সাধনবাবুকে আপনারা চেনেন? ভদ্রলোকের বেজায় সন্দেহের বাতিক। ঘরের মেঝেতে কেন গাছের ডাল পড়ে আছে? চড়ুই পাখি বাসা বাঁধল কেন জানলায়? আরও কত কী! সত্যজিৎ রায় অবশ্য তেমনটাই জানিয়েছিলেন আমাদের। কিন্তু শেষাবধি, সাধনবাবুর বাড়িতে পৌঁছল একটি পার্সেল। আকারে বেশ বড়। তবে কি টাইম-বোম? না, মানুষের কাটা মুন্ডু? পটুয়াটোলা লেনে খুন হয়েছে সম্প্রতি। শোনা গেছে, মৃতদেহের ধড় ছিল। মাথা নেই। এইবার সাধনবাবুর সন্দেহ একেবারে তুঙ্গে বৃহস্পতি! কী করবেন তিনি? পার্সেল ফেলে পালাবেন? খুলে দেখবেন না একটিবারও?
এ-গল্প থেকে বাস্তবে যদি নেমে পড়ি এক্ষুনি, সাধনবাবুর সন্দেহই তবে সত্য হয়ে জ্বলে।
গ্রাহামস রোড। টালিগঞ্জ। বেলা বারোটা। একটি নর্দমায়, ভ্যাটে পড়েছিল যুবতীর কাটা মুন্ডু। প্লাস্টিক-ব্যাগে মুড়ে রাখা। ডিসেম্বরের মৃদুমন্দ সকালে কিনা কাটা মুন্ডু? অকস্মাৎ? এমনই এক সকালে ফেলুদা অ্যাণ্ড কোং পাড়ি জমিয়েছিল হাজারিবাগ। মহেশ চৌধুরীর আমন্ত্রণে। সেখান থেকে রাজারাপ্পা। শীতকালীন পিকনিক। যাত্রাপথে আছে ভেড়া নদী। একটি পুরনো কালীমন্দির। দেবী ছিন্নমস্তার। অর্থাৎ, মস্তকবিহীন। একহাতে খড়্গ। অন্য হাতে নিজেরই কাটা মুন্ডু। সেই বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে, চিরটাকাল মহেশ চৌধুরী উদাস হয়ে যেতেন। কিন্তু পিকনিকের দিন তিনি কিনা জ্ঞান হারালেন। শেষ পর্যন্ত মৃত। সকলে ভেবেছিল, দেবী ছিন্নমস্তার অভিশাপ! রহস্যের শুরুয়াত সেই।
ইতিহাসে অবিশ্যি সম্রাট কনিষ্ক মারফত জেনেছিলাম কাটা মুন্ডু। যার মূর্তিতে কেবল ধড় অবশিষ্ট ছিল। স্বীকার করি, পড়তে পড়তে রোমাঞ্চ লেগেছিল। রোমাঞ্চ আরও জমজমাট হল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন গল্প লিখলেন, ‘ভয়ংকর সুন্দর’। কাকাবাবু এবং সন্তু— মিশন কাশ্মীর! স্রেফ নিসর্গের টানে নয়। তাই গুজর আর খশ জাতির মানুষের গ্রামে দিন কাটাচ্ছিল। চারিপাশের জঙ্গলে কী যে খুঁজে মরছিল! তারপরই একদিন কুয়োর মধ্যে সটান পড়ে গিয়ে সন্ধান মেলে এক সুড়ঙ্গের। ভেতরে একটা তামার বাক্স। সেখানেই সন্তু দেখছে: ‘‘এবার আমি লক্ষ করলাম, ওটা ঠিক সাধারণ পাথর নয়, অনেকটা মানুষের মুখের মতন। যদিও কান দুটো আর নাক ভাঙা… আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাকাবাবু, এটা কার মুন্ডু?
—সম্রাট কণিষ্কর নাম শুনেছিস? পড়েছিস ইতিহাস?”
অ্যাডভেঞ্চারের মায়াবী আলোয় কাকাবাবু যদি খুঁজে পান কনিষ্কের বহুপ্রতীক্ষিত কাটা মুণ্ডু, তবে আপত্তি কী! এই এআই সময়ে, কাটা মুণ্ডু কিংবা বেওয়ারিশ লাশ— বাসরাস্তায়, মাছের বাজারে, শপিং মলের পেছনে হামেশাই পড়ে থাকে, সুড়ঙ্গের প্রয়োজন হয় না। অদৃশ্য সমস্ত স্কন্ধকাটা হেঁটেচলে বেড়ায় মানুষের সঙ্গেই। এ-শহরে। খোঁজে মাথা। মাথা গোঁজার ঠাই। ভয় দেখাতে পারে না। তাই কাটা মুণ্ডু দেখে এ-শহরের মেরুদণ্ডে হিমশীতল রক্তস্রোত বয়ে যায় না তেমন। সাময়িক বমি পায়। তারপর ইনস্টাগ্রাম রিল আর ফুড-ভ্লগারের হইহল্লায় সে বমি গন। অনায়াসে ভ্যানিশ! মগজে মগজে শুধু চিলিচিকেন আর ফ্রায়েড রাইসের খ্যামটা নাচন। সংবাদপত্রের হেডলাইনে যে কেন ‘হাড়হিম’ শব্দটি লেখা হয় মশাই!
তা এই কাটা মুণ্ডু কি মহাকাশ থেকে নেমে এসেছে? উঁহু। কিন্তু মহাকাশেও কাটা মুণ্ডুর অবাধ বিচরণ। জ্যোতিষশাস্ত্রে। একেবারে দেবতার আসনে। নাম শোনেননি, রাহু? যা কিছু অশুভ, অন্ধকার, অলক্ষুণে— সমস্তটাই রাহুর দোষে। রাহুর খিদে যেহেতু তুমুল। আমরা ফোকাস করব সেখানেই। খিদের এতই প্রবল তেজ, গ্রাস করে ফেলেছিল চাঁদ। সূর্য। তারপর থেকেই ধড় এবং মুণ্ডু— পৃথক। এত খিদে পেল কোত্থেকে? সম্প্রতি জানা গেছে, ক্ষুধাসূচকে ভারতের স্থান ১০৫। আবিশ্বের ১২৭টি দেশের মধ্যে। অর্থাৎ বলা যেতেই পারে, ভারতের সংখ্যাগুরু বেঁচে আছে প্রায় অনাহারে। যেন একেকটি রাহু। একেকটি কাটা মুণ্ডু। ধড় আছে। কিন্তু সাড় নেই। পেটের সঙ্গে, ভাতের সঙ্গে, ঘুমের সঙ্গে সম্পর্কহীন তারা। দীর্ঘদিন। এক পৃথিবী খিদে নিয়ে পড়ে থাকে ফুটপাথে। বস্তিতে। হাই-রাইজের তলায়।
টালিগঞ্জের ঘটনাটির মূলে আসলে খিদে। রক্তের খিদে। যৌনতার খিদে। মৃত যুবতীর সঙ্গে জড়িয়েছিল বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের কিসসা। অগত্যা খুন। শহরের ভিন-ভিন্ন প্রান্তে দেহের ভিন্ন ভিন্ন অংশ। যাবতীয় প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য পরিচিত টেকনিক। মনে পড়তেই পারে, নবারুণ ভট্টাচার্যর একটি উপন্যাসের কথা। ‘কাঙাল মালসাট’। উপন্যাসটি শুরুই হচ্ছে: ‘‘কাতার দিয়ে কাটা মুণ্ডু আদি গঙ্গার পাড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অর্থাৎ রাতে ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। বস্তা করে মুণ্ডুগুলো ডাঁই করে সটকেছে? ধড়গুলোর তাহলে কী হল? কুপিয়ে কাটা না পোঁচ দিয়ে? মুণ্ডুগুলো কি ব্যাটাছেলের না ফিমেল?’’
হঠাতই জোয়ারের জলে লোপাট হয়ে গিয়েছিল মুণ্ডুগুলো। এরপরই, উপন্যাস জুড়ে তারা ফিরে ফিরে আসে। আশ্চর্যভাবে! ভদি আর বেচামণি যখন চাকতির ঘরে, নবারুণ ভট্টাচার্যর ভাষায় সেই ঘর যখন ‘বিকট বোম্বাচাক’-এ পরিণত হয়েছে, তখনই শোনা যায়: “মুণ্ডু মারেন উঁকি/ফিক লো কালো খুকি”। একটা কাটা মুণ্ডু যে ঘোরতর পলিটিক্যাল হয়ে উঠতে পারে, এরপরই আমরা দেখতে পাব। নবারুণ লিখছেন: “২৮ তারিখ মুণ্ডু-ড্যান্স হয়েছিল তা সকলেই জানে। অতীব সংস্কৃতিবান পাঠক নিশ্চয়ই মুণ্ডু-ড্যান্সকে ক্যান্ডি-ড্যান্সের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। ফেললেই বা কী? যাহা ক্যান্ডি, তাহাই মুণ্ডু।’’
একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ অথবা শ্রমের যে পণ্যায়ন অবধারিত, কার্ল মার্ক্স আমাদের ঢের জানিয়েছেন। সেই উচ্চারণেই ক্যান্ডি এবং মুণ্ডু— কী আশ্চর্যভাবে একটি কমন প্লেনে আসীন! দুটোই নিদারুণ আরামে চুষে চুষে খেয়েছে রাষ্ট্র। খাচ্ছে। খাবেও। কাটা মুণ্ডুকে ঘিরে রহস্য, গা ছমছম, ভীষণ আতঙ্ক ঘনীভূত হয় তাই ভূতের গল্পে। অথচ এই রিয়েলিটিতে, রাতের অনন্ত আকাশে যে কাতার দিয়ে কাটা মুণ্ডু ভেসে ভেসে বেড়ায়, নির্ঘাত, লক্ষ করে আমাদের দেশ। কাল। রাজ্য। তারপর যেদিন নেমে আসবে পৃথিবীতে, ধূমকেতু কিংবা ফ্যাতাড়ুর মতো, মিশে যাবে কোনও দ্রোহের মিছিলে, সেইদিন বোধ করি কেঁপে যাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা। অকস্মাৎ। সে আঁতকে ওঠায় কোনও খামতি থাকবে না।
এহেন জাদুবাস্তবের তাড়নায় মিখাইল বুলগাকভ লিখে ফেলেছিলেন আস্ত এক উপন্যাস। ‘দ্য মাস্টার ও মার্গারিটা’। প্রথম পরিচ্ছেদে দু’জনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। প্রথম ব্যক্তি— মস্কো শহরের প্রলেতারীয় লেখক সমিতির সভাপতি মিখাইল আলেক্সান্দ্রভিচ বের্লিওজ। দ্বিতীয় জন কবি। ইভান নিকলাইয়েভিচ। একদিন সন্ধেবেলায়, পাত্রিয়ার্খ দিঘির ধারে বড়ই অদ্ভুতুড়ে মানুষের সঙ্গে মোলাকাত হল। অদ্ভুতুড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি, সন্ধ্যার পরেই বের্লিওজে মাথা কাটা যাবে। সে কি আদৌ সম্ভব? বের্লিওজ শয়তানে বিশ্বাসী নয়। তবু ধারণা হয়, সম্মুখে শয়তানই এসে দাঁড়িয়েছে। যখন ব্রোন্নায়া স্ট্রিটের ওপরে, ট্রামগাড়িতে চাপা পড়ছে সে। উপন্যাসের অনুবাদে, অরুণ সোম লিখছেন: “বের্লিওজ ট্রামগাড়ির তলায় ঢাকা পড়ে গেল। পাত্রিয়ার্খ দিঘির বীথির জাফরির নীচে, পাথরে বাঁধানো ঢালটার গায়ে গোল মতন কী যেন একটা বস্তু ছিটকে এসে পড়ল, ঢালের পা বেয়ে গড়িয়ে ব্রোন্নায়ার পাথর বাঁধানো রাস্তার ওপর পড়ে সেটা লাফাতে লাগল। বস্তুটা ছিল বের্লিওজের কাটা মুণ্ডু।”
দেখুন, সাধনবাবুর সন্দেহই কেমন সত্যি হয়েছে শেষমেশ।