জগৎ তার সম হারাল। যে-মাত্রা থেকে তাল শুরু হয়, তাকে ওই তালের ‘সম’ বলে। আমাদের সবার জীবনেই জাকির হুসেন ছিলেন সেই সম, যাঁকে ঘিরে তালের ব্রহ্মাণ্ডটা ঘুরত। ৭৩ কি একটা চলে যাওয়ার বয়স? ওঁর চলে যাওয়াটা এতটাই অকল্পনীয়, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কত যে কাজ করার বাকি থেকে গেল!
আমার কাছে উনি ছিলেন বড় দাদারই মতো। ছেলেবেলায় একই বাড়িতে থাকতাম আমরা। আমেরিকার সেই বাড়ির ওপরতলায় আমি থাকতাম বাবা-মা’র সঙ্গে, এবং নীচতলায় জাকিরভাই আর কত্থক-মায়েস্ত্রো পণ্ডিত চিত্রেশ দাস একসঙ্গে থাকতেন। তখন ওঁর কতই-বা বয়স? বড়জোর ১৮ কি ১৯। মনে আছে এরকম বহু সময়েই হয়েছে যে, বাবা-মা কোথাও গেলে আমায় ওঁর কাছে রেখে যেতেন দেখাশোনার জন্য। আমার তখন চার/পাঁচ বছর বয়স।
জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কথা বলেছেন, সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন; এবং নানাভাবে চেষ্টা করতেন কীভাবে সেসব সমস্যার সমাধান করা যায়। আমার প্রতি ওঁর স্নেহ তো ছিলই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল নিঃস্বার্থ ভালবাসা। আমিও ওঁকে শ্রদ্ধা যেমন করতাম, তেমনই প্রচণ্ড ভালবাসতাম। আমাদের দুজনের দেখা হলেই এই আন্তরিকতার আত্মীয়তাটুকু টের পাওয়া যেত সবসময়ে।
আমি ওঁর কাছে সেই ছেলেমানুষই থেকে গেছিলাম শেষদিন পর্যন্ত, যে-কারণে দেখা হলেই জড়িয়ে ধরে আদর করতে কিংবা গালে চুমু খেতে উনি দ্বিধাবোধ করতেন না। মাঝে মাঝে মজা করে বলতেন, ‘তোকে যে ছেলেবেলায় কোলেপিঠে মানুষ করেছি, এখন কেউ বিশ্বাস করবে! কত বড় হয়ে গেছিস!’
গত বছর ঠিক ১৫ ডিসেম্বরই ওঁর সঙ্গে আমার গোয়াতে দেখা হয়। কী যে প্রাণশক্তি ছিল ওঁর মধ্যে, যাঁরা ওঁকে দেখেননি, তাঁদের ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। অনেক পথচলার রাস্তা, অনেক গানবাজনার রাস্তায় জাকিরভাই আমায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। উৎসাহিত করেছেন। ভারতবর্ষ শুধু নয়, সারা পৃথিবীর সংগীতজগতের কাছে ওঁর চলে যাওয়াটা একটা অপূরণীয় ক্ষতি। আক্ষেপ হচ্ছে আমার, আরেকটু আয়ু কি পেতে পারতেন না উস্তাদ? এই কথা কি খুব সহজে মেনে নেওয়া যায় যে, কাউকে আর কোনওদিন এই পৃথিবীতে জাকিরভাই বলে ডাকতে পারব না?
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)