আকাশের মেঘ দেখে যারা ভেবেছিল, হাতি, বাজপাখি, পক্ষীরাজ— তারা নিশ্চয়ই বদলে-বদলে যেতেও দেখেছিল সেসব গড়ন? স্তরে-স্তরে জগদীশ্বর যখন মেঘের মণ্ড দিয়ে তৈরি করছিল অপূর্ব অবয়ব আর আকাশের ক্যানভাসে সময় মেপে নড়ছিল-চড়ছিল তারা, ঠিক তখনই, ঈষৎ ট্রানজিশনে পাখির ডানা কী করে যে হঠাৎ হাতির কান হয়ে যায়— সে-ফন্দিটা বহুকাল ধরতে পারেনি কেউ। টেকনিকটা আসলে কতটা সম্ভাবনাময়, সেটা অনুধাবন করার জন্য ১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর ওয়াল্ট এলিয়াস ডিজনিকে জন্মাতে হল চিকাগো শহরের কোল আলো করে। আর ঠিক একইসঙ্গে কে যেন অলক্ষ্যে লিখে দিল অ্যানিমেশনের বিজয়যাত্রা। সোনার বরণ অক্ষরে।
১৯৩৭ সালের ২১ ডিসেম্বর, অর্থাৎ ঠিক আজকের দিনেই মুক্তি পেয়েছিল ওয়াল্ট ডিজনির প্রথম অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম, ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস’। অ্যানিমেশন ছবির ইতিহাসে এই ছবিটিকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে ছবিটি এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে সফল, ইনফ্লেশনের অঙ্কে। কিন্তু শুধু বাণিজ্য বা ব্যাবসায়িক সাফল্যের গরিমায় বাঁধা যায় না এই ছবির মহিমা। ডিজনির ‘স্নো হোয়াইট…’ আসলে খুলে দিয়েছিল এমন এক দিগন্ত, যা পার করার স্বপ্ন সারা পৃথিবীর শিল্পীকুল দেখে থাকলেও সে রাস্তাটার হদিশ পায়নি বাস্তবে।
এ-কথা সত্য নয় যে, ডিজনি সাহেবই পৃথিবীর প্রথম অ্যানিমেটেড ফিচারটি বানিয়েছিলেন। বরং প্রথম অ্যানিমেটেড ফিচার তৈরি হয়ে গিয়েছিল ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দা সেভেন ডোয়ার্ফস’-এরও কুড়ি বছর আগে। আর্জেন্টিনায়। কুইরিনো ক্রিশ্চিয়ানি তাঁর ‘El Apòstol’ ছবিটি রিলিজ করেছিলেন ১৯১৭ সালের ৯ নভেম্বর, বুয়েনো আইরেসে। কিন্তু সে-ছবি ছিল কার্ডবোর্ড অ্যানিমেশন। অর্থাৎ, হাজার-হাজার কার্ডবোর্ড কাঁচি দিয়ে কেটে ক্রিশ্চিয়ানি সাহেব তৎকালীন আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট হিপোলিতো ঋগোয়েন-এর আদলে একটি চরিত্র বানিয়ে তৈরি করে ফেলেছিলেন আস্ত একটি অ্যানিমেটেড ফিচার। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই ছবির সংরক্ষণ করা যায়নি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ডিজনি সাহেব তাঁর ভাই রয়ের সঙ্গে ‘Disney Brothers Cartoon Studio’ তৈরি করার বেশ কিছুকাল পরে স্বয়ং নিজে আর্জেন্টিনায় গিয়ে ক্রিশ্চিয়ানিকে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন তাঁর স্টুডিওয়। কিন্তু ক্রিশ্চিয়ানি সেই লোভনীয় প্রস্তাবের চেয়ে নিজের মাতৃভূমিকে এগিয়ে রাখলেন। তাই আর্জেন্টিনা ছেড়ে উত্তর আমেরিকায় গিয়ে ডিজনির স্টুডিওয় চাকরি করা তার আর হয়ে ওঠেনি।
যদিও ‘El Apòstol’ ছবিটি পৃথিবীর প্রথম অ্যানিমেনেটেড ফিচার, তবে তার পথ ধরে কিন্তু এগোয়নি অ্যানিমেশন শিল্পের জুড়িগাড়ি। বরং এগিয়েছিল ডিজনির পথ ধরে। এ-কথা বলার মানে কী? এর মানে বুঝতে গেলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে অ্যানিমেশনের তাত্ত্বিক ও নান্দনিক দিকগুলোকে।
মিকি মাউজ দিয়ে ডিজনির ‘সেল অ্যানিমেশন’-এর পথ চলা শুরু হয়। প্রথম শর্ট ফিল্মটির নাম ছিল ‘প্লেন ক্রেজি’। ১৯২৮ সালের এই ছবিটি তৎকালীন সময়ে খুব বিশেষ সাড়া না ফেলতে পারলেও খুলে দিয়েছিল অ্যানিমেশন-বিজ্ঞানের সিংহদুয়ার। ‘সেল অ্যানিমেশন’ শব্দটি এসেছে সেলুলয়েড অ্যানিমেশন থেকে। অর্থাৎ, স্বচ্ছ সেলুলয়েড কাগজের ওপর প্রথমে আঁকা হত সব ছবি। আর রং করা তার উলটোপিঠে। চরিত্রের প্রতি একটা মুভমেন্ট এক-একটি সেলুলয়েড কাগজে এঁকে তার ছবি তোলা হত রস্ট্রাম ক্যামেরায়। ধরা যাক, একটা ফ্রেমে একটার বদলে একাধিক চরিত্র আছে। তখন আলাদা-আলাদা সেলুলয়েড কাগজে সেগুলো জায়গামতো এঁকে স্তরে-স্তরে একের ওপর এক-একটা চাপানো হত, যেমন আকাশের মেঘেরা থাকে স্তরে-স্তরে। একদম তলায় রাখা হত ব্যাকগ্রাউন্ড। সেটা জঙ্গল হলে, জঙ্গলের ব্যাকগ্রাউন্ড আঁকা হত, পাহাড় হলে পাহাড়, সমুদ্র হলে সমুদ্র। এর পর সেই সমস্ত আঁকা সেলুলয়েড কাগজের একটা দিস্তে বানানো হত। আর একদম ওপরে চাপানো হত একটা স্বচ্ছ ওজনদার কাচ, যাতে তলার সব সেলুলয়েড কাগজগুলো সমান হয়ে বসে যায়। তারপর রস্ট্রাম ক্যামেরায় টপ শট নেওয়ার মতো করে সেটার ছবি তোলা হত একসঙ্গে। যেহেতু সেলুলয়েড ও কাচ— সব ক’টাই স্বচ্ছ, তাই প্রত্যেকটা স্তরের আঁকা টপ শটে পরিস্কার দেখা যেত এবং তার সঙ্গে যোগ হত নিটোল একটা ডেপথ অফ ফিল্ড। এটা হল একটা ফ্রেম। এরপর চরিত্রের পরের মুভমেন্ট আবার নতুন সেলুলয়েডে আঁকা হত। ফ্রেমে অন্যান্য চরিত্রর প্রয়োজন থাকলে আঁকা হত আলাদা-আলাদা সেলুলয়েডে। তারপর পুনরায় সব ক’টা সেলুলয়েড একের ওপর এক সাজানো হত থরে-থরে দিস্তের মতো, তারপর স্বচ্ছ ভারী কাচ বসিয়ে সেই নতুন দিস্তের ছবি তোলা হত আবার। যে-জিনিসটা চমকপ্রদ, তা হল এক সেকেন্ডের জন্য এমন চব্বিশটি দিস্তে তৈরি হত। অর্থাৎ, এক মিনিটে ১,৪৪০টা দিস্তে। এরপর ছবি যত মিনিটের হবে, তা ১,৪৪০ দিয়ে গুণ হবে।
মিকি মাউজের প্রথম ছবি ছিল পাঁচ মিনিট ছাপান্ন সেকেন্ডের। অর্থাৎ, সেই ছবিতে ডিজনিদের ৮,৫৪৪ দিস্তে ছবি আঁকতে হয়েছিল। ঠিক ন’বছর পর যখন ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস’ ছবিটি তৈরি হয়, তখন সে-ছবির জন্য ডিজনিদের আঁকতে হয়েছিল ১,১৯,৫২০ দিস্তে ছবি। কারণ এই ছবিটির দৈর্ঘ্য ছিল ৮৩ মিনিট। বলা বাহুল্য, এক-একটি দিস্তেতে যতগুলো চরিত্র থাকবে, ততগুলো আলাদা-আলাদা ছবি আঁকাতে হত। সেভাবে হিসেব করতে হলে দেখা যাবে, ‘স্নো হোয়াইট…’ ছবিটির জন্য ডিজনিদের প্রায় ১০-১২ লক্ষ ছবি আঁকতে হয়েছিল। ডিজনির এই পদ্ধতি ভয়ংকর পরিশ্রমসাধ্য হলেও এটাই তাবৎ অ্যানিমেশন টেকনোলজির খোলনলচে পালটে দেয়। এই পদ্ধতির জন্য শিল্পের গুণমান-উৎকর্ষই যে শুধু বৃদ্ধি পেয়েছে, এমন নয়। ডিজনির এই বিদ্যার জোরেই আজও মডার্ন 2D অ্যানিমেশনে আমরা ফোটোশপ, প্রো-ক্রিয়েট কিংবা টিভি পেন্ট জাতীয় সফটওয়্যারে লেয়ারিং পদ্ধতিতে অ্যানিমেশন করে থাকি। তাই ‘সেল অ্যানিমেশন’-কে অ্যানিমেশন বিপ্লবের সিংহদুয়ার বলা যথোচিত।
এ তো গেল টেকনিক্যাল দিক। কিন্তু ‘স্নো হোয়াইট…’ কেবলমাত্র টেকনিক্যাল দিশাই দেখায়নি। সেই টেকনোলজিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাণিজ্যও করেছিল মারকাটারি। তৎকালীন সময়ে ছবিটি দেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলারে তৈরি হলেও সর্বসাকুল্যে বাণিজ্য করেছিল ৪১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবু ডিজনির স্নো হোয়াইটের যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না প্রথমে। যখন দেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট-সাপেক্ষ প্রোজেক্টটির কথা জানাজানি হয়, তখন হলিউডে হাসাহাসির রোল পড়ে যায়। বিদ্বজ্জনদের ধারণা ছিল, মিকি মাউজের হাত ধরে যে ডিজনি স্টুডিও জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, তা অচিরেই অন্ধকারে যেতে চলেছে। প্রোজেক্টটিকে তারা ‘Disney’s Foly’, অর্থাৎ, ডিজনির ভ্রান্তি হিসেবে দেগে দিতেও ছাড়েনি।
কিন্তু ডিজনি সাহেব তাতে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। ‘স্নো হোয়াইট…’ ছবির গুণমানের উৎকর্ষর জন্য তিনি তাঁর অ্যানিমেটরদের শুইনার্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-এ ট্রেনিং নিতে পাঠান কোম্পানির খরচে। এমনকী, নিজের স্টুডিওতে ছোটখাটো একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে বিভিন্ন পশুপাখি এনে রাখেন, যাতে আর্টিস্টরা সেসব স্টাডি করে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে পশুপাখিদের আচার-আচরণ, অভিব্যক্তি। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত প্রায় চার বছর সময় নিয়ে দুশোর বেশি আর্টিস্টকে নিয়ে ডিজনি সাহেব তৈরি করেন ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস’। ১৯৩৭ এর ২২ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ছবিটি। এরপর ডিজনি স্টুডিওকে আর ঘুরে তাকাতে হয়নি। পৃথিবীব্যাপী জয়জয়কার শুরু হয়ে যায়। ছেলে-বুড়ো সকলেই মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে ‘স্নো হোয়াইট…’-এর বিজয় যাত্রা।
১৯৩৯-এর অ্যাকাডেমি পুরস্কার অনুষ্ঠানে ঘটে যায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা, যার কোনও পূর্বাপর নেই। ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস’ অস্কার পায়। তবে এই পুরস্কারটি আর পাঁচটা অস্কারের মতো নয়। ডিজনির দিগন্তকারী অবদানের জন্য অস্কার কমিটি তাঁকে একটি আস্ত অস্কার তো দেন-ই, তার সঙ্গে কেবল সেভেন ডোয়ার্ফকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য সাত-সাতটা খুদে অস্কারও দেন মূল ট্রফিটির সঙ্গে। অ্যাকাডেমির এই অস্কার অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফ অস্কারস-এর নিদর্শন ইতিহাসে আর ঘটেনি। মহীরুহদের মধ্যে চার্লি চ্যাপলিন স্বয়ং ডিজনির এই ছবিকে চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে বেছে নেন। তবে প্রশংসার তালিকায় সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে থাকবেন সের্গেই আইজেনস্টাইন। ডিজনির স্নো হোয়াইটকে দেখে আইজেনস্টাইন এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন, যে চলচ্চিত্রের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনের রাজতিলক পরিয়ে দেন ছবিটিকে। ১৯৮৭ সালে ছবিটি হলিউডের ওয়াক অফ ফেম-এ জায়গা করে নেয় পাকাপাকিভাবে।
অ্যানিমেশনের জগতে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও এরপর একের পর এক চমক নিয়ে এসেছে। পিনোকিও, মেরি পপিন্স, দ্য জাঙ্গল বুক, রবিন হুড, পপাই, আলাদিন, লায়ন কিং এদের মধ্যে বিশ্ববন্দিত। একশো বছরের অনেক কম সময়ে সর্বসাকুল্যে এখনও পর্যন্ত নয় নয় করে ১৩৯টি অ্যানিমেশন ফিচার ছবি বানিয়ে ফেলেছ ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও। আর তার সঙ্গে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য প্রতিভার। প্রভাবিত করেছে তার চেয়েও বেশি শিল্পীদের। বলা বাহুল্য, ডিজনি সাহেবের সাফল্য আর সাম্রাজ্যকে পাথেয় করেই প্রাচ্যের মাটি থেকে ফুজিয়ামার মতো ফেটে পড়েছেন হায়াও মিয়াজাকি। জাপানে তৈরি হয়েছে স্টুডিও ঘিবলি।
কিন্তু অ্যানিমেশন-এর ইতিহাসে ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস’ চিরকাল জ্বলজ্বল করবে সূর্য হয়ে। যাকে ঘিরে গ্রহ-উপগ্রহর মতো ঘূর্ণাবর্তে মেতে থাকবে আর বাকি সব ছবি, চিরকৃতজ্ঞ হয়ে। তাই আকাশের ক্যানভাসে মেঘেরা আজও অবয়ব বদল করে ট্রানজিশন থেকে ট্রানজিশনে। কখনও হাতি, কখনও পক্ষীরাজ, কখনও মিকি মাউজ, কখনও স্নো হোয়াইট হয়ে।