শোণিতের অন্য গণিত
কিছু-কিছু ঘরানা শিল্পীদের এমন প্রিয় হয়ে ওঠে, তা নিয়ে কাজ করে আশ মেটে না। ভ্যাম্পায়ার নিয়ে গোড়ার দিকে হত শুধু ভয়ের ছবি, পরে যে কত ধাঁচের ও ছাঁচের ছবি এই নিয়ে তৈরি হয়েছে-হচ্ছে, ইয়ত্তা নেই। কোথাও ভ্যাম্পায়ার এক আকুল প্রেমিক, কোথাও সে মানুষের মতো হতে চায়, কোথাও সে একলা মানুষের একমাত্র বন্ধু, কোথাও সে অন্য ভ্যাম্পায়ারের খোঁজে যুগ-যুগ ঘুরছে। ভ্যাম্পায়ারকে বাঁচতে গেলে রক্ত খেতে হয়, সে সূর্যালোকে বেরোতে পারে না, আর তার বয়স বাড়ে না (যে-বয়সে ভ্যাম্পায়ার হয়েছে সেই বয়সেই আটকে থাকে)— বেশির ভাগ ছবিতে এই সূত্রগুলো কাজে লাগিয়ে গল্পের ঘাঁতঘোঁত তৈরি হয়। বেশ কিছু ছবিতে, কোনও মানুষ ভ্যাম্পায়ারের প্রেমে পড়ে মিনতি জানায়, তাকেও যেন ভ্যাম্পায়ার করে নেওয়া হয়। অর্থাৎ, ভ্যাম্পায়ার ইচ্ছে করলে তার শিকারকে কামড়ে, মেরে না ফেলে, ভ্যাম্পায়ারে পরিণত করে দিতে পারে। এবং সিনেমা-শিল্প প্রেমকে জিতিয়ে দিতে বহু নারী ও পুরুষ চরিত্র তৈরি করে, যারা মানুষ থেকে ভ্যাম্পায়ার হতে দিব্যি রাজি, তাতে সে অমর হয়ে যুগ-যুগ এই লোকটার সঙ্গ পাবে, মানুষ-জাতে নাহয় না-ই রইল। যেমন অমুক পরিবারের মেয়ে তাদের শত্রু-পরিবারের ছেলেকে ভালবেসে তার সঙ্গে পালাতে চায় (রোমিও-জুলিয়েট বা কয়ামত সে কয়ামত তক-এ ট্র্যাজিক পরিণতি হয়) সেভাবেই চেনা ভিটেমাটি ছেড়ে ভ্যাম্পায়রত্ব বরণ। আসলে, ভ্যাম্পায়ার মানুষের পাশে থাকে, মানুষের মতোই তাদের চালচলন, এদিকে তারা মানুষ নয়, এইখানে তাদের আকর্ষণ। ভ্যাম্পায়ারের গল্প দিয়ে ভিনজাতের বিয়ে আর অনার-কিলিং-বাজ ভিড়কেও তাই দেখানো যায়, আবার মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের অসহিষ্ণুতাকেও ফোটানো যায়। আগেকার ছবিতে ভ্যাম্পায়াররা সারাদিন শুধু ঘুমোত, আর রাত হলেই রক্ত খেতে বেরিয়ে পড়ত। তাই সে একটা ত্রাসের প্রাণী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পরের ছবিওয়ালারা বহু সময় ভ্যাম্পায়ারদের বাড়িঘরদোর-জীবনযাপন-চলনবলন দেখান দিব্যি মানুষেরই মতো, শুধু তারা খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারটায় একটু আলাদা। সেখানে অপরাধের ব্যাপারটাও যুক্ত আছে, মানুষটাকে রক্ত খেয়ে খুন করলেই তো হল না, তার মৃতদেহটাও হাপিস করতে হবে। কিন্তু সেই ইনসুলিন-নেওয়া-মার্কা কটাস বাধ্যতাটুকু বাদ দিলে, ভ্যাম্পায়াররা কামনা-বাসনা-হতাশা-বিষাদ জড়িয়েমড়িয়ে মানুষেরই মতো পিণ্ডি, তাদের অনেকে আবার চিরকাল বেঁচে থাকাটাকে আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ বলে মনে করে, এই অনন্ত যাপনের সীমাহীন ক্লান্তি তাদের নুইয়ে দেয়। তাই আদতে যা ছিল বীভৎস রসের গল্প, পরে তাতে দর্শন থেকে শূন্যতা সব কিছু জুড়ে দিয়ে বারে বারে নতুন করে গড়ে নিয়েছেন বহু শিল্পী, এবং চলচ্চিত্রেও তার সোৎসাহ উদযাপন চলেছে বহুদিন ধরে। অনেক ছবিতে দেখা যায়, ভ্যাম্পায়ার মানুষ মারতে রাজিই নয়। এদিকে আলু-পটল বা পিৎজা-ঝালমুড়ি খেয়ে সে বাঁচতে পারবে না, একমাত্র রক্তই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। তখন কোনও ভ্যাম্পায়ার জন্তুজানোয়ারের রক্ত খেয়ে বাঁচে। মানে, ধরে নেওয়া হয়, জন্তু মারার চেয়ে মানুষকে মারা বড় পাপ, যেমনটা আমরা মুরগি-পাঁঠা-গরু-ভেড়া খাওয়ার সময়ে ভাবি।
‘হিউম্যানিস্ট ভ্যাম্পায়ার সিকিং কনসেন্টিং সুইসাইডাল পার্সন’ ফরাসি ছবিতে (চিত্রনাট্য: আরিয়ান লুই-সেজ ও ক্রিস্টিন ডোয়োঁ, পরিচালনা: আরিয়ান লুই-সেজ, ২০২৩) এক ভ্যাম্পায়ার-পরিবারের একটা ছোট মেয়ে মানুষ খুন করতে রাজি নয়। তার মা শিকার ধরে, রক্ত খেয়ে, কিছু রক্ত ব্যাগে করে ফ্রিজে জমিয়ে রাখেন, সে সেগুলো খায়, কিন্তু মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গলায় দাঁত বিঁধিয়ে খেতে সে পারে না। শুধু তা-ই নয়, ভ্যাম্পায়রদের মন-চিকিৎসক তার মা-বাবাকে বলেন, মানুষের রক্তপাত হচ্ছে দেখলে ভ্যাম্পায়ারদের খিদে চাগাড় দেয়, কিন্তু এই মেয়েটি উলটে কষ্ট পায়, তার সমবেদনা উপস্থিত হয়। তাকে মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, কিন্তু তার বাবা রাজি নন। বাবা বলেন, সময় হলে সব হবে, মেয়ের ওপর তিনি কক্ষনও জোর খাটাবেন না। ফলে বাবার আদরের দুলালী দিব্যি প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে রক্ত খেয়ে বড় হতে থাকে। মা বিরক্ত হয়ে গঞ্জনা দেন, সংসার ফাটিয়ে ঝগড়াও করেন, ‘আমি আগামী ২০০ বছর ধরে শিকার করতে পারব না!’, বাবা মিনমিন করে বলেন, ‘আমি আগের সোমবার গেলাম তো।’ এই ছবিতে দেখানো হচ্ছে, ভ্যাম্পায়ারের বয়স বাড়ছে, সে ছোট থেকে বড় হচ্ছে, তবে বয়স বাড়ার গতিটা কম, মানে, যে-মেয়েকে দেখে আমাদের মনে হচ্ছে ১৬ বছর বয়স, আসলে হয়তো তার ৬৮। এই মেয়েটির ছোটবেলায় তার জন্মদিনে একটি ক্লাউন এসেছিল, তাকে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে খাওয়া হয়। মেয়েটি সেই ভোজে যোগও দিতে পারেনি, তারপর বহুদিন সে ক্লাউন আঁকতে ব্যস্ত থাকত। শেষমেশ তার পরিবারের সবাই (হ্যাঁ, বাবাও) ঠিক করে, তাকে থাকতে হবে এক তুতো-বোনের সঙ্গে, যে বেশ কড়া। সে স্পষ্ট বলে, হয় তুই শিকার করে রক্ত খা, নইলে খেতেই পাবি না, আমি তোর জন্যে ব্যাগে করে রক্ত জমাতে পারব না। সেই তুতো-বোন তরুণ ছেলেদের ভুলিয়েভালিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে, কিন্তু তাকে একাই তাদের খুন করতে হয়, আমাদের নায়িকাটি কোনও অংশ নেয় না। এক সময়ে আমাদের ছবির মেয়েটি ঠিক করে, সে আত্মহত্যা করবে, মানুষের খাবার খেয়ে। তারপর একটা ফোন নম্বর দেখে, যায় একটা আত্মহত্যাকামীদের সাহায্য-গ্রুপে। সেখানে একটা ছেলে বলে, তার জীবনের প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই, সে বরং অন্যের উপকারের জন্যে জীবন দিতে এক্ষুনি রাজি। এই ছেলেটাকে আমরা ছবিটায় আগেও দেখেছি, তাকে সবাই ইস্কুলে যাচ্ছেতাই অত্যাচার করে, বিদ্রুপ করে, সে মুখচোরা, নরম, মার খেয়ে ফিরতি-মার দিতে পারে না, খেলাধুলোয় দড় নয়, শিক্ষকের কাছেও বকুনি তার নিত্য-পাওনা। সেই ছেলেকে ভ্যাম্পায়ার-মেয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। তাদের কথাবার্তায় আমরা বুঝি, রফা হয়ে গেছে, সে মেয়েটির ইচ্ছুক ও সম্মত শিকার, ছেলেটি নিতান্ত বাধ্য ও সমর্পিতের মতো গর্দান পেতেও দেয়। কিন্তু তা দেখেও মেয়েটির লোভ-সুলসুলে খর দাঁত বেরিয়ে আসে না, সে বরং ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, তোমার শেষ ইচ্ছে কী, বলো না।
মানে, এ এক মানুষ-প্রেমী ভ্যাম্পায়ারের কাহিনি, যে এই জাতটাকে ভালবাসে। মানুষ সম্পর্কে বই পড়ে, মানুষকে দেখেশুনে, সে এই জাতের লোকদের খাদ্য মনে করতেই পারে না। সোজা কথায়, ভ্যাম্পায়ারের প্রবৃত্তির উলটোদিকে এ চলেছে। মুশকিল হল, তার শরীর তাকে টানছে রক্তের দিকে, মন টানছে অ-রক্তের দিকে, এবার সে কোনদিকে যাবে? ছবিটাকে দেওয়া হয়েছে কমেডির ঠাট, ফলে ক্লাউন আসার পর আমরা যখন বুঝতে পারি তাকে আনা হয়েছে মজা দেখার জন্য নয়, বরং ঘাড় মটকে খাওয়ার জন্য, আমাদের চমকও জাগে, হাসিও পায়। যখন ছোট ভ্যাম্পায়ার-মেয়ে সিনেমায় ভ্যাম্পায়ার দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে এবং ডাক্তার চিন্তান্বিত মুখে জানান এর সহমর্মিতার অসুখ সারাতে হবে, কিংবা তুতো-বোন একটা ছেলের ঘাড় মটকে খাওয়ার সময়ে এই মেয়েটি এমন বাধা দেয় যে সেই ছেলেটি পুরোপুরি মরে না বরং ভ্যাম্পায়ার হয়ে তুতো-বোনটির সঙ্গেই থাকতে শুরু করে (এক প্রবীণা বলেনও, এরা ঠিকঠাক খুন করতে পারবে না আর আমাদের আত্মীয়ের সংখ্যা বেড়ে যাবে), বা আড়ষ্ট ছেলেটি যখন আত্মহত্যা করতে উঁচু থেকে লাফ দেবে কি না ভাবছে, তার বন্ধু বিরক্ত স্বরে বলে, দিবি তো দে, নইলে আমায় সাহায্য করতে আয়, তখন কৌতুকের আমেজ আমাদের স্পর্শ করে। আবার ছেলেটা যখন সারারাত জেগে ভেবে বার করে, বিভিন্ন আত্মহত্যাকামী ও প্রকাণ্ড বিষণ্ণদের সাহায্য-সভায় গিয়ে খুঁজে বার করা হবে, কে কে স্বেচ্ছায় ভ্যাম্পায়ারের বলি হতে চায় (যে-প্রস্তাব থেকেই ছবিটির নাম) তখন আমরা হেসেও ফেলি, আবার এর মধ্যে যে সমঝদারি ও আপোস-রফা রয়েছে তার কিঞ্চিৎ তারিফও করি। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে ছেলেটির ডাক্তার-মা যদি বলেকয়ে রাজি করান, এবং সেই রোগী শেষ সময়ে মেয়েটির বাজানো কি-বোর্ড শুনতে-শুনতে, ছেলেটির লাগানো নলে নিজের রক্ত বিসর্জন দিতে-দিতে অবসানের দিকে ঢলে পড়ে, অসুবিধে কোথায়? ছেলেটি যদি মেয়েটিকে অনুরোধ করে, তারই দংশনে ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়, আর এই যুগল ভ্যাম্পায়ার কখনও কারও অধিকার লঙ্ঘন না করে, সবাইকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে ঠিকঠাক রক্তপান চালিয়ে যায়, আর সে-প্রক্রিয়ায় অনারোগ্য রোগের মানুষকে নিষ্কৃতি-মৃত্যুতেও সাহায্য করে, মন্দ কী? তার চেয়ে বড় কথা, ভ্যাম্পায়ার-সমাজে একদম বেখাপ্পা এক মেয়ে আর মানুষ-সমাজে একেবারে বেমানান এক ছেলে যদি পরস্পরকে খুঁজে পায়, আর দুজনে দুজনের স্নিগ্ধতায় ও প্রেমে স্নান করে, আর তারপর একটা পরিকল্পনা করে দুজনেরই সমস্যার সমাধান হয়, এও মানুষ-সমাজ ছেড়ে বেরিয়ে নতুন অস্তিত্ব উপভোগ করে, ও-ও ইচ্ছুকের রক্ত গ্রহণ করে মূল্যবোধের কিচকিচ থেকে পরিত্রাণ পায় ও জৈবিক পুষ্টিরও ঝামেলা দূর হয়, তার চেয়ে বড় ইচ্ছাপূরণের গপ্প আর কী?