ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • আবহমান আখ্যান

    বিষাণ বসু (February 10, 2025)
     

    একবার (রাধারাণী) নিয়ে এল রেডিও, সাতগাঁয়ে প্রথম রেডিও। পিতৃপক্ষের শেষ দিন ভোররাতে এল-ডোরাডোর বৈঠকখানা থেকে ভেসে এল শঙ্খধ্বনি, দেবীর আগমনী গান। আদিরামবাটির ছোটো-বড়ো সকলে ঘুম ভেঙে উঠে উঁকি দিয়ে দেখল এল-ডোরাডোর রঙীন শার্সি আলোকিত, বৈঠকখানার দরোজা খোলা, ভেতরে চেয়ার শতরঞ্চি পাতা হয়েছে।

    কিন্তু কেউ সেই বেতার অনুষ্ঠান শুনতে এল না। শুধু তাই নয়, পরদিন রামরাম শাস্ত্রীমশাইয়ের নেতৃত্বে সাতগাঁর কনৌজি ব্রাহ্মণ সমাজ অল ইন্ডিয়া রেডিওর অধিকর্তাকে প্রতিবাদপত্র লিখল। তাঁদের অভিযোগ – যে সময়ে এই রেডিও সম্প্রচার করা হয়েছে, তখন পিতৃজাতকের আত্মারা তিল-গঙ্গাজল পেতে দ্যুলোক থেকে ইহলোকে নেমে আসেন। এই বিশেষ দিনটি মর্ত্যভূমিতে তাঁদের মহা আলয়। এমত সময়ে বেতার তরঙ্গে জনৈক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নামধারী অব্রাহ্মণের কণ্ঠে পুরাণপাঠ তাঁদের যাত্রাপথে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। বাংলা ইংরেজি ও সংস্কৃতে লেখা ১১৮টি চিঠি জমা পড়ল ১ নং গার্সটিন প্লেসের দপ্তরে। সাহেব অধিকর্তা মহিষাসুরমর্দিনী নামে অনুষ্ঠানের সম্প্রচার সাত দিন পিছিয়ে দিলেন। রাধারাণীও আর এল-ডোরাডোয় রেডিও নিয়ে আসেনি।…’

    না এলেই বা! ঠিক তার পরের বছরেই শোনা গেল আগমনী গান— হুবহু অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির গলায়— অবশ্য শাকম্ভরী দেবী না চিনলে, সে গলা কে-ই বা চিনত। দেখা গেল, কাদের একটা বাড়ির কাকাতুয়া আদিরামবাটির লাগোয়া নিমগাছের ডালে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির গলায় গান গাইছে। পুজো পেরিয়ে গেলেও পাখিটি নিমগাছ ছেড়ে কোত্থাও যায় না। শেষমেশ, শাকম্ভরী দেবী আগেই যেমন বলেছিলেন, সাতগাঁ-র আদিরামবাটির বাড়ির বাসিন্দাদের একজন হয়ে ওঠে সে-ও। এদিকে শাকম্ভরী দেবী, তাঁর গল্পটিও তো কিছু কম ইন্টারেস্টিং নয়। তাঁর আশ্চর্য জীবন— শেষমেশ অন্তর্জলি যাত্রা— আর সেখানে শেষ মুহূর্তে সেই… ‘জলে-ডোবা দুই পায়ের ফাঁকে কী যেন ভেসে উঠল। ঘাটে শোরগোল পড়ে গেল। ছাতা হাতে লোকটার মুখে রামনাম দ্রুত হলো। রামপ্রাণ ঘাটের সিঁড়িতে অপেক্ষমাণ শ্মশানযাত্রীদের দিকে ফিরে ঘোষণা করলেন— ‘ও কিছু না, ফুলটা আবার বেরিয়ে এসেছে!’…’

    আরও পড়ুন : বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিসরে যেভাবে ফিরে এল কাজী নজরুল ইসলামের এই কাব্যগ্রন্থ! লিখছেন কোয়েল সাহা…

    ফুল বেরিয়ে আসা অর্থে, শাকম্ভরী দেবীর জরায়ু বহির্গম, এবং অন্তর্জলি যাত্রা থেকে তাঁর বাড়ি ফিরে আসা। অথবা সরোজা। যে কিনা… ‘বিয়ের সময়ে বাপের বাড়ি থেকে এক দুর্লভ যৌতুক এনেছিল। জলে-জলে শব্দতরঙ্গে দূরনিবাসী আত্মীয়পরিজনদের সঙ্গে বার্তা বিনিময় করতে পারত। ব্যাপারটা অনেকটা টেলিফোনের মতোই, শুধু তারের বদলে মাধ্যম হলো নদীর বহতা জল। এবং এই বার্তালাপ শুধুমাত্র দুজন মানুষের মধ্যেই সম্ভব, সেই দুজনকে একই সময়ে জলে ডুব দিতে হয়।…’ এভাবেই সে স্নানের সময় বার্তা পাবে শিউলির অসুখের। আর-একদিন স্নান করতে গিয়ে..

    কিন্তু আমরা তো পুরো গল্পটা বলতে যাচ্ছি না। বলা সম্ভবও নয়। কেননা, সার্ভেয়ার কেশব কুমার গুছাইত তো বলেই দিয়েছেন, ‘ত্রিবেণীর নীচের দিকে সরস্বতী আর হুগলি নদী বারে বারে বন্যায় কুল ভাসিয়ে খাত বদলিয়ে দইয়ের ঘোলের মতো ঘেঁটেছে।’ যা কিনা ঘোল খাইয়ে দিয়েছিল রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। ‘এখানে যত খুঁড়বেন, ততই দেখবেন অনেকটা নিচের লেয়ারে ওপরের সময়ের আর্টিফ্যাক্ট রয়েছে, প্রায় দুটো-তিনটে সেঞ্চুরি মিলেমিশে আছে।’ সে গল্প বলা কি সোজা কথা, যার সম্পর্কে খোদ রাখালদাসবাবু বলে গেছেন, ‘হিয়ার দ্য পাস্ট অ্যান্ড দ্য প্রেজেন্ট আর সো ইনেক্সট্রিকেবলি লিংকড দ্যাট সিকিং আ প্রপার ক্রনোলজিকাল সিকোয়েন্স ইজ অ্যাজ গুড অ্যাজ চেজিং আ মিরাজ!’

    কিন্তু পরিমলবাবু বলেছেন। সেই গল্প। ছয়-সাত শতাব্দী ধরে ঘটে যাওয়া গল্প। সময়ক্রম মেনে নয়, সাল-তারিখ মেনে তো নয়-ই। সরস্বতী আর হুগলি নদীর মধ্যেকার সাতগাঁ-র দইয়ের ঘোলের মতো ঘাঁটা গল্প। যে জীবনে রয়েছে পুরনোকে আঁকড়ে গোঁড়ামির চূড়ান্ত প্রকাশ আর তারই পাশাপাশি রয়েছে নতুনকে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার স্পর্ধা (ক্ষেত্রবিশেষে নতুনের আকর্ষণে তলিয়ে যাওয়া ও তাই দেখে গোঁড়ামির আত্মপ্রসাদ)— ক্ষয়িষ্ণু এক সভ্যতার উত্থান-পতনের কাহিনি। কলকাতা থেকে তিপ্পান্ন কিলোমিটার দূরের এক জনপদের বিচিত্র সমৃদ্ধি সৃজন ক্ষয় ও ধ্বংসের গল্প (যে গল্প কি শুধুই সেই জনপদের?)— আদিরামবাটির সুপ্রাচীন মন্দিরের গায়ের টেরাকোটা টালির এলোমেলো বিন্যাসের মতো গল্পমালা লেখক শুনিয়েছেন আশ্চর্য মুনশিয়ানায়।

    সার্ভেয়ার কেশব কুমার গুছাইত তো বলেই দিয়েছেন, ‘ত্রিবেণীর নীচের দিকে সরস্বতী আর হুগলি নদী বারে বারে বন্যায় কুল ভাসিয়ে খাত বদলিয়ে দইয়ের ঘোলের মতো ঘেঁটেছে।’ যা কিনা ঘোল খাইয়ে দিয়েছিল
    রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কেও।

    সাতগাঁ-র আদিরামবাটির এক গোঁড়া স্মার্ত পরিবারের লোকজন ও তাঁদের জীবন আপাতদৃষ্টিতে এই উপন্যাসের কেন্দ্র। শিউলি বিবাহসূত্রে বাঙাল পরিবারে বাঁধা পড়েছে যেহেতু, সেহেতু স্মৃতির ভূখণ্ড হিসেবে সিলেটও উপকেন্দ্র বইকি— কিন্তু ‘সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা’ এক আশ্চর্য উপন্যাস, যাকে সময় বা ভূখণ্ড দিয়ে বোঝাতে পারা মুশকিল। অজস্র চরিত্র, কমপক্ষে সত্তর-আশিটি তো বটেই, যার মধ্যে বাড়ির পোষা সেই কাকাতুয়া ও ঘোড়াটি, এমনকী, লঝঝরে হার্লে-ডেভিডসনটিও, গুরুত্বে কিছু কম নয়। ইতিহাসের খুঁটিনাটির সঙ্গে লেখকের নিখুঁত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিস্ময়কর কল্পনাশক্তির মিশেল। তার সঙ্গে একেবারে বাদাম পাহাড় থেকে খুঁজে ফিরিয়ে আনা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা। সত্যি বলতে কী, এর সঙ্গে তুলনা করার মতো উপন্যাস, আমার সীমিত পঠন-অভিজ্ঞতায়, দেশ ও বিদেশের লেখকদের ধরেই বলছি, খুব বেশি পড়িনি।

    দেশ-বিদেশের লেখক ও তাঁদের সৃষ্টির কথা যখন প্রসঙ্গক্রমে এসেই পড়ল, তখন মনের মধ্যে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেলা যাক। লেখক ও তাঁর মাস্টারপিসের নির্মাণে স্থানিকতা তথা ভৌগোলিকতা তথা তাঁর শিকড়ের তাৎপর্য কতখানি? এককথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু কিছু সৃষ্টি এমন মাটি কামড়ে থাকে, তখন একটা চটজলদি উত্তর দিয়ে ফেলতে লোভ হয়।

    এই বই পড়ে যেমন। লেখককে কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলাম, ‘যা-ই বলুন, আপনার ভাটপাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড (পরিমল ভট্টাচার্যের জন্মস্থান ভাটপাড়া) ছাড়া এ উপন্যাস লেখা হত না।’

    পরিমলদা হেসে ফেললেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, বলতে পারেন, এক অর্থে এটা হল আমার হোমেজ টু ভাটপাড়া অ্যান্ড দ্যাট লাইফ!’

    যদ্দূর মনে পড়ে, ‘রূপসী বাংলা’-র উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল— আবহমান বাংলা ও বাঙালীকে। ‘সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা’ প্রসঙ্গেও কথাটা বলা যায়— আবহমান বাঙালী জীবন তথা বাঙালিত্বের প্রতি… হোমেজ।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook