সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দ্যোপাধায়— এঁরা প্রত্যেকেই আমার জীবনে টুকরো-টুকরো রবীন্দ্রনাথ। তার মধ্যেও সুচিত্রাদি ছিলেন আমার কাছে আলাদা। ওই বিশেষত্বটুকু নিয়েই থেকে গেছেন সারা জীবন। ওয়ার্কশপ করেছি, উচ্চারণ নিয়ে অনেক সংশয় দূর করেছেন উনি, তবে সামনে বসে গান শেখার যে-সৌভাগ্য, তা আমার কখনওই হয়নি। এ-কথা ঠিক, যোগাযোগ হওয়ার পর আমি যেমন ওঁকে চেয়েছিলাম শিক্ষাগুরু হিসেবে, উনিও আমায় ভীষণভাবে চেয়েছিলেন।
আমি ক্লাসিক্যাল ঘরের মেয়ে হলেও, ছেলেবেলায় যখনই রবীন্দ্রনাথের গান শুনতাম, এক অপূর্ব মুগ্ধতায় মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। বাবাকে বলতাম, তোমাদের গান ‘ক্লাসিক্যাল’ আর রবীন্দ্রনাথের গান ‘ক্লাসিক’। সুচিত্রা মিত্রের গান কিন্তু সেই সময় থেকেই রেকর্ডে শুনছি। এবং আশ্চর্যের যেটা, কিছুটা জেনেবুঝে বা খানিকটা অজান্তেই তখন থেকে আমি সুচিত্রা মিত্রকে নকল করতে শুরু করি। কতই-বা বয়স আমার তখন! বড়জোর ১৫/১৬ হবে। আশেপাশের লোকজন আমার ব্যক্তিত্ব দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতেন। বলতে দ্বিধা নেই, ওইরকম দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আমি সুচিত্রাদির মধ্যেই প্রথম দেখি, এবং নিজের আয়ত্তে আনতে সচেষ্ট হই। আমার জীবনের আজ যতটুকু রাবীন্দ্রিক, তার প্রতিটা মোড়ে-মোড়ে অদ্ভুতভাবে এসে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।
দিল্লি থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট পড়া বাতিল করে যখন গান নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখনও উনি অবসর নেননি। ওঁর কাছেই আমি ইন্টারভিউ দিয়ে পাশ করেছিলাম স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হওয়ার জন্য। মনে আছে, সে-সময়ে আমার শরীর খুব একটা ভাল যাচ্ছিল না। দিল্লিতে বার বার যেতে হত চিকিৎসার জন্য। উনি আমায় বলেছিলেন, ‘ভর্তি হও বা না হও, যা-ই করো, শুধু খেয়াল রেখো নিজের শরীর যেন ঠিক থাকে।’ কিন্তু আমার কপালই এমন, যখন সব কিছু সামলে রবীন্দ্রভারতীতে এসে ভর্তি হলাম, তখন উনি অবসর নিয়েছেন। ওঁর কাছে গান শেখা আমার সে-যাত্রা হল না।
এর পরের ঘটনা ’৮৫ কি ’৮৬ সালে। আকাশবাণীর যে সংগীত প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে কলকাতা থেকে আমি প্রথম হয়েছিলাম। বিচারক কে ছিলেন? সে-ই সুচিত্রাদি! আমার ভজন শুনে একদিন ফোন করে বললেন, ‘শোনো স্বাগতালক্ষ্মী, আমি তোমার সঙ্গে একটা শর্ত করতে চাই। তুমি আমার কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখবে, আমি তোমার কাছে ভজন শিখব। এত ভাল হিন্দি উচ্চারণ করো কী করে?’ জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান যে-ক’টা ফোন আমি পেয়েছি, তার মধ্যে এটা একটা। কিন্তু এবারেও ওঁর কাছে গান শেখা হল না, কেননা তখন সাতদিন হল আমি মায়া সেনের কাছে গান শিখতে শুরু করেছি। আর ওঁকে সে-কথা বলাতে, উনি মায়াদির কাছেই গান শিখে যেতে বললেন। মায়াদি মজা করে একবার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘স্বাগতালক্ষ্মী গান শেখে আমার কাছে, কিন্তু গান করে সুচিত্রার মতো…’
আমার ‘হে নূতন’ অ্যালবামের আগের বছর ‘আগুন জ্বালো’ নামে যে-অ্যালবাম প্রকাশ পায়, তা সুচিত্রাদির হাত দিয়ে উদ্বোধন হয়। ওটাই আমার প্রথম সোলো অ্যালবাম। এরও অনেক পরে, ২০০৬ সাল নাগাদ যখন আমি সমগ্র ‘গীতবিতান’ রেকর্ড করি, তখন সুচিত্রাদি আমায় বলেছিলেন, ‘তোমায় আমি নোবেল দিলাম। দিলাম এই কারণে, কারণ এই ভাবনাটা আমরা কেউ ভাবতে পারিনি কোনওদিন।’ ওই অ্যালবাম প্রকাশের সময়েও উনি ছিলেন। সুচিত্রাদি চলে যাওয়ার পরে আমি ওঁকে নিয়ে একটা অ্যালবাম প্রকাশ করি।
অনেকেই আমায় জিজ্ঞাসা করেন, উনি চলে যাওয়ায় কোনও অভাববোধ হয় কি না আমার। সত্যি কথা বলতে কী, আমার কোনও অভাববোধ নেই। এর একটাই কারণ, আমি যখন সুচিত্রা মিত্রকে ভালবেসেছিলাম, তখন আমি ওঁকে চোখে দেখিনি। আমি প্রেমে পড়েছিলাম ওঁর কণ্ঠের। এখনও যখন উনি নেই, তখনও থেকে গেছে তাঁর কণ্ঠ-ই। সারাজীবন যাঁকে মনের ভেতরে লালন করেছি, খুঁজে বেড়িয়েছি, এখনও তাঁকে সেভাবেই লালন করি। আমি যেখানে গান শেখাই, সেখানে সুচিত্রাদির ছবি জ্বলজ্বল করে সারাক্ষণ। যতদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন, ততদিনই থেকে যাবেন সুচিত্রা মিত্র…