সবকিছুর আগে, জ্যোৎস্নারাতে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বাবার সন্তানকে কবর দেওয়ার ছবি ভেসে উঠুক। স্থায়ী জায়গা করে নিক আমাদের মনে। কানে আসুক মায়ের এই মুহূর্তের হাহাকার কান্না।
২৩ মার্চ ইজরায়েলি গোলানি ব্রিগেড হামলা চালিয়েছে। চিকিৎসা করে রাফার মানুষকে বাঁচিয়ে তুলবেন এমন ১৫ জন মানুষকে গুলি করে মারা হয়েছে আচমকা।
দিনকয়েক আগে ইউএন জানিয়েছে, গোটা গাজার প্রায় সত্তর ভাগ ‘নো গো জোন’ করে রেখেছে ইজরায়েলি সেনা। মেরে ফেলা হচ্ছে সাংবাদিকদের।
আরও পড়ুন : আন্দোলনের মুখ কেন হয়ে উঠছে পিকাচু থেকে জোকার?
লিখছেন অর্ক ভাদুড়ী…
সামাজিক মাধ্যমে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র অ্যাভিচাই আদরাই জানিয়েছেন যে, গাজার সবাইকে, বিশেষ করে দেইর আল-বালাহ এলাকার আল-সাহাবা, আল-সামাহ, আল-আউদা, আল-জাওয়াইদা আর আল-সালাহ পাড়ার বাসিন্দাদের আবারও কড়া সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে— এটাই শেষবারের মতো। এরপর আমরা ভয়াবহ হামলা চালাব, যেখানেই রকেট ছোড়া হচ্ছে, সেখানেই।
তিনি আরও বলেন, ‘এই যুদ্ধ আর সাধারণ মানুষের ভোগান্তির পুরো দায় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর, বিশেষ করে হামাসের। নিজেরা বাঁচতে চাইলে এখনই দক্ষিণে, আল-মাওয়াসির পরিচিত নিরাপদ আশ্রয়স্থলগুলোতে চলে যানা’
উম আহমেদ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম রাফা নিরাপদ। তাই সব ফেলে এখানে এসে উঠেছিলাম কিন্তু এক রাতে সব শেষ। এখন আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’ রাফা-র বাসিন্দা মুহাম্মদ শেখ আল-আশরক আল-আওসাতকে বলেন, তিনি বারবার ঘর ছেড়ে পালাতে পালাতে একেবারে ক্লান্ত। ‘আমার বাড়িটা বোমায় উড়ে গেছে, মা মারা গেছেন। আমার স্ত্রী আর তিন মেয়েও আহত হয়েছে। তারপর আমরা খানের ইউনিসে পালিয়ে যাই। সেখানেও এক আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আরেকটায় ঘুরে বেড়াতে হয়, শেষ পর্যন্ত আবার রাফা ফিরে আসি। আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির ওপর একটা তাঁবু খাটিয়ে থাকতাম। এক-দেড় মাস পরে আবার সব আগের মতোই হয়ে গেল, বরং আরও খারাপ। সেই থেকে শুধু এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। জীবনে কখনও এত ক্লান্তি আসেনি, যতটা গত দেড় বছরে অনুভব করছি।’ শেখ বলেন আরব নিউজ চ্যানেলকে।
প্রতিদিন গাজায় নবজাতক আর গর্ভবতী নারী খাবারের অভাবে আর ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়ে এমনভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন, যেগুলো সহজেই ঠেকানো যেত।
এমন আরও খবর আসছে। আসবে।
অন্যদিকে ও অন্যপ্রান্তে, একেবারে বিপরীত না হলেও, মানবতা ও গাজা প্রসঙ্গে এক অনন্য ভাবধারার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও তার বিতর্কিত প্রস্তাবটি দিয়েছেন, গাজা উপত্যকার দায়িত্ব যেন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পাশে বসে ট্রাম্প গাজাকে বলেছেন, ‘an incredible piece of important real estate’, আর তাঁর মতে, যদি আমেরিকা এই জায়গা চালায়, তাহলে সেখানে শান্তি ও স্থিরতা ফিরতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র গাজা-র দায়িত্ব নিয়ে এলাকাটিকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারে, যাতে এটি একদিন অর্থনৈতিকভাবে সফল অঞ্চল হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিদের আরও নিরাপদ ও আধুনিক জায়গায় বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হবে, আর যুক্তরাষ্ট্র এই পুরো উন্নয়ন-কাজের দায়িত্ব নেবে। এর জন্য মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হবে না, তবুও এতে গাজায় শান্তি ফিরে আসবে।
গাজার সাম্প্রতিক বাস্তবতার সফল কারিগর ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু যখন ‘শান্তি’-র কথা বলেন, শব্দটি নতুন অর্থ খুঁজে পায়।
রিয়েল এস্টেট আধুনিক বাণিজ্যের একটি সোনার খনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই রিয়েল এস্টেট এবং পুঁজি হাতে হাত রেখেই এগিয়েছে। তবে শিশুদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে, পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের সমর্থনে, ঠান্ডা মাথায় এমন বৈঠকি আলোচনা ইতিহাসে মনে হয় প্রথম।
বিরোধকে সঙ্গে নিয়েই সভ্যতার অগ্রগতি। মনে রাখতে হবে, এখানে অগ্র এবং গতি দুই-ই বিচার্য সেই সময়ের বাস্তবতার মূর্ত এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে। এই মুহূর্তের রাফার দিকে চোখ রেখে কিছু বিশ্লেষণ করা মানে এমন এক জায়গায় দাঁড়ানো, যেখানে শব্দ গতি হারায়, উপমার শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে, অগ্র এবং পশ্চাৎ juxtaposed হয়ে আমাদের বিভ্রান্ত ও উন্মাদ করে তোলে। কীভাবে লেখা যায় এমন এক যন্ত্রণার কথা, যার কোনও তুলনা নেই? পোড়া মাংসের গন্ধ বা বেঁচে থাকা মানুষের চোখের শূন্যতা কি শব্দে বলা যায়? মনে হয়, লেখার এই চেষ্টাটাই যেন সচেতন বিশ্বাসঘাতকতা, রক্তমাংসের মানুষদের কষ্টকে কাগজে-কালিতে মিশিয়ে হাহাকারকে সাজিয়ে রাখা নিষ্প্রাণ বাক্যে।
তবুও বলতেই হয়, চুপ থাকাটাই হয়তো আরও বড় অন্যায়।
এই ভাঙাগড়ার মধ্যেই প্রকৃত সত্য লুকিয়ে আছে। যখন আমরা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হই, ভাষা যথেষ্ট নয়, তখন আমরা নিজেদের বিপুল অসহায়তাকেই স্বীকৃতি দিই। যতই ঘরে-বাইরের শহুরে সমস্যায় আমরা আক্রান্ত হই না কেন, চমৎকার এলইডি আলোয় ভরা আমাদের ঘরগুলোয় বসে বোঝা যায় না, ড্রোনের শব্দে রাত কাটানো কতটা আতঙ্কের।
গাজার দক্ষিণে, একেবারে শেষ প্রান্তে পড়ে থাকা রাফা আমাদের বলে, ‘কথা বলো, সোচ্চার হও’, এমনকী, তখনও, যখন বলাটা কঠিন মনে হয়। ভাঙা ঘর আর নিঃশব্দ কবরের ভেতর আমরা শুধু বহুকাল ধরে চলতে থাকে নির্মম অত্যাচারই দেখি না, ভাবার চেষ্টা করি, সহানুভূতিরও সীমা কোথায় গিয়ে থামে। অথচ ভাষা, মানুষের সবচেয়ে প্রিয় হাতিয়ার, এখানে এসেই থমকে যায়। রাফার বাস্তবতাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশেষণে ব্যাখ্যা করলেও সেটা অনেকটাই হালকা করে ফেলা হয়। আবার ‘গণহত্যা’ বললেও সংখ্যার মধ্যে আটকে পড়ে সামগ্রিকতা। X সংখ্যক মৃত, Y সংখ্যক উদ্বাস্তুর, ক্যালোরি, ঘণ্টা, বিদ্যুৎ, বর্গমিটার আশ্রয়ের হিসেব। যন্ত্রণা তখন ক্যালকুলেশনের মতো শোনায়।
থিওদোর আদর্নো বলেছিলেন, ‘অ্যাউশভিৎজের পর কবিতা লেখা বর্বরতা।’ তাই রাফা আমাদের জিজ্ঞেস করে, শব্দ যদি এতটাই নিঃসহায় হয়, তাহলে আমরা কীভাবে লিখি? প্রতিটি লাইন যেন এক মিহি একটা সেতু তৈরি করার চেষ্টা, চুরমার হয়ে যাওয়া দুনিয়া আর নিরাপদ দূরত্বে থাকা পাঠকের মাঝখানে।
তবু, এই ভাঙাগড়ার মধ্যেই প্রকৃত সত্য লুকিয়ে আছে। যখন আমরা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হই, ভাষা যথেষ্ট নয়, তখন আমরা নিজেদের বিপুল অসহায়তাকেই স্বীকৃতি দিই। যতই ঘরে-বাইরের শহুরে সমস্যায় আমরা আক্রান্ত হই না কেন, চমৎকার এলইডি আলোয় ভরা আমাদের ঘরগুলোয় বসে বোঝা যায় না, ড্রোনের শব্দে রাত কাটানো কতটা আতঙ্কের। নবজাতকের মৃতদেহ কোলে নেওয়ার অনুভূতি কেমন হতে পারে। তবু চেষ্টা করতে হয়, করতেই হয়, কারণ সেই চেষ্টার মধ্যেই মিলেমিশে থাকা গোটা বিশ্বের মানবতার ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যায়।
Civil defense crews retrieve an injured person from a hail of bullets during the occupation's operation in Tel Sultan, west of Rafah. #VIDEO #Gaza_War https://t.co/3QvzR2FBYv pic.twitter.com/tJ32jldb4R
— 🇵🇸✌Mahmoud 🔻 (@GazaMahmoudGaza) April 8, 2025
বুঝে নিতে হবে, রাফার বাস্তবতা শোনামাত্রই একটা দায় কাঁধে নেওয়া। আর তখনই লেভিনাসের ‘অপরের মুখ’ আমাদের ওপর সীমাহীন দায় চাপিয়ে দেয়। রাফার ধুলোমাখা চোখ, ভাঙা খেলনা ধরে থাকা শিশুর রক্তাক্ত মুখ আমাদের প্রশ্ন শানাতে থাকে। এই শিশুরা, বাবারা, মায়েরা যাদেরকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বের করা হচ্ছে, হয়তো এই মুহূর্তেই, তারাই আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে এক অথর্ব অভিব্যক্তিতে প্রশ্ন তোলে, এই পৃথিবীটাকে আমরা কীভাবে এমন হতে দিলাম? প্রতিবাদে, প্রতিরোধে কোথায় ত্রুটি থেকে গেছে?
মেনে নিতেই হয়, খবরের শিরোনাম, মাউজ ক্লিকের বোবা প্রতিযোগিতা, সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট— সবকিছুতেই মানুষের যন্ত্রণা একটা অতিমুনাফার পণ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা দেখি, মর্মাহত হই, তারপর স্কুল করে এগিয়ে যাই। ব্রেখট লিখেছিলেন, ‘যে হাসে, সে এখনও সত্যিকারের খবরটা শোনেনি।’ রাফার খবরটা কি আমরা আসলে শুনেছি? শুনে কেঁদেছি? প্রিয়জনের মৃত্যুতে যেমন বুকফাটা কান্না…। না কি কেবলই শব্দ! পোস্ট! ভিডিও ক্লিপ!
‘শেষ সীমান্ত পার হলে আমরা কোথায় যাব? শেষ আকাশের পরে পাখিরা কোথায় উড়বে?’
রাফায় বাঁচতে হলে অন্য ধরনের সাহস লাগে। বাবা খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মেয়ের স্কুলব্যাগ। নার্স মোমের আলোয় সেলাই করছেন আহতদের, কখন শেষবারের মতো খেয়েছেন, তাঁর খেয়াল নেই। বছর দশের একটি ছেলে গুলির দাগে ভরে ওঠা দেওয়ালে সূর্যমুখী আঁকছে। এই ব্যবহারের জন্য সাহস লাগে। অতিলৌকিক বললেও অতি উক্তি হয় না।
তবে এই সাহসকে রোমান্টিসাইজ করা ঠিক হবে না। ওদের টিকে থাকার লড়াই আমাদের কাছে ইতিবাচক দীর্ঘশ্বাস হয়ে থেমে থাকতে পারে না, এমন নির্মমভাবে কেন নবজাতকদের মেরে ফেলা হল, কী এবং কেন এই অসহ্য বাস্তবতা, নেপথ্যে কী ধরনের মানসিকতা আরও বেশি নারকীয় হয়ে উঠছে প্রত্যেকদিন, অনেকদিন আগেই মৃত এই পচনশীল অসভ্যতার শেষ কোথায়— এমন অনেক প্রশ্ন আমাদের আমূল আক্রান্ত করুক আগামীর শিশুদের নিরাপদ রাখার একমাত্র লক্ষ্যে।
রাফা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, এই আমরা-ওরা-র তৈরি করা বোধটাই আসলে আমেরিকার তৈরি F-84 বিস্ফোরকের মতোই ঘাতক। মা যদি তার মৃত সন্তানকে জড়িয়ে কাঁদে, সেই কান্না নিউ ইয়র্ক, কিয়েভ, সুদান, কলকাতা যেখানকারই হোক, তা আমার মায়ের কান্নাই তো। আনন্দ ছড়াতে যেমন পাসপোর্ট লাগে না, আর্তনাদের কোনও কাঁটাতার হয় না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এই বিশ্বজুড়ে যে জীবনধারা প্রবাহিত হচ্ছে, সেই ধারাই আমার শিরায় বইছে।’ তাই রাফার শিশুদের রক্ত আমাদেরই রক্ত। এই দায় আমাদের, যাদের আকাশ এখনও অবধি নীল।
তাই এই শোক মানে চুপ করে থাকা মোটেও না। শোক মানে বলা, এই পৃথিবীটা এরকম হতেই পারে না। একে বদলে ফেলা যায়। মানুষই পারে বদলে দিতে।
ক-দিন আগেই, মাইক্রোসফটের পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বিল গেটস, সত্য নাদেলা, স্টিভ বামার যখন স্টেজে, ইবতিহাল আবুসাদ এবং বন্যা আগরওয়াল, এই দু’টি মেয়ে সরাসরি প্রশ্ন ছোড়েন মাইক্রোসফট-এর হর্তাকর্তাদের দিকে, শিশুদের হত্যা করতে কেন মদত দিচ্ছে মাইক্রোসফট? বন্যা লিখছেন, বর্তমান যখন ইতিহাস হবে, আপনার পরবর্তী প্রজন্ম আপনাকে ওই প্রশ্নটাই করবে, আর আপনাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, ইতিহাসের কোনদিকে আপনি ছিলেন?
বন্যার মতো মানুষেরা ছিলেন, আছেন আমাদের আশপাশেই, থাকবেন। তারা আছেন বলেই গোটা পৃথিবীটা এখনও রাফা হয়ে যায়নি।
আমরা যারা এখনও উদাসীন, জীবনের অপ্রয়োজনীয় দিকগুলিতে ঘোর মশগুল, এড়িয়ে চলার কৌশলে, তোষামোদে ফেঁপে ওঠা আমাদের হাসিতে আসলে মেফিস্টোরই ছোঁয়া। আমরা আদপে চালাক, নীচ, সম্ভ্রান্ত, সুদর্শন হিপোক্রিট— ক্রমশ ওজন হারিয়ে ফেলছি। কিন্তু আমাদের প্রতিটি কাজ, পোস্ট, কথা, লেখাগুলির মধ্যের প্রতিটি শব্দ আর বাক্যের খাঁজে মৃত নবজাতকের ক্ষতবিক্ষত শরীর জেগে আছে। মধ্যরাতে সেই পরীর মতো শিশুরা জেগে উঠবে। আমাদের যাপনের দিকে সহজ চোখে তাকিয়ে কোরাসে বলে উঠবে, তোমরা সবই জানতে, কিন্তু কিছুই করোনি।