“সুলতান!
সুলতান! সুলতান!
গম্ভীর স্বরটা নরম হয়ে এলো। অবাক হয়ে দেখলাম রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন রিংমাস্টার কারান্ডিকার…”
আপামর বাঙালির কাছে অন্যতম পরিচিত এক ফেলুদাকাহিনি— ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’। সেখানে মহেশ চৌধুরীর মৃত্যুরহস্যের জট ছাড়ানোর সঙ্গে এগতে থাকে সার্কাসের বাঘকে খাঁচায় ফেরানোর গল্প— টানটান উত্তেজনার শেষে ট্রেনারের ইশারায় বাঘের ঘরে ফেরা।
ডিসেম্বরের শেষে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার জঙ্গলেও উত্তেজনার রসদ কিছু কমতি ছিল না। একদিকে ন’দিন ধরে জঙ্গল চষে ফেলা তিন রাজ্যের বনদপ্তর আর তাদের সুকৌশলে এড়িয়ে চলা সাড়ে তিন বছরের বাঘিনী জিনাতের (Tigress Zeenat) চোর-পুলিশ খেলা— বছরশেষের কয়েকটা দিন বিনোদনের অভাব ছিল না রাজ্যবাসীর। অবশেষে, বাঁকুড়ার জঙ্গল থেকে ঘুমপাড়ানি গুলির শিকার হয়ে আলিপুর চিড়িয়াখানায় ছোট্ট করে ইয়ার-এন্ড ট্রিপ সেরে সিমলিপালের জঙ্গলে ফেরত গেছে সে।
আরও পড়ুন : এদেশে অবিবাহিত যুগল একান্তে সময় কাটালেই দোয?
জিনাতের ‘বঙ্গদর্শন’ পর্ব মিটতে না-মিটতেই আবার ঝাড়খণ্ড এবং পুরুলিয়ার সীমানায় আরেক বাঘের আনাগোনা, ইনি যদিও এখনও বাংলায় পদার্পণ করেননি, কিন্তু ঝাড়খণ্ড সীমান্তে নাকি ইতিউতি দেখা গেছে তাকে— বনকর্মীরা সতর্ক রয়েছেন, বিনা অনুমতিতে বাংলায় ঢুকলেই যাতে খপ করে ধরে ফেলা যায় তাকে।
এখন কথা হল, আপাত-শান্তিপূর্ণ দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলে, যেখানে সচরাচর মানুষ হাতির সঙ্গে সহাবস্থানের চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকে সারা বছর, সেখানে হঠাৎ এত বাঘের আনাগোনা কেন? এ কি নিছকই কাকতালীয়, না কি রাতারাতি বদলে গেল আমাদের ছোটনাগপুরের জঙ্গলের চরিত্র?
উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করা যাক ধাপে ধাপে।
২০২৪ সালের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে মহারাষ্ট্রের তাড়োবা-আন্ধেরি টাইগার রিজার্ভ থেকে উড়িষ্যার সিমলিপালে নিয়ে আসা হয় দু’টি বাঘিনীকে, যাদের বয়স আনুমানিক তিন ও সাড়ে তিন বছর। তাড়োবার কোর এরিয়া, অর্থাৎ গভীর জঙ্গল থেকে পাকড়াও করা হয় কলারওয়ালি ও বাবলি নামক দু’টি বাঘিনীর দুই সন্তান— যমুনা ও জিনাতকে। মহারাষ্ট্র ও উড়িষ্যা সরকারের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ সংস্থা (এনটিসিএ)-র তত্ত্বাবধানে সিমলিপালের জঙ্গলে বাঘের জিনগত বৈচিত্র বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে দু’টি বাঘিনীকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রকল্পের প্রথম ধাপে। আর সেখানে গোড়াতেই গণ্ডগোলের একশেষ।
সহজভাবে বলতে গেলে, আপনি বাজার থেকে মাংস কিনে এনে কড়াইতে চাপালেন, তেল-নুন-মশলা সব দেওয়ার পর মনে পড়ল, ঘরে গ্যাস সিলিন্ডারটাই নেই!
তাড়োবা-আন্ধেরির কোর এরিয়ায় বড় হয়ে ওঠা বাঘিনীদের বর্ষার ঠিক পরে পরেই নিয়ে এসে ফেলে দেওয়া হল সিমলিপালে, যেখানে জঙ্গল তত ঘন নয়, ইতিউতি মানুষ-গবাদি পশুর আনাগোনা এবং সর্বোপরি তাড়োবার সঙ্গে তুলনা করলে খাবারের বিশেষ টানাটানি। একে বর্ষাকাল, তায় সম্পূর্ণ অন্যরকমের হ্যাবিট্যাট, খাবারের অভাব এবং উঠতি বয়সের বাঘিনী, ফলে তারা যে পাড়া চড়তে বেরবে— তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, আপনি এবং আপনার সমাজ সদ্য-যৌবনপ্রাপ্তা কন্যাদের এদিকসেদিক চরে বেড়াতে দেখলে চশমার তলা দিয়ে যতই জাজ করতে বসুন না কেন, বাঘসমাজে এ অত্যন্ত স্বাভাবিক। একটি তিন সাড়ে তিন বছরের বাঘিনী তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুযায়ী ‘দুনিয়াদারি’-র স্বাদ নিতে পথে বেড়িয়ে পড়বে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। আর উড়িষ্যা থেকে ঝাড়খণ্ড হয়ে ছোটনাগপুর অঞ্চলের গভীর জঙ্গল, এ যেন অনেকটাই তার ঘর গেরস্থালির সঙ্গে মিল খায়— ফলে সিমলিপালের খোলামেলা জঙ্গল ছেড়ে পুরুলিয়ার দিকে ধাবমান হওয়াটাও নিতান্ত স্বাভাবিক।
একটা বাঘ নিজের খেয়ালে নিজের টেরিটরি বেছে নেবে মাইলের পর মাইল হাঁটাহাঁটি করে, এ যেমন অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের এই অঞ্চলের সঙ্গে বাঘের ইতিহাস খুব একটা মধুর নয়, লালগড়ের স্মৃতি আমাদের মনে এখনও দগদগে, তাই হয়তো বনদপ্তরের তৎপরতা একটু বেশিই ছিল আসামিদের হাতে-নাতে ধরে মহারাষ্ট্রের বাঘ উড়িষ্যায় ফিরিয়ে দিতে।
মোদ্দা কথা হল, সঠিকভাবে প্রে এস্টিমেশন না করে, জঙ্গলের সঙ্গে ঠিকভাবে খাপ না-খাইয়ে, বর্ষার ঠিক পরে দুমদাম সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ থেকে উদ্ভিন্নযৌবনা বাঘিনীদের নিয়ে এসে পরিকল্পনারহিতভাবে ছেড়ে দিলে— তাদের মন যে ঘরে টিকবে না, এটা খুবই স্বাভাবিক। আর যদি বন্যপ্রাণের জন্য সত্যিকারের দরদ দেখাতেই হয়, তাহলে বাঘেদের আপন খেয়ালে চলাফেরা করতে দিয়ে বনদপ্তরের বরং গ্রামবাসীদের সচেতন করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে আরেকটি লালগড়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
আমাদের দেশ পৃথিবীর প্রায় সত্তর শতাংশ বাঘের শান্তিপূর্ণ বাসভূমি। বাঘের সংখ্যা বন্দে ভারতের স্পিডে না হলেও, দুন এক্সপ্রেসের গতিতে বেড়ে চলেছে এই দেশে, এদিকে দেশের জঙ্গলও বিকশিত ভারতের হাত ধরে ওজন কমিয়ে কমিয়ে লঘুনিতম্বিনী হয়েই চলেছে। এমতাবস্থায় অদূর ভবিষ্যতে এদিক-ওদিক শার্দূল ঠাকুরের দল ঘোরাঘুরি করে বেড়াবে, সেটা বলার জন্য জ্যোতিষীর প্রয়োজন পড়ে না। অতএব, ‘তোর বাঘ আমার ঘরে এল কেন’ টাইপের সস্তা রাজনৈতিক কাজিয়ায় মন না-দিয়ে রাজ্যগুলো যদি করিডর বৃদ্ধি, জঙ্গল বৃদ্ধি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিজ্ঞানসম্মত ট্রান্সলোকেশনে মন দেয়, তাহলে এই পোড়া দেশে বাঘের বাচ্চারা আগামী আরও বেশ কয়েকশো বছর শান্তিতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে।
আর তা না চাইলে? খুব সহজ, বিকশিত ভারতের বিকল্প তো রয়েইছে হাতের সামনে! সিদ্ধান্ত আপনার।