ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • ধূসর প্রতিশ্রুতি

    ভাস্কর মজুমদার (March 7, 2025)
     

    গত ২২ ফেব্রুয়ারি তেলেঙ্গানার শ্রীশৈলম লেফট ব্যাঙ্ক ক্যানাল (এসএলবিসি) অন্তর্গত আলিমিনেটি মাধব রেড্ডি প্রকল্পের একটি অংশ ধসে গিয়ে আটজন মানুষ আটকা পড়েন। একাধিক কেন্দ্রীয়, রাজ্য এবং অন্যান্য সংস্থা উদ্ধার অভিযান এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। এসএলবিসি টানেল নির্মাণের চুক্তি ২০০৫ সালে প্রয়াত ওয়াই.এস. রাজশেখর রেড্ডির শাসনামলে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম সেচ-সুড়ঙ্গ। প্রশ্ন জাগে, এমন ঘটনা প্রথম কি? সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সুড়ঙ্গ-ধসের ঘটনায় থাকবে উত্তরাখণ্ড সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ-ধসের কথা।

    আরও পড়ুন: সত্যের পক্ষে থাকলে কি নিহত হওয়াই নিয়তি ভারতীয় সাংবাদিকদের? লিখছেন ভাস্কর মজুমদার…

    উত্তরকাশী জেলার যমুনোত্রী জাতীয় সড়কের একটি নির্মাণাধীন সুড়ঙ্গ ধসে পড়ে ৪১ জন শ্রমিক আটকে পড়েছিল। এই সুড়ঙ্গটি একবার নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে একাধিকবার ধসে পড়েছে। অন্যদিকে মণিপুরের থাগলা সুড়ঙ্গ-প্রকল্পে ধসের ঘটনায় প্রাণহানি এবং নির্মাণকাজে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটে; কিংবা হিমাচল প্রদেশের ভালু বাঁধের একটি অংশ ধসে পড়ে বাঁধের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বন্যার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গেরও তিস্তা নদী প্রকল্পের একটি নির্মাণাধীন সুড়ঙ্গে ধস নেমে প্রাণহানি ঘটে এবং নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বহু ভারতীয় গবেষকের মতে, এই বিপর্যয়গুলি বিজ্ঞানীদের বার বার সতর্কতা উপেক্ষা করার ফলাফল। এখন তাঁরা আশা করছেন যে, সুড়ঙ্গ-ধস এবং অন্যান্য প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত ভূমিধস ও বন্যা— সরকারকে নির্মাণ-পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে। যেমন, চার ধাম রোড ২০১৬ সাল থেকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

    মোদি সরকার ৯০০ কিলোমিটার রাস্তা উন্নত করার জন্য ১.৯ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নেয়। চারটি প্রধান হিন্দু তীর্থস্থানকে সংযুক্ত করে এটি একটি প্রধান পর্যটন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প হয়ে উঠেছে। এই পরিকল্পনায় রাস্তা চওড়া করা, সুড়ঙ্গ খনন, এবং ১০০টিরও বেশি সেতু ও ৩৫০০ কালভার্ট নির্মাণের কথা ছিল। এতে ব্যাপক বিস্ফোরণ, জঙ্গল-সাফাই, বর্জ্য ফেলা এবং খাড়া পাহাড়ের ঢালে বিশাল রাস্তা কাটার প্রয়োজন। এসব কাজে পাথর খসে যাওয়া, ভূমিধস এবং বন্যার সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে, সরকার প্রকল্পটিকে ১০০ কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের অংশে বিভক্ত করে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিবেশগত মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে গেছে।

    তেলেঙ্গানার শ্রীশৈলম লেফট ব্যাঙ্ক ক্যানাল

    তবে ২০১৯ সালে, পরিবেশ-বাঁচাও নানা সংগঠনের আইনি বাধার ফলে সুপ্রিম কোর্ট ২৫ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে রবি চোপড়ার নেতৃত্বে। ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনে সেই কমিটি জানায় যে, প্রকৌশলীরা একাধিকবার চারধাম নির্মাণ স্থানগুলির স্থানীয় ভূতত্ত্ব এবং জলবিজ্ঞান বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং এসবের ফলে ভূমিধস বৃদ্ধি পেয়েছে, সঙ্গে মারাত্মক পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সে-দল একটি বিভক্ত রায় দেয় পেভমেন্টের উপযুক্ত প্রস্থ নিয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠরা ১০ মিটার প্রস্থের পেভমেন্ট সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু চোপড়ার নেতৃত্বে সংখ্যালঘু পক্ষ নির্মাণ ঝুঁকি এবং পরিবেশগত ক্ষতি কমাতে পেভমেন্ট ৫.৫ মিটারে সীমিত রাখার সুপারিশ করেছিলেন।

    ভারতে টানেল ধসের ঘটনা ঘটলে কিছু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ রয়েছে। বিশেষ দলগুলি, যেমন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ) দ্বারা উদ্ধার অভিযান শুরু করা, দুর্বল অংশগুলিকে শক্তিশালী করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা স্থিতিশীল করা, অবশিষ্ট টানেলের কাঠামোগত অখণ্ডতা মূল্যায়ন করা, নিকটবর্তী কর্মীদের সরিয়ে নেওয়া এবং ধসের কারণ নির্ধারণের জন্য একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত শুরু করা। দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে টানেল নির্মাণের জন্য নিরাপত্তা প্রোটোকল পর্যালোচনা এবং আপডেট করা, নতুন প্রকল্প শুরু করার আগে স্থান-নির্দিষ্ট ভূতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালনা করা এবং নির্মাণের সময়ে গুণমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। উদ্ধার দলগুলির দ্রুত মোতায়েন করাও আবশ্যক।

    উত্তরাখণ্ড সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ

    এনডিআরএফ, ভারতীয় মেরিন কমান্ডো ফোর্স (মার্কোস) এবং বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশনের (বিআরও) মতো বিশেষ দলগুলিকে আটকা পড়া ব্যক্তিদের দ্রুত উদ্ধার করার জন্য ব্যবহার করা উচিত। আটকা পড়া শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করা, প্রয়োজন অনুযায়ী ভারী যন্ত্রপাতি এবং হাতের শ্রম ব্যবহার করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। টানেলের দুর্বল অংশগুলিকে শক্তিশালী করে আরও ধস রোধ করা এবং উদ্ধারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও দরকার। আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য মেডিকেল কর্মীদের সাইটে থাকা আবশ্যক। ধসের মূল কারণ চিহ্নিত করার জন্য একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা উচিত, যার মধ্যে ভূতাত্ত্বিক অস্থিরতা, নির্মাণ ত্রুটি বা জল প্রবেশের মতো সম্ভাব্য কারণগুলি অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। কাঠামোগত প্রকৌশলী এবং ভূ-প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের ক্ষতি এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি মূল্যায়ন করার জন্য সর্বদা পরামর্শ নেওয়া উচিত।

    ধসের সমস্ত দিক— যার মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, উদ্ধার প্রচেষ্টা, এবং তদন্তের ফলাফল পর্যালোচনা করা উচিত। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রক (এমওআরটিএইচ) সুড়ঙ্গ নির্মাণের জন্য এসওপি আপডেট করছে কি না তা দেখা প্রয়োজন। এর মধ্যে কঠোর নিরাপত্তা নির্দেশিকা এবং সাইট মনিটরিং প্রোটোকল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। টানেল প্রকল্প শুরু করার আগে বিস্তারিত ভূতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করা উচিত যাতে ফাটলরেখা বা অস্থিতিশীল শিলা গঠনের মতো সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা যায়। নির্মাণের সময়ে কঠোর গুণমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা আবশ্যক, যাতে সঠিক সমর্থন ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তার মান অনুসরণ করা হয়।

    নির্মাণ শ্রমিকদের টানেল নিরাপত্তা পদ্ধতি এবং জরুরি প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। ক্ষতিগ্রস্ত টানেল থেকে যানবাহন সরিয়ে দ্রুত নেওয়া উচিত যাতে ব্যাঘাত কম হয়। উদ্ধার প্রচেষ্টা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ সম্পর্কে জনসাধারণকে নিয়মিত আপডেট করাও সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সরকার আদৌ এতসব করার জন্য ইচ্ছুক কি না! সুড়ঙ্গে কাজ করা শ্রমিকদের জীবন নিয়ে জুয়োখেলা যেন একটা স্বাভাবিক ঘটনায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যাতে কারও কিছু যায় আসে না।

    যমুনোত্রী জাতীয় সড়কের একটি নির্মাণাধীন সুড়ঙ্গ

    সুড়ঙ্গ-ধসের ঘটনাগুলিতে উদ্ধারকাজের ক্রমাগত টিভি-খবর দেখতে জনগণ প্রস্তুত। এ যেন তাদের একটা অচেনা উত্তেজনা দিচ্ছে। কিন্তু এই অনভিপ্রেত ঘটনাগুলিকে কীভাবে বন্ধ করা যায়, কীভাবে পরিবেশ রক্ষা হয় এবং কীভাবেই-বা নিরীহ শ্রমিকদের এসব কাজে প্রাণের সুরক্ষা দেওয়া যায়, তা নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। ঠিক যেমন আজ অবধি আমাদের দেশে মেথরের কাজের কোনও সুরাহা হল না। প্রতি বছর ভারতে ক্ষতিকর রাসায়নিক কাদায় নিমজ্জিত হয়ে, শ্বাসরোধে মৃত্যু হয় নর্দমায় নেমে কাজ করা বহু মানুষের। তাদের মধ্যে অনেকেই এই কাজের জন্য দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগতে বাধ্য হয়— যার মধ্যে রয়েছে সংক্রমণ, ত্বক ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, হেপাটাইটিস-এ, গ্যাস্ট্রিক ক্যানসার এবং কাজের সময় নতজানু অবস্থানে থাকার কারণে সৃষ্ট মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিকতা।

    এই সব কারণে পর্যায়ক্রমিক চিকিৎসা-পরীক্ষা এবং বীমা-সুরক্ষা অপরিহার্য। এই অত্যাবশ্যক কর্মীবাহিনীর কাজের মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাদের জন্য আরামদায়ক আবাসনের ব্যবস্থা এবং তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত প্রতিশ্রুতি কাগজ-কলমেই থেকে গেছে। মেথরের কাজ বা ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ আইন অনুযায়ী ভারতে বিলুপ্ত। কিন্তু চরম দারিদ্র্যের কারণে এইসব কর্মীরা এখনও লক্ষ-লক্ষ মানুষের মল-মূত্রে নিজেদের নিমজ্জিত করতে বাধ্য হয়। যার ফলে তারা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয় এবং সামাজিক অস্পৃশ্যতারও শিকার হয় তারা। যদি পৌর সংস্থাগুলি রাস্তার সৌন্দর্যায়ন আর সবুজের উন্নয়নে কোটি-কোটি টাকা ব্যয় করতে পারে, তাহলে কেন সেই তহবিল নতুন মেশিন কেনার জন্য ব্যয় করা যায় না, যা মানুষকে এই বিপজ্জনক কাজ থেকে খানিক মুক্তি দিতে পারে? ভারতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনগুলির একদম প্রথম অবস্থায় মন্ত্র ছিল, ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সুড়ঙ্গে, নর্দমায় কাজ করা মানুষগুলি একটি প্রাণ হবার মর্যাদা কবে পাবে, সেই প্রতিশ্রুতি ক্রমশ ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook