সন্দীপ কুমার সম্পাদিত ‘সুরের জগৎ’ পত্রিকার জন্য সংগীতশিল্পী সুবীর সেনের এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল বছর পনেরো-ষোলো আগে। নিয়েছিলেন রেকর্ড সংগ্রাহক দেবদীপ সাহা। অপ্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারটি সন্দীপ কুমারের সৌজন্যে প্রকাশ করা সম্ভব হল।
আপনার জন্মতারিখ, কোথায় জন্মেছেন এবং বাবা-মা’র পরিচয়টা যদি শুরুতে একটু বলেন…
আমার জন্ম আসামের ডিব্রুগড়ে। ২৪ জুলাই ১৯৩৪, (যেটা উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন)। বাবা ছিলেন ডাক্তার, ডক্টর শৈলেশচন্দ্র সেন। মায়ের নাম ছিল লিলি সেন।
আপনাদের আদি বাড়ি কোথায়?
আমরা পূর্ববঙ্গের লোক। ঢাকা, সোনারং গ্রাম।
পিতার জীবিকা কি ডাক্তারিই ছিল? নাকি সঙ্গে অন্য কিছুও করতেন?
হ্যাঁ। বাবা পুরোদস্তুর ডাক্তারই ছিলেন। আমাদের বিরাট ফার্মেসি ছিল। বাবা একসময়ে টি-গার্ডেনে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবেও কাজ করেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, তিনি খুবই বড় মাপের একজন ডাক্তার ছিলেন।
সংগীতের প্রতি আপনার যে-টান, সেটা কি বাবা-মায়ের থেকে পাওয়া?
আমার মামাবাড়িটা পুরো গানের। আমার মামাতো দিদিরা অসাধারণ গান গাইত। মাও অসাধারণ গাইতেন। মনে আছে, মা রান্না করতেন, আমি বসে থাকতাম। ‘এই গানটা তোল’ বলে যেসব গান শোনাতেন, আপনারা শুনলে হাসবেন— ‘দেবতার মন্দির অঙ্গন তলে’, এইসব গান। বা রবীন্দ্রনাথের কিছু নির্বাচিত গান। তা, আমি তখন খুবই ছোট, তবুও গাইতাম। সেটাই আমার গানের প্রথম উৎস, মানে শৈশবের অনুপ্রেরণা।
আপনারা কয় ভাই-বোন? আপনি ছাড়া তাঁদের মধ্যে আর কেউ কি গানের জগতে এসেছিলেন?
আমরা চার ভাই, এক বোন। সকলেই চাকরি করতেন। আমার বড়দা ছিলেন ইনকাম ট্যাক্সে অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার। এক ভাই পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট, আর এক ভাই ফিলিপ্স কোম্পানিতে ম্যানেজার ছিলেন। সুনীল সেন তাঁর নাম। সারা ভারতে প্রায় সব লাইট অ্যান্ড শ্যাডো ওর করা। তাঁরা গান ভালবাসলেও পেশাগতভাবে গানের জগতে কেউ আসেননি।
আপনি কোনওদিন গান লেখার চেষ্টা করেছেন?
একটা গান লিখতে গিয়ে দু’চার লাইন হয়তো লিখলাম, ব্যাস ওটুকুই। আমার ধৈর্য বরাবরই একটু কম। যেমন একটা গান আমি লিখেছিলাম, ‘পথ যে এখনও বাকি,/ রাত যে এখনও বাকি/ যত কথা সবই বাকি,/ শুধু সময় এগিয়ে যায়।’ অভিজিৎবাবু (বন্দ্যোপাধ্যায়) শুনে বললেন, ‘এ তো অসাধারণ লেখা!’ আমি বললাম, কমপ্লিট করতে পারছি না। তখন উনি কমপ্লিট করে দিলেন। ‘প্রেম যদি ফিরে চায়/ জীবনে সবই ফেরানো যায়’। এটা সুপারহিট গান।
কোন গান আপনাকে প্রথম পরিচিতি এনে দেয়, মনে আছে?
আমার জীবনের প্রথম গান যেটা, সেই গানই আমায় জনপ্রিয় করে তোলে। সেই গানটা হল সুধীন দাশগুপ্ত-র কথা ও সুরে ‘উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’। ইমার্জেন্সিতেও বেজেছে এই গান।
বাংলা চলচ্চিত্রের সংগীতে আপনার উল্লেখযোগ্য কাজ?
বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে সব উল্লেখযোগ্য না হলেও, কিছু-কিছু উল্লেখ করার মতো। যেমন সন্ধ্যা মুখার্জি আর আমি একটা গান গেয়েছিলাম। সন্ধ্যা গেয়েছিলেন বাংলাটা, ‘ফাগুনেরও ডাক এল যে তারই সাড়া পাই’। আর এর ইংরেজি ভার্শনটা আমি গেয়েছিলাম। বাংলা চলচ্চিত্রে আমার উল্লেখযোগ্য কাজ সেরকম নেই তার কারণ ১৯৫৮ সালে আমি পাকাপাকিভাবে বম্বে চলে যাই। বরং হিন্দি সিনেমার কথা যদি বলেন, হাত উঁচু করে বলব, আমার অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ সেখানে আছে।
সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কীভাবে হল?
সলিলদার সঙ্গে আমার আলাপ কলকাতা থেকে। সলিলদা যখন গণসংগীত করতেন, তখন ওঁর দলের কাউকে না পেলে বলতেন, ‘সুবীরকে নিয়ে যাও, ও একাই সব গাইবে।’ আমিও গাইতাম। তখন থেকেই খুব স্নেহ করতেন আমায়। তবে বম্বে যাওয়ার পর সলিলদার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানগুলো আমি গেয়েছিলাম। ‘ধরণীর পথে পথে ধূলি হয়ে রয়ে যাব’; তাছাড়াও ‘পাগল হাওয়া’, ‘কিছুদিন পর আর কিছু চাইব না’ এরকম আরও কত গান!
আপনি I.P.T.A.-তে কোনওদিন ছিলেন?
I.P.T.A.-তে মেম্বার হিসেবে কখনও যাইনি। তবে গান গেয়েছি; গ্রুপের সঙ্গে নয়, একাই গান গাইতাম। সলিলদার জীবনের শ্রেষ্ঠ গণসংগীত, ‘অধিকার কে কাকে দেয়… অধিকার লড়ে নিতে হয়’ এও তো আমারই গাওয়া। এই গানটা রেকর্ড হওয়ার পর ভীষণ জনপ্রিয়ও হয়েছিল।
অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় ও প্রবীর মজুমদারের সঙ্গে কবে থেকে এবং কীভাবে যোগাযোগ? সলিল চৌধুরীর পাশাপাশি ওঁদের প্রভাব আপনার সংগীত জীবনে কতটা?
প্রবীর মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক আগে থেকে। ওঁর গান গেয়েছিলাম ‘যার আলো নিভে গেছে’, অসাধারণ গান। অভিজিৎবাবুরও অসংখ্য গান আমার গাওয়া, এটা উনিও বলেন। যেমন, ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’, ‘জ্যোৎস্নাভেজা রাত’, ‘নগরজীবন ছবির মতন’, ‘তুমি বলেছিলে মনের মুক্তো কভু যায় না কো কেনা’—অসাধারণ সব গান!
সুরকার ও গীতিকার যা সৃষ্টি করেন, তাকে আমরা শুধু রূপ দিই। বরং আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সব থেকে বেশি। আমি কার্ডিফে ট্রিনিটি কলেজে আঠারো বার গেছি শুধু গায়কি কী তা জানার জন্য! শেখার চেষ্টা করেছি। আবার ক্লাসিক্যাল মিউজিকে লখনউ মরিস কলেজে আমি থার্ড ইয়ারে ফার্স্ট প্রাইজ নিয়ে এসেছি। যে-কারণে চিন্ময় রায়ের কাছে যখন গান শিখতে গেছিলাম, তখন বলেছিলেন, ‘আমি জীবনে সেকেন্ড-থার্ড হতে পারিনি, তোকে কী শেখাব? তুই ঠুংরি শেখ ঊষারঞ্জনের কাছে।’ পরে আমি ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, অনুপম ঘটকের মতো গুণিজনের কাছে গান শেখার সুযোগ পেয়েছি, এটাই আমার সৌভাগ্য। অনুপম ঘটক কিন্তু বাংলা গানের শেষ কথা। নওশাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘হম লাহোর মে জিন্দেগি শুরু কিয়া, উয়াহা এক মিউজিকাল গড সে মিলা, উসকা নাম থা অনুপমঘটক…’
নিজে গান লিখতে বা সুর দিতে ইচ্ছে হত?
হ্যাঁ। আমি বহু গান সুর করেছি। আমার নিজের সুরে গানও বেরিয়েছে। লোকে প্রশংসাও করেছে। কিন্তু সুর নিয়ে কোনওদিনই মাথা ঘামাইনি বেশি। রবীন্দ্রসদনে ‘একরাশ এলোচুল পিঠের ওপরে ছিল মেলা’ শুনে শ্রোতারা মুগ্ধতায় দাঁড়িয়ে উঠেছিল।
গীতা দত্তের সঙ্গে আপনার কিছু ছবি দেখেছি, তাঁর সঙ্গে আলাপ কীভাবে?
ওঁদের বাড়ি আমি দু-বেলা যেতাম।ওঁর দাদারা— রঞ্জিতদা, মুকুলদা, নকুদা আমায় খুব ভালবাসতেন। গীতাদি আমায় সুবীরদা ডাকতেন, আমিও ওঁকে গীতাদি বলতাম। ওঁর সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড গেছিলাম। সেসব স্মৃতি ভোলার নয়। অসাধারণ মহিলা। গীতাদির সঙ্গে আমার শেষ গান একটা ডুয়েট, ‘গোরি তেরি নটখট ন্যায়না…’
জীবনের চলার পথে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কিছু বলার আছে?
না। আমি কোনওদিন কাজ পাওয়ার জন্য কারোর কাছে যাইনি। মিডিয়ার কাছে কখনও মাথা নত করিনি। আমি শুধু জানতাম, আমার গান ভাল লাগলে লোকে আপনিই আমায় ভালবাসবে। এটাই আমার জীবনের শিক্ষা।
বাংলা গানের বিবর্তন নিয়ে আপনার কী মত?
সারা পৃথিবীতে পরিবর্তনই তো নিয়ম! বাংলা গানে এখন কিছু ভাল শিল্পী আছেন। তবে তাঁরা এখনও হেমন্তদা, ধনঞ্জয়দা এঁদের স্তরে পৌঁছতে পারেননি। বাংলা গানে রক, এটা আমাদের সংস্কৃতি নয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলতেন, ভাষাটাই আসল। তুমি যদি বাংলা ভাষাটাই ভাল করে না বোঝ, তাহলে কী করে সৃষ্টি করবে! এখন ঠিক সেই অবস্থা। গান গাওয়ার সময়ে কোনও ম্যানারিজম থাকলে হবে না। তবে একটা ফোনেটিক ব্যালান্স থাকা দরকার। বাজে উচ্চারণে গান গাইলে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু লোক হাততালি দিতে পারে কিন্তু সেই গান স্থায়ী হবে না। একবার এক অনুষ্ঠানে গেছি, সেখানে বলা হল, ‘পুরনো দিনের শিল্পী সুবীর সেন আপনাদের গান শোনাবেন।’ তা আমি বললাম, ‘ভ্যান গখও তো পুরনো শিল্পী, তাঁর সৃষ্ট শিল্পের মূল্য আজও মিলিয়ন ডলার। রবীন্দ্রনাথের মতো লেখা এখন কি কেউ লিখতে পারবে?’ আসল কথা হল, ক্রিয়েশন কখনও পুরনো হয় না। সেটা চিরস্থায়ী।
টেকনোলজিতে এখন তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রেকর্ড থেকে ক্যাসেট হয়ে সিডি/ডিভিডি। আপনার কী মনে হয়, রেকর্ডই সেরা?
না, সেটা বলা যাবে না। আগে আমরা মোনো-রেকর্ডিং করতাম। অনেক মেকানিকাল ছিল সেটা। অসুবিধেও ছিল প্রচুর। এখন অনেক বেশি ক্ল্যারিটি পাওয়া যায়। ছোট-ছোট ডিটেল ধরা পড়ে। একটা হিসিং সাউন্ডও গানে কালার দিতেপারে, আবার গানটাকে নষ্টও করতে পারে। নির্ভর করছে আপনি কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন তার উপর।
শোনা যায় যে লতা মঙ্গেশকর আপনাকে বম্বে নিয়ে গেছিলেন, গান গাওয়ানোর জন্য?
একেবারে ভুল তথ্য। লতা মঙ্গেশকরকে আমি চিনতামই না। বম্বে যাওয়ার গল্প অন্য। আসামে আমাদের পৈতৃক ব্যবসা ছেড়ে চলে এসেছিলাম, শুধু সংগীতের প্রতি প্যাশনের জন্য। সাংবাদিক শরৎ সেনের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। এবং আমি জানতাম, শরৎদার বম্বেতে অনেক চেনাজানা। তখন কলকাতায় গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’র শুটিং চলছে। শরৎদাকে বললাম আমাকে গুরু দত্তের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার জন্য, যদি হিন্দি সিনেমায় গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। তা নিয়ে গেলেন আমায় গুরুদার কাছে। গুরু দত্ত কিন্তু খুব ভাল বাংলা বলতেন, এখানে ভবানীপুরে ছিলেন অনেকদিন। আমার গান শুনে বললেন, ‘তুমি বম্বে চলে এসো। আমি তোমাকে আমার সিনেমায় একটা গানে সুযোগ দিয়ে দেখব।’ ওঁর অফিস ছিল মহালক্ষ্মী স্টুডিয়োতে। যেবার দেখা করতে গেলাম, সেদিন উনি ছিলেন না। তার আগের রাতে গীতাদির যমজ ছেলে জন্মায়। গুরুদা সেই নিয়ে খুবই আনন্দে ছিলেন। ওখানে শংকর-জয়কিষণের অফিস ছিল। শরৎদার সঙ্গে ওঁদের ওখানেও গেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ আর সুধীন দাশগুপ্তর গান গেয়েছিলাম মনে আছে। ওঁরা আমার গান শুনেই আমায় কনট্র্যাক্টে সই করিয়ে নিলেন তাঁদের ছবিতে গান গাওয়ানোর জন্য। সেই শুরু হল আমার বম্বেতে পথচলা।
কোন হিন্দি ছবিতে আপনার প্রথম গান গাওয়া?
‘কাঠপুতলি’, বলরাজ সাহনি-র ছবি। তারপরে লতাজির সঙ্গে ‘ছোটি বহেন’ ছবিতে ডুয়েট। তালাত মাহমুদ আমার গান শুনে খুব প্রশংসা করতেন। একদিন এসে বললেন, আমি নাকি ওর রেকর্ড ভেঙে দিয়েছি। ওঁর দু-নম্বর গান হিট ছিল, আর সেখানে আমার প্রথম গানই হিট। বম্বেতে দশ বছর ছিলাম। প্রথম আড়াই বছর অন্য কোথাও গাইতে পারিনি। পরে কল্যাণজি-আনন্দজি, মদনমোহন, শ্রীনাথ ত্রিপাঠী এঁদের সঙ্গেও কাজ করেছি।
সিনেমাতে অভিনয়ও তো করেছেন…
হ্যাঁ। উত্তমকুমার আমার খুব ফ্যান ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ‘মোমের আলো’-তে অভিনয় করেছি। উনি ডাক্তার, আমি হিরো। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় হিরোইন। আমি হিরো আর উনি সেকেন্ড রোলে, ভাবা যায় কখনও! আর একটা অজানা গল্প বলে রাখতে চাই। হৃষীকেশ মুখার্জির সঙ্গে আমার খুবই সুসম্পর্ক ছিল। এডিটর থাকাকালীন ওঁর আন্ধেরির বাড়িতে প্রায়ই যেতাম। দিলীপকুমারের সঙ্গে আমার সেখানেই আলাপ। উনি হৃষীদাকে প্রায়ই অনুরোধ করতেন আমাকে সিনেমায় নামানোর জন্য। আমি পাত্তা দিতাম না। ‘অভিমান’ ছবিটা করার জন্য হৃষীকেশ মুখার্জি ছ-বছর আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। আমি করিনি। কেননা মা বারণ করেছিলেন। ওই রোলটা অমিতাভ বচ্চন করেন। নায়কের নাম সুবীর। গায়ক। ওইটাই আমি…