কাতারে শেষ দিন
আমরা শেষ খেলা দেখলাম আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনাল। তার পরের দিনই হয়তো দেশে ফিরে আসতে পারতাম কিন্তু সেমিফাইনাল দেখে এত রাতে হোটেলে ফেরা, ক্লান্ত থাকব কিনা, কখন ফিরব হোটেলে— এ সব ভাবনা-চিন্তা করে কাতারে আরও এক দিন কাটিয়ে তার পরের দিন আমরা ফিরলাম।
সেই দিনটা আমাদের কাছে ছিল নির্ভেজাল ছুটির দিন। আমরা ব্রেকফাস্ট শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য মিউজিয়াম অফ ইসলামিক আর্ট। এই জায়গাটা এত সুন্দর, কী বলব! মিউজিয়াম ছাড়া, মিউজিয়ামের প্রাঙ্গণটা এত সুন্দর, এত বড় যে চোখ জুড়িয়ে যায়। চারদিকে গাছপালা, জল, কয়েকটি মিউজিয়াম স্টোর। বেশ পার্কের মতো ডিজাইন করা। অনেকটা হেঁটে হেঁটে মিউজিয়ামে পৌঁছতে হয়। কিন্তু এত সুন্দর করে সাজানোগোছানো যে কেবল মিউজিয়ামটা দেখাটাই একমাত্র দর্শনীয় নয়, একটা মিউজিয়ামের চারপাশকে এত সুন্দর করে রেখেছে যে ওই জায়গাটায় সময় কাটাতে খুব ভাল লাগল।
কাছাকাছি পৌঁছে খুব ভাল করে আমরা মিউজিয়ামের আর্কিটেকচারটা দেখলাম, মিউজিয়ামের স্টোরগুলোয় গেলাম। যে স্যুভেনিরগুলো পাওয়া যাচ্ছিল, তার মধ্যেও একটা আর্ট লুকনো আছে। অবশ্য, সেটা পৃথিবীর সব মিউজিয়াম স্টোরের স্যুভেনিরেই থাকে। সেই সব কেনাকাটা করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মিউজিয়াম চত্বর থেকে।
হাঁটতে শুরু করলাম। এই হাঁটাটা আমাদের কাছে কনস্ট্য়ান্ট ছিল গোটা কাতার সফরে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা গেলাম শুক-ওয়াকিফ। বলা যেতে পারে ওখানকার নিউমার্কেট। ওখানে আমরা আগেও গেছিলাম, কিন্তু এ বার তার একটা অন্য রূপ দেখলাম। আমরা যখন পৌঁছলাম তখনও বিকেল। ফলে ওখানকার মস্ক, ওখানকার আর্কিটেকচার আরও ভালভাবে নজরে পড়ল। আর চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে মরক্কোর ফ্যান হাঁটছে। যেদিকে তাকাই শুধু মরক্কোর সমর্থক। বোধহয় একটা আরব-ব্রাদারহুডও কাজ করছিল। মুসলিম আর আফ্রিকার একটা দেশ, আবার আরব-লিগের অন্তর্গত—সব মিলিয়ে বহু মানুষ চাইছিল ওরা জিতুক। মেসির রূপকথাও যেমন অনেকে চেয়েছে, ফরাসি রূপকথাও যেমন অনেকে চেয়েছে তেমনি আবার মরক্কোন রূপকথাও বহু বহু মানুষ চেয়েছে।
সেই উন্মাদনার মধ্যে হেঁটে হেঁটে গিয়ে আমরা পৌঁছলাম একটা সিরিয়ান রেস্তোরাঁয়। নাম দামাস্কা ওয়ান। এই রেস্তোরাঁর কথা আগে থেকে আমাদের এক বন্ধু জানিয়েছিল। রেস্তোরাঁর গড়ন কিন্তু ইউরোপীয় ধাঁচের। ফুটপাথের ওপর টেবিল-চেয়ার পাতা। আগে কখনও সিরিয়ান খাবার খাইনি। এবং প্রচন্ড খিদের মুখে যে খাবার খেলাম, তা অপূর্ব। যে খাবারের কথা সবচেয়ে আগে বলব, সেটা হল রুটি। অমন ফোলা, সুস্বাদু রুটি আমি খাইনি আগে। রুটিটা মোটা, অথচ নরম এবং ফোলা, এবং লুচির মতো ফোলা। এবং শুধুই খেয়ে নেওয়া যায়, সঙ্গে কিছু না হলেও হয়, এত ভাল খেতে। গোটা কাতার সফরে এই সিরিয়ান খাবার ছিল সেরা খাবার। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ফের শুক-ওয়াকিফ চষে হোটেল ফিরলাম মেট্রো করে। পরের দিন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরব।
ফ্লাইট ছিল সকাল আটটায়। আমায় বেরোতে হয়েছিল সকাল সাড়ে-পাঁচটা নাগাদ। এইখানে কাতারের উবার ব্যবস্থার কথা বলতেই হয়। ঠিক এক থেকে দু মিনিটের মাথায় উবার ডাকলেই চলে আসে। একবার জিজ্ঞেস করে না গন্তব্য কোথায়। ব্যবস্থা এতই ভাল যে হোটেল থেকে আমায় বলল উবার ডেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার কথা। আমি সাড়ে পাঁচটায় উবার ডেকেছিলাম, কিন্তু উবার চলে এল ভোর চারটে বেজে একত্রিশ মিনিটে। একটা বিদেশ-বিভুঁইয়ে সময়ের আগে যদি ট্রান্সপোর্ট চলে আসে, এবং কোনও রকম ভাবনাচিন্তা করতে হয় না, টেনশন নিতে হয় না, এমনটা হলে অনেকটা ভরসা জাগে মনে। আমাদের দেশে কেন এমনটা হয় না, তাই ভাবছিলাম।
এয়ারপোর্ট পৌঁছে ইমিগ্রেশন থেকে শুরু করে চেকিং, সব কিছু এত সহজ ভাবে হয়ে গেল যে কোনও কিছু নিয়ে টেনশন করার আগেই দেখলাম সিকিউরোটি চেক করে নির্দিষ্ট গেট-এ পৌঁছে গেছি।একদম সুষ্ঠু ভাবে, প্রায় মেকিনিক্যাল প্রিসিশনে পুরো ব্যাপারটা হয়ে গেল। এসে পৌঁছলাম মুম্বই। এবং ঝামেলার শুরু। ইমিগ্রেশন, চেকিং সব কিছু ঝঞ্ঝাটের। প্রতিটি কাউন্টারের সামনে লাইন, প্রতিটি লাইনে অন্তত ৪০ মিনিট করে দাঁড়াতে হচ্ছে। লোকজন বিরক্ত, তিন বার করে চেকিং। একই ব্যাগ চেক হচ্ছে অন্তত বার পাঁচেক। যেন হেনস্থাটাও আমাদের এয়ারপোর্ট সিস্টেমের একটা পার্ট। আমি বুঝি না যে আমাদের সব এয়ারপোর্টেই কি কাজ করার লোকজন কম, না কি যাত্রী বেশি? কোনও জায়গাতেই কোনও কিছু স্মুদ না। সব জায়গায় একটা করে ঝামেলা লেগেই থাকবে। এতে মেজাজটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। ভ্রমণের আনন্দটা কিছুটা হলেও তেতো হয়ে যায়।
ফিরে এসে ফাইনাল ম্য়াচ দেখা টেলিভিশনে, এত বছর ধরে ওয়ার্ল্ডকাপ যে ভাবে দেখে এসেছি আর কী! কিন্তু এই যে মাঠে খেলা দেখার নেশাটা ধরে গেল, মনে হয় এটা প্রতি চার বছর অন্তর হাতছানি দেবে। আমিও চাইব, এই বিরাট মাঠগুলোয় ২২জনের দৌড় দেখতে, টানটান উত্তেজনায় মেতে উঠতে, মনে মনে কোনও কোনও একটা দলকে সাপোর্ট করব মাঠে, তারা হেরে গেলে মন খারাপ করব, তারা জিতলে হইহই করব। তবে মাঝে চারটে বছর অপেক্ষা। একটা লাগাতার ছটফটানি। মাঝের সময়টা দ্রুত কাটে না আস্তে, সেটাই দেখার।