বর্ণময় পাণ্ডুলিপি
ঘুম ভাঙতে চায় না, তবুও ঘুমের ঘোর থেকে জেগে উঠতে হয়। আজ যে সোমবার।
তখনও জীবিকার সন্ধানে আসিনি। ‘শনিবারের বারবেলা’ শুনে, ‘বোরোলিনের সংসার’-এ বুঁদ হয়ে, তারপরে গল্পের বই পড়ে কখন ঘুমের দেশে পৌঁছতাম, মনে থাকত না। রবিবারের সকাল শুরু হত ‘রঙ্গোলি’ দিয়ে, তারপরে বিক্রমাদিত্যের পিঠে চড়ে বেড়ানো বেতাল যে-ই উড়ে আবার গাছে ঝুলে যেত, তারপরেই বিষণ্নতা নেমে আসত। স্কুলের বই খুলে বসা, জলদি খেয়ে স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে ঘুম। ভোরবেলায় কোকিল ডাকবে আর মা ঠেলে তুলে দেবে। শুরুর দিনেই ভাবতাম আবার কবে শনিবার আসবে।
এ তো গেল আমার ছোটবেলার কথা। এবার আসি বাবার কথায়। সোম থেকে শনি রোজ সাড়ে দশটায় বেরিয়ে রাত সাড়ে এগারোটার পরে বাড়িতে ঢুকতে দেখতাম। সারাদিন বইয়ের মধ্যে, কাগজের মধ্যে আর লেখক ও পারিপার্শ্বিক লোকজনের মাঝে কাটাতেই দেখতাম। সোমবারের ব্যস্ত জীবনে ঢোকার আগে যে সময়টা বাবাকে কাটাতে দেখতাম, তা একেবারে অন্যরকম। প্রত্যেক রবিবার বাবা-র নাইট শো ছিল বাঁধাধরা। বাবা-মা, বাবার বন্ধু ও তাঁর স্ত্রী। কখনও-কখনও চাঁদনি-র কাছে ‘আনন্দ’ থেকে দোসা কিনে ঢুকে পড়তেন মেট্রো, রকশি, প্যারাডাইস, হিন্দ, এলিট অথবা লাইটহাউস-এ। সবসময় যে হিন্দি বা বাংলা সিনেমা কপালে জুটত এমনটা নয়। কখনও কখনও ভোজপুরী সিনেমাও জুটেছে। কোন হলে কী সিনেমা চলছে, তা জানতেন না। কখনও সিনেমার টাইটেল কার্ড দেখেননি। আমি অবশ্য কোনওদিন সাহস করে জিজ্ঞাসা করিনি যে, আজ কোন সিনেমা দেখলে, পরেরদিন বাবার বন্ধুর থেকে জানতে পারতাম, কোন সিনেমা কখন থেকে দেখেছেন। সোমবার এলে বাবাও মনে হয়, আমার মতোই অপেক্ষায় থাকত, কবে রবিবার আসবে।
ক্যাফে ফাঁকা থাকলেই ব্লুজ! পড়ুন পারমিতা গাইনের কলমে
‘মনডে ব্লুজ’-এর পর্ব ১৩…
জীবিকার সন্ধানে ঢুকে বুঝলাম, মঙ্গলবারের আগেরদিন সোমবার আর সোমবারের আগেরদিন ছুটির দিন। ছুটির সঙ্গে কর্মদিনের যে তফাত, তা বোঝার আগেই মনে হয় সোমবার এসে গেল। স্কুলজীবনে শনিবারের বারবেলার আগেই বাড়ি ঢুকে পড়তাম, মনে হত, আজ বিকেলটা ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, মোমবাতি, পেটকাটি, চাঁদিয়াল লোটার দিন। প্রকাশনায় ঢুকে সোম থেকে শনি বইয়ের পাতায় লেখা দেখি, ছেলেটা ঘুড়ি ওড়ায়, মেয়েটা ব্যাডমিন্টনে দারুন। লেখকের কথা শুনি, নতুন কবির নতুন কবিতা লেখার গল্প শুনি।
রবিবার কাটিয়ে যখন সোমবারে দপ্তরে বসি, লেখক আসেন, কবি আসেন তাঁর কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে। সেই লেখক-কবিদের লেখার গল্প, জীবনের গল্প শুনতে থাকি। কেউ এসে বলেন, তার লেখা কবিতাই সর্বশ্রেষ্ঠ। ছাপলেই বিক্রি। যখন জিজ্ঞাসা করি, কার লেখা কবিতা পড়েছেন? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত তারপরে অনেক কষ্টে মনে করে জয় গোস্বামী। জয় গোস্বামীর কোন লেখা পড়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘সাতটি তারার তিমির’।
সোমবার শুরুর আগে এখন আর বোরোলিনের সংসার শুনি না, চিত্রহার-ও দেখি না। কোকিলের সুরে আর ঘুম ভাঙে না। বরং ভোররাতের ঘুম কোলবালিশে সকাল পেরিয়ে যায়। শোনার জায়গা দখল করে নেয় কখনও শংকর, কখনও প্রফুল্ল রায়। দেখার জায়গা দখল করে নিয়েছিল শঙ্খ ঘোষের বাড়ির আড্ডা, সুনীলজেঠুর বাড়ির আড্ডা।
রবিবার কাটিয়ে যখন সোমবারে দপ্তরে বসি, লেখক আসেন, কবি আসেন তাঁর কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে। সেই লেখক-কবিদের লেখার গল্প, জীবনের গল্প শুনতে থাকি। কেউ এসে বলেন, তার লেখা কবিতাই সর্বশ্রেষ্ঠ। ছাপলেই বিক্রি। যখন জিজ্ঞাসা করি, কার লেখা কবিতা পড়েছেন? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত তারপরে অনেক কষ্টে মনে করে জয় গোস্বামী। জয় গোস্বামীর কোন লেখা পড়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘সাতটি তারার তিমির’।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পঁয়ষট্টি বছরের বয়স্ক কবির ধ্যানজ্ঞান। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েই তাঁর কবিতা লেখা। রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার বই ভাল লেগেছে, জিজ্ঞাসা করতে উত্তর পাই, ‘রক্তকরবী’।
প্রথমে বুঝতে পারিনি বছর আঠাশের ছেলেটি কী বলছেন। একগোছা পাণ্ডুলিপির পাতা আমার দিকে বাড়িয়ে দেন। আমি উল্টে উল্টে দেখতে থাকি। ছেলেটি বলেন, এই সব লেখা আপনাকে দিয়ে দেব। আপনি যত খুশি ছাপাবেন। আরও যদি কিছু লিখতে বলেন, লিখে দেব। আপনি আমায় ১৯ লাখ দেবেন।
সোমবারে সম্বিত ফেরার আগেই অন্ধকার নেমে আসে। সোমবারটা কখন যেন শেষ হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না।