ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • নীল কৌটো

    সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় (March 15, 2025)
     

    আচ্ছা, বিষের রং যে নীল হয়, একথা প্রথম কে বলল? পুরাণ, না কেমিস্ট্রি ল্যাব, না কি মানুষের শরীর?

    আমি তো জেনেছি গল্প শুনে। সমুদ্রমন্থনের সময় অমৃত তোলার জন্য দেবতা আর অসুরেরা যে হেঁইয়ো-মারো করেছিল, তাতে ক্ষীরসাগর থেকে অমৃতের আগে আরও অনেক কিছু উঠেছিল, তার মধ্যে একটা ছিল মারণ বিষ— হলাহল বা কালকূট ৷ আবার অন্য মতও রয়েছে। সে বিষ নাকি সমুদ্রমন্থনে ওঠেনি, বরং মন্থনের জন্য মোটা দড়ি হিসাবে ব্যবহৃত নাগরাজ বাসুকিই অত্যধিক ঘূর্ণন ও দেবাসুরে অবিরত টানাটানির কারণে বিষ নির্গত করেছিল। সে যে-ভাবেই গরল উঠে আসুক না কেন, তার একটা গতি তো করতে হয়। সেক্ষণে সাংঘাতিক বস্তুটির হিল্লে করার জন্য, দেবতাকুলের ত্রাণকর্তা স্বয়ং শিব এসে ঢকঢক করে বিষ পান করলেন। এসব দেখেশুনে কি কোনও বউ ঠিক থাকতে পারে? মা দুগ্গা তখন শিবের গলা চেপে ধরলেন, যাতে বিষ না মহাদেবের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই বিষ মহাদেবের গলায় থিতু হল। বিষের তাড়নায় মহাদেবের কণ্ঠ নীলবর্ণ হয়ে গেল, আর মহাদেবের আর এক নাম হল— নীলকণ্ঠ। অতএব, বিষের রং যে নীল তাহা প্রমাণ হইয়া গেল। বাঁদিক ও ডানদিক মিলে গেল।

    এই আখ্যান থেকে ভক্তি বা বিস্ময় জাগতে পারে ঠিকই, কিন্তু বিষের যে তীব্রতা আর ভীতি, তা ছলকে এসে মন বা মস্তিষ্ক, কিছুই ভেজায় না। অথচ আসলি বিষের একটু ছিটেও আতঙ্ক তৈরি করতে পারে অনন্ত-সমান। যখন সাপে কাটা ছেলেটা প্রতিষেধক না পেয়ে ধীরে ধীরে নীল হয়ে যায় গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, যখন শ্বশুরঘরের গঞ্জনা শুনতে শুনতে বিষ খেয়ে ছোট্ট মেয়েটা আত্মহত্যা করে, আর সুরতহালের সময় দেখা যায় মুখের গ্যাঁজলা শুকিয়ে গেছে আর ঠোঁটদুটোয় রং ধরেছে কালচে নীল, তখন বিষের রং কেমন, তা আত্মায় সেঁধিয়ে যায়, পরের কোনও ওরাল পরীক্ষায় তা ভুল হওয়ার নয়। এই যে গোটা ঠোঁট, গলা, বুক পুরোটাকে নীল করে দিয়ে বিষ আমাদের মেরে ফেলে, তাতে বোঝা যায় মৃত্যুর রং নীল। যা কালো নয়, কিন্তু যা রক্তের আভা হরণ করে নেয়, যা প্রায়-কালো।

    আরও পড়ুন : আকাশের রং ভ্যান গঘের ছবিতে অমন নীল হয়ে উঠল কীভাবে? দোলের বিশেষ সংখ্যা ‘এবড়োখেবড়ো রং’-এ লিখলেন শ্রীজাত…

    প্রশ্ন উঠতে পারে, বিষের সঙ্গে নীল রঙের কি কোনও রাসায়নিক সম্পর্ক আছে? বিজ্ঞান বলে, আছে। ‘সায়ানোসিস’ নামে একটা অবস্থায়, রক্তে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না থাকলে শরীর নীলচে দেখায়। কিছু বিষাক্ত পদার্থ বা নাইট্রেট/নাইট্রাইটের সংস্পর্শে এলে ‘মেথেমোগ্লোবিনেমিয়া’ নামক একটি অবস্থা দেখা দিতে পারে, যেখানে শরীর অক্সিজেনের অভাব বোধ করে, যার ফলে ত্বক নীল-ধূসর বর্ণের হয়ে যায়। সায়ানাইডের রং নাকি মলিন নীল। আর সায়ানাইড নামটাতেই তো কিন্তু নীল রং জড়িয়ে আছে। গ্রিক ভাষায় ‘সায়ান’ মানে গাঢ় নীল। আর এই দুই আক্রমণকারী আমাদের পরিবেশেই ছড়িয়ে থাকে বহাল তবিয়তে।

    সক্রেটিসের হেমলক পান। প্রতীকী ছবি

    এক্ষণে মনে রাখা দরকার, সব বিষের রং নীল নয়, আবার আকাশ কিংবা সমুদ্র নীল হলেও সব সময় রোম্যান্টিক নয়, বরং বেশিরভাগটাই ভয়াল। আকাশ যখন নীলের আওতা ছাড়িযে অনন্তের দিকে ধায় তখন কিন্তু তার নীলের মায়াবী আবরণ সংকুচিত হয়ে যায় কালোর মস্তানিতে। একটা দমচাপা কিচ্ছু নেই-এর মধ্যে সে মিলিয়ে যায়। এ ভয়ংকর অনন্তের বহিরঙ্গ নীল, কিন্তু আদত চরিত্র কালো। আবার সমুদ্রের উপরিতল নীল। তার ঢেউয়ের মোহ কাটানো কঠিন। কিন্তু যে গভীরতার দোহাই দিয়ে সমুদ্র নীল, সেই গভীরতার আসল রং কিন্তু ঘোর কালো। আর সেই কালোয় কেবল মানসিক ভয়ের বিষ নেই, আছে বিষাক্ত জীবজন্তুও। এতে বদনামটা পায় নীল, কিন্তু আসল ভিলেনের নাম কালো।

    নিস্তরঙ্গ, একাকী জীবনের অভিঘাতের যে বিষ, তা সঞ্চিত হতে থাকে চক্রবৃদ্ধি হারে। ধূসর রং যদিও একাকী জীবনের ইজারা নিয়ে নিয়েছে। তবে কিনা নিঃসঙ্গতার তীব্রতা যত বাড়ে, নীল রং চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে বিষের ন্যায় যন্ত্রণাও বাড়াতে থাকে।

    আবার গোটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে নীল হল বিষাদের রং। Blues মানেই হল বিষণ্ণ অবসাদ। অনেকে তো বলেন, ঘ্যানঘ্যানে কান্না-সুরের জন্যই একরকম গানের নাম blues. সিনেমায় নায়ক বা নায়িকার নিঃসঙ্গতার দুঃখ বোঝাতে দৃশ্যে নীল রঙের আধিক্য প্রায় নিয়ম হয়ে গেছে। আর কালশিটে তো নিজেই এমন নীল, যা ব্যথার সব মাত্রা ছাপিয়ে যায়। শরীরের কালশিটের যখন এমন নীল রং, মনের কালশিটের তো রং তো আরও খানিকটা গাঢ় নীল হবে। আর মনের যন্ত্রণার সঙ্গে শরীরের যন্ত্রণার সম্পর্কও তো সহজ নয়, যেমন শরীর টাটালে মনেও তার ছাপ পড়ে, তেমন আবার ফোড়ার যন্ত্রণা প্রবল হলে, ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা কিছুটা পিছনের দিকে সরে যায়। তাই হরেক রকমের নীলের যাতায়াত শরীর-মনে চলতে থাকে, তবে হরেদরে মনে হয় আধুনিক মনগুলো বরং বিষ-নীলের দিকেই ধাবমান বেশি। আর মনের কালশিটেতে তো আমরাই রং চড়াই, বেশি গাঢ় করে তুলি চালাতে থাকি অহর্নিশ।

    ওদিকে আবার নিস্তরঙ্গ, একাকী জীবনের অভিঘাতের যে বিষ, তা সঞ্চিত হতে থাকে চক্রবৃদ্ধি হারে। ধূসর রং যদিও একাকী জীবনের ইজারা নিয়ে নিয়েছে। তবে কিনা নিঃসঙ্গতার তীব্রতা যত বাড়ে, নীল রং চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে বিষের ন্যায় যন্ত্রণাও বাড়াতে থাকে। যাকে আমরা বাংলায় বলি স্লো-পয়জনিং। কেবল সম্পত্তিলোভী ভাইপো-ভাগ্নেরাই কি স্লো-পয়জনিং করে? সারা জীবনের জমানো অপমান, হেরো হয়ে দিন কাটানো, সংকুচিত অস্তিত্ব কি নীল রঙের বিষ ঢেলে ঢেলে নিয়ত স্লো-পয়জনিং করে না? বাইরের মৃত্যু হার্ট-অ্যাটাকে হলই বা, অস্তিত্ব খতম করেছে সেই কালশিটে-রঙের বিষ।
    আদতে মানুষ কিন্তু বেনীআসহকলা-র আধার। তবে হলুদ-কমলারা মাঝেসাঝে আসে, কিন্তু ‘নী’ যেন সর্বক্ষণের সঙ্গী।

    আসলে, আমাদের সব্বার মনের কোটরে রাখা আছে একটা ছোট্ট নীল রঙের কৌটো। কেবল যেদিন সে হৃদয় ফাটিয়ে বেরিয়ে আসবে, সেদিন তাকে আমরা শনাক্ত করব– ইহা ছিল নীল রঙের।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook