দুশো হর্সপাওয়ারের সেডান হাঁকিয়ে কাগয়ু বিফ কিনতে চলেছে হ্যারি অরোরা। মহল্লার নতুন মলে এখন ওই জাপানি মাংস তো পাওয়া যায়ই, সঙ্গে মিলবে ঝাঁঝালো ওয়াসাবি, ক্যালিফোর্নিয়ান রেড্স, ইতালিয়ান ফ্যাশন-গুরুর ব্র্যান্ডেড কুমিরের চামড়ার জুতো। সেই জুতো পরে এবড়োখেবড়ো রাস্তা বেয়ে সে যাচ্ছে অজিতের টাওয়ার ব্লক এপার্টমেন্টের দিকে। ঝাঁ-চকচকে কমপ্লেক্স, গেটের মুখে লাঠিধারী জোড়া পালোয়ান, কিন্তু অ্যাপ্রোচ রোডটা গর্তে ভরা চন্দ্রপৃষ্ঠ। হয়তো পায়ে কুমিরের চামড়া থাকায় তার ভ্রম হয়, চাঁদে নয়, জলের ওপর ভেসে চলেছে।
রাত হলেই সাঁতরাবে ওরা। আট হাজার কিলোমিটার দূরের এক উদ্বেল-যৌবনা স্রোতস্বিনীর স্পর্শে শোধিত সোনালি স্বপ্নাবেশে ভাসবে দুই ইয়ার— ওদের মতো আরও অনেকে। ফ্রিস্টাইল, ব্রেস্টস্ট্রোক, বাটারফ্লাই, ব্যাকস্ট্রোকে… অজিতের পাঁচ হাজার স্কোয়ার-ফুটিয়া এই ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্ট ওদের দারু-আড্ডার ঠেক। ইনফিনিটি পুল, জাকুজি, ফেংশুই আর বাস্তুর চাটনি, কী নেই সেখানে। হ্যারিও ভাবছে বাপ-দাদাদের নড়বড়ে অট্টালিকাটি বেচে দিয়ে এরকম একটা অ্যাপার্টমেন্টে শিফ্ট করবে— ফ্যাশন এবং লাইফস্টাইলের যুগলবন্দি নাহলে জীবন তো অর্থহীন।
ফ্যাশন আর লাইফস্টাইল শব্দদুটিকে চিনে নেওয়া জরুরি। পৃথিবীতে আজ কেন এত যোশীমঠ, কেন সর্বত্র হিমবাহদের পেট খারাপ, কী কারণে বারে বারে সমুদ্রে ফুঁসে উঠছে বিধ্বংসী আয়লা-ক্যাটরিনা, বাড়ছে দাবানলের প্রকোপ, কেন আজ চরাচরজুড়ে খরা, বন্যা, মহামারী আর আর্ত, বুভুক্ষু, পরিযায়ী মানুষের হাহাকার, পশুপাখির আর্তনাদ? কোন কালো-জাদুবলে চেনা পৃথিবী ক্রমেই হয়ে উঠছে দান্তের ইনফার্নো-সম?
চিৎসাঁতার, ফ্রি-স্টাইল, ব্রেস্টস্ট্রোক, বাটারফ্লাই! তবে কি ওই গা-ভাসানো মোহ, ওই লোভ, আকাঙ্ক্ষা, লাক্সারি, লাইফস্টাইল-মরীচিকার উদ্দেশে অন্ধ সাঁতার, শেষ করে দিচ্ছে পৃথিবীকে? সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু রোগমুক্তি কোন পথে? মোহ-আকাঙ্ক্ষার হাতছানির আড়ালেই যখন লুকিয়ে বিপদ, সমাধান-সূত্রও হয়তো রয়েছে সেখানেই।
হ্যারি অরোরার কথা ভুলে এবার তাকানো যাক অমলের দিকে। অমল আর তার স্ত্রী দুজনেই মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। স্ত্রী এবং পুত্র নিয়ে অমলের ছোট পরিবার। সঞ্চয়ের টাকা আর কিছু লোন নিয়ে একচিলতে ফ্ল্যাট কিনেছে শহর-প্রান্তে। অমলদের কোনও ফ্যাশন নেই, নেই ব্র্যান্ড-প্রীতি। পুজোর সময়ে আর পয়লা বৈশাখে লোকাল মার্কেট থেকে দু’চারটে জামাকাপড় কেনে, সেগুলো দিয়েই সারা বছর বেশ চলে যায়। জিন্স ছিঁড়ে গেলে আলাউদ্দিন দর্জির কাছে সারিয়ে নেয়, টেলিভিশন খারাপ হলে যায় টিভির ডাক্তারের কাছে, আর বাড়ির নীচে বসা রামপ্রসাদ তো ওদের জুতো আর ব্যাগ সারিয়ে-সারিয়েই একটা ইলেকট্রিক-স্কুটার কিনল। অমল আজও বেড়াতে যায় ট্রেনে চেপে, প্লেন তার প্রয়োজন হয় না। আর মোবাইল ফোন? সহকর্মীরা নিরামিষ খেয়ে ইনস্টলমেন্টে আইফোন কিনছে দেখে সে মনে-মনে হাসে।
অমল আনফ্যাশনেবল, বোরিং, আনকুল। তার লাইফস্টাইল নেই, নেই ব্র্যান্ড-প্রীতি বা চকচকে সিডানের অ্যাকসিলারেটর চাপার লোভ। কেন সে সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়ায় আর মেট্রোতে যাতায়াত করে? তাহলে কি সাঁতার কাটতেই শেখেনি সে? পাশের বাড়ির গদামবাবুর মতো পাহাড়ের কোলে একটা ছোট জমি তো কিনতেই পারে? তবে কি সে প্রকৃতিপ্রেমী নয়?
ব্যাঙের ছাতার মতো এইসব প্রশ্ন অমলের চিন্তাজগতকেও ছেয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু সে বিচলিত হয় না। কারণ গোপনে, ভীষণ গোপনে, সে নিজেকে ফ্যাশনেবলই মনে করে। সে বিশ্বাস করে, পৃথিবীর এই সংকটকালে সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়ানো সভ্যতার লক্ষণ, ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়ের নেশাকে সে শিশুসুলভ মনে করে, ট্রেনের মজা সে প্লেনে পায় না, অযথা অপচয় আর কৃত্রিমতায় ভরা বিলাসবহুল জীবনকে সে অবজ্ঞার চোখে দ্যাখে। ওই অন্ধ সাঁতারুদের দেখে ওর হাসি পায়, আবার করুণাও হয়।
এ তো শুধু ওই অমলের কথা নয়। দুনিয়ার এপার থেকে ওপার, আলাস্কা থেকে সান্তিয়াগো, সাইবেরিয়া থেকে এর্নাকুলাম— সর্বত্র ক্রমেই সচেতন মানুষ বুঝতে শিখছেন যে, পৃথিবীর অসুখ সারানোর ব্যাপারে তাঁদের দায়িত্ব কিছু কম নয়। গ্রেটা থানবার্গের মতো ক্লাইমেটকর্মী নিজে পালতোলা জিরো-কার্বন বোটে অতলান্তিক পেরিয়ে এটাই বলতে চেয়েছেন যে, কার্বনসর্বস্ব জীবনযাত্রা, প্লেন, গাড়ি, এয়ার-কন্ডিশনার আর সেন্ট্রাল হিটিং-এর অভ্যাস ছাড়তে না পারলে উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ এলাকা শীঘ্রই বাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।
একটি হিসেব অনুযায়ী, প্লেনের বদলে ট্রেনে চড়লে যাত্রীর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ প্রায় ৪০ শতাংশ কম হয়। হিসেব করে এও দেখা গেছে যে, মাংসের বার্গারের বদলে উদ্ভিদজাত মাংসের (plant-based meat) বার্গার তৈরির প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ কম। পরিবেশের উপর ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির প্রভাবও কিছু কম নয়। একটি জিন্স বানাতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার লিটার জল খরচ হয়। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, বছরে প্রায় ৬২ থেকে ৭৩ শতাংশ ব্যবহার করা জামাকাপড় এবং টেক্সটাইল বর্জ্য পদার্থ হিসাবে ফেলে দেওয়া হয়, পরিবেশের উপর যার প্রভাব ভয়াবহ।
মন্থর গতি হলেও গাড়ি-ঘোড়া ব্যবহার থেকে ফ্যাশন, বিদ্যুতের অপচয় থেকে খাদ্যাভ্যাসে, সচেতন মানুষ নানারকম পরিবর্তন আনতে শুরু করেছেন। পরিবেশ সচেতনতা এবং উষ্ণায়নের পৃথিবীতে ভিগানদের (vegan) সংখ্যাও দিনে-দিনে বেড়েছে। ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার একটি নিবন্ধ অনুযায়ী, ২০২১ সালে পৃথিবীতে ভিগানদের সংখ্যা প্রায় ৭৯ মিলিয়ন এবং ২০২৬ সালে ভিগান খাদ্যের বাজারের আয়তন হবে আনুমানিক ২০.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাশাপাশি, দূর দেশ থেকে তেল পুড়িয়ে নিয়ে আসা খাবার-দাবার বর্জন করে দলে দলে লোকাভোরেরা (locavores)— যাঁরা শুধু নিজের এলাকায় উৎপন্ন খাবার খান— উষ্ণায়নের সঙ্গে মোকাবিলা করার আরেকটি পথ দেখিয়েছেন। অন্যদিকে দামি ব্র্যান্ডের ফ্যাশন পরিত্যাগ করে বহু মানুষ রিসাইকেল্ড জামাকাপড় এবং সাসটেনেবল ফ্যাশনের দিকে ঝুঁকেছেন এবং সেই কারণেই অ্যাডিডাস-এর মতো ব্র্যান্ডও ২০২১-এ প্রায় ৫৪% রিসাইকেল্ড জুতো-জামাকাপড় বানিয়েছে।
ইউরোপের কিছু দেশে ‘নো-ফ্লাই’ মুভমেন্ট এবং ‘ফ্লাইট-শেমিং’— হয় স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে, নয় লজ্জায় ফেলে প্লেনে চড়ার অভ্যাসের সঙ্গে উষ্ণায়নের সম্পর্ক বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে। এই ‘shame’ বা লজ্জা শব্দটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ— যখন আমরা ফ্যাশন বা লাইফস্টাইলের কিছু-কিছু জিনিস বা অভ্যাস লজ্জায় বা সচেতনতার কারণে বর্জন করতে পারব, তখন উষ্ণায়ন এবং আনুষঙ্গিক সংকটের মোকাবিলা করা অনেকটা সহজ হবে।
এইসব তথ্য পরিবেশন করার উদ্দেশ্য কোনওভাবেই সাধারণ ক্রেতার ওপর পরিবেশকে বাঁচানো এবং পোষণযোগ্যতার (sustainability) দায় পুরোপুরি চাপিয়ে দেওয়া নয়। এই দায় শিল্প ও বাণিজ্যের সংস্থাগুলির এবং প্রথম বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলির ওপর অনেকটাই বর্তায়। এ-কথাও ঠিক যে, সামগ্রিক (সিস্টেমিক) কিছু পরিবর্তন ছাড়া উষ্ণায়ন এবং অন্যান্য বিশ্বব্যাপী সংকটের মোকাবিলা করা অসম্ভব। শুধু মানুষকে প্লেনে কম চড়তে বললেই হবে না, পাশাপাশি ট্যাক্স বা অন্য উপায়ে এয়ার-ট্র্যাভেলকে কম আকর্ষণীয় করতে হবে। এই কারণেই ইংল্যান্ডের ‘এক্সটিঙ্কশন রেবেলিয়ন অ্যাক্টিভিস্ট’রা হিথরো এয়ারপোর্টে শুয়ে পড়ে নতুন রানওয়ে বানানোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন, আবার লন্ডন শহর কনজেশন চার্জ (congestion charge) আরোপ করে গাড়ি ব্যবহার এবং পলিউশনের মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু তার মানে এও নয় যে, আমরা ড্যাং ড্যাং করে নেচে বেড়াব আর বেআব্রু ভোগবাদ বা কন্সপিকিউওয়াস কনসাম্পশনের (conspicuous consumption) জয়ধ্বনি দেব, আর সুযোগমতো জেফ, এলনদের রকেটে চেপে মার্সে ফুড়ুৎ হওয়ার স্বপ্ন দেখব। এই শিশুসুলভ আচরণ ত্যাগ করতে না পারলে পৃথিবীর অসুখ সারবে না।
রোগমুক্তির পথে বড়-ছোট প্রত্যেকটি চরিত্রের কিছু ভূমিকা আছে। অমলের মতো মানুষের সরাসরি অবদান ছাড়াও প্রতীকী ভূমিকাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। দরকার শুধু একটা ম্যাজিকের।
অমলদের এই যাপন যেদিন কোনও জাদুবলে বহু মানুষের কাছে ফ্যাশন হবে, সেদিন আমরা কয়েক ধাপ এগিয়ে যাব পৃথিবীর অসুখ সারানোর লক্ষ্যে। ফ্যাশনের সুবিধা হল, সে সর্বদাই পুরনোকে ছুড়ে ফেলে দিতে প্রস্তুত। রোলাঁ বার্থ-এর কথায়, ‘Fashion is a refusal to inherit, a subversion against the oppression of the preceding Fashion…’
ওই হ্যারি অরোরার লাইফস্টাইলকে ছুড়ে ফেলে মানুষ ইচ্ছে করলে কালকেই অমলকে স্টাইল-আইকন বানাতে পারে। এবং আমরা দেখেছি এই ধরণের অমলদের সংখ্যা এবং তাদের জীবনযাপন নিয়ে কৌতূহল সারা পৃথিবীতে বাড়ছে। সেই কারণেই তো স্লো লিভিং, সাসটেনেবল ফ্যাশন, লোকাভোর, ভিগান লাইফস্টাইল ইত্যাদি নিয়ে এত গবেষণা, এত লেখালেখি।
ফরাসি দার্শনিক বদ্রিয়ার-এর মতে, পণ্যের একটি ‘সাইন-ভ্যালু’ আছে, অর্থাৎ ব্যাবহারিক বা বিনিময়-মূল্যের বাইরেও এর সঙ্গে একরকম প্রেস্টিজ এবং দেখনদারি জড়িয়ে থাকে। তুমি এই সিডান চড়ছ, অতএব তুমি কেউকেটা। কিন্তু এই সাইন বা ইঙ্গিতের অঙ্কটি নিঃশব্দে, উলটোদিক থেকেও বদলে ফেলা যায়। যেদিন কাতারে-কাতারে মানুষ অমলকে স্টাইল-আইকন বলে অনুসরণ করতে শুরু করবে, তখন বাইসাইকেলের সাইন-ভ্যালু ছাপিয়ে যাবে পেট্রল পোড়ানো সিডানকে। সেদিন আমরা হব সত্যিকারের পরিবেশপ্রেমী, সেইদিনটি হবে ভোগবাদ এবং কন্সপিকিউওয়াস কনসাম্পশন-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।
অলীক কল্পনা বা আষাঢ়ে গল্প নয়। দেশে-বিদেশে যেসব মানুষ অমলের মতো অল্টারনেটিভ যাপনকে বেছে নিচ্ছেন, তাঁরা সবাই অ্যাক্টিভিস্ট বা পরিবেশকর্মীও নয়। কিন্তু পৃথিবীর অসুখ, ক্লাইমেট চেঞ্জ, হাজারে-হাজারে প্রজাতির বিলুপ্তি, প্লাস্টিক পলিউশন— এই সমস্ত ব্যাপারে তাঁরা সচেতন। আমরাও চেষ্টা করলে পারব এই অল্টারনেটিভ জীবনধারাকে ফ্যাশনেবল করে তুলতে। তবে এই কাজে হয়তো আমাদের সেলেব্রিটিদের দরকার হবে। যে-সেলেব্রিটিরা আজ বেআব্রু ভোগবাদের আর লাইফস্টাইলের মন্ত্র কোটি-কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁরাই কাল ঘুরে দাঁড়িয়ে অমলের জীবনযাত্রাকে স্টাইল স্টেটমেন্ট করতে পারেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আর কার্বন-কর্মের বোঝামুক্তির পথ দেখিয়ে তাঁরাই হতে পারেন ম্যাজিশিয়ান, চ্যাম্পিয়ন্স অ্যান্ড চিয়ারলিডার্স ফর আ বেটার টুমরো। এই পরিবর্তনের ফল পেতে সময় লাগবে না বেশিদিন, পৃথিবীর রোগমুক্তির ইঙ্গিত দ্রুত মিলবে এবং সেই কারণেই হয়তো ফ্যাশনের ক্ষণস্থায়িত্ব এই নতুন যাপনকে সহজে গিলে খেতে পারবে না।