ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ডেটলাইন : পর্ব ১১


    তপশ্রী গুপ্ত (December 10, 2024)
     

    পর্ব ১০

    ক্যারাভান বাড়ি, সমুদ্রের গন্ধ, আশ্চর্য স্টেশন

    সর্ষেক্ষেতে ফুল হয়ে তাই জাগল’— বাঙালি এই লাইনটা গুনগুন করে না গেয়ে পারবেই না এ-পথে। নরউইচ থেকে আউলটনে যাওয়ার হাইওয়ের ধারে দিগন্তবিস্তৃত সর্ষেক্ষেত। হলুদ সমুদ্রে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ঢেউখেলানো সবুজ দ্বীপ ভুবনবিখ্যাত ইংলিশ মেডো। সেখানে সারাদিন অলসভাবে চরে বেড়ায় ভেড়ার দল। টিপিক্যাল কান্ট্রিসাইড। আর কদাচিৎ পুরনো ধাঁচের কটেজ। সামনে এক ফালি বাগান পেরিয়ে ছোট্ট দরজা, পাশে ঝোলানো আলো, দোতলার কাচের জানালা সাদা পরদা ঢাকা, ত্রিভুজের মতো ছাদে চিমনির মাথাটুকু বেরিয়ে আছে। দরজার পাশে একটা মোটাসোটা বেড়াল চুপটি করে বসে থাকলেই ছবিটা সম্পূর্ণ হয়। লন্ডনের শহরতলিতে এমন বাড়ি অনেক আছে, যার সামনে দিয়ে সারাদিন হাঁটাহাটি করে লোকের মুখ দেখা না গেলেও গেটের ওপারে পোষা বেড়াল-কুকুর দেখবেনই। অক্সফোর্ডের কাছে কটসওল্ডস নামে একটা গ্রাম আছে, যেটা এখন ট্যুরিস্ট স্পট, যেখানকার প্রতিটি বাড়ির রং এক— লাইমস্টোনে তৈরি মধুরঙা বাড়িগুলোর ছাদে বসানো আছে কুকুর বা বিড়ালের মূর্তি। এমনকী, দু-একটা বাড়ির ছাদে দেখেছিলাম, তিন-চারটি পোষ্য মিলে দৌড়চ্ছে বা খেলছে, এমন ছবিও ভাস্কর্যে ধরা আছে। এদিকে অবশ্য সেরকম চোখে পড়ল না।

    আসলে আমরা এগোচ্ছি সাগরপানে। ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। কাউন্টি বদল হয়ে যাবে— নরফোক থেকে সাফোক। গাড়ি চালাতে-চালাতে আফশোস করছিল হিমুদা, ‘আর একটু সময় থাকলে নর্থ সি-র ধারে যাওয়া যেত। দারুণ বিচ।’ জয়বৌদি তো দেখলাম সমুদ্রের নামেই উচাটন হয়ে যায়। একটু আগে বাড়ির ভেতর ফায়ারপ্লেসের ধারে বসে ভূতের গল্প শোনাতে পারেনি, নেহাত বাইরে ভালরকম দিনের আলো ছিল বলে। সেই আক্ষেপ ফিরে এল, কেন একটা রাত থেকে গেলাম না! হিমুদা বলল, আউলটন হল অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। সরাসরি সমুদ্রের সঙ্গে যোগ না থাকলেও নোনাজলের হ্রদ লোদিং-এর সঙ্গে যুক্ত আউলটন ব্রড, যে-লেকের একটা প্রান্ত আবার মিশেছে নর্থ সি-তে। তাই পরোক্ষে আমরা সাগরে যাচ্ছি বলাই যায়! পথে দু-একটা ছোট জনবসতি পড়ল বলে অফিসফেরত জ্যাম ছিল। একটু দেরি হল। চিন্তা নেই, রাত আটটা পর্যন্ত দিন থাকে এখানে। যদিও তার মধ্যেই লোক ডিনার সেরে ফেলে। আমরা নরউইচের বাড়িতে পুরো বাঙালি কেতায় লাঞ্চ খেয়েছি বেলা তিনটেয়, সুতরাং পেট ভর্তি।

    ক্যারাভানের কথা বইতে পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি। যাযাবরদের ভ্রাম্যমাণ বাসা ক্যারাভান। কিন্তু ক্যারাভান বাড়ি এই প্রথম দেখলাম, যাকে এখানে বলে স্ট্যাটিক ক্যারাভান। আউলটনে জলের ধারে গেটেড কমিউনিটি। আবাসনের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে কিছু ক্যারাভান, যেগুলোর নীচে চাকা লাগানো থাকলেও নড়ে না। কিন্তু বেশ একটা বোহেমিয়ান ফিল হয় বলেই এত দাম দিয়ে কেনে লোকে। ছুটি কাটানোর চমৎকার ঠিকানা। আর আছে কিছু দুধসাদা কটেজ, ছোটর মধ্যে কী নেই ভেতরে! এরকম পাশাপাশি দুটো কটেজের মালিক হিমুদা আর জয়বৌদি। সামনে-পেছনে বারান্দা, লিভিং রুম, দুটো শোয়ার ঘর, কিচেন, টয়লেট। সবই অত্যাধুনিক কায়দায় সাজানো, শুধু সাইজে একটু ছোট এই যা। নাতি-নাতনিদের ঘরটা সবচেয়ে সুন্দর, দোতলা বাঙ্ক বেড আর রঙিন কাবার্ড দিয়ে সাজানো। আমার ক্যারাভান বাড়ি দেখার তুমুল ইচ্ছে দেখে হিমুদা এক প্রতিবেশীর বাড়ি নিয়ে গেল। এর ভেতরটা কিন্তু কটেজের থেকে একটু বড় মনে হল। একটু আগে নরউইচে হিমুদার বাড়িতে যে উনিশ শতকের ফায়ারপ্লেস দেখে এসেছি, এখানকারটা তার একেবারে উলটো। রিমোট কন্ট্রোলে চলে, কাচের ঢাকনার ওপারে নকল বহ্নিশিখার দাউদাউ জ্বলে ওঠা কিম্বা টিমটিম আলো ছড়ানো, সবটাই আঙুলের আজ্ঞায় নিয়ন্ত্রিত। আমি গভীর মনযোগে তাকিয়ে আছি দেখে গর্বিত মালকিন হেসে বললেন, ‘সন্ধেবেলা আরও ভাল লাগে এর ওম আর আলো দুটোই।’

    এসব কিছু পার্থিব বস্তুর অনেক ওপরে যা এই জায়গাটার আসল টান, তা হল সমুদ্রের ডাক। যেন ওই দেখা যায় নীল ঢেউ। দু-পা হেঁটে যে-বিশাল জলরাশির ধারে গিয়ে দাঁড়াবেন, সেই আউলটন ব্রডের বাতাসে নোনা গন্ধ, পাড়ে বাঁধা রংবেরঙের নৌকোগুলো হাতছানি দেয়, ‘আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে/ আমাকেও সাথে নিও/ নেবে তো আমায়/ বলো নেবে তো আমায়…’। মৌসুমী ভৌমিক কানে নিয়ে আপনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যাবেন, শেষ বিকেলের আলো মেখে আউলটন ব্রডের আধভেজা কাঠের পাটাতনে পা রাখবেন, আপনার মাথার ওপর তখন একশো সিগালের ওড়াউড়ি, স্যান্ডপাইপার্সদের ডাক যেন একরাশ জেদি শিশুর কান্না। এটা আবাসনের নিজস্ব ব্রড বলে ফাঁকা; অন্যপাশে পার্ক, ক্যাফের ছড়াছড়ি। সেগুলো দেখে অবশ্য ভুলেই যাবেন এই আউলটন ব্রড জায়গাটার খুব পুরনো ইতিহাস আছে। ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নাকি এই অঞ্চলটাই সেতুর মতো যোগ করে রেখেছিল ব্রিটেনকে মূল ইউরোপের সঙ্গে। সে যাক, আপাতত দেখা হল ১৬৮৫ সালের স্থাপত্য ব্রড হাউস, যার ভেতরে রয়েছে মিউজিয়াম। সেখানে উনিশ শতকের পোর্সেলিন শিল্পের সম্ভার দেখে তাক লেগে যাবে। কিন্তু এই মিউজিয়ামের যে-ব্যাপারটা আমাকে বেশি ভাবাল, তা হল এর চরিত্র। স্থানীয় প্রত্নসামগ্রীতে ভরা। যেহেতু এই এলাকা খুবই প্রাচীন, তাই অনেক ফসিল রয়েছে। কিছু প্রাগৈতিহাসিক ধরনের জিনিসপত্র দেখে প্রশ্ন করতে যে-উত্তরটা পেলাম, তাতে হাঁ হয়ে গেলাম। ওগুলোর বয়স নাকি সাত লক্ষ বছর। তখনকার মানুষ এগুলো ব্যবহার করত। এরপর কি আর ভিক্টোরীয় আমলের আসবাব দিয়ে সাজানো ঘর কিম্বা ‘কবলার কবলার মেনড মাই শু’ ছড়ার সেই আদ্যিকালের মুচির দোকানের মডেল আদৌ প্রাচীন বলে মনে হতে পারে?

    এই মিউজিয়ামের যে-ব্যাপারটা আমাকে বেশি ভাবাল, তা হল এর চরিত্র। স্থানীয় প্রত্নসামগ্রীতে ভরা। যেহেতু এই এলাকা খুবই প্রাচীন, তাই অনেক ফসিল রয়েছে। কিছু প্রাগৈতিহাসিক ধরনের জিনিসপত্র দেখে প্রশ্ন করতে যে-উত্তরটা পেলাম, তাতে হাঁ হয়ে গেলাম। ওগুলোর বয়স নাকি সাত লক্ষ বছর।

    ঘরের ভেতর ইতিহাসের ছায়ার মতোই দীর্ঘ হয়েছে বাইরের মেঘলা বিকেল। এবার ফেরার পালা। সোজা নরউইচ স্টেশন, লন্ডনের ট্রেন ধরতে হবে। হিমুদা আর বৌদির মন খারাপ, এই ‘এসেই বলে যাই যাই যাই’ ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। কোথা দিয়ে যে কেটে গেল আস্ত একটা দিন, কত কী যে ধরা রইল মোবাইলের থেকেও বেশি চোখের ক্যামেরায়, আর তার থেকেও বেশি মনের ভাঁড়ারঘরে! কিন্তু তখন বুঝিনি, আজকের দিনের মতো খাতা বন্ধ করব বলে ভাবলেও সেটা ছিল মস্ত ভুল। যে লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশন দিয়ে সকালবেলা ছুটতে-ছুটতে ট্রেন ধরেছিলাম, সেটাও একটা দেখার মতো জায়গা। আসলে সত্যি বলতে কি, লন্ডনের লাইফলাইন টিউবের বহু স্টেশনই ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা। যাতায়াতের তাড়ায় হয়তো উলটে দেখা হয় না, তাই মিস হয়ে যায়। ফাঁকা ট্রেনে বসে আবার ফিরে এল সকালের সেই টিকিট কেলেঙ্কারির শোক। ফোরেক্স কার্ড থেকে টাকা কেটে নিল, কিন্তু জমা পড়ল না টিকিট কাউন্টারে। এই রহস্য সমাধান হবে কীভাবে? লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশনে পৌঁছে আমার মেয়ে বলল, ‘চলো, একবার খোঁজ করে যাই কাউন্টারে। যদি সারাদিনের কোনও আপডেট থাকে!’ সকালের মহিলা অবশ্য শিফ্‌ট শেষ করে বাড়ি চলে গেছেন। তবে তিনি যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে ঘটনাটি জানিয়ে গেছেন তাঁর পরের জনকে। সেই সাহেব তরুণটি আশ্বস্ত করলেন, সময় লাগবে মিটতে। তবে ডিজিটাল পেমেন্টের যে-স্তরেই আটকে থাকুক না কেন টাকা, একদিন-না-একদিন তা ফেরত পাওয়া যাবেই। পাশের কাউন্টারের শ্যামলা ছেলেটি নিশ্চয়ই শুনছিল সবটা, এবার মুখ তুলে বলল, ‘আই অ্যাম শেখর, ফ্রম তামিলনাড়ু।’ আমাদের মনে হল, হাতে চাঁদ পেলাম। এবার স্পষ্ট হিন্দিতে বলল, ‘এখানে রোজ এরকম অনেক ঘটে। তোমাদেরটা আমি স্পেশাল ভাবে দেখব। আমার ফোন নম্বর দিচ্ছি। হোয়াটসঅ্যাপে একটা হাই পাঠিয়ে রেখো।’ সত্যিই শেখর কথা রেখেছিল। টাকা একদিন ফেরত আসতই অ্যাকাউন্টে জানি, কিন্তু নিয়মিত খোঁজ দেওয়া-নেওয়া করতে-করতে যে-বন্ধনটা তৈরি হল একটা অচেনা মানুষের সঙ্গে, সেটা অনেক বড় পাওয়া। তারপর থেকে ‘কেমন আছ’ মেসেজ তো প্রায়ই আসে, আর দশেরা-দীপাবলিতে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলে না শেখর।

    ক্যারাভান বাড়ি

    লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশন অনেকগুলো কারণে দ্রষ্টব্য। ব্রিটেনের প্রাচীনতম, গভীরতম, ব্যস্ততম স্টেশনগুলোর একটা। ১৮৭৪ সালে তৈরি এই স্টেশন দিয়ে এত যাত্রী যাতায়াতের কারণ হল, টিউব থেকে নেমে মেন লাইনের ট্রেন ধরা যায়। ওই রাতেও কিছুটা সময় এখানে না কাটিয়ে ফিরতি টিউব ধরতে পারলাম না। চলার পথে অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। এক-একটা ভাস্কর্য এত জীবন্ত, যেন এক-এক টুকরো ইতিহাস। যেমন কিন্ডারট্রান্সপোর্ট। ব্রোঞ্জে তৈরি পাঁচটি বালক-বালিকা, সঙ্গে স্যুটকেস, সামনে রাখা বেহালা, একটি ছোট্ট মেয়ের কোলে টেডি বিয়ার। এবং তাদের চোখের দৃষ্টিতে কিছু খোঁজার ভাব থাকলেও অসহায় নয়। বরং আশার আলো ফুটে উঠেছে মুখে। ১৯৩৮-’৩৯ সালে প্রায় দশ হাজার ইহুদি শিশুকে জার্মানি আর অস্ট্রিয়া থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছিল ব্রিটেনে, নয়তো নাৎসি বাহিনী তাদের মেরে ফেলত। তারা নেমেছিল এই লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশনে, তাদের হয় দত্তক নিয়েছিল বিভিন্ন ব্রিটিশ পরিবার অথবা আশ্রয় মিলেছিল ফস্টার হোমে। তবে দুঃখের কথা এটাই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এদের বেশির ভাগই আর আসল বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে পারেনি। অনেকের ফেলে আসা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, অনেকের নিখোঁজ। তাদেরই প্রতীক এই পাঁচজন। আর একটু এগোলেই বিশাল মার্বেলের ওপর ১০০ নাম লেখা। এঁরা সবাই গ্রেট ইস্টার্ন রেলওয়ের কর্মী, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শহিদ হিসেবে এই মর্যাদা পেয়েছেন।

    বেশ রাত হয়ে গেল ওয়েম্বলির টিউব ধরতে। হ্যাঁ, পৃথিবীবিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, ইংলিশ ফুটবলের তীর্থক্ষেত্র, যেখানে একসঙ্গে ১০,০০০ লোক বসে খেলা দেখতে পারে, তার সামনেই আমাদের হোটেল। লিগের খেলা থাকলে সামনের রাস্তায় ফুটবল ফ্যানদের ভিড়ে হাঁটা দায়। অবিকল কলকাতার ইস্ট-মোহন সমর্থকদের মতো দলের ফ্ল্যাগ কাঁধে, মাথায় ফেটি বেঁধে, গালে রঙের পোঁচ দিয়ে, হইহই করতে করতে যায় তারা। মাঝে মাঝে ঝামেলাও বাঁধে দু-দলের ফ্যানদের মধ্যে। জয়ী টিমের সমর্থকদের গন্তব্য কাছাকাছি বিয়ার পাব। এই অঞ্চলের বাসিন্দা বন্ধু তমালিকা অবশ্য বলল, হেরোদের গন্তব্যও এক। কে না জানে, কেউ বৃষ্টি পড়লে খায়, কেউ না পড়লে খায়!

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook