রাজনৈতিক নেতাদের প্রচুর লোকজনের সঙ্গে মিশতে হয়, কথা বলতে হয়, তাঁরা জনসভায় বহু মানুষের সামনে বক্তৃতা দেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্যকেও এইসব জনসংযোগ করতে হত। কিন্তু সুযোগ পেলেই তিনি অনেকটা সময় একা থাকতেন। দিল্লিতে বঙ্গভবনে যখন থাকতেন, তখন যখন বুদ্ধবাবুর কাছে গেছি, তাঁর সঙ্গে সবসময় তাঁর নিরাপত্তা অফিসার কাম আইপিএস অফিসার মালিওয়াল থাকতেন। বুদ্ধবাবু হয়তো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, অথবা কোনও বহুপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দেবেন; কখনও বিজ্ঞান ভবনে, কখনও যোজনা কমিশনে। সারাদিন ধরে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে একনাগাড়ে বৈঠক করা, কথা বলা এসব বুদ্ধবাবুর খুব একটা পছন্দের বিষয় ছিল না। বুদ্ধবাবু বঙ্গভবনে নিজের ঘরে কিছু সময় একা একা কাটাতেন।
মালিওয়ালকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘কী করছেন বুদ্ধবাবু?’ উনি বলতেন, তিনি যে বৈঠকে যাবেন, তার জন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে খবর দেখতেন, তার কাগজগুলো, ফাইলগুলো দেখতেন, পড়তেন। আবার অনেক সময় অন্য কোনও কাজ না থাকলে বই পড়তেন এবং কিছু না-কিছু লিখতেন। তবে খুব পছন্দের লোক না হলে আড্ডা মারা তাঁর ধাতে সইত না। এটা শুধু দিল্লিতে নয়, রাইটার্স বিল্ডিংয়েও দেখতাম, বিভিন্ন বৈঠকের ফাঁকেও তিনি পাশের একটি চেম্বারে গিয়ে হয়তো কোনও একটা পছন্দের বই পড়ছেন। সামনে একটা বিরাট রবীন্দ্রনাথের ছবি টাঙানো ছিল।
বুদ্ধবাবুর সঙ্গে বিদেশে গিয়েও দেখেছি, সেখানে আরও অনেক বেশি আত্মমগ্ন থাকতেন। এক-একজন রাজনৈতিক নেতা এক-একরকম হন। অটলবিহারী বাজপেয়ী, এমনকী, লালকৃষ্ণ আদবানির সঙ্গেও বিদেশে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা সে-দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যটনস্থল ঘুরে দেখতে ভালবাসতেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী তো প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় অনেক সময় কোনও দেশে শুক্রবার পৌঁছতেন, যাতে শনি-রবি যখন কুটনৈতিক কোনও কাজকর্ম থাকে না, সেই সময়টা উনি সেই গেস্ট হাউসের সামনেটা ঘুরে দেখতে পারেন। তাতে লাভ হত আমাদেরও। তাঁর সঙ্গে আমরাও ঘুরতাম। সোমবার থেকে সরকারি কাজকর্ম শুরু হত।
আরও পড়ুন : ‘ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট’ ব্যক্তিত্ব ছিলেন মনমোহন সিং! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল…
বুদ্ধবাবুর মধ্যে এইরকম ‘ট্যুরিস্ট’ মানসিকতাই ছিল না। খুব আত্মমগ্ন মানুষ ছিলেন। নিজের সঙ্গে নিজের সময় কাটাতেন অনেক বেশি। একা থাকতে ভালবাসতেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী আর লালকৃষ্ণ আদবানির মধ্যে তফাত দেখেছি, অটলবিহারী বাজপেয়ীও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সরকারি বৈঠক ছাড়া দেখাসাক্ষাতের কর্মসূচি রাখতেন খুব কম। হয়তো একজন আমলা, একজন রাজ্যপাল, একজন কূটনীতিক— এইরকম ছিল তাঁর দৈনন্দিন কর্মসূচি। সেখানে লালকৃষ্ণ আদবানি সারাদিন ধরে ব্যাক টু ব্যাক বৈঠক রাখতেন। মানুষকে সময় দিতেন। বহু মানুষকে, এমনকী, রাজ্যের নেতাদের সঙ্গেও দেখা করতেন। এক প্রবীণ সাংবাদিক সেই সময় বলেছিলেন, আসলে বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন আর আদবানি প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছিলেন। সেই কারণে আদবানি আরও বেশি জনসংযোগে সক্রিয় ছিলেন। বাজপেয়ীর মধ্যে সেই তীব্র সক্রিয়তা ছিল না। কেননা, তিনি যা পাওয়ার সেটা ইতিমধ্যে তিনি পেয়ে গেছেন। জানি না, এইরকমভাবে তুলনামূলক বিচার কতটা বৈজ্ঞানিক! মোদ্দায়, বুদ্ধবাবু এক্ষেত্রে একেবারে অন্য ধরনের ছিলেন।
বুদ্ধবাবুর জন্মদিন আর অনিল বিশ্বাসের জন্মদিন পিঠোপিঠি ছিল। সে-ব্যাপারে একটা মজার গল্প ছিল। ১ মার্চ অনিল বিশ্বাস প্রথম বুদ্ধবাবুকে শুভেচ্ছা জানাতেন, আবার ২ মার্চ সকালবেলা উঠেই বুদ্ধবাবু প্রথম অনিল বিশ্বাসকে ফোন করতেন। এটা দীর্ঘদিনের একটা রেওয়াজ হয়ে উঠেছিল।
বুদ্ধবাবুর ব্যক্তিগত সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায়কে আমি দিল্লি থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন করতাম। তখন বুদ্ধবাবু দপ্তরে চলে আসতেন। জয়দীপ আমাকে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিতেন। জন্মদিন নিয়ে আলাদা কোনও উন্মাদনা ছিল না। বরং নিজের জন্মদিন সেভাবে কোনওদিন পালন করতেন না। আবার অন্য কোনও নেতার জন্মদিন পালনের ঘটা দেখলে কিঞ্চিৎ বিরক্তই হতেন। তিনি সবসময়ই ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতির ভাবনাতেই।
অনেকে ভাবতেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বোধহয় রাজনৈতিকভাবে বড় বেশি কট্টরপন্থী। আসলে তাঁর প্রকৃতিটা ছিল সম্পূর্ণই উল্টো। তা না হলে লালকৃষ্ণ আদবানির মতো মানুষের সঙ্গে তাঁর কীভাবে এত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে? আদবানির সঙ্গে মতাদর্শগত পার্থক্য ছিল তীব্র। কিন্তু দু’জনের মধ্যে স্বভাবগত মিল ছিল। দু’জনেই কিন্তু খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন। আদবানিকেও দেখেছি, তিনি বুদ্ধবাবুকে খুব পছন্দ করতেন। আর প্রশাসন, উন্নয়ন— এসব বিষয় বুদ্ধবাবু রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করতেন না।
বুদ্ধবাবু সবসময়ই মনে করতেন, ভারতীয় সমাজতন্ত্র, ভারতীয় মার্কসবাদকে মর্যাদা দিতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে, ভারতীয় স্বাতন্ত্র্য। দীর্ঘদিন বলশেভিক বিপ্লবের পর আমরা সোভিয়েত মডেলকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেছি। আবার একটা সময়ের পর, চিনে সমাজতন্ত্র আমাদের কাছে রোল মডেল হয়ে উঠেছিল। সিপিএম দলের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বুদ্ধবাবু বদল আনতে চেয়েছিলেন। তিনি বারবার বলতেন, ভারতীয় মার্কসবাদ, ভারতীয় সমাজতন্ত্র প্রয়োজন। অর্থাৎ, সমাজতন্ত্রটা হবে ভারতীয় অভিজ্ঞতার নিরিখে।
একবার তো প্রকাশ কারাট চেয়েছিলেন, বুদ্ধবাবু ভারতে কর্মরত চিনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন তাদের দেশের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে কথা বলে। সেই সময় আসলে ভারতের উপকূলবর্তী বন্দরগুলিতে চিনা সংস্থা কাজ করতে চাইছিল। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণন বাদ সেধেছিলেন। তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে চিনা সংস্থাকে বন্দরগুলিতে বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দরে বরাত দিতে রাজি ছিলেন না। তাই নিয়ে বারবার নিরাপত্তা-বিষয়ক মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হত।
চিনা রাষ্ট্রদূত বুদ্ধবাবুকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালেন প্রকাশ কারাটের মাধ্যমে। বুদ্ধবাবু গেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে, প্রকাশ কারাটকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি বিষয়গুলো শুনলেন। বুদ্ধবাবু সাফ-সাফ জানিয়ে দেন, ‘আমি দুঃখিত। আমি দেশের ফেডারেল স্ট্রাকচারের একজন মুখ্যমন্ত্রী-মাত্র। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিষয় এটি। এটা প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিচার্য বিষয়। আমি এ-ব্যাপারে নাক গলাব না।’
বুদ্ধবাবু সবসময়ই মনে করতেন, ভারতীয় সমাজতন্ত্র, ভারতীয় মার্কসবাদকে মর্যাদা দিতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে, ভারতীয় স্বাতন্ত্র্য। দীর্ঘদিন বলশেভিক বিপ্লবের পর আমরা সোভিয়েত মডেলকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেছি। আবার একটা সময়ের পর, চিনে সমাজতন্ত্র আমাদের কাছে রোল মডেল হয়ে উঠেছিল। সিপিএম দলের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বুদ্ধবাবু বদল আনতে চেয়েছিলেন।
পরে বেশ কয়েকবার আমাকে বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ‘আমি সেরকম মার্কসবাদী হতে চাই না, যে ভারতের মাটিতে চিনা পতাকা পুঁততে চায়। আমি ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলনে বিশ্বাসী।’ নৈতিকতার প্রশ্নে বুদ্ধবাবু চিরকাল খুব শক্ত মনের মানুষ ছিলেন। অসত্য কথা বলা, উচ্চকিত আস্ফালন— এসব তাঁর কোনওদিনই পছন্দের ছিল না।
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, যেটা আমার নিজের সাংবাদিক জীবনের গোড়ার দিকের সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে। তখন আমি ‘বর্তমান’ সংবাদপত্রে কাজ করি। বুদ্ধবাবু মন্ত্রিসভায় যোগ দিচ্ছেন। বুদ্ধবাবু হবেন তথ্য ও প্রচারমন্ত্রী। তখন শপথগ্রহণ হয়নি। শপথপ্রহণ হবে সম্ভবত শনিবার। আমাদের রোববারের পাতার বিষয় ছিল— প্রবীণ এবং নবীন নেতৃত্ব। তা বরুণ সেনগুপ্ত বললেন, নবীন নেতৃত্বের তিন প্রতিনিধি— বিমান, অনিল, বুদ্ধ। প্রমোদ দাশগুপ্ত কীভাবে তাঁদের তিনজনকে তিনদিকে তৈরি করেছিলেন। প্রশাসনে বুদ্ধবাবু, রাজনৈতিক দলের কাজে বিমান বসু, আর ‘গণশক্তি’ এবং সংবাদমাধ্যম দেখার জন্য অনিল বিশ্বাস।
আমার দায়িত্ব পড়ল বুদ্ধবাবুর একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার। কিন্তু রোববারের কাগজ, শুক্রবার আমাদের লেখা জমা দিতে হত। এটা টেকনিক্যাল ব্যাপার। রোববারের পাতাটা রঙিন পাতা হত এবং আগে থেকে ছাপতে হত। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে গিয়ে দেখা করলাম। তখন সাংবাদিকতায় নবীন। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র সাংবাদিক কল্যাণ চৌধুরী বুদ্ধবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। কল্যাণদা-র হাত ধরে গেলাম। বুদ্ধবাবুকে বললাম, ‘আপনার একটা সাক্ষাৎকার ছাপতে চাই রোববারের পাতার জন্য। আপনি তথ্যমন্ত্রী হয়ে কী করতে চান? কীভাবে ভাবছেন?’ বুদ্ধবাবু অনেক আলোচনা করলেন আমার সঙ্গে। কিন্তু সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন?’ উনি বললেন, ‘আমি তো এখনও তথ্যমন্ত্রী হইনি। শপথগ্রহণ হয়ে যাওয়ার পর আমি সাক্ষাৎকার দিতে পারব।’ তখন আমি বললাম, ‘এটা তো আমাদের পত্রিকাতে শুক্রবার জমা দিতে হবে। এটা তো একটা রুটিন। আগে থেকে আমাদের খবরটা করে রাখতে হয়।’ সাংবাদিকতাতে তো এইগুলো এখন জলভাত! আমরা তো অবিচুয়ারি পর্যন্ত আগে লিখে রাখতাম। কিন্তু বুদ্ধবাবু কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ‘নৈতিকতার প্রশ্ন এটা। আমার প্রচারের থেকেও সেটা আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
অগত্যা সাক্ষাৎকার হল না। আমি নিজের মতো করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলাম। কিন্তু বুদ্ধবাবুর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হল না।
খুব ছোট্ট ঘটনা। কিন্তু এখন মনে হয়, মনের দিক থেকে নৈতিকতার প্রশ্নে কী দৃঢ়চেতা ছিলেন!