The stars are blotted out,
The clouds are covering clouds,
It is darkness vibrant, sonant.
In the roaring, whirling wind
Are the souls of a million lunatics.
Just loose from the prison-house,
Wrenching trees by the roots,
Sweeping all from the path.
The sea has joined the fray,
And swirls up mountain-waves,
To reach the pitchy sky.
The flash of lurid light
Reveals on every side
A thousand, thousand shades
Of Death begrimed and black—
Scattering plagues and sorrows,
Dancing mad with joy,
Come, Mother, come!
For Terror is Thy name,
Death is in Thy breath,
And every shaking step
Destroys a world for e’er.
Thou ‘Time’, the All-Destroyer!
Come, O Mother, come!
Who dares misery love,
And hug the form of Death,
Dance in Destruction’s dance,
To him the mother comes.
—Kali The Mother. Swami Vivekananda
‘How I used to hate Kali!’— সন্দেহপ্রবণ নরেন্দ্রনাথ দত্তর কথা স্মরণ করে পরিণত বয়সে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই এই কথাগুলি বলেছিলেন। সেই সময় শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁর মনে হত, ‘a brain-sick baby’, ‘always seeing visions’। তিনি অকপটে বলেছেন, ‘I hated it’। এরপরও দীর্ঘ ছ’বছর লড়াই করেছেন, বলেছেন, “That was the ground of my six years’ fight that I would not accept Her. But I had to accept Her at last!”
১৮৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, অর্থাৎ, তাঁর মৃত্যুর কমবেশি চার বছর আগে কাশ্মীরের ক্ষীরভবানী মন্দির দর্শনের পর, শ্রীনগরে তিনি লেখেন, ‘Kali The Mother’। সম্প্রতি দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী তাঁর ‘কাশ্মীরী শৈবদর্শনে কালীতত্ত্ব’ বক্তৃতায় কবিতাটির একটি অসামান্য তান্ত্রিক ব্যাখ্যা করেছেন। বোঝাই যায়, ১২৭ বছরেও কবিতাটির বয়স একটুও বাড়েনি।
আমি এখানে বৈদিক দৃষ্টিতে কবিতাটিকে বুঝতে চাইব। তার আগে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া দরকার, ভূমিকা হিসেবে।
আরও পড়ুন : বারীন ঘোষকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ…
কবিতাটির প্রথম তিনটি লাইনে এক আশ্চর্য অন্ধকারের বর্ণনা করা হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনুবাদ করেছিলেন, ‘নিঃশেষে নিভেছে তারাদল, মেঘ এসে আবরিছে মেঘ/ স্পন্দিত ধব্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণ-বায়ুবেগ!’
সংগত কারণেই, সত্যেন দত্ত ‘blotted out’ অনুবাদ করেছেন ‘নিভেছে’। কিন্তু শব্দটিকে অন্যভাবেও দেখা যায়। সাদা ব্লটিং পেপার যেভাবে গাঢ় নীল কালি শুষে নেয়, তেমনই এক অন্ধকার শুষে নিচ্ছে কালো আকাশের বুক থেকে আলোর সমস্ত বিন্দু। মৃত্যুর মতো এক অন্ধকার, যা শুষে নিচ্ছে নিখিল অস্তিত্ব। মেঘ দিয়ে আলো ঢাকা পড়ে, এই অন্ধকারে মেঘ দিয়ে মেঘ ঢাকা আছে।
এখানে আমাদের মনে পড়বে, নাসদীয় সুক্তের কথা ‘সর্বপ্রথমে অন্ধকার দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল।’ (ঋক ১০/১২৯/৩) স্বামীজির নিজের অনুবাদে, ‘At first in darkness hidden darkness lay’. স্বভাবতই আমাদের প্রশ্ন জাগে, দুটো অন্ধকার বা দুটো মেঘ কেন? দ্বিতীয় অন্ধকারটা আমাদের অজ্ঞানের অন্ধকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান ইত্যাদি কোনও প্রমাণ দিয়েই যেমন আমাদের নিজেদের মৃত্যুর অনুভূতিটা যে ঠিক কেমন— তা আমরা জানতে পারি না। এই না-জানাটাই অন্ধকার। অর্থাৎ, সব খোওয়ানো এক অন্ধকারে মহাবিশ্বের তলিয়ে যাওয়া একটা অন্ধকার আর সেই অন্ধকারকে আমাদের না-জানাটা আরেকটা অন্ধকার। একটা দিয়ে আরেকটা ঢাকা আছে।
এমন এক গাঢ় অন্ধকার, অথচ এই অন্ধকারে ‘কিছু নেই’, ‘সব শূন্য’— এমন কিন্তু নয়। সমস্ত অস্তিত্ব শুষে নেওয়ার পরেও এই অন্ধকার ‘vibrant, sonant’, অর্থাৎ, স্পন্দিত ও ধ্বনিময়। পপুলার ফিজিক্সের বইতে লেখা হয়, শূন্য থেকে এসেছে এই মহাবিশ্ব। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই জানা যায়, সেই শূন্যের ভেতরেও থাকে নানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংঘর্ষ। সোজা কথায়, ‘কিছু না’ থেকে ‘কোনও কিছু’-র জন্ম হতে পারে— এই কথা ভারতীয় দর্শন বিশ্বাস করে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে অন্ধকারের বর্ণনা, আধুনিক ভাষায় যাকে বলে ‘Poetic imagery’— তাকে আমরা কীভাবে বুঝব? এই অন্ধকার কি শুধুই কবির কল্পনা বা শব্দের পাশে শব্দ বসানোর খেলা, যাকে ‘লেখা’ বলা চলে— যার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই?
‘কল্পনা’ শব্দটি সাধারণত বাংলায় অবাস্তব হিসেবেই ব্যাবহার করা হয়। শ্রীমৎ অনির্বাণ ‘Poetic imagery’ শব্দটির সংস্কৃত বা ‘বৈদিক ভাষান্তর’ করেছিলেন— ‘কবিকল্প’। ‘কবি’ শব্দের অর্থ ক্রান্তদর্শী— যিনি অনেক দূরের একটা কিছুর প্রভাস দেখে তাকে রূপ দেওয়ার আকুতি বহন করেন। বস্তুত, ‘কব্’ বা ‘কূ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘কবি’ শব্দটির অর্থ, ‘আকুতি আছে যার’। বেদের ভাষায়, ‘ঋষির্বিপ্রঃ কাব্যেন’, অর্থাৎ, তিনিই ঋষি বা কবি, ‘অলখের আকুতিতে হৃদয় যাঁর টলমল’। আকুতি আছে, বলেই তিনি কবি। বেদে ‘কল্প’ শব্দটি সৃষ্টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। নিজের ভেতরে বা অন্তর্দৃষ্ট রূপের বাস্তব হওয়াকে বলা হয় ‘কল্প’।
সুতরাং, বৈদিক অর্থে কল্পনা অবাস্তব তো নয়ই, বরং বস্তুর জগৎ থেকে এই ভাবের জগৎটাই ঢের বেশি সত্যি। অনির্বাণজি লিখেছেন, ‘কবি বাল্মীকিকে বলেছিলেন, তুমি রামের যে কল্পনা করবে, তাই সত্য হবে, ইতিহাসের রাম মেকী।’ তাই বলা যায়, অন্তত বৈদিক ভাবনায় কবিকল্পনা কদাচ অসত্য নয়। সুতরাং, অন্ধকারের এই ‘কবিকল্প’ এক সত্য উপলব্ধিরই বয়ান। কারণ, মৃত্যু আর সত্য একেবারে সমার্থক।
অনির্বাণজি তাঁর একটি চিঠিতে লিখছেন, “Death আর Truth একেবারে সমার্থক। সত্যের ক্রমবিকাশ আছে— মৃত্যুরও তাই। ম’রে ম’রে মরণ যেন আর ফুরায় না। সত্যি সত্যি না মরতে পারলে সত্যকে জানা যায় না। ঘুম হচ্ছে নকল মরণ— সমাধি সত্যিকার মরণ। ‘এক’-এর অনুভব মানেই মরে যাওয়া।”
এই মৃত্যু আমাদের জীবনের একমাত্র স্থির নিশ্চিন্ততা। অতর্কিতে চিলের মতো ছোঁ মেরে সে আমদের নিয়ে যাবে অন্ধকারের দেশে। যা আসবেই, তাকে দূরে ঠেলে রেখে কী লাভ! তাই জীবনের বুকে বসে যদি মরণের আস্বাদ পেতে পারি, তবে সেই পাওয়ার নামই জ্ঞান, সেই অনুভূতিই রাধার প্রেম বা দশমী দশা, তাই হল যোগীর যোগ, শিবের শিবত্ব। মরণের পেয়ালায় এই যে জীবনের মদে চুমুক দেওয়া— এই হল মহেশ্বরের বিলাস; না হলে করোটি তাঁর পানপাত্র কেন!
বৃহদাকারণ্যক উপনিষদে এই অন্ধকারের কথা আমরা পাই। সেখানে মরমি কবির ভাষায়, সৃষ্টির একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। উপনিষদের দ্বিতীয় ব্রাহ্মণের শুরুতেই বলা হচ্ছে— “[মন প্রভৃতি উৎপত্তির] আগে এখানে কিছুই ছিল না। মৃত্যুর দ্বারা এইসব ঢাকা ছিল অথবা অশনায়ার দ্বারা। অশনায়-ই মৃত্যু। এরপর মৃত্যু মনে করলেন ‘আমি সমনস্ক বা আত্মবান হব’, আর সেই কারণেই মৃত্যু ‘তদ্রূপ’ বা সেইপ্রকার মনের সৃষ্টি করলেন” (বৃ-১/২/১)।
‘অশনায়’ অর্থ ‘আশনাই’, বা ‘খাই খাই ভাব’ অর্থাৎ, বুভুক্ষা। ঋক সংহিতায় একেই বলা হয়েছে, ‘কাম’ (কামস্তদগ্রে সমবর্ততাধি মনসো রেতঃ প্রথমং য়দাসীৎ— ঋ-১০/১২৯/৪)। সুতরাং, আমাদের মন হল মৃত্যু আর বুভুক্ষার মিথুন। যার একপ্রান্তে রয়েছে অতৃপ্ত বা ‘অব্যাকৃত কামনা’ আর অপর প্রান্তে রয়েছে ‘নিত্য পরিনামের উন্মুখীনতা’, যাকে বলা যায়, নির্বাণ বা উৎসে ফিরে চলার টান। বস্তুত ‘অধ্যাত্মসাধনা মাত্রেই তাই প্রবৃত্তিপর (Progressive) নয়, নিবৃত্তিপর (Regressive)। পরিণামবাদ রূপের বিবর্তনকে দেখে অস্ফুট থেকে স্ফুটের দিকে। কিন্তু অধ্যাত্মসাধনা ফিরে চলে স্ফুটব্যক্ত থেকে আদিঅব্যক্তের দিকে, উৎসের দিকে।’ (বেদ-মীমাংসা, অনির্বাণ) এই ‘আদিঅব্যক্ত’ মিথুনতত্ত্বই তন্ত্র-সিদ্ধান্তের প্রাণ।
আমরা জানি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবলীলা দেখার পর ফ্রয়েড সাহেব, তাঁর দর্শনের মূল ভিত্তি যে ‘সুখনীতি’ (pleasure principal), সেই ধারণার আমূল পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯২০ সালে রচিত তাঁর বিখ্যাত ‘Beyond plesure principal’ প্রবন্ধে তিনি মানুষের অবচেতনায় ‘সুখনীতি’ ছাড়াও আরও এক নীতির সক্রিয় ভূমিকা টের পান। সেটি হল, মরণ-প্রবৃত্তি বা ‘Death-instinct’। এই মরণ-প্রবৃত্তিকেই তিনি সমস্ত আক্রমক-প্রবৃত্তির উৎস ভেবেছিলেন। যদিও, বৃহদারণ্যকের সঙ্গে ফ্রয়েডের মরণ-প্রবৃত্তির গুরুতর ভেদ আছে। ফ্রয়েডের এই ‘মরণ-প্রবৃত্তি’ নিষ্প্রাণ (inanimate) বা জড় থেকে উৎপন্ন; প্রাণের আবার সেখানেই ফিরে যাওয়ার টান। কিন্তু উক্ত মন্ত্রটিতে যাজ্ঞবল্ক্ বলছেন— ‘এরপর মৃত্যু মনে করলেন আমি আত্মবান হব। তিনি জ্বলতে-জ্বলতে চলতে লাগলেন।’ বলাই বাহুল্য,যাজ্ঞবল্কর মৃত্যু তো নিষ্প্রাণ নয়ই, বরং চৈতন্যবান। শুধু তাই নয়, এই মৃত্যুই অনন্ত বুভুক্ষা মেটানোর জন্য সব কিছু সৃষ্টি করেছেন আর যা যা সৃষ্টি করেছেন, তাই তাই তিনি খেয়ে চলেছেন— ‘মৃত্যু আবার চাইলেন, আমার দ্বিতীয় আত্মা জন্মাক্। তখন তিনি মনে মনে মিথুনীভূত বাকের সঙ্গে সংগত হলেন। তাতে যে রেতঃপাত হল, তা-ই হল সংবৎসর, তার আগে সংবৎসর ছিল না [সংবৎসর= Time]। সংবৎসরকাল ভরণের পর সেই বীজটি কুমার [মহাবিশ্ব বা space] হয়ে জন্মাল। মৃত্যু হাঁ করে তাকে গিলতে গেলেন। সে ‘ভ্যাঁ’ করে উঠল (ভাণ্ অকরোৎ), তা-ই হল বাক্। মৃত্যু দেখলেন, একে খেলে আর কতটুকু পেট ভরবে! তখন তিনি তাঁর এই দ্বিতীয় আত্মা আর তাঁর ওই বাক্ দিয়ে, এই যা-কিছু সৃষ্টি করলেন। যা-যা সৃষ্টি করলেন তাই তিনি খেয়ে চললেন (বৃহ-১/২/৪-৫)।
সমস্যাটি গ্রিক দার্শনিকরাও বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরাও বলতেন, জীবনের একদিকে রয়েছে প্রচণ্ড কামশক্তি বা Eros, যার মধ্য দিয়ে এই গোটা সৃষ্টি ব্যাপার চালু আছে। জীবের জন্ম হচ্ছে, প্রজাতির স্থায়িত্ব সম্ভব হচ্ছে। আর একদিকে রয়েছে মৃত্যু বা Thanatos। এদের যুগ্ম ভূমিকা ছাড়া জীবন সম্ভব নয়। জীবন মানেই কালিক অভিব্যক্তি, তাই ‘কাল’ শব্দটিকে ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিক থেকে দেখলেও, এই ‘যুগ্ম ভূমিকা’-র স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ‘কল্’ ধাতুর প্রধানত দু’টি অর্থ। ‘কল্যতে ইতি কালঃ’— এই ব্যুৎপত্তি অনুসারে ‘কাল’ শব্দটির অর্থ ‘নির্ধারিত সময়’ বা ‘নির্দিষ্ট পরিমাপ’ বোঝায় (to calculate)। যেমন— বর্ষাকাল, গমনকাল ইত্যাদি। আবার, ‘কলনাৎ ইতি কালঃ’— এই ব্যুৎপত্তি অনুসারে ‘কাল’ বলতে বোঝায় ‘ভক্ষণ করা’, ‘ধ্বংস করা’ (to destroy) (তুলনীয়- কালেহস্মি লোকক্ষয়কৃত-গীতা)। সুতরাং, ‘কাল’ শব্দটির অর্থের মধ্যেই রয়েছে এই বিরোধাভাস। বলাই বাহুল্য, ‘কালী’-র মূলে রয়েছে এই ‘কাল’ শব্দটি।
সোজা কথায়, মৃত্যু আর বুভুক্ষা— দ্বৈতের টানাপোড়নে এই যে ভবরোগ বা অসুখ, তাই হল জীবনের সমস্যা। সুতরাং, এর সমাধান দ্বৈতে হতে পারে না, হতে পারে যুগনদ্ধতায়। অর্থাৎ, মৃত্যু ও অশনায় জীবনের এই দু’টি বিপরীত প্রান্তের মিলনই যুগনদ্ধ এবং তাই পরম সত্য। সুতরাং, এই কথা বলাই যায়, জীবনের বুকে বসে মরণের আস্বাদনই যুগনদ্ধ। অর্থাৎ, একই চৈতন্যে একই সময় কাম আর মৃত্যু জড়াজড়ি করে আছে। জড়াজড়ি করে আছে সৃষ্টি আর প্রলয়। আমরা সকলেই শুনেছি, বৌদ্ধতন্ত্রের বিখ্যাত মন্ত্র ‘ওম্ মণিপদ্মে হুঁ’। এখানে মণি প্রলয় বা মৃত্যু, আর পদ্ম সৃষ্টি বা কাম আর তার বীজ— হুঁ। বাউলের ভাষায়, ‘জ্যান্তেমরা’। এই হল জ্ঞান, এই হল প্রজ্ঞার প্রজ্ঞাত্ব।
আমাদের দেশের কৃষ্ণ (Eros) ও কালী (Thanatos) এই দুই দেব-দেবী কল্পনার মধ্যেও একই তত্ত্বের অনুরণন দেখতে পাই। বিবেকানন্দের লেখা দু’টি কবিতার উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি আরও একটু স্পষ্ট করে বোঝানো সম্ভব হবে। প্রথম কবিতা ‘সখার প্রতি’, যেখানে তিনি লিখছেন— বিদ্যার জন্য অর্ধেক জীবন ক্ষয় করে, ধর্মের জন্য অনেক নদী, পাহাড়, শ্মশান ঘুরে— ‘কি ধন করিনু উপার্জন’! মন্ত্র-তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মণ, মতামত, দর্শন-বিজ্ঞান, ত্যাগ-ভোগ— স্রেফ ‘বুদ্ধির বিভ্রম’। তবে সত্য কী? ‘শোনো বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার/ তরঙ্গ আকুল ভবঘোর, এক তরী করে পারাপার—’ কী সেই ‘এক তরী’? সেই তরী হল— ‘প্রেম প্রেম এইমাত্র ধন’। আর এর ঠিক বিপরীত কথা তিনি লিখেছেন, ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’ কবিতায়। সেখানে বলেছেন— প্রেম, সে তো ‘মায়ার ছায়া’, অর্থাৎ, মিথ্যারও মিথ্যা। তবে সত্য কী? ‘সত্য তুমি মৃত্যুরূপা কালী, সুখবনমালী তোমার মায়ার ছায়া।’ এই কবিতাটির শেষ পঙক্তিগুলো অনেকেরই জানা— ‘চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান/ হৃদয় শ্মশান নাচুক তাহাতে শ্যামা’।
কবিতাদু’টির আপাত -বিরোধ যদি মিলিয়ে নিতে পারি, তবে বুঝতে পারব, ‘হৃদয় শ্মশান’ না হলে, ‘প্রেম প্রেম এইমাত্র ধন’ জীবনের প্রত্যক্ষদৃষ্ট সত্য হয়ে ওঠে না। জীবনের বুকে বসে মরণের এই আস্বাদনের রহস্যই কালীর রহস্য। অভিনব গুপ্ত লিখেছিলেন, একে সম্পূর্ণ খুলে বলাও ঠিক নয়, আবার সম্পূর্ণ ঢেকে রাখাও ঠিক নয়। স্বামীজিও কালীর রহস্য আমাদের কাছে সম্পূর্ণ খুলে বলতে চাননি, বলেছেন— ‘No, the thing that made me do it is a secret that will die with me.’
এই রহস্যেরই ঈঙ্গিত দিয়ে কবিতাটি শেষ হয়, শেষ হয় এক ভয়ংকর প্রার্থনায়—
‘…Come, O Mother, come!
Who dares misery love,
And hug the form of Death,
Dance in Destruction’s dance,
To him the Mother comes.’