এক আকাশ ভয়ানক মেঘের কলকাতায় রাতের বেলা গাড়ি ভাড়া করে অফিস ছুটছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নীল বাঁচাতে। অ্যাটকিনসন সাহেবের অফিসে রোজকার মতো হিসেবের কাজ শেষ করে সেদিনও বাড়ি ফিরে এসেছেন তিনি। সেদিন কলকাতায় দিনের বেলা আকাশ ছিল খটখটে। রাতে কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। গিরিশচন্দ্রের মনে হল, ‘অফিসের ছাদে নীল পড়িয়া আছে, বৃষ্টি হইলে বিস্তর টাকা ক্ষতি হইবে। তাড়াতাড়ি একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া অফিসে গেলাম। দারোয়ানদের জাগাইয়া দ্বিগুণ মজুরী দিয়া কুলী সংগ্রহ করিলাম, পরে নীল গুদামে তুলাইয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। পরদিন অফিসে গিয়া শুনিলাম, আমি চলিয়া আসিবার পর অ্যাটকিনসন সাহেব নীল রক্ষার জন্য ব্যস্ত হইয়া অফিসে গিয়াছিলেন। দারোয়ানের মুখে আমার নীল তোলার কথা শুনিয়া তিনি নিশ্চিন্ত হইয়া বাটী যান।’
নীল ব্যবসায়ীর সাহেবি অফিসের প্রতি এই দায়বদ্ধতার পুরস্কারস্বরূপ গিরিশচন্দ্র পেয়েছিলেন নিজের হাতের আঁজলার মাপে তিন আঁজলা টাকা। আর ২১০ টাকা উঠেছিল তাঁরই নেতৃত্বে ন্যাশনাল থিয়েটারের ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের টিকিট বিক্রি থেকে। টাউন হলে সে-অভিনয় হল ১৮৭৩ সালের ২৯ মার্চ। পুরো টাকাটাই দান করা হল সেকালের নেটিভ হাসপাতালের (এখন মেয়ো হাসপাতাল) উন্নতির জন্য। চ্যারিটি নাইট বা সাহায্য-রজনী বাংলা থিয়েটারে সেই প্রথম।
আরও পড়ুন: বিনোদিনীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন স্বয়ং গিরিশচন্দ্রই…
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ দিয়েই ন্যাশনাল থিয়েটার উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু সে-ন্যাশনাল থিয়েটার ছিল গোটা ন্যাশনাল থিয়েটার। আর তার প্রেরণায় খানিকটা ধুনো দিয়েছিলেন এক নাম-না-জানা দর্শক। ১৮৭২ এর ২৪ মে ‘এডুকেশন গেজেট’ সংবাদপত্রে ‘কশ্চিৎ দর্শক’ চিঠি লিখেছিলেন। সে-চিঠির এক জায়গায় তিনি লেখেন, ‘আমার বোধ হয় এই নাটকাভিনেতৃগণ মনোযোগ করিলে এমন একটি দেশীয় নাট্যশালা স্থাপন করিতে পারেন, যেখানে লোকে ইচ্ছা করিলে টিকিট ক্রয় করিয়া যাইতে পারেন এবং দেশেরও অনেকটা সামাজিকতার পরিচয় হয়।’ এ-চিঠি লেখা দীনবন্ধু মিত্রেরই আর একটি নাটক ‘লীলাবতী’-র অভিনয় দেখে। অভিনয় করেছিল ‘বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’। ১৮৬৮ সালে গিরিশচন্দ্রেরই উদ্যোগে সেই শখের থিয়েটারের দলের সূচনা, পরে যার নাম হবে ‘শ্যামবাজার নাট্য সমাজ’। গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে ছিলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। ওই নগেন্দ্রনাথের বাগবাজারের বাড়িরই অর্কেষ্ট্রা-পার্টিতে মাঝে মাঝে আসতেন গিরিশচন্দ্র, খোসগল্প করতে আর বাজনা শুনতে। সুরের পথের সেই হাওয়ায় অভিনয়ের হয়তো ছিল স্বপ্নমাত্র। কিন্তু গানের ভুবন তখন ঘিরে আছে অ্যাটকিনসনের দায়বদ্ধ হিসেবিকে। এভাবেই চলতে চলতে ঠিক হল মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা’ অভিনয় করবেন তাঁরা। গান রচনার ভার পড়ল গিরিশচন্দ্রের ওপর। ১৮৬৭-তেই গীতিকার হিসেবে গিরিশচন্দ্রের আত্মপ্রকাশ। তার পরে সে-বছরই বাগবাজারে দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির কাছে দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদের ভূমিকায় এলেন অভিনেতা গিরিশচন্দ্র, যে অভিনয় দেখে স্বয়ং দীনবন্ধু উচ্ছ্বসিত।
‘সধবার একাদশী’ এত জনপ্রিয় হল যে, কলকাতার নানা জায়গায় সাত-সাতবার তার অভিনয় হল। তার পরে ‘লীলাবতী’। সেও বেশ সাড়া জাগাল। গিরিশচন্দ্র নিজেই জানাচ্ছেন, ‘সামান্য চাঁদার অর্থে কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, কিন্তু অভিনয়ের সুখ্যাতি এত বিস্তৃত যে দলে দলে লোক টিকিটের জন্যে উমেদার।’ আর তার পরেই ওই জনৈক দর্শকের চিঠি। বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারের সদস্যরা স্থায়ী একটি নাট্যশালা গড়ে টিকিট বিক্রি করে অভিনয়ের কথা ভাবলেন। নাট্যশালার নাম ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ হবে ঠিক হল। কিন্তু বেঁকে বসলেন গিরিশচন্দ্র। তাঁর মতে, ‘ন্যাশন্যাল থিয়েটার নামে অনেকেই বুঝিবে যে ইহা জাতীয় রঙ্গমঞ্চ কিন্তু কয়েকজন গৃহস্থ যুবা একত্র হইয়া ক্ষুদ্র সরঞ্জামে ন্যাশন্যাল থিয়েটার করিতেছে ইহা বিসদৃশ জ্ঞান হইল।’ কিন্তু গিরিশচন্দ্রের মত মেনে নিলেন না বাকিরা। দল ছাড়লেন গিরিশ। ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর চিৎপুরে মধুসূদন সান্যালের ‘ঘড়িওয়ালা’ প্রাসাদের সামনের উঠোনে ‘নীলদর্পণ’ অভিনয় দিয়ে শুরু হল ন্যাশনাল থিয়েটার। টিকিট— প্রথম শ্রেণি এক টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি আট আনা। রেগে গেলেন গিরিশ, বেনামে চিঠি লিখলেন ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এ ধুয়ে দিলেন ন্যাশনালের ‘নীলদর্পণ’-কে। তাতেও মিটল না, এর পরে স্বনামেই ন্যাশন্যাল থিয়েটারকে ব্যঙ্গ করে গানও লিখলেন।
ততদিনে ন্যাশনাল থিয়েটার ভেঙে গিয়েছে। গিরিশ বাদে বাকি ন্যাশনাল থিয়েটার হয়েছে হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার আর গিরিশের ন্যাশনাল থিয়েটার। হিন্দু ন্যাশন্যাল থিয়েটার পুব বাংলায় রীতিমতো কল-শো করে বেড়াচ্ছে। গিরিশচন্দ্রও পাল্লা দিয়ে করছেন কলকাতায়, একের পরে এক চ্যারিটি শো। রাজা রাধাকান্ত দেবের নাটমন্দিরে ন্যাশন্যালের অভিনয়মঞ্চ হল। ১২ এপ্রিল, ১৮৭৩-এ মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’র রিজার্ভ সিট চার টাকা, প্রথম শ্রেণি দু’টাকা আর দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট ধার্য হল এক টাকা। ম্যানেজার ধর্মদাস সুর। সেখানেই আবার ‘নীলদর্পণ’ হল। ১০ মে ১৮৭৩-এ বঙ্কিমের ‘কপালকুণ্ডলা’ দিয়ে সেবারের মতো শেষ। তবু এই সফলতার মধ্যেও ভঙ্গ রঙ্গমঞ্চের বেদনা গিরিশচন্দ্রের ছিল। লিখেছেন, ‘এক দলে অর্ধেন্দু, আর এক দলে আমার থাকা না থাকা সমান, কারণ নানা স্থানে বেড়াইবার আমার শক্তি, সুযোগ ও ইচ্ছা ছিল না।’ হয়তো তাই ১৮৭৩-এর ফেব্রুয়ারিতেই মিলে গেল দুই ন্যাশনাল, ফিরে এলেন গিরিশ।
কয়েকজন যুবকের সখের উদ্যোগকে ন্যাশনাল নাম দিতে চাননি গিরিশ। সেই না-চাওয়ার পিছনে পেশাদারিত্বের বোধই হয়তো ছিল সবচেয়ে প্রবল। যে-পেশাদার মনোভাবই হয়তো তাঁকে রাতের কলকাতায় অফিস ছুটিয়েছিল সাহেব কোম্পানির নীল বাঁচাতে। সেই বোধ থেকেই কি দুই ন্যাশনাল মিলে যাওয়ার পরে প্রথম অভিনয় করার সময়ে নিজের নাম ছাপাতে দ্বিধা ছিল তাঁর? অমৃতলাল বসুর স্মৃতি জানাচ্ছে, ‘গিরিশবাবু আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে প্রথম অভিনয় করবার সময় বিজ্ঞাপনে তাঁর নাম ছাপিয়ে পাশে ‘এমেচার’ কথাটা লেখা হয়, তার কারণ আমি এখানে উল্লেখ করছি।… গোড়ায় গিরিশবাবু আমাদের দলে নাই, এ-ক্ষোভটা আমাদের মনে বড়ই আঘাত করত, পুনর্মিলনের পর আমরা বড় আহ্লাদে তার নামটি ছাপাবার অনুমতি প্রার্থনা করলুম, তাতে তিনি বলেন যে, আমার কোন আপত্তি নাই, তবে অফিসে একটা ভাল কর্ম করি, টিকিট বিক্রী থিয়েটারে এক্ট কচ্ছি, এই বলে আমার নাম প্রচার হলে তাঁরা হয়ত কিছু মনে করতে পারেন; তাতেই আমরা বলি যে, এমেচার কথাটা তাঁর নামের পাশে দিলে আর লজ্জার কোন কথা থাকবে না; নইলে পর্দার আড়ালে সকল এক্টরই এমেচার।’
গিরিশচন্দ্রের জন্মদিনে তাঁর স্ববিরোধী মনের নানা রঙের দিনগুলিকে আমরা অ্যামেচার না প্রোফেশনাল— কোন দৃষ্টিতে দেখব, সেটা কি আজও নিশ্চিত করা যাচ্ছে!