ইন্টারভিউটা দিতে এসে সুব্রতর মনটা খারাপ হয়ে গেল। কীরকম অফিস কে জানে বাবা, সব উল্টো। শুধু সিক্সথ ফ্লোরে অফিসে ঢোকার গেটটাতে একটা দারোয়ান বসে তার মাথার কাছে দেওয়ালে লেখা ‘থার্টি টু বাই সিক্স।’ বাইরেটা চকচকে হলেও সেরকম লোকজন কোথায়? ভেতরে দুজন স্টাফ কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। সুব্রত অফিসে ঢুকতেই তাদের মধ্যে থেকে একজন এমন ভাবে দেখল, যেন কোন অপরাধ করে অফিসে সেল্টার নিতে গেছে। এই সব বিষয়গুলো দেখলে সুবতর মাথা গরম হয়ে যায়। তাও খুব শান্ত থেকে আস্তে-আস্তে জিজ্ঞেস করে, ‘আজ ইন্টারভিউয়ের জন্যে ডেকেছিল, আরম্ভ হয়ে গেছে?’
একজন ভদ্রলোক ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কোন পোস্টে কিছু জানেন?’
‘না, সেরকম কিছু তো জানি না। তবে…’
সুব্রতকে আর কিছু বলতে হয় না। ডান হাত তুলে ভদ্রলোক কিছুটা দূরে রাখা একটা সোফা দেখিয়ে বলেন, ‘ওখানে বসুন, ডেকে নেব।’
সুব্রত সেই জায়গায় বসে চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। পুরনো দিনের অফিসবাড়ি। দেওয়াল থেকে প্লাস্টার খসে গেছে, কিছু জায়গায় ইটের দাঁতখিঁচুনিও দেখা যাচ্ছে। অথচ বাইরেটা দেখে এইসব বোঝার উপায় নেই। সাধারণত অফিসের ভেতরটা খুব চকচকে থাকে, এখানে সব কিছু কেমন উল্টো। যাক গে, অত কিছু ভাববার দরকার নেই, বাইরে চাকরির অবস্থা ভাল নয়। সেটা হয়ে গেলেই মিটে যাবে।এর বেশি আর কিছু জানার কী দরকার!
কিছু সময় পর একটা বিচ্ছিরি রকমের শব্দ কানে এল। কিছু সময় চুপ করে বসে সুব্রত শব্দটাকে বোঝার চেষ্টা করল। কেউ কিছু চেবাচ্ছে, সেই রকমই আওয়াজ।
‘এত জোরে-জোরে আর কে চেবায় রে বাবা?’
সুব্রত ঘাড়টা উঠিয়ে সেই দুজনকে দেখবার চেষ্টা করতেই চমকে উঠল। আশ্চর্য! দুজন লোক টিফিন খাচ্ছে, অথচ এমন শব্দ হচ্ছে যেন টিন ভাঙছে, ওদের থেকে আসছে! সুব্রত ব্যাগ থেকে বোতল বের করে একটু জল পান করে ওই দুজনের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল অফিসটাতে কোথা থেকে আরও কয়েকজন এসে ডেস্কের উপর ঘাড় রেখে কীসব কাজ করছে। ‘এরা কি আদৌ কাজ করছে, না কি ঘুমাচ্ছে?’ তবে সুব্রত বুঝতে পারল, সবাই খুব জোরে-জোরে শ্বাস নিচ্ছে, কেমন যেন হাঁপাচ্ছে। সবার দিকে একবার চোখদুটো ঘুরিয়ে সংখ্যাটা গোনার চেষ্টা কলল। এগারোজন! এই দুজনকে নিয়ে তেরো। কিন্তু একটু আগে একসাথে এতজন গেছিল কোথায়?
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সেই দুজনের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় একজন বলে উঠল, ‘একটু পরেই বস ডাকবেন। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।’
‘আরও অপেক্ষা!’
ইতিমধ্যে এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। এবার কি অনন্ত অপেক্ষা করতে হবে না কি রে বাবা? কাউকে কিছু বলাও যায় না। না এলেই ভাল হত। এই সব ভুলভাল কোম্পানিতে কী যে কাজ হয় কে জানে!
বেরোনার সময়েও বাবা বলেছিল, ‘আজকাল সারাটা দেশ চিটিংবাজে ভরে গেছে, খুব সাবধান।’ চোখদুটো বন্ধ করে সেই সোফাটাতে বসবার সঙ্গে-সঙ্গেই একজন এসে বলে গেল, ‘ওই নীল দরজাটার ভেতরে চলে যান, ওখানেই আপনার ইন্টারভিউ হবে।’
নীল দরজাটা একটু আড়ালে। সুব্রত ব্যাগ থেকে ফাইলটা বের করে হাতে ধরল। এক পা এগোতেই একজন বলে উঠল, ‘ফাইল-টাইল লাগবে না, এমনিই যান।’
সুব্রত বেশ আশ্চর্য হয়ে উঠল। কী মুশকিল, একটা ইন্টারভিউ হবে অথচ কোনও ফাইল দেখবে না! এখানেই তো সার্টিফিকেটগুলো আছে।
নীল রঙের দরজাটা খুলে তো আরও অবাক হয়ে গেল। ঘরটার ভেতরে একটা হালকা রঙের আলো জ্বলছে, সেই আলোতেই সুব্রত দেখতে পেল একটা ছোট টেবিলের আরেক প্রান্তে একজন বসে আছেন, তার পাশে খালি গায়ে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সুব্রতকে দেখে বসে থাকা অদ্ভুত ভাবে বলে উঠল, ‘কাল থেকে চলে আসবেন।’
সু্ব্রত কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সেই ভদ্রলোক তার বাঁ-হাতটা তুলে থামতে বলে নিজেই বলে উঠলেন, ‘যা কাজ সব বাইরে থেকে জেনে নিন। আর এখানে প্রতিদিনের পেমেন্ট প্রতিদিন পেয়ে যাবেন, কোনও ব্যাঙ্ক বা চেকের ঝামেলা নেই।’
নীল দরজার রুমটা থেকে বেরিয়েই সুব্রত চমকে ওঠে। সেই দুজন ভদ্রলোক ঠিক দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। সুব্রতকে দেখতে পেয়েই একজন বলে উঠল, ‘তাহলে কাল থেকে আসুন, আর পেট ভরে খেয়ে আসবেন। কাল এলেই কাজ বুঝতে পারবেন।’
কথাগুলো কানে কী রকম হাতুড়ির মতো লাগল। ‘অদ্ভুত ব্যাপার, ওই ভদ্রলোকও বললেন এরাও বলছে, অফিসে কাজ করতে এলে তো কিছু খেয়ে আসতেই হবে, সেটা আবার বলবার মতো কিছু?’
অফিস থেকে বেরোতে যাবে, এমন সময় গেটের মুখে সেই দারোয়ানটার সাথে আবার দেখা হল। সুব্রতকে দেখে এক গাল হেসে বলে উঠল, ‘কাল থেকে আসবেন, খেয়ে আসবেন কিন্তু।’
সুব্রতর মাথাটা আবার ঝনঝন করে উঠল। তার পরের দিন সকাল-সকাল উঠে মায়ের রান্না ভাত ও মাছ খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হল। মা’কে বেশি কিছু বলেনি। বাড়িতে একটা রীতি প্রচলিত আছে। কেউ বাইরে বেরোলে স্নান করে ভাত খেয়ে বের হয়।
অফিসে এসে অবশ্য কোনও চেনা মুখ দেখতে পেল না। এমনকী রিসেপশনে সেই দুজন ভদ্রলোকও নেই, বদলে অন্য দুজন বসে আছে। সুব্রতকে দেখে একজন বলে, ‘আপনি বসুন, ডাক এলে ওই নীল দরজার রুমটার ভেতরে যাবেন।’
‘সে না হয় যাব, কিন্তু আমার কাজ কী?’
‘কাজ! সেটা সময় এলেই বুঝতে পারবেন।’
সুব্রত একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। আধঘণ্টা পরে দেখে সেই নীল রঙের দরজাটা ঠেলে একজন ভদ্রলোক টলতে-টলতে বাইরে বেরিয়ে সুব্রতর পাশে রাখা একটা চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসল। সুব্রত মুখ-চোখ দেখে বুঝল, তার উপর দিয়ে একটা ভয়ংকর রকমের ঝড় বয়ে গেছে, কিন্তু সেটা ঠিক কী সেটা বুঝতে পারল না। ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করতেও সাহস হল না। কিছু সময়ের মধ্যেই সুব্রতরও ডাক এল। কিছুটা ভয় নিয়েই ভেতরে গিয়ে কালকের সেই রিসেপশনের দুজন ভদ্রলোককে দেখতে পায়। একজন বলে ওঠে, ‘আপনার জামাটা খুলে বসের কাছে চলে আসুন।’
‘কেন?’
‘আরে আপনি জানেন না, বস আপনার রক্ত পান করবে, মাসে একবার আপনার মাংস খাবে। কাল শোনেননি বস হাড় চেবাচ্ছিলেন।’
‘রক্ত পান করবে? মানে!’
সুব্রতর হাত-পা থরথর করে কাঁপতে থাকে।
‘আরে কাল আপনি বুঝতে পারেননি, আপনাকে তো খেয়ে আসতে বলা হয়েছিল। এমনি-এমনি নাকি? আজ আপনার প্রথম দিন। বস আপনার শরীর থেকে এক কাপ রক্ত স্যার পান করবেন, কাল আপনার ছুটি; পরশু থাকবেন রিসেপশনে, তারপরের দিন আবার রক্ত। মাসে একবার আপনার মাংস খাবেন। ভয় নেই, ডাক্তারের খরচ অফিস দেবে। এখানে আমাদের সবার তো এটাই কাজ।’
সুব্রত কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ কোথা থেকে শরীরে একটা শক্তি এল, সুব্রত সেই শক্তি দিয়েই নীল দরজাটা খুলে বাইরের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল। অফিসের গেটের সামনে সেই দারোয়ান ভদ্রলোকের চিৎকার শোনা গেল। সুব্রতর লিফ্টে চাপার ধৈর্য থাকল না। সিঁড়ি দিয়ে একশ্বাসে ছুটে নেমে আসবার সময় একটা মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। সুব্রত সিঁড়ির মধ্যেই পড়ে গেল। মেয়েটি তাড়াতাড়ি এসে সুব্রতর হাত ধরে উঠে বসাল। সুব্রতর শরীর বসতে চাইলেও মন চাইছিল না। এই বাড়ি থেকে বেরোতে পারলেই আপাতত মুক্তি। নামতে গেল। মেয়েটার গলা শুনল, ‘থার্টি টু বাই সিক্স কোন ফ্লোরে জানেন…?’
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী