পর সে দেখা দিল, দুপুরবেলা। ‘ছিলাম না ক’দিন! খেলা দেখাচ্ছ না?’ বলল, ‘নিশ্চয়ই। অন্য।’ আমার সঙ্গে বেশ একটা ইয়ে হয়েছে ওর। কেউ কারুর নাম জানি না। যেটুকু চিনেছি বলে আমার ধারণা, সেটা যথেষ্ট। বলল, ‘চলো, তোমাকে একটা ডে ট্যুর করিয়ে দিই।’ পুল অবধি আমাকে টেনে এনে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। নীচে কালো জলে পদ্মের মতো চেহারার থার্মোকলের থালা ভেসে যাচ্ছে। দূরে ছয় বাতির মোড়। এর মাঝখানের রাস্তাটা আমাদের পাড়া। পুল থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে যেতে-যেতে কমেন্ট্রি শুরু করে দিল সে। আমি দৌড়লাম তার কথা ধরতে। হারিয়ে না যায়। ‘ওইটা দেখো।’ একটা বিজ্ঞপ্তি। ‘সিলিন্ডার হইতে সাবধান, বিপজ্জনক বাড়ি। আদেশানুসারে।’ এর মানে বুঝতে না পারায় জানাল, মালিক তিন তলায় থাকে। একা। টাকা আছে। শরীর ভাল না। অক্সিজেন সাপোর্ট লাগে সারাক্ষণ। ফুরোলে নিজেই নল বদলে ফেলে। বাতিল সিলিন্ডার নীচে ফেলে দেয়। কয়েকটা জমলে আবার ফ্রেস মাল চলে আসে। ওপর থেকে ময়লা ফেলা অনেকের স্বভাব। ‘কী সাংঘাতিক, কারুর মাথায় পড়লে?’ ‘সেটা অন্য ব্যাপার। আচ্ছা, ওইদিকে দ্যাখো।’ একটা নিরীহ দোকান, সামনে কিছু গমের বস্তা। ভেতরে আটা পেষাইয়ের মেশিন ঘুরছে। ‘এখানে যা তৈরি হয় বলে ভাবছ তা নয়। আটটার মধ্যে একটা বস্তায় অন্য মাল থাকে। পিষলেই ডেঞ্জার।’ চুপ করে রইলাম। আর একটা দোকানের সাইনবোর্ড দেখাল। বেশিরভাগ অক্ষর খসে গেছে। ওপরের লাইনে প্রথমে একটা ‘ঘো’ আর শেষে ‘সন্স’-টা রয়েছে। বুঝেছি, ‘ঘোষ’। পরের লাইনে ‘ওয়া’ আর ‘জু’। ‘আরে বাবা, একটু মাথা খাটাও! ওয়াচমেকার্স অ্যান্ড জুয়েলার্স। ওই যে সন্স দেখছ, ওদের নিয়ে বেজায় অশান্তি।’ ধুলোভরা শো-কেসের পেছনে পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক বই পড়ছেন। এরপর একটা পুরনো বাড়ি। দু’পাশে রোয়াক, মাঝখানে হাট করে খোলা ঢোকার দরজা। ওপরে আধ চাঁদা রঙিন কাচ লাগানো ফ্রেম। কয়েকটা ভাঙা। ভেতরে হাফ দরজা, সুইং ডোর। দু’পাশে দু’সারি বন্ধ জানলা। ওপরে ঝুলবারান্দা। ‘উকিলবাড়ি। বাঁ-দিকে চেম্বার। ডান দিকে বসার ঘর। চাইলে তুমিও বসতে পারো।’ ‘অন্যের বাড়িতে?’ ‘বললাম তো, যে কেউ বসতে পারে!’ এরপর দু’দুটো তিনতলা বাড়ি। একরকম দেখতে। তবে রং আলাদা। যদিও জ্বলে গেছে অনেকটাই। সিমেন্টের ওপর সিমেন্ট দিয়ে দুটোরই দোতলার বারান্দায় লেখা আছে ১৯৩২। ‘এদিককার প্রথম পাকা বাড়ি। যখন হয়েছিল, তখন বারান্দায় বসে দেখা যেত, বাঘ জল খাচ্ছে ওই নালায়। কিন্তু সেটা আসল ব্যাপার নয়, কী, দেখলে কিছু?’ কিছুতেই কোনও দ্রষ্টব্য খুঁজে না পাওয়ায় আমার লোক বেজায় খেপে গেল। খামচে ধরে আমাকে দাঁড় করাল দুটো বাড়ির উলটো ফুটপাথে, ঠিক মাঝখানে। ‘গ্যাপ দেখো বাপ! গ্যাপ!’ সত্যিই তো, দুটো বাড়িই হেলে মাথায় মাথায় ঠেকে গেছে। বেশ কয়েক মাস আছি, এসব চোখে পড়েনি কখনও। আবার এটাও ঠিক যে, এসব দেখে আমার কোনও লাভ হত না। বরং বাসিন্দাদের সম্পর্কে কিছু জানা গেলে কাজে লাগত। মনের কথা বুঝে ফেলে লোকটা বলল, ‘কীসের এত তাড়া?’
‘এই রে, দেরি হয়ে গেল’ বলে চলে যাওয়ায় সেদিন আমি অবাক হইনি। কয়েকদিন গেল। রাতে রুটি নিয়ে ফেরার পথে দেখি পা ঝুলিয়ে বসে আছে পুলের পাঁচিলের ওপর। আমাকে দেখে কিছু বলল না। আমিও চুপচাপ পাশে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ গেল। হঠাৎ, ‘ওই আসছে’ বলে তড়িঘড়ি কোথাও একটা চলে গেল। স্বাধীন পার্কের দিক থেকে একটা কেঁদো গাড়ি গুড়গুড় করে এগিয়ে এল হেডলাইট জ্বেলে। পুলে কিছুটা উঠে থামল। সামনের কাঁচ নামল। কালো চশমা পরা একজন লোক আমাকে দেখিয়ে পিছনে কাউকে কিছু বলল। কাচ উঠে গেল। গাড়ি ব্যাক করে মুখ ঘুরিয়ে কিছুদূর গিয়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার মন বলছিল, ওই গাড়ি না বিদায় হলে এ আসবে না। একটু বসে, রুটির মধ্যে আলুর তরকারি ভরে রোল করে খেয়ে বাড়ি চলে গেলাম। এর মধ্যে আটা ভাঙানোর দোকানের লোকের সঙ্গে একটু আলাপ হয়েছে। তার কাছে খোঁজ নিলাম। সে বুঝতেই পারল না কার কথা বলছি। অস্বাভাবিক ব্যাপার। সূত্র পেলাম কিছু দূরে ওপরে পান-সিগারেটের দোকান, তলায় মুড়ি, বাদাম, চিঁড়ে, ছোলা বিক্কিরি করে একটা লোক, তার কাছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে নীচু হয়ে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল। ‘ভেতরে আসুন না’ বলায় একটু কসরত করে সেঁধিয়ে গেলাম সেখানে। যেখানে বসলাম, তা রাস্তার লেভেলের একটু নীচে। ওখানে আরও জায়গা আছে। মোমবাতির আগুনে বাদামের প্যাকেট সিল করতে-করতে দোকানদার বলল, ‘ও এসবের কী জানে? যা হোক বলে দিলেই হল? নতুন এসেছেন। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন।’ একটা আধা-অন্ধকার, ঠান্ডা বাঙ্কারে বসে সাপের দৃষ্টিকোণ থেকে রোদমাখা, আধা-ব্যস্ত পাড়াটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এই দেখা আর আগের দেখা আলাদা। এই লোক আর সেই লোকও যে আলাদা হবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কোথা থেকে যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া আসছিল। আকাশে কি মেঘ করেছে? ‘আপনি বসুন, অসুবিধা নেই। বৃষ্টি হবে। থামলে বেরোবেন। আমি ভেতর থেকে একটু আসছি।’ লোকটা কোথায় গেল মুখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম না।
‘অল ক্লিয়ার, এখন আর কোনও অসুবিধে নেই।’ ব্রিগেডে হওয়া খাচ্ছিলাম। চেনা গলা। যাক। সেদিন আমার একটু ভয়ই করছিল। কোনও প্রশ্ন নয়। ‘আর কদ্দিন টেকা যাবে জানি না। যে-রেটে ধরপাকড় চলছে, ময়দানে ম্যারাপ বেঁধে জেল না বানাতে হয়। ভিআইপি ক্রিমিনালগুলোকে একটা ফানেল দিয়ে ওই বেয়াল্লিশের বাড়িটার মধ্যে ঢেলে দিলেই ব্যাস! তোমার অসুবিধে নেই। যাক গে, বাকি কাজটা সেরে ফেলতে হবে।’ এই প্রথম ওর গলায় একটু ক্লান্তি টের পেলাম। সেই খেলা, একবারই দেখেছিলাম। আর দেখিনি। লোকটা কী করে, কোথায় থাকে, আমার সঙ্গেই বা কেন কথা বলে, এর একটারও উত্তর আমার কাছে নেই। অপেক্ষা করতে রাজি আছি। আজ পর্যন্ত ওকে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ হয়নি। বিস্ময়, সম্ভ্রম জেগেছে। তার প্রধান কারণ, আমার মনের মধ্যে কী প্রশ্ন ঘুরছে ও টের পায়। সরাসরি উত্তর দেয় না ঠিকই কিন্তু যা বলে তার মূল্য অনেক। এইমাত্র বলল, ‘দোলপূর্ণিমার রাত হলে একটা জিনিস দেখাতাম। লাল চাঁদটা ওঠে ওই দুটো বাড়ির ঠিক মাঝখান দিয়ে। তারপর একটু সাদা হয়ে আস্তে-আস্তে ঠেকনায় পৌঁছয়। অমনি শুরু হয় ক্যাচাল। এদিকের লোক মারামারি শুরু করে দেয় ওদিকের সঙ্গে। হাতে চাঁদ পেয়ে কেউ ছাড়তে চায় না। মাল কিন্তু স্লিপ করে বেরিয়ে যায়। প্রত্যেক মাসে এই ঝামেলা লেগে থাকে। ভাল্লাগে না।’
‘আটার দোকানের মালিকের আসল ব্যবসা পেটো মশলার। বোমাবাজরা কেনে। সব পার্টির রেগুলার লাগে। তাই পুলিশের সমস্যা নেই। আমার ভয় অন্য, দোকানটা দুম করে উড়ে না যায়!’ অবিশ্বাস করলাম না। এই মুহূর্তে আমার কাছে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং হল উকিলবাড়ির বসার ঘর। ‘যাব তো, এখন জাস্ট বলছি। ধরো কেউ কারুর সঙ্গে শান্তিতে একটু কথা বলে নিতে চায়। বা কয়েকজনের একটা জরুরি আলোচনা সেরে ফেলা দরকার। একটা কোয়ায়েট জায়গা পাবে কোথাও? না। এই সেই জায়গা, উকিলবাবু অ্যালাউ করেছেন। বিশ্বাস হচ্ছে না তো, ওকে, আগামীকাল দুপুরে, কেমন?’ পরদিন দুপুরে ভয়ংকর রোদে ওই বাড়ির সামনে আমাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে ‘খালি দেরি হয়ে যায়’ বলে আমাকে ডেকে নিল। ছায়াধরা আসছিল রাস্তায় চোখ রেখে। তাকে কী একটা নির্দেশ দিয়ে ‘এসো, এসো’ বলে আমাকে নিয়ে ডান দিকের ঘরে ঢুকে পড়ল। ঝপ করে অন্ধকার। চোখ সইতে দেখি এদিক-ওদিক কিছু ফোল্ডিং কাঠের চেয়ার। আগেকার বিয়েবাড়িতে খাবার জায়গায় দেখা যেত। একদিকে কয়েকজন চাপা গলায় গুজগুজ করছে। ঘরের কোণে চৌকিতে বসে একটা ছোট ছেলে লেখাপড়া করছে। সব জানলা প্রায় বন্ধ। ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু আলো আসছে, তা যথেষ্ট। আমরা দুটো চেয়ার টেনে বসে গেলাম। অন্যরা মাথা দিল না। ‘একটাই কন্ডিশন, হাফ দরজা পেরোনো চলবে না।’ একটু পরে জানলায় দুটো টোকা পড়ল। আমার লোক উঠে গিয়ে একটা পাল্লা সামান্য ফাঁক করে দুটো চা ঢুকিয়ে নিল। ‘যে চা খাবে, সে বাইরে বলে আসবে, দিয়ে যাবে। এটাই নিয়ম। নাও। কী, বিশ্বাস হল? তবে হ্যাঁ, মদ-ফদ খেয়ে ল্যাপটা-ল্যাপটি করার কথা কেউ যেন স্বপ্নেও না ভাবে।’ শুনলাম আর একটা বাড়ির ঘটনা। সেই বাড়িটা নাকি আমাকে দেখাবে না! বাংলাদেশ থেকে পাচারকারীদের হাত গলে একটা মেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন সহৃদয় লোক তাকে রিলে করে কলকাতায় ঢুকিয়ে দেয়। পাড়ার একজন তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আশ্রয়ও। মেয়েটা বেরোয় না। এভাবেই চলছে। আধো-অন্ধকারে শুনতে ভালই লাগছিল। বলা-কওয়া নেই, দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল একটা লোক। হাতে ধুনুচি, গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ঝিমধরা গন্ধ। ঘরে কে আছে না আছে তার জানার দরকার নেই। সর্বত্র তাল-তাল ধোঁয়া গুঁজে ঘর একদম ছাই-ঘুলঘুলে করে সে চলে গেল। আমরা কিছুক্ষণের জন্য কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যেই শুনলাম পরের ঘটনাটা। এই পাড়াতে একটা বাড়িতে গোপন বৈঠক বসে। অল্টারনেটিভ অমাবস্যায়। কী যেন সোসাইটি, নাম আছে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত, নামী অনেকেই আসে। আর্টিস্ট, আমলা, শিল্পপতিরা। মহিলারাও, সম সংখ্যায়। ধ্যান, স্তোত্রপাঠ, মন্ত্রোচ্চারণ, আধ্যাত্মিক ব্যাপার-স্যাপার চলে। সবাই মুখোশ পরে থাকে। কিন্তু বাকি জামাকাপড়ের অনুমতি নেই। এই অবধি শুনে আমি যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। বাড়াবাড়ি রকমের গুল মারা হচ্ছে ধরে নিয়ে একটু রেগেও গেলাম। মুখে কিছু বললাম না। আমাকে দেখে সে বুঝল সেটা। চালু মাল। বলল, ‘তোমার অসুবিধে কোথায়? খুব কমন ব্যাপার। কিউব্রিকের ছবি দেখলে বুঝতে পারবে। কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। বা, চিনলেও মাথা দিচ্ছে না। দুনিয়াসুদ্ধ লোক ন্যাকা সেজে আছে। তুমিও আছ। আমিও আছি। অথচ একটা ভাললাগার ব্যাপার আছে। সবাই, নো কন্ডিশন অ্যাপ্লায়েড, নিজেকে মেলে ধরছে, ক্লিয়ার? মুনিঋষিরা বসনভূষণ ত্যাগের কথা কবে থেকে বলে আসছে। তা, সেটাই তো করছে সবাই। অন্যায়টা কী?’ ‘কেউ ঝামেলা করে না?’ ‘না। সবাই ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক। কোনও চ্যানেল এখানে ঢুকে অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদনের চেষ্টা করেনি। করলে এই সোসাইটি এক রাতের মধ্যে ওদের পাঁক নালায় কচুরিপানা করে দেবে। জানে সবাই। আমরা তো আসলে সবই জানি। ধোঁয়া দিয়ে মাঝে মাঝে একটু অস্পষ্ট পরিস্থিতি তৈরি করি। তবে, ভাল দিকও আছে। কিছু মশা মাছি মরে যায়।’ এসব আমাদের পাড়ার কোন বাড়িতে ঘটে জানার সাংঘাতিক আগ্রহ তৈরি করিয়ে শেষে মই সরিয়ে নেওয়াটা ঠিক নয়। অন্যায়। অসভ্যতা। নির্লিপ্ত মুখে বললাম, ‘আর কিছু?’ হেসে বলল, ‘খুব চটেছ দেখছি। আচ্ছা ঠিক আছে, আর একদিন হবে।’
একটা ডিসিশন নিলাম। ঝুলিয়ে দেব ব্যাটাকে। বড্ড বেড়েছে। ট্যালেন্টেড। কিন্তু ধান্দাবাজ, খারাপ। আমাকে এভাবে ল্যাজে খেলানোর কোনও যুক্তি নেই। তাছাড়া এসব গোপন ব্যাপার লিক করে চলেছে। এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা তো বটেই। অলরেডি লোক লেগেছে ওর পেছনে, লুকোতে হচ্ছে। অন্য কেউ কাউন্টার ভরসা দিলে হয়তো ফের রাস্তায় ঘুরছে। আমি কি কিছু বুঝি না না কি? এর সাংঘাতিক শাস্তি হোক। কোর্ট কেস নয়। প্রতিশোধ চাই। পাড়ার কেউ ওকে মান্যতা দেয়নি, এখনও পর্যন্ত। পাতালঘরের বাদামওয়ালার সঙ্গে কথা বলা দরকার। বোমা-মশলার কারবারিকেও কনফিডেন্সে নিতে হবে। আর, খুব সাবধানে, খুঁজে বের করতে হবে ঠিক কোথায় ওইসব কাণ্ড হয়।
ক’দিন ধরেই দেখছি পাড়ায় মোটরবাইকের দৌরাত্ম্য খুব বেড়েছে। বিশেষত রাতে। আজকাল পুলের রেলিঙে বসে রুটি-আলু খেয়ে অন্ধকারে প্লাস্টিক ফেলে দিই। অনেক রাত অবধি বসে থাকি। নীচের স্লো-মুভিং দুর্গন্ধে এক ধরনের নেশা হয়। ওকে কম দেখি আজকাল। আসছে। পায়ে হেঁটে নয়। পিচের রাস্তায় বুক ঘষটে-ঘষটে। দূরে সেই গাড়ি, হেডলাইট নেভানো। ও ব্রিজে উঠতে চেষ্টা করছে। আমি রেলিঙের ওপর। খাওয়া-দাওয়া শেষ। আয়, আয়। আমার পায়ের তলায় পৌঁছে একটা ডায়ালগ দে দেখি। হয় বেদম মার খেয়েছে। পা বা শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। আমাকে দেখতে পেয়ে থামল। মুখ তুলে বলল, ‘মোটামুটি যা বলার বলে দিয়েছি কিন্তু।’ ও যদি পুল পেরোতে না পারে তাহলে গাড়ি চলে যাবে। পারলেও যাবে। দেখতে লাগলাম। একটু-একটু করে আমার সামনে দিয়ে পুল পেরোল সে। এই অবস্থার জন্য খুব একটা বিচলিত বলে মনে হল না। শুনলাম, বলছে, ‘তুমি কেন এ-পাড়ায় ঘাপটি মেরে আছ আমি কি জানি না না কি?’ কিছু বললাম না। দূরের ছ-বাতির মোড় দেখিয়ে বলল, ‘ওখানে রোজ একটা হাতরিকশা দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে নিও নিজের মতো। দুটো চাকা। অথচ একটা ছায়া। দু’চাকার ঠিক মাঝখানে। বেঁধে রাখে দুটোকে। তুমি ভাবতে থাকো, কেমন? বুঝতে পারলে সব কিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার গেম ওভার।’
ছবি এঁকেছন শুভময় মিত্র