ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ‘স্বাধীনতা’-র বড়দিন


    শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় (December 25, 2024)
     

    বেআইনি পর্ব কাটিয়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নতুন পর্বে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৫১ পার্টির দৈনিক মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’-র নবপর্যায়ের সূচনা। বাড়িতে বামপন্থী আবহ ছিল। আমার জীবনে প্রথম যে-নাটক দেখি ১৯৪৯ সালে, তা ছিল বেআইনি গণনাট্য সংঘের ‘দক্ষিণ কলিকাতা শাখা’-র ‘জনান্তিকে’; অনুষ্ঠিত হচ্ছিল হিন্দুস্তান পার্কের একফালি মাঠে। সলিল চৌধুরীর লেখা নাটক, অভিনয় করছেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দিরা কবিরাজ, আমার বউদি করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সলিল চৌধুরীর নেতৃত্বে সমবেত গণনাট্য সংগীত দিয়ে। হিন্দুস্তান পার্কের একাধিক গলিমুখে প্রহরায় ছিলেন সতর্ক গণনাট্যকর্মী স্বেচ্ছাসেবকরা; পুলিশ হানা দিলে তাঁরা দর্শকদের আগাম খবর দিয়ে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দেবেন, গায়ক-অভিনেতাদের কাছাকাছি চেনা বাড়িতে লুকিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করে দেবেন! সৌভাগ্যক্রমে সেদিন পুলিশি হানায় অনুষ্ঠান বিপর্যস্ত হয়নি। নিষেধমুক্তির পর ‘স্বাধীনতা’ পুনঃপ্রকাশ শুরু হলে বাড়িতে নিত্য পত্রিকা আসে। ইশকুলে পড়তে-পড়তেই পঁচিশ নম্বর পার্ক লেনে ‘স্বাধীনতা’-র কার্যালয়ে যাতায়াত শুরু করি। রবিবারে ‘স্বাধীনতা’-র ‘কিশোর সভা’-র পাতায় লেখালিখি করি; ইশকুল-পড়ুয়া লেখক-লেখিকাদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায় ‘স্বাধীনতা’-র আড্ডায়। তাদের সবার নাম অশীতিপরতায় পৌঁছে মনে করতে পারি না। যাদের নাম মনে পড়ে— দীপালি গঙ্গোপাধ্যায়, রমেন আচার্য, মুস্তাফা নাশাদ, এখলাসউদ্দিন আহমেদ, ইকবালউদ্দিন আহমেদ, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়— তাদের কে কোথায়, জীবিত কি মৃত, তাও জানি না। ‘কিশোর সভা’-র ওই পাতা প্রতিষ্ঠা করে, তার আদি সম্পাদক ছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। নবপর্যায়ে প্রথম সম্পাদক সৈয়দ আবুল হুদা। ১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র যখন, তখনই আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করি। পার্টি নেতৃত্ব আমার পার্টির ‘কাজের’ ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে দেন ‘স্বাধীনতা’-য়।

    বেআইনি সশস্ত্র আন্দোলনের পথ পরিহার করে কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতির পথ বেছে নিয়ে ততদিনে দু-দুটো সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদে, রাজ্যসভায়, বিধানসভায়, বিধান পরিষদে স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত। কেন্দ্রীয় সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে তখন এস এ ডাঙ্গে, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রেণু চক্রবর্তী, সাধন গুপ্ত, রবিনারায়ণ রেড্ডি, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, এ কে গোপালন, পার্বতী কৃষ্ণণ-এর মতো মনস্বী সুবক্তারা। তখন ‘স্বাধীনতা’-র সম্পাদক সরোজ মুখোপাধ্যায় আমার ‘কাজ’ বোঝাতে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পার্টির রাজনৈতিক মতাদর্শ, লক্ষ্যকল্প ও রাজনৈতিক কর্মনীতি জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য ‘স্বাধীনতা’-র। ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় আমার জন্য নির্দিষ্ট হল তিনটি বিভাগীয় দায়িত্ব। সম্পাদক সরোজ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি ‘কাজ’— সকালে সংসদে বা রাজ্যসভায় কমিউনিস্ট সদস্যদের ভাষণ বা প্রশ্নোত্তরপর্বে তাঁদের উত্থাপিত প্রশ্ন ও তার উত্তরের বা তর্ক-বিতর্কের বয়ান সন্ধের মধ্যে আমাদের টেলিপ্রিন্টারে চলে আসে। সরোজদা তা থেকে প্রাসঙ্গিক ভাষণের বা তর্কের পূর্ণ বয়ান আমার হাতে তুলে দেন, আমি সন্ধেয় ‘স্বাধীনতা’ দপ্তরে বসে অনুবাদ করে ফেলি— পরের দিন সকালে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় তা প্রকাশিত হয়, ‘ওপেড’ হিসেবে। এই পরিকল্পনার মূলে যে-চিন্তা ছিল, তা এই যে নাগরিকেরা যাঁদের তাঁদের প্রতিনিধিরূপে সংসদে পাঠিয়েছেন, তাঁরা সেই নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ, তাঁদের সেই জবাবদিহির বাহন পার্টির পত্রিকা। ভাবলেও লজ্জা হয়, কষ্ট হয়, সেই গণতন্ত্রবোধ আজ সম্পূর্ণ তিরোহিত! একবার নির্বাচিত হলে বিধায়ক বা সাংসদ তাঁর নির্বাচকদের কাছে তো নয়ই, এমনকী, তাঁর দল বা নির্বাচনপর্বে তাঁর ঘোষিত মতামতের প্রতিও কোনওভাবেই দায়বদ্ধ নয়, দলবদল বা পক্ষবদলেও বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই!

    আমার দ্বিতীয় ‘কাজ’ ছিল রবিবারের পাতার সম্পাদক সরোজ দত্তের সঙ্গে। ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্রিকা ‘ডেলি ওয়ার্কার’ তখন বিমান-ডাক যোগে আমাদের দপ্তরে নিয়মিত আসে; বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনীতি ও বঞ্চিত মানুষের স্বাধিকারের দাবিতে যা কিছু আন্দোলন (যা ব্যাবসায়িক মিডিয়ার দৃষ্টিতে পড়েই না), তার খবরের একমাত্র সূত্র তখন এই সযত্ন-সম্পাদিত পত্রিকা। তার থেকে আমরা কমিউনিস্টরা সারা পৃথিবীর বাস্তবের অন্য একটি প্রামাণ্য ছবি পাই, যা আমাদের বিশ্বদৃষ্টি তথা বিশ্ববোধকে আলোকিত করে, যা প্রতিফলিত হয় আমাদের লেখালিখিতে। ‘ডেলি ওয়ার্কার’-এর প্রতিদিনের কপি ‘স্বাধীনতা’-র টেবিলে-টেবিলে ঘোরে। রবিবারে সংস্কৃতি সাময়িকী অংশটি সরোজ দত্ত বাড়ি নিয়ে যান। সমকালীন বিশ্বসংস্কৃতির টালমাটাল থেকে সরোজদা বেছে নেন এক একটা প্রসঙ্গ। আমার ওপর ভার পড়ে ‘ডেলি ওয়ার্কার’-এ প্রকাশিত এক একটি তাৎপর্যপূর্ণ বয়ান, প্রাসঙ্গিক আরও অনেক তথ্যবিবরণবিচারে পুষ্ট করে, আমাদের পাঠকদের কাছে পুনরুপস্থাপন করার। ‘স্বাধীনতা’-র রবিবারের পাতায় আমার লেখার বিষয় হয় মস্কো আক্রমণে পরাভবে পর্যুদস্ত সাম্রাজ্যলিপ্সু নাপোলিয়ঁ-কে তিরস্কার করে লেখা ইংরেজ রোম্যান্টিক কবি বায়রন-এর কাব্যাংশ (সঙ্গে সরোজ দত্তের অনুবাদে সেই কবিতা); ডি এ্যচ্‌ লরেন্‌স্‌-এর ‘লেডি চ্যাটারলিজ লাভার’ উপন্যাসের তিন ভাষ্যের রূপরূপান্তর; ফ্রান্সের উপনিবেশ আলজিরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে দার্শনিক সার্ত্র্‌-এর সেই ঐতিহাসিক অঙ্গীকার : ‘এক একটা সময় আসে যখন দেশদ্রোহই হয়ে দাঁড়ায় নৈতিক কর্তব্য’; নোবেল পুরস্কারে সদ্যসম্মানিত কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে-র উপন্যাসমালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য এক ইতিহাসের আখ্যান। মার্কসবাদী এক পরিপ্রেক্ষিতে যে-বিশ্বসংস্কৃতি বীক্ষণের পাঠ সেদিন সরোজ দত্ত ‘স্বাধীনতা’-র পাতায় সযত্নে মেলে ধরেছিলেন, তার শিক্ষা আমি আজও সসম্ভ্রমে বহন করি।

    আমার তৃতীয় ‘কাজ’ ছিল প্রথমে ‘কিশোর সভা’ পৃষ্ঠার সম্পাদনায় যথাক্রমে হুদাভাই ও অমরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সহকারী হিসেবে। পরে বছরতিনেক একাই সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করি। ততদিনে ‘স্বাধীনতা’ দপ্তর স্থানান্তরিত হয়েছে তেত্রিশ নম্বর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে— সম্প্রতি ওই ঠিকানায় একদিন গিয়ে আবিষ্কার করলাম, সে-বাড়ির আয়তন, ভোল একদম পালটে গিয়েছে।

    ‘স্বাধীনতা’-র সম্পাদক সরোজ মুখোপাধ্যায় আমার ‘কাজ’ বোঝাতে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পার্টির রাজনৈতিক মতাদর্শ, লক্ষ্যকল্প ও রাজনৈতিক কর্মনীতি জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য ‘স্বাধীনতা’-র। ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় আমার জন্য নির্দিষ্ট হল তিনটি বিভাগীয় দায়িত্ব।

    ‘স্বাধীনতা’-য় আমার সক্রিয় কর্মজীবন— বলতে পারেন সাংবাদিকজীবন (তার মধ্যে দু-তিনবার আড়ালে-আবডালে সংবাদ শিকারও)— শেষ হয়ে যায় ১৯৬৪ সালে পার্টি বিভাজন ও ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকাও সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। আর সেই সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায় প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের সন্ধ্যায় পার্ক সার্কাস ময়দানে মঞ্চ বেঁধে বিশাল উন্মুক্ত জনসমাবেশে ‘স্বাধীনতা’র জন্মবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠান— যে-অনুষ্ঠানে দেখেছি বিজন ভট্টাচার্য নির্দেশিত ও অভিনীত ‘মরাচাঁদ’ নাটক, শুনেছি শম্ভু মিত্রের ‘মধুবংশীর গলি’ কবিতা আবৃত্তি, সুচিত্রা মিত্র ও সলিল চৌধুরীর দ্বৈত গায়ন— পিঠোপিঠি দুই চেয়ার জুড়ে তার উপর হারমোনিয়াম রেখে বাজাচ্ছেন সলিলদা, প্রথমে সুচিত্রাদি গাইছেন একগুচ্ছ রবীন্দ্রসংগীত, যার শেষে ‘কৃষ্ণকলি’, তারই অন্তে সলিলদা গলা মেলান ‘সেই মেয়ে’ গানে, তারপরে দু’জনে গলা মিলিয়ে গেয়ে যান সলিলদার গণনাট্যগীতি— ইতিহাসে অবগাহন।                       

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook