একটি ফোটোগ্রাফ ইন্টারনেটে ঘুরছে। বিনোদনের গ্লোবাল মেট্রোপলিস লস অ্যাঞ্জেলেসের বিধ্বংসী দাবানলে কোনও একজনের ছাই হয়ে যাওয়া বাড়িতে পড়ে আছে একটি অস্কার পুরস্কার, সেই চেনা সুঠাম স্বর্ণমূর্তিখানি। ছবিটির ‘সত্যতা’ নিয়ে যথারীতি প্রশ্ন উঠেছে। আমরা ইমেজকে বিশ্বাস করার যুগে আর বসবাস করি না, একবিংশ শতাব্দী ইমেজকে প্রাথমিকভাবে অবিশ্বাস করার যুগ। আপাতত, এই ইমেজের প্রামাণ্যতা প্রমাণিত নয়। কিন্তু সত্যি বলতে কি, তাতে কিছু যায় আসে না। চিরকালই ইমেজ বাস্তবের এভিডেন্স যতটা না ছিল, তার চেয়ে ছিল আশা এবং আশঙ্কার কল্পনার মূর্তায়ন। তাই, এই ইমেজে একধরনের ‘সত্য’ আছে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং ক্রমবর্ধমান। লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো হাইপার-আর্বানাইজড এলাকায় ক্রমবর্ধমান তাপ পাহাড়ের গাছগাছালির আর্দ্রতা শুকিয়ে দিচ্ছে; তার মধ্যে বনজঙ্গল যত কাটা হবে, তত দ্রুতগতির হাওয়ার বাধা কমবে। এই বছর যেরকম বিধ্বংসী দাবানল দিয়ে শুরু হল— সেরকমটি বহুদিন ধরে হয়ে আসছে। এইবারের মাত্রাটি এরকম ভয়ানক আকার ধারণ করল, কারণ শুকনো গাছগাছালি অপ্রতিরোধ্য হাওয়ায় বয়ে নিয়ে আনা আগুনের কাছে আরও দাহ্য জ্বালানি। এই জ্বালানি আধুনিক মানুষ দ্বারা নির্মিত। মানুষের নিজের হাতে প্রকৃতির বৈকল্য রচনার ফলেই এই দুর্যোগের মাত্রা অস্বাভাবিক হল।
আরও পড়ুন : মার্কিন মুলুকের দাবানলে ধনী-গরিব সমানভাবে পুড়ল কি?
লিখছেন অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়…
১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মাইক ডেভিসের লেখা একটি বই। নাম ‘ইকোলজি অফ ফিয়ার: লস অ্যাঞ্জেলেস অ্যান্ড দ্য ইমাজিনেশন অফ ডিজাস্টার’। ২০২৫-এর জানুয়ারিতে কী হতে পারে, তার অনেক চেতাবনির একটি হল এই বইটি। সারসংক্ষেপ করলে, ডেভিস আলোচনা করছেন যে, লস অ্যাঞ্জেলেসের ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক বিপন্নই ছিল। তিনি আলোচনা করেন, আগ্রাসী পুঁজিবাদের ফলে বেপরোয়া নগরায়ন কীভাবে এরকম প্রলয়ের সম্ভাবনা বাড়িয়ে চলেছে শুরু থেকেই। এই বইয়ে সে অর্থে হয়তো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু ডেভিস দেখাচ্ছেন যে সিনেমায়, জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে কতবার লস অ্যাঞ্জেলেস ধ্বংস হয়েছে, কীভাবে শহরটি যে ‘অভিশপ্ত’, সেরকম একটি প্যারানোইয়া বারবার উঠে এসেছে কাহিনিতে, রূপকার্থে। সে ভূমিকম্প হোক বা ভিনগ্রহীদের আগ্রাসন, বা দাঙ্গা অথবা ডিসটোপিয়ার কল্পনা, ভোগ ও বৈভবের স্বপ্নের শহর এলএ-র উল্টো পিঠেই যেন আছে ধ্বংসের দুঃস্বপ্ন। ডেভিস বলছেন, এই কল্পনা যতটা না সম্ভাব্য সত্যের রূপক, তার চেয়েও যেন প্রলয়কে ‘নর্মালাইজ’ করে দৃষ্টিটা সরিয়ে রেখেছে সমাধানযোগ্য সমস্যার দিক থেকে। ‘বাস্তবমুখী’ হলে এই প্রলয় এড়ানো যেত।
পুঁজিবাদ বিচিত্র কিসিমের ব্যাপার। সে নিজের পতনকেও পণ্যায়িত করতে পারে। এমনকী, সেই নিয়ে সাবধান করে দিলে সেই বাণীকেও। এমনকী, এই গ্রহের বিপন্নতাকেও। উদাহরণ, কিছু বছর আগেই মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ডোন্ট লুক আপ’, ছবিটি পুঁজিবাদের এই দিকটা নিয়েই। ১৯১২ সালের ‘টাইটানিক’-এর ট্র্যাজেডি পুঁজিবাদের ইতিহাসের একটি অন্যতম কলঙ্কিত অধ্যায়। অত্ত বড় জাহাজখানি ছিল পুঁজি ও প্রযুক্তির তুঙ্গ স্পেকট্যাকল। তাতে বৈভবগর্বিত উচ্চবিত্ত এবং ভাগ্যান্বেষণে নিম্নবিত্তের মধ্যে যে বেশ কয়েক তলার ফারাক থাকবে, তা তো বোঝাই গেছিল। কিন্তু ‘টাইটানিক’ যখন ডুবেছিল, তখন আর উচ্চ এবং নিম্নবিত্তর ভাগ্যে খুব বেশি তফাত থাকেনি। নিম্নবিত্ত সংখ্যায় বেশি ছিল, সংখ্যায় বেশি মরারই কথা ছিল। কিন্তু প্রসঙ্গটা আনলাম ভিন্ন কারণে, ১৯৯৭ সালের ‘টাইটানিক’ না ডুবে ভেসে ওঠেনি শুধু, মুনাফা গগনচুম্বী হয়েছিল। অতএব, এই হল বিনোদন-পুঁজিবাদের ধরণ, নিম্নে পতনকেই উড্ডীন পণ্যে পরিণত করা। সেখানে একদার প্রযুক্তির তুঙ্গ বৈকল্যের ট্র্যাজেডির পূণর্নির্মাণ হয়ে ওঠে অধুনার প্রযুক্তির উৎকর্ষের তুঙ্গ মুহূর্ত। অতএব, এই মাসের ট্র্যাজেডি নিয়েও একদিন স্পেকট্যাকুলার ছবি হয়ে উঠবে ধরেই নেওয়া যায়। তখন ঠিক যেভাবে অনেকে সন্দেহ করছেন পোড়া বাড়িতে ওটা কার অস্কার, আদপেই কি ছবিটা ‘সত্যি’, ঠিক তার উল্টোপথে আমরা ‘সত্যি নয়’, এমনকী, কিছু সিজিআই নির্মিত হাইপাররিয়েলিস্ট ইমেজ উপভোগ করব। সেই ছবিতে ২০২৫ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস পুড়বে। সেখানে কোনও নায়ক-নায়িকার প্রেমের গল্প থাকবে, পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ফলে তারা আর শ্বেতাঙ্গ হবেন না হয়তো, যদি না ট্রাম্পের দক্ষিণপন্থা হলিউডের woke-পনাকে ততদিনে রক্ষণশীলতার দাবানলে ধূলিসাৎ না করে দেয়।
অথবা, সেই উপভোগ কি আমরা অলরেডি করতে আরম্ভ করেছি? অস্বীকার করে লাভ নেই, জ্বলতে থাকা ক্যালিফোর্নিয়াকে দেখে পার্ভার্ট আনন্দ পেয়েছেন অনেকে। প্রকৃতির নিষ্ঠুর রসিকতার ফলে হলিউডের উচ্চবিত্ত প্রতাপ কীভাবে এক লহমায় সর্বস্বান্ত সাধারণ মানুষের অসহায়তায় পর্যবসিত হয়, তা দেখে অনেকে ভাবছেন— দ্যাখ, কেমন লাগে! কিন্তু সেই রগড় নিষ্ঠুর; ভাবতে হচ্ছে যে, এই শহরেও অনেক নিম্নবিত্ত মানুষও আছেন। তাদের হয়তো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সেভাবে বিমা করা নেই। প্রকৃতির রোষ এখন উচ্চ ও নিম্ন— দুই শ্রেণির মানুষকেই রাস্তায় নামিয়েছে। কিছু মানুষের পুনর্বাসন হবে, অনেকেরই হবে না। তাই দ্যাখ-কেমন-লাগে-মার্কিন-বড়লোকরা এই নিষ্ঠুর হাস্য সরিয়ে রাখলেও ভাবতে হচ্ছে, আমরা কিন্তু এই ইমেজ দেখছি এমন এক যুগে, যখন ইমেজ আর সে অর্থে ‘এমপ্যাথি’-র বাহক নয়। সেই অসংবেদনশীলতা একটি শ্রেণির চরিত্র নয়, মানবচরিত্রই বলা যায়। ইমেজ এখন ভোগ্য এমনভাবে, যা বিংশ শতকও দেখেনি। এই ইমেজ না হেসেও ভোগ করা যায়।
অর্থাৎ, এখনকার যে ইমেজ-কন্টকিত সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, সেখানে রাতের অন্ধকারে রক্তিমাভ দিগন্ত, আকাশে উড়তে থাকা হেলিকপ্টার, সাইরেনের আওয়াজ ভেসে আসছে হাওয়ার গর্জন ভেদ করে, এমন ফুটেজ কি সেই স্পেকট্যাকলের ‘উপভোগ্যতা’ আমাদের দিতে আরম্ভ করেছে? আগামী দিনে সম্ভাব্য সেই ডিজাস্টার ফিল্মটি তো এই ইমেজের ‘নকল’ করেই তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে, সেই ইমেজ তৈরি হবে কম্পিউটার-জেনারেটেড ইমেজ দিয়ে, এবং সেই ইমেজের অনেকটাই তৈরি করবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, শিল্পীর শ্রম নয়। অর্থাৎ, বিংশ শতকে সেই সিনেম্যাটিক ইমেজ তৈরি করতে হয় নিয়ন্ত্রিত অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে হত, নয়তো মিনিয়েচার শহর জ্বলত। তেমনটা আর প্রয়োজন হবে না। এখন পুড়তে থাকা পাহাড়, বন, শহর দেখাতে গেলে সদর্থে আগুন নিয়ে খেলতে হয় না, সেই আগুন তৈরি করে আনরিয়েল ইঞ্জিনের মতো সফটওয়্যার। খুবই হাইপার-রিয়াল বা অতি-বাস্তবোচিত হয় সেই ইমেজ। সেই ইমেজকে এখনকার ইন্সটাগ্রামের আর নিউজ চ্যানেলের ফুটেজের মতোই দেখতে লাগবে। ইমেজের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক পালটে গেছে যখন, আমাদের সঙ্গে ইমেজের নৈতিক সম্পর্ক এখন কেমন?
ভিন্ন কথা বলি, মার্কিন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কেন স্থাপিত হয়েছিল হলিউডে? ভেবে দেখুন, ভারতে কোথায় কোথায় প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি? মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই বা মাদ্রাজে। দিল্লিতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নেই, লখনউতেও নয়; দু’টি শহরই সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যবান হওয়া সত্ত্বেও। পুনে থেকে স্বাধীনতার সময়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সরে এসেছিল বম্বেতে। অর্থাৎ, বিংশ শতকের শুরুর দিকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কোনও এক কারণে স্থাপিত হয় মূলত সমুদ্র-নিকটবর্তী বন্দর-শহরে। নিশ্চয়ই জাহাজে যন্ত্রাদি, কাঁচামাল আসত এই কারণে। তাহলে এর অন্যথা কেন হল সিনেমার গ্লোবাল সুপারপাওয়ার হলিউডের ক্ষেত্রে? কেন হলিউড স্থাপিত হল ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় জনহীন দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরে? শুরু তো হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই ইস্ট কোস্টের তীরে, শহরে। দেশ পেরিয়ে ওপারে গেল কেন, যেখানে আবহাওয়া এরকম শুকনো? মূল কারণ দুটো, সস্তা বিস্তীর্ণ জমি, যা মাইলের পর মাইল একটি বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠান কিনে নিতে পারে, সারাদিন মোটামুটি স্থির আলোর মাত্রা (আমাদের মতো যখনতখন মেঘ ইত্যাদি এসে আলোর তারতম্য ঘটায় না) যা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিল্মমেকিং-এর পক্ষে অনুকূল, সস্তা প্রাকৃতিক সম্পদ ও বলাই বাহুল্য, ইন্ডিজিনাস আদিবাসীদের মানবশ্রম। সিনেমা ছিল আর্টিজানাল, ছোট পুঁজির শিল্প; তাকে বৃহৎ পুঁজির (ও প্রযুক্তির) ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করে হলিউড।
একটি শব্দের জন্ম হয়েছে একবিংশ শতকের শুরুতে, এবং তার গুরুত্ব আগামী দিনে বাড়বে। শব্দটি হল anthropocene, অর্থাৎ, এই গ্রহের ইতিহাসের সেই পর্যায়, যখন মানুষের ক্রিয়াত্মক উপস্থিতি এই গ্রহকে অপরিবর্তনীয়ভাবে পালটে দিয়েছে। এই পর্যায়টি আদপেই হোমো সেপিয়েন যতদিন আছে, ততদিনের নয়; কারণ আরও অনেক প্রাণীর মতোই মানুষের উপস্থিতি এই গ্রহকে সেভাবে পালটে দিতে পারেনি অন্তত উনিশ শতক অবধি। পাল্টেছে গত শতক থেকে; এবং এই পরিবর্তন নিম্নমুখী। এটা সমাপতন নয় যে, জিওলজির নিরিখে মানুষের প্রাধান্যকামী উপস্থিতির এই পর্যায় আসলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজমেরও প্রাধান্যের ঐতিহাসিক পর্যায়, যে সময়ে এই গ্রহের অসুস্থতা বেড়েছে, অগুনতি জীব, এই গ্রহ যাদেরও ঘরবাড়ি ছিল, এক্সটিংকট হয়েছে, প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্ন জীবন পরিণত হয়েছে মানুষের মুনাফার কাঁচামালে বা কো-ল্যাটারালে। সেই শোষিত গ্রহের মাতৃস্নেহ এখন পরিণত হয়েছে রোষে, এখন তার পাল্টা দেওয়ার পালা।
আবার, নেহাতই সমাপতন নয় যে, এই সময়টাও ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিনেমার। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিনেমা আগ্রাসী ধনতন্ত্রেরই বাহক ছিল, আগ্রাসী ধনতন্ত্রকেই সে অভীষ্ট চিত্রমালায় পরিণত করেছে বেশিরভাগ সময়ে। জেমস বন্ডের ছবিতে ক্যামেরা যখনই তৃতীয় বিশ্বে গেছে ধুন্ধুমার ধ্বংসাত্মক অ্যাকশনে তোলপাড় করেছে। বিশ্বজোড়া তাণ্ডব এই ধরনের ছবির প্রধান আমোদ। বিশ্বজোড়া প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবশ্রমকে মুনাফার জন্য শোষণ করার পথপ্রদর্শক হলিউড, তারপর সেই মডেল অনুসরণ করেছে অন্যান্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। যদি একটা হিসেব নেওয়া যায় যে, বৃহত্তর বাজেটের ছবি শুট করার জন্য কত ডিফরেস্টেশন হয়েছে গত একশো বছরে, বা কতটা দূষণ ঘটেছে প্রকৃতির, এবং তাতে মুনাফা হয়েছে ক’জনের, প্রামাণ্য একটা পরিসংখ্যান পাব আমরা।
তাই একটি বৈকল্যকণ্টকিত গ্রহ যখন আধুনিক মানুষকে পাল্টা মার দিতে শুরু করেছে; তখনকার অন্যতম স্পেকট্যাকল হিসেবে হলিউডের বাসিন্দাদের ঘর জ্বালানো দিয়ে হবে, তা কি নেহাতই কাকতালীয়? কিছু একটা ‘কাব্যিক সংযোগ’ তো আছেই। এই দাবানল শেষ দাবানল নয় লস অ্যাঞ্জেলেসে, এই দাবানল শুরুও নয়। পুঁজির খেয়ালে হলিউডের সেই প্রতাপ কমছে, হয়তো এই জ্বলতে থাকা শহর তার প্রতীকী শুরু। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেছে অন্য কিছু মিউটেশন, একবিংশ শতকে চলমান চিত্রমালা প্রেক্ষাগৃহ থেকে ড্রইং রুমে, আমাদের বেডরুমের দেওয়াল থেকে কোলে, কোল থেকে পকেটে আসার পর আমাদের সেই ইমেজের সঙ্গে সম্পর্ক পাল্টে গেছে। গ্রহের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যদি বিঘ্নিত হয়, ইমেজের সঙ্গে গ্রহের সম্পর্কও যে বিঘ্নিত হবে তা আর আশ্চর্যের কী? আমরা ইমেজের সঙ্গে দিব্যি আছি, কিন্তু সেই ইমেজ, এই মিডজার্নির যুগে অনেকটাই কুহকী ইমেজ, সেই ইমেজের সঙ্গে বাস্তবের আর যোগ নেই। তেমনই আমাদেরও আর এই গ্রহের, তার বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ একইরকম কুহকী। অথবা, আমাদের জগতটাই এখন ‘রিয়েল’-এর চাইতে অনেক বেশি ‘ভার্চুয়াল’-এর সঙ্গে, বা ‘রিয়েল’ আমাদের কাছে ক্রমবর্ধমান ‘ভার্চুয়াল’।
আগামী দিনে, চলমান চিত্রমালায় মানুষের উপস্থিতি কমবে, কমবে তার শ্রমের উপস্থিতি। এভাবেই, ইমেজ যে সমস্ত মানুষের শ্রমে নির্মিত হয়, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও পাল্টাবে, পাল্টিয়েছে। আমরা যেভাবে সেইসব মানুষদের শ্রমকে সমীহ করতাম, এমনকী, সেখানে সবচেয়ে দৃশ্যমান যারা সেইসব তারকাদের যেভাবে ভালবাসতাম, তাও কমবে। তাঁরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন কি নামলেন না, তারা সকালবেলায় কী বললেন, সন্ধেবেলায় কী পরলেন, তাই নিয়ে তাদের নিয়ে রগড় করাই আমাদের প্রধান বিনোদন এখন। তাদের মেধা-কৃতি-শ্রম নয়, তাঁদের অস্তিত্ব আমাদের কাছে উপভোগ্য, তারা বিদূষক। তাঁদের ব্যক্তিগত পরিসরকে নস্যাৎ করেছি আমরা বহুদিন হল, তাই তাঁদের ঘরে গিয়ে কেউ যদি ছুরি দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে সেটাও রিয়েলিটি শো, তাদের জ্বলে যাওয়া ঘরবাড়িও। জ্বলতে থাকা গ্রহও আমাদের কাছে উপভোগ্য হবে, যদি আমরা ভার্চুয়ালে নিমজ্জিত থাকি, যতদিন না আঁচটা ত্বকে এসে লাগবে।
প্রসঙ্গত, হলিউড এবং লস অ্যাঞ্জেলেসের এই দুঃসময়ে যদি ঘরের পাশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কথা ভাবি। একটু গুগল করে নিন পরিবেশবিদরা কীরকম হিসেবে করছেন, ঠিক কত সাল থেকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে কলকাতারও ফুলতে থাকা সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া শুরু হবে, অর্থাৎ আর সবের সঙ্গে টালিগঞ্জেরও। কোথাও প্রকৃতির রোষের অস্ত্র আগুন, কোথাও ঝড়, কোথাও জল। আমি এই আনুমানিক সালটা জানি, আপনারা খোঁজ করে নিন। ততদিন আমরা বাংলা সিনেমা আর সংস্কৃতির পাশে দাঁড়াই।