কড়া-গণ্ডা-পণ বা কাঠা-বিঘার পরিমাণ নির্ণয়ের জটিল হিসেব-নিকেষকে ‘আর্যা’সূত্রে গেঁথেছিলেন জনৈক ‘শুভঙ্কর’নামক এক গণিতজ্ঞ। কিন্তু কে এই শুভঙ্কর? কী তার প্রকৃত পরিচয়? তার সময়কাল কোনটা? তার সঠিক জন্মস্থানই-বা কী?— সবকিছু নিয়েই দ্বন্দ্ব ও মতান্তর রয়েছে। শুভঙ্কর এবং তাঁর নামানুসারে ‘শুভঙ্করী আর্যা’ বিষয়ে যা তথ্য মিলেছে, তাতে করে তাঁর সময়কাল অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। অন্যদিকে নানা তথ্য-সাক্ষ্যের সূত্রে এবং তাঁর রচিত গণিত পদাবলিতে ব্যবহৃত শব্দচয়নে একপ্রকার প্রমাণিত, তিনি বাঁকুড়া জেলার বাসিন্দা। ‘শুভঙ্করী আর্যা’-তে ধান-চাল-সরিষা মাপার পাত্র হিসেবে ‘পাই’, ‘কোনা’ কিংবা‘চৌঠী’র উল্লেখ আছে, যা বাঁকুড়ার মল্লভূম ও তুঙ্গভূম অঞ্চলে পরিমাপের ক্ষেত্রে আজও ব্যবহৃত হয়। আবার বেশ কিছু আলোচনায় উঠে এসেছে, গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর ছিলেন এক অসাধারণ পূর্তবিদ্যা-বিশারদ। বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী-পাত্রসায়র এলাকার যে প্রাচীনতম সেচখাল, তা গণিতজ্ঞ শুভঙ্করের নকশা, যা আজও ‘শুভঙ্করের দাঁড়া’ বা ‘শুভঙ্করের খাল’ নামে পরিচিত। যদিও সুকুমার সেন মহাশয় ‘শুভঙ্করের দাঁড়া’ সূত্রে, ‘দাঁড়া’ অর্থে বাঁধা গৎ, অর্থাৎ তরজা বলছেন। শুভঙ্করকে বাঁকুড়া জেলার বাসিন্দা মেনে নিয়েও, তিনি বাঁকুড়ার কোন এলাকার, এ-নিয়েও শুভঙ্কর-সন্ধানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। এমনকী, তাঁর প্রকৃত নাম, পদবি নিয়েও আছে যথেষ্ট মতপার্থক্য।
বাংলা প্রাইমার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে,‘শিক্ষাসার’, ‘শিশুবোধক’, ‘বর্ণবোধ’প্রভৃতি প্রাইমার গ্ৰন্থে শুভঙ্করের আর্যার উল্লেখ পাই। এরমধ্যে আমাদের সন্ধানে পাওয়া কাঙালীচরণ সিংহের ‘বর্ণবোধ’ (সংস্করণ ১৮৬৩) গ্ৰন্থে শুভঙ্করের নামে পাঁচখানা আর্যা সংকলিত হয়েছে। ‘শিশুবোধক’কোনও রচনাকারের একক গ্ৰন্থ নয়, উনিশ শতকের শিশু-শিক্ষার্থীদের জন্য একটি জনপ্রিয় সংকলন গ্ৰন্থ, যার প্রারম্ভে ‘সরস্বতী বন্দনা’ দিয়ে বাংলা বর্ণপরিচয়, ইংরেজি বর্ণপরিচয়, নাম-ঠিকানা লেখার ধারা, পত্রলেখার ধারা, অঙ্ক পরিচয়, গণিত শতকিয়া, গণিত নামতা, গণিত কড়া, গণিত আর্যা এবং তার সঙ্গে পুরাণকাহিনি, দেবদেবী বন্দনা ও চাণক্য শ্লোক-সহ নানাবিধ বিষয়ের সমাহার। ড. আশিস খাস্তগীর সম্পাদিত ‘বাংলা প্রাইমার সংগ্ৰহ’-র(সংস্করণ ১৮৯৮) একটি ‘শিশুবোধক’সংকলিত হয়েছে। যেখানে ২০টি আর্যার মধ্যে, অধিকাংশই শুভঙ্করের। আরপ্রবোধচন্দ্র সেন মহাশয় তার‘শিশুবোধক, শিশুশিক্ষা ও বর্ণপরিচয়’ প্রবন্ধে যে ‘শিশুবোধক’-এর পরিচয় দিয়েছেন, সেখানেও আর্যার অধিকাংশ শুভঙ্করের। এই আর্যা সম্পর্কে প্রবোধচন্দ্র সেন মহাশয়ের অভিমত,‘… সকলেই জানেন যে, ভাস্করাচার্যের ‘লীলাবতী’প্রভৃতি প্রাচীন গ্ৰন্থে গাণিতিক সমস্যা সমাধানের সূত্র রচিত হত ছন্দোবদ্ধ শ্লোকে। মনে হয় পরবর্তীকালে লোকশিক্ষার প্রয়োজনে এ জাতীয় শ্লোক সংস্কৃতের বদলে প্রাকৃত ভাষাতেই রচিত হত। বাংলা আর্যাগুলি এসব সংস্কৃত ও প্রাকৃত শ্লোকেরই উত্তরকালীন বিবর্তিত প্রাদেশিক রূপ। আরও অনুমান করা যায়, এককালে এসব শ্লোক প্রধানত প্রাচীন ‘আর্যা’ছন্দেই রচিত হত। ফলে বাংলা ছন্দে রচিত সূত্রগুলিও ‘আর্যা’নামেই পরিচিত হয়ে গেল।… এসব আর্যা সম্ভবতঃ মুখে মুখেই রচিত ও প্রচলিত হত। কোন কোন রচয়িতার নাম জানা যায় আর্যাগুলি থেকেই। যেমন— শুভঙ্কর ও নরসিংহ। শুভঙ্করই সর্বাধিক খ্যাত।’
এরপর শুভঙ্কর ও শুভঙ্করী আর্যার অনুসন্ধানে প্রত্যক্ষ করি, ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত শ্রীপঞ্চানন ঘোষের ‘সরল শুভঙ্করী’। এই পঞ্চানন ঘোষ হলেন তাঁর সমকালের এক খ্যাতনামা গণিত পুস্তক-প্রণেতা, পি. ঘোষ নামে অধিক পরিচিত; যিনি ‘শুভঙ্করের আর্যা’কে গ্ৰন্থাকারে জনপ্রিয় করেছিলেন। তাঁর রচনা ‘শুভঙ্করী’ (১৮৮২), ‘সরল শুভঙ্করী’ (১৮৮৩), ‘মানসাঙ্ক সম্বলিত শুভঙ্করের গণিত’ (১৯০৩)। এছাড়াও পি. ঘোষের ‘পাটিগণিত’, ‘জ্যামিতি’, ‘ব্যবহারিক পরিমিতি’গ্ৰন্থগুলিশিক্ষার্থীমহলে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল।
আমাদের অনুসন্ধানে পাওয়া, ‘সরল শুভঙ্করী’র গোড়ায় শ্রীপঞ্চানন ঘোষ লিখছেন, ‘ভাস্করাচার্য কৃত ‘লীলাবতী’ নামক সংস্কৃত পাটিগণিত ভারতবর্ষের সর্বত্রে পণ্ডিতগণের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কিন্তু উহা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বলিয়া সর্ব্বসাধারণের ব্যবহারে আসিত না। এই অভাব দূর করিবার নিমিত্ত ভৃগুরাম দাস নামে একজন অঙ্কশাস্ত্রের পন্ডিত অঙ্ক কষিবার কতকগুলি নিয়ম সহজ পদাবলীতে প্রস্তুত করেন, তাঁহার রচিত এই নিয়মগুলি ব্যবসায়ী প্রভৃতি সর্ব্বসাধারণের লোকের বিশেষ (শুভকর) উপকারী বলিয়া তাঁহাকে সকল লোকে শুভঙ্কর বলে। ঐ পদাবলীগুলিকে ‘শুভঙ্করের আর্য্যা’বলে। শুভঙ্করের আর্য্যার সাহায্যে অঙ্ক করিবার প্রণালীকে ‘শুভঙ্করী’বলে।’
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শুভঙ্কর বিশেষজ্ঞ হেমেন্দ্রনাথ পালিত তার ‘শুভঙ্কর ও শুভঙ্করী’প্রবন্ধে (‘প্রবাসী’, ভাদ্র ১৩৫১) এবং ‘শুভঙ্করী/রাঢ় বঙ্গের গণিত পদাবলী’ সংকলন গ্রন্থে, পঞ্চানন বাবুর ‘শুভঙ্করী আর্যা’ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আর শুভঙ্কর দাস এবং ভৃগুরাম দাস স্বতন্ত্র ব্যক্তি বলে দাবি করেছেন, নিজের মতের স্বপক্ষে উভয়ের আর্যা পাশাপাশি রেখে বিশ্লেষণ করেছেন। যদিও ‘সরল শুভঙ্করী’ বইটিতে সেই সময়ের প্রচলিত হিসেবের ধারা রয়েছে। যেমন—
চারি কড়ায় এক গণ্ডা
পাঁচ গণ্ডায় এক বুড়ি
চার বুড়িতে এক পণ
ষোল পণে এক কাহন
কুড়ি কাঠায় এক বিঘা
চল্লিশ সেরে এক মণ
পাঁচ সেরে এক পশুর
অনুরূপভাবে সেই সময়ের টাকা-পয়সার একক পরিচয়ে, পি. ঘোষের ‘সরল শুভঙ্করী’-তে পাই—
৩ পাইয়ে ১ পয়সা
৪ পয়সায় ১ আনা
৪ আনায় এক সিকি
২ সিকিতে ১ আধুলি
২ আধুলিতে ১ টাকা
১৬ টাকায় ১ মোহর
আবার উপরের হিসাবটি বিহার, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে—
৫ কড়িতে ১ আদ্ধি
২ আদ্ধিতে ১ দামড়ি
২ দামড়িতে ১ ছিদাম
২ ছিদামে ১ আধেলা
২ আধেলায় ১ পয়সা
প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য ‘শিশুবোধক’গ্ৰন্থেও এইরূপ ‘গণিত-কড়া’সঙ্কলিত আছে। যেমন, সোনা-রূপার ওজন—
৪ ধানে ১ রতি
৬ রতিতে ১ আনা
৮ রতিতে ১ মাষা
১২ মাষায় ১ তোলা
ভূমির মাপ—
৮ যবে ১ অঙ্গুলি
৪ অঙ্গুলিতে ১ মুট
৩ মুটে ১ বিঘত
২ বিঘতে ১ হাত
পঞ্চানন ঘোষের ‘সরল শুভঙ্করী’ গ্ৰন্থের মূল বিষয় হল ‘শুভঙ্করের আর্যা’কে মাধ্যম করে অঙ্কের সমাধান। সেই সমাধানসূত্রে শুভঙ্করের মূল আর্যার অবতারণা ঘটেছে। যার নমুনা আমরা প্রবন্ধের গোড়াতেই রেখেছি। তবে বেশ কিছু আর্যা-পাঠে হেমেন্দ্রনাথ পালিত মহাশয়ের মত, আমাদেরও সন্দেহ হয়েছে, যা প্রাচীন মানসাঙ্ক-প্রণেতা শুভঙ্করের ভাব-ভাষা নয়। যেমন, দৃষ্টান্ত—
১. ‘জমা খরচের কথা বলি শুন সবে
বড়টির নীচে ছোটো রাশিটি লিখিবে।
বড় হতে ছোটো রাশি যত কম হয়
তাহাই হইবে বাকি শুভঙ্কর কয়।’
২. ‘তিরিশ দিনেতে হয় মাস সেপ্টেম্বর
সেরূপ এপ্রিল, জুন আর নভেম্বর।
আটাশ দিনেতে সবে ফেব্রুয়ারী ধরে
বাড়ে তার একদিন চতুর্থ বৎসরে।
অবশিষ্ট মাস হয় একত্রিশ দিনে
ইংরাজী মাসের দিন এইরূপে গণে।’
এ একপ্রকার নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, শুভঙ্করের নাম ভাড়িয়ে এগুলি পঞ্চাননবাবুরই রচনা। তবে এই ‘তরল শুভঙ্করী’গুলিকে বাদ দিলে, শুভঙ্করের আর্যা-সম্বলিত ‘সরল শুভঙ্করী’তে গণিতজ্ঞ শুভঙ্করের আর্যার বৈশিষ্ট্য বর্তমান। তবে তা কতখানি প্রকৃত শুভঙ্করের, তা গবেষণাসাপেক্ষ। প্রসঙ্গত, প্রবোধচন্দ্র সেন মহাশয় তাঁর উক্ত প্রবন্ধে বেশ কয়েকটি ‘শুভঙ্করী আর্যা’র সঙ্গে একটি বহুশ্রুত ধাঁধার উল্লেখ করেছেন, যে-ধাঁধায় শুভঙ্করের নাম আছে জড়িয়ে, সেটি হল—‘শুভঙ্করের ফাঁকি/ ৩৬ থেকে ৩০০ গেলে কত থাকে বাকি?’আপাত-অসম্ভব এই ধাঁধার মধ্যে লুকনো আছে ছত্রিশ ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে ৩০০ (এর কূট ব্যাখ্যা বাংলা ব্যঞ্জনের তিন শ-কার শ-ষ-স) গেলে বাকি থাকে তেত্রিশ। প্রবোধচন্দ্র মহাশয় প্রদত্ত ধাঁধাটি মজার, কিন্তু এই ধাঁধার রচনাকার কি সেই আদি গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর? ভাষার আধুনিকতা দেখে এখানেও মনে ধন্দ লাগে, এ শুভঙ্করের নামে অন্যের রচনা।
‘সরল শুভঙ্করী’র গোড়ায় শ্রীপঞ্চানন ঘোষ লিখছেন, ‘‘ভাস্করাচার্য কৃত ‘লীলাবতী’ নামক সংস্কৃত পাটিগণিত ভারতবর্ষের সর্বত্রে পণ্ডিতগণের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কিন্তু উহা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বলিয়া সর্ব্বসাধারণের ব্যবহারে আসিত না। এই অভাব দূর করিবার নিমিত্ত ভৃগুরাম দাস নামে একজন অঙ্কশাস্ত্রের পন্ডিত অঙ্ক কষিবার কতকগুলি নিয়ম সহজ পদাবলীতে প্রস্তুত করেন, তাঁহার রচিত এই নিয়মগুলি ব্যবসায়ী প্রভৃতি সর্ব্বসাধারণের লোকের বিশেষ (শুভকর) উপকারী বলিয়া তাঁহাকে সকল লোকে শুভঙ্কর বলে…’’
পঞ্চানন ঘোষ, ওরফে পি. ঘোষের ‘শুভঙ্করী’এবং ‘সরল শুভঙ্করী’গ্ৰন্থের সূত্রে জানাই, সেই সময়ে আরও অন্যান্য অঙ্ক পুস্তক-প্রণেতারাও শুভঙ্করের নামে বই প্রকাশ করেছেন। ড. যোগজীবন গোস্বামী, তার ‘বাংলা পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাস’গ্ৰন্থে গণিত পুস্তকের যে-দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন, সেখানে উনিশ শতকের শেষ সিকি-দশক ও বিশ শতকের প্রথম ভাগেও শুভঙ্করের নামে যে-ক’টি বইয়ের উল্লেখ রাখছেন, তা বেশ নজরকাড়া। এখন সেই দীর্ঘ গ্ৰন্থতালিকার সবক’টি গ্ৰন্থ প্রত্যক্ষকরণে যদি প্রমাণিত হয়, এর অধিকাংশই শুভঙ্করের নামে জাল গ্ৰন্থ, তাহলেও অষ্টাদশ শতকের গোড়ার এক মানসাঙ্ক-বেত্তার নামগুণ এতখানি প্রবলযে বিশ শতকেও তাঁর নামে গ্ৰন্থ প্রকাশ করেন খ্যাতনামা অঙ্ক পুস্তক-প্রণেতারা। শুভঙ্করের নামে গ্ৰন্থ প্রকাশ তার গ্ৰহণযোগ্যতারই প্রবল প্রমাণ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, অষ্টাদশ শতকে শুভঙ্কর ছাপাখানার আনুকূল্য পাননি। তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ মানসাঙ্ক প্রণেতা। সাধারণ মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে ‘শুভঙ্করের আর্যা’কে মনে রেখে বংশ-পরম্পরায় জিইয়ে রেখেছে। শুভঙ্কর-সন্ধানী শ্রীমতিলাল দাশ তার ‘শুভঙ্কর’রচনায় (চৈত্র ১৩৩৭, ‘মাসিক বসুমতী’) এই বিষয়ে এক মনোজ্ঞ চিত্র তুলে ধরেছেন, তিনি লিখছেন, ‘পল্লীর বিততশাখ বটতরুর ছায়ে খড়ো পাঠশালায় পড়ুয়ারা কোলাহল করিতে করিতে শুভঙ্করের আর্যা আবৃত্তি করিতেছে, হাটে বাজারে মুদী ও পসারী ব্যবসায়ী ও মহাজন শুভঙ্করের কৃপায় কার্য্য সমাধা করিতেছে, জমীদারী সেরেস্তায় শুভঙ্করেই হিসাব মিলাইতে সাহায্য করিতেছেন, দীঘির কালি কষিতেছেন। ইঁটের পাঁজার ইঁট গণিতেছেন, নদীমাতৃক বাঙ্গালার নৌকার বোঝাই নিরূপণ করিতেছেন, আবার ভোজন সর্বস্ব বাঙালীর ভোজের দধির পরিমাণ স্থির করিতেছেন। শুদ্ধ ও মিশ্র গণিতে উপাধিধারী তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি সের-ছটাকের যে সূক্ষ্ম হিসাব কষিতে গলদঘর্ম্ম হইয়া কাগজ ও কলম নষ্ট করেন, অশিক্ষিত মুদী শুভঙ্করের কল্যাণে তাহা মনে মনেই সমাধান করিয়া লয়।’এখানেই শুভঙ্করী পদ্ধতির ধারাবাহিক জনপ্রিয়তা। মতিলাল দাশ বর্ণিত সমাজচিত্রটি বিশ শতকের তিনের দশকের সাক্ষ্যপ্রমাণ। আর বিশ শতকের সাত/আটের দশকেও তামাম বাংলার গ্ৰামগঞ্জের পাঠশালায় পাঠশালায় যে শুভঙ্করী আর্যা আবৃত্তির চল ছিল, তার প্রত্যক্ষজনেরা এখনও অনেকে বেঁচেবর্তে আছেন। বিশেষত বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর অঞ্চলের বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বললেই জানা যাবে তাদের স্মৃতিচিহ্নরূপে আছে, পাঠশালার গুরুমশাই মুখে-মুখে ‘শুভঙ্করী আর্যা’আওড়াতেন।আজ শুভঙ্কর এক বিস্মৃত নাম। শুভঙ্করের গণিত-কৌশল প্রাচীনতা-দোষে দুষ্ট। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, গণিত-শাস্ত্র যখন সংস্কৃত ভাষায় শুধুমাত্র পণ্ডিতদের দখলে, তখন সেই গণিতকে সহজ-সরল পদ্যবন্ধে সাধারণের মনে রাখার উপযোগী করে ছড়িয়ে দিয়ে তিনি অত্যন্ত শুভকর কাজ করেছিলেন।
ছবি সৌজন্যে : লেখক