এই দেবী জন্মান শহর থেকে দূরে— অলক্ষ্যে, নির্জনে। তাঁর বসত আলোর বহু দূরে, মাটির গভীরে, অন্ধকারের চির-আস্তানায়। এই তো, হয়ে এল প্রায়। আর ক-দিন পর যখন কার্তিকী অমাবস্যায় শহর হয়ে উঠবে উৎসবমুখর— অন্ধকারের গায়ে লাগবে আলোর পোঁচ, তখনও তিনি থেকে যাবেন ধরিত্রীর ভেতরেই। মাটির বল্গাহীন খোঁড়াখুঁড়ি আর নিরন্তর ব্লাস্টিংয়ের সেই অনন্ত জাহান্নামেই বছরভর বসত তাঁর। দেবীর নাম— খাদানকালী।
খাদান অঞ্চলের সঙ্গে কোনও সূত্রেই পরিচয় নেই আমার। ফলে, এই আশ্চর্য দেবীর কথা জানতে হয়েছিল কিছু কাল আগে— গবেষক ধীরজ কুমার নিতে-র একটি প্রবন্ধ পড়ে। খাদানকালীর সঙ্গে শহুরে পাঠকের যোগাযোগ নেহাতই পরস্মৈপদী— কিঞ্চিৎ কল্পনা, আর, বাকিটা চুঁইয়ে-পড়া গবেষণার মধ্যস্থতা। সেখানেই জানা গিয়েছিল প্রথম, ঝরিয়া, রানিগঞ্জ বা ভিলাইয়ের মতো মধ্য ভারতের যাবতীয় খনি-অধ্যুষিত প্রদেশেই এই দেবী নিয়মিত পূজিতা। সমস্ত কোলিয়ারিতেই তাঁর ছবিটুকু টাঙানো থাকে। ওইসব জায়গার কোথাও-কোথাও তাঁর ডাকনাম ‘শক্তিদেবী’, কেউ ডাকেন ‘নিলোদি মা’ বলে।
ঝরিয়ার দক্ষিণ পেরোলেই আসে একের পর এক কোলিয়ারি— মধুবন, তেতুলিয়া। এসব কোলিয়ারির আশেপাশে এই ক-দশকে ইতস্তত গড়ে উঠেছে তাঁর খানকয়েক মন্দির। সেখানে নিয়মিত চলে পুজোআচ্চা, দেবী রুষ্ট হলে নিয়মিত ছাগবলি, ঈষৎ ফলমূল, মিষ্টি আর নৈবেদ্য। কী করে বোঝেন যে দেবী অপ্রসন্না? জিগ্যেস করা হয়েছিল ওখানকার শ্রমিকদের, যাঁরা অনেকেই পারিবারিক সূত্রে ওইসব অঞ্চলের শ্রমিক। তাঁদের কল্পনায়, খনির হাঁ-মুখ গহ্বর যেন কালীর অনন্ত জরায়ুপ্রদেশ, যার ভেতরে বেচাল ঘটলেই দেবী দ্রুত রুষ্ট হয়ে উঠবেন। দুর্নীতি-অধ্যুষিত ওই সব অঞ্চলে নিয়মিত এসব বেচাল লেগে থাকে। এসব ফাঁড়া কাটাতে তখন খাদানকালীই অবধারিত বিপত্তারণ! এই যেমন, কার্পো রাজওয়াড় ১৯৪০ থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত ঝরিয়ার কয়লাখনিগুলির শ্রমিক ছিলেন। নিতে-র প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘মায়ের প্রতি টুকটাক নৈবেদ্য দেওয়া আরম্ভ করেছিলাম ভয়াল একটা দুর্ঘটনার পর। একটা ছাগল বলি দিলাম। সঙ্গে, সামান্য মিষ্টি আর ফলমূল। ক্বচিৎ দুর্ঘটনা ঘটলেই ধরে নিতে হবে, দেবী রেগে উঠেছেন। তক্ষুনি পুজোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ছাগল বলি-টা ভীষণ কাজে আসে।’ দেবী রেগে যান-ই বা কেন? ঝটিতি জবাব আসে, ‘তাঁর জরায়ুতে ঢুকে খোঁড়াখুঁড়ি চালালে তিনি রেগে যান, এমনটাই বিশ্বাস আমাদের।’
একই কথা বলেছিলেন শ্যামচরণ রওয়ানিও। আদিতে ভোজপুরের লোক রওয়ানি, জন্ম ১৯২৫-এ, আর এই পেশায় ঢুকে পড়েন ষাটের দশকের ভেতর। এই যে এত অনৈতিক কাজকর্মের কথা উঠছে, সেগুলো ঠিক কীরকম? রওয়ানি উত্তরে তাঁর স্মৃতি নাড়াচাড়া করবেন। ‘মালিকদের লক্ষ্য একটাই : উৎপাদন বাড়াও। এ-ব্যাপারে সব চেয়ে গোঁয়ার ছিল ব্রিটিশ ম্যানেজারগুলো। ফলে, অনৈতিক কাজকর্মও টুকটাক করতে হত বইকি।’ ব্রিটিশ আমলে নিরন্তর টানতে হত কাজের হাঁপর, ছুটির সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছিল। তা-ও, কর্তৃপক্ষের সতর্ক পাহারার ফাঁক গলে দিওয়ালি, দশেরা, হোলি আর বড়দিনে দু’একটা ছুটি গলে পড়তও বইকি। তখনই বলির তোড়জোড়, তখনই বসত খাদানকালীর উপাসনা। আমাদের পরিচিত কালীমূর্তির মতো ইনি বছরে একবার তিথি-নক্ষত্র মেনে আসেন না। তিনি শাশ্বত, নিয়ত— সতত অভয়দায়ী।
খনির সঙ্গে অচিন্ত্যনীয় এসব কিংবদন্তির সহাবস্থান কিন্তু নেহাত আনকোরা নয়। সারা দুনিয়াতেই, ঈষৎ পরখ করলে দেখা যাবে, এক-একজন খনিদেবতার প্রাবল্য। এই সহস্রাব্দেই, ২০১০ সালে চিলে-র খনিকন্দরে ৩৩ জন শ্রমিকের টানা ৬৯ দিন আটকে পড়ার বৃত্তান্ত মনে আছে? কেবল মিডিয়া নয়— বহু গবেষণাই স্বীকার করে, ওখানকার ফিলিপাইন চার্চের জোরালো, সংগঠিত প্রচার অনেকখানি চর্চিত করে তুলেছিল খনিশ্রমিকদের সেই দুরবস্থাকে। বলিভিয়ার কথাও ভাবা যায়। সেখানে টিন তোলেন যাঁরা, তাঁদের বিশ্বকল্পনা জুড়ে রয়েছেন পাচমামা নামের এক ঈশ্বর, আর, অপদেবতা এল-টিও— যে-শয়তান ধনকুবের বাড়িয়েছে নখর। শুধু লাতিন আমেরিকা নয়, আমাদের পড়শি চিনেও রয়েছে পেশাভিত্তিক দেবদেবীর এমন বাহার। ওখানে অভিনেতা, শিল্পী, ছুতোর বা ব্যাঙ্ককর্মীদেরও বরাদ্দ থাকে নিজস্ব ঈশ্বর— টিন, দস্তা আর সোনার খনিগুলোও এই ভূগোলের খুব একটা বাইরে নয়। শাংসি বা বেজিংয়ের মতো প্রদেশে এসব ঈশ্বরীদের নিত্য অবস্থান, কোলিয়ারিগুলোতে পুজো করা হয় ইঁদুরকে। চিনের আম-বিশ্বাস ঘিরে রয়েছেন নিওয়া নামের এক দেবী, যিনি সূচিত করেন কয়লাকে। তিনিই নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের পালয়িত্রী, সূচিত করেন এই গ্রহের সমস্ত প্রাণকে। চৈনিক উপকথায় রয়েছে দেবতা আর দানবে সেই মারকাটারি যুদ্ধের বিবরণ : যা পাঁচ দিন ধরে চলল, শেষে ভেঙে গেল স্বর্গের দেওয়াল, জন্ম নিল চকমকে এক পাথর।
সারা পৃথিবীতেই, খনির সঙ্গে দেবতার এই সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মপরিধির ঈষৎ বাইরেই। বহুল দেবতার চিনের কথা ছেড়ে দিলাম— চিলে বা বলিভিয়ার খনিগুলোতেও রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব সামান্যই। খাদানে দেবতার জন্ম হয়ে থাকে এভাবেই, ইতিহাসের বিমিশ্র আর আকস্মিক সব পাকেচক্রে। ১৯৬৮ সালে দুর্গাপুরের ইসিএল ইউনিটে জলভর্তি ট্রাক আস্ত ডুবে যায় খাদানে। অমর ঘোষ, ওই ট্রাকের লোডিংবাবু, উপায়ান্তর না-দেখে কালীর কাছে মানত করলেন। তার পর, কী আশ্চর্য, ট্রাক নাকি উঠেও এসেছিল! তাঁর স্বপ্নে কালী ধরা দেবেন আরও বছর তিনেক পর। এর পরই অমরবাবু স্থানীয় জঙ্গল সাফ করে খাদানকালীর মন্দির গড়েন দুর্গাপুরে। কোনও মূর্তি নেই। আছে কেবল খাদানকালীর পট। সেখানেই প্রতি মঙ্গলবার পড়ে মানতের লম্বা লাইন, ফি-বছর কালীপুজোয় ভক্তদের আনাগোনা এবং রাতে আনুমানিক পঞ্চাশটি ছাগবলির বন্দোবস্ত। দুর্গতিহরা দেবীর কৃপা পেতে এমনই উপচারে সেজে ওঠে খাদানকালীর মন্দির।
এই পুজোয় জড়িয়ে থাকেন কারখানার ম্যানেজার, মালিক, কন্ট্রাক্টর থেকে কয়লাকাটুরে ও কামিন— সব্বাই। ধর্ম আর জাতের আগল নেই বিশেষ, অঞ্চলের সকলেই স্বাগত। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা জানায়, মুসলিমরাও নিয়মিত আসেন সেখানে— খাদানকালীর পাশাপাশি আল্লাহ্-র নামও জপেন। রোজাও রাখা হয়। সাঁওতাল বা ওঁরাও-রাও সোৎসাহে আসেন খাদানকালীর পুজোয়। আসেন ডোম কিংবা মুসাহাররাও। কী করে এমন সর্বব্যাপী বিস্তার ঘটল খাদানকালীর? বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই কোলিয়ারিতে বেড়ে যায় উৎপাদনের চাপ, খাদানকালীর দৈব মহিমা ফলাও হতে থাকে তার কিছু কাল পর থেকেই। ১৯৭০-এর দশকে অনেক উন্নত হয়েছে প্রযুক্তি, কমে গেছে খনির ঝুঁকিও— তা সত্ত্বেও, খাদানকালীর মহিমা কিন্তু কমেনি বিশেষ— বেড়ে গেছে বরং। এবং, এখানেই বিরোধাভাস। প্রযুক্তিতাড়িত একুশ শতকে খাদানকালীর এই উত্তরোত্তর পুজো দাঁড় করিয়ে দেয় অনেকগুলো প্রশ্নের সামনে। যন্ত্র আর মানুষের সম্পর্ক কী হবে, ভেসে ওঠে সেই অমোঘ জিজ্ঞাসা। শ্রমিক চেতনার ভেতর কীভাবে পাকাপাকি থেকে যায় ধর্মের ছাপ, সেই প্রশ্নটাও ঘুরেফিরে আসে বইকি।
আপাতত এ-বাংলায় সবে হেমন্ত ধরল। আর ক-দিন পরেই ঘোর অন্ধকারে বেজে উঠবে খাদানকালীর ছায়া। শহরজীবনের অজ্ঞাতে, প্রত্যন্ত যক্ষপুরীর মাটি ফুঁড়ে ফের ভেসে উঠবেন সেই দেবী। ঝুঁকিপূর্ণ, শ্রমসাধ্য পেশায় গতর-খাটানো খনিশ্রমিকেরা ফের নিয়োজিত হবেন দেবীর পুজোয়। সেই পুজো হয়তো চলতে থাকবে, কিন্তু শ্রমিকের অবস্থা? রাত গাঢ় হয় ক্রমশ। সে-প্রশ্নের জবাব মেলে না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র