ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • বাড়ি থেকে পালিয়ে

    তরুণ গোস্বামী (January 16, 2025)
     

    ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসের এক বিকেলবেলা। শিশির বসু মেডিকেল কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এমন সময়ে পরিবারের এক সদস্য এসে বললেন, রাঙাকাকা তাঁকে কয়েকবার খুঁজেছেন এবং বলেছেন শিশির কলেজ থেকে ফিরলেই যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করে। শিশির বসু তখন কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়াচ্ছেন; আর রাঙাকাকা হলেন সুভাষচন্দ্র বসু।

    এই কথা শুনে শিশির আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলেন। যদিও নেতাজি তাঁর কাকা, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কাকার খুব ভাব। বন্ধুর মতো। কাকাবাবু মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে গল্প করেন। খোঁজখবর নেন তাঁর পড়াশোনার। কিন্তু এখন তো অনেকদিন দেখা হয় না, কারণ রাঙাকাকাকে ব্রিটিশ পুলিশ এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দি করে রেখেছে। নেতাজি ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখেন। ঘরের বাইরে তাঁর জন্য প্রতিদিন খাবার রেখে দিয়ে আসা হয়। এই অবস্থায় শিশির রাঙাকাকার ডাক শুনে সত্যিই অবাক হলেন।

    দরজায় টোকা দিয়ে রাঙাকাকার ঘরে ঢুকে দেখেন, রাঙাকাকা বেশ খানিকটা রোগা হয়ে গেছেন। মুখে কয়েকদিনের না-কাটা দাড়ি। শিশির যখন ঘরে ঢোকেন, নেতাজি তখন একটি বই পড়ছিলেন। শিশিরকে বসতে বলে, তিনি আবার পড়াতে মন দিলেন। শিশিরের উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল, তাহলে তিনি কি নিজের অজান্তে এমন কোনও কাজ করেছেন, যাতে রাঙাকাকার মনে আঘাত লেগেছে! শীতকালেও ঘাম হতে লাগল শিশিরের।

    আরও পড়ুন : নোবেল পেতে পারতেন, তাও আজীবন বঞ্চনাই সহ্য করে গেলেন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়! লিখছেন বিষাণ বসু…

    কথা শুরু করলেন নেতাজি। শিশিরের পড়াশুনার খবর নিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, শিশির হাইওয়েতে গাড়ি চালাতে পারেন কি না এবং একসাথে কতটা গাড়ি তিনি চালিয়েছেন। উত্তরে শিশির বললেন, তিনি বেশ কয়েকবার রাঁচি গেছেন নিজে গাড়ি চালিয়ে এবং সম্প্রতি বাবা-মাকে নিয়ে তিনি গাড়ি চালিয়ে হাজারিবাগে গিয়েছিলেন। নেতাজি বললেন, ‘তুমি আর্ট সিলিন্ডারের স্টুডিবেকারটা নিয়ে গিয়েছিলে না!’ শিশির ‘হ্যাঁ’ বলতেই তিনি বললেন, ‘অত বড় গাড়ি ভিড়ের মধ্যে দিয়ে যাবার সময়ে কোনও অসুবিধে হল না!’ শিশির একটু অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, রাঙাকাকা আজকে গাড়ি নিয়ে এত কথা জানতে চাইছেন কেন! দূর সফরে শিশিরকে কতবার গাড়ি থামাতে হয়, তিনি রাতে গাড়ি চালাতে পারে কি না, ভোরের দিকে ঘুম আসে কি না— কত প্রশ্ন! শিশিরের কাছে উত্তর শুনে তিনি বললেন, ‘খুব ভাল। ভাল গাড়ি চালানো শিখেছ দেখছি!’

    শিশিরকুমার বসু

    এবার এল এক অদ্ভুত প্রশ্ন— ‘আচ্ছা, তুমি গাড়ির চাকা পালটাতে জানো?’ এই প্রশ্নের জন্য শিশির প্রস্তুত ছিলে না; অবাক বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গেলেন। গাড়ির চাকা তিনি কখনও পালটাননি কিন্তু রাঙাকাকা বললে তিনি ড্রাইভারদের থেকে শিখে নেবেন। নেতাজি বললেন, ‘না, তা হবে না। গাড়ির চাকা নিজেকে পালটানো শিখতে হবে।’ নিজেই রাঙাকাকা বললেন, ‘দ্যাখ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সামনের রাস্তাটা দুপুর-বিকেলের দিকে ফাঁকা থাকে। তখন চাকা পালটানো অভ্যাস করতে হবে। প্রথম-প্রথম গাড়ি ব্যাকে তোলা এবং চাকার নাটবল্টু খুলতে সময় লাগবে কিন্তু ক্রমে-ক্রমে অভ্যাস হয়ে যাবে; তখন কয়েক মিনিটে চাকা পালটিয়ে নেওয়া যাবে।’ শিশির নেতাজির কথায় সম্মতি জানালেন এবং প্রতিদিন ব্রেবোর্ন কলেজের সামনে গিয়ে চাকা পালটানো অভ্যাস করতে লাগলেন।

    সকালে যখন নেতাজিকে খবরটা জানানো হল, উনি কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলেন। তারপর শিশিরকে বললেন, ‘তুমি ওয়ান্ডারারকে তৈরি করো।’ ওয়ান্ডারার একটি জার্মান জৌলুসহীন গাড়ি। দেখতে ভাল না হলেও মাটি কামড়ে
    চলে গাড়িটি।

    এখানেই শেষ নয়। বাড়ি ফিরে গিয়ে রাঙাকাকাকে বলতে হত তাঁর কতটা সময় লেগেছে। এইভাবে রোজ চলতে থাকল এক অদ্ভুত প্রয়াস। রাস্তার ট্যাক্সি ড্রাইভারেরা প্রায় এসে শিশিরকে বলত, ‘বাবু ছেড়ে দিন, আমরা চাকা পালটিয়ে দিচ্ছি; ওটা আপনার কাজ নয়।’ প্রথম-প্রথম কালঘাম ছুটে যেত শিশিরের। প্রথম দিন ৪৫ মিনিট লাগার কথা রাঙাকাকাকে বলতেই, তিনি বললেন, ‘মন দাও! অত সময় লাগার কথা না।’ দশদিন পরে যখন শিশির বললেন, পালটাতে পাঁচ মিনিট সময় লেগেছে, নেতাজি খুব খুশি হলেন এবং বললেন, ‘আর দরকার নেই। ঠিক আছে।’ শিশির ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাঙাকাকা, এর কি কোনও প্রয়োজন ছিল?’ বিরক্ত হলেন নেতাজি। ‘কী বলছ? নিজে গাড়ি চালাব আর গাড়ির চাকা পালটাতে পারব না?’জানুয়ারি মাস আসতেই নেতাজি বললেন, শিশির যেন একবার বড় স্টুডিবেকার গাড়িটা নিয়ে বর্ধমানে যান এবংকত সময় লাগল সেটা যেন তাঁকে জানানো হয়।

    মহানিষ্ক্রমণের মানচিত্র

    সেদিন রবিবার। শিশির সকালে স্টুডিবেকার চেপে বর্ধমানের দিকে রওনা হলেন। স্টুডিবেকার আট সিলিন্ডারের গাড়ি। গড়গড় করে জিটি রোড দিয়ে ছুটতে লাগল। ফিরে আসার সময়ে হল এক মহা বিপত্তি। সবে বর্ধমান ছাড়িয়েছেন, এমন সময়ে গাড়িটির ক্রাঙ্ক গেল ভেঙে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল জগদ্দল। আর স্টার্ট নেয় না। শিশিরের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। বুঝতেই পারছেন না কী করবেন। শেষে একটা ক্রেন ভাড়া করে গাড়িটিকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলেন। কলকাতা পৌঁছতে মাঝরাত। বাড়ির বুড়ো ড্রাইভারের মাথায় হাত। ব্যারিস্টার সাহেবের কাল হাইকোর্ট।

    ২৭ জানুয়ারি, ১৯৪১, আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত

    সকালে যখন নেতাজিকে খবরটা জানানো হল, উনি কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলেন। তারপর শিশিরকে বললেন, ‘তুমি ওয়ান্ডারারকে তৈরি করো।’ ওয়ান্ডারার একটি জার্মান জৌলুসহীন গাড়ি। দেখতে ভাল না হলেও মাটি কামড়ে চলে গাড়িটি। শিশিরের আগামী ক-দিন ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠল ওয়ান্ডারার। ১৬ জানুয়ারি সকালে রাঙাকাকা শিশিরকে বললেন, ‘ওয়ান্ডারারে তেল ভরে নাও। রাতে তোমাকে নিয়ে বেরব। বাড়ির কেউ যেন না জানে।’ শিশির এতটাই অবাক যে, কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলেন না নেতাজিকে।

    রাত প্রায় পৌনে একটা। নেতাজি নীচে নামলেন। গোটা বাড়ি ঘুমে অচেতন। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে কলকাতায়। গেটে পুলিশ দুজন গভীর ঘুমে মগ্ন। নেতাজির পরনে আফগানদের মতো লম্বা পাঞ্জাবি-পাজামা। মুখে নকল দাড়ি, মাথায় ফেজ টুপি। ব্যাগে ট্যাগে আটকানো— মহম্মদ জিয়াউদ্দিন।

    ২৭ জানুয়ারি, ১৯৪১, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এ প্রকাশিত

    শিশির বেশ গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পথে টহলদারি পুলিশের গাড়ি। তাদের নজর এড়িয়ে গেল সাদামাঠা চেহারার একটি গাড়ি। জিটি রোডে একটি লেভেল ক্রসিঙের আগে গাড়ি গেল বন্ধ হয়ে। ফাঁকা রাস্তা দেখে শিশির বেশ জোরেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এদিকে গাড়ি বন্ধ হয়ে যেতেই একজন পুলিশ এসে জানতে চাইলেন কী হয়েছে। শিশির বললেন, ‘ইঞ্জিনে তেল চলে এসেছে, এখনই স্টার্ট হবে গাড়ি।’ তাই নিল। নেতাজি বিরক্তি নিয়ে শিশিরকে বললেন, ‘কখনও জোরে এই গাড়ি চালাবে না। হঠাৎ ব্রেক করলেই গাড়ির ইঞ্জিনে তেল চলে আসবে, কারণ গাড়ির এসি পাম্পটি পিছনে।’

    বাকি রাস্তা আর কোনও অসুবিধে হয়ি শিশিরের। দেখতে-দেখতে চলে এল এক আত্মীয়ের বাড়ি গোমোতে। রাতে গোমো থেকে ট্রেন। শিশির দেখলেন, দীর্ঘদেহী এক আফগান ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে হারিয়ে গেলেন ভিড়ের মধ্যে। শিশিরের সঙ্গে সেই শেষ দেখা রাঙাকাকার। সাক্ষী রইল আকাশের তারারা আর সময়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook