ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৪৭


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (October 28, 2024)
     

    রুনা (কুসুমের মেয়ে)

    আমি রুনা, কুসুমের মেয়ে রণেন জ্যাঠামণির স্টুডিয়োঘরে আজ তো ঢুকতে পারবে সকলেই কারণ, সন্ধেবেলা তাঁর স্মরণসভা হবে এ-ঘরেই এই প্রথম তাঁর ওই ঘরে তিনিই শুধু নেই; অথচ এত লোক আসবে এবং গান হবে! কিন্তু কেউই তো সাজানোয় হাত লাগাচ্ছে না সকাল থেকে! আলপনা এঁকে, ফুল-পাতা-মালা বা আলো দিয়ে এই ঘর, সিঁড়ি বা বাড়ির সামনের দরজাটা! এ-ঘটনাটাও তো এই প্রথম সব যেন কেমন থমথম করছে কেউ আর বকাবকি করেছে না ঝিনিকেও— ‘হাতে-পায়ে দস্যিপনা’ এমন শাসন করে! তিনতলার ঘর থেকেই ‘ঝিনি’ বলে জ্যাঠামণির সেই হাঁক এবং তেড়ে উঠে বকুনি— এ সবই মনে হয় খুবই মিস করছে ঝিনি মনে তো পড়ছে আমারও মায়ের কাছে শুনেছি, কতবার কত রকম অনুষ্ঠান হয়েছে ওই ঘরে সেসব না দেখলেও একটা অনুষ্ঠান কিন্তু আমিও দেখেছি সে তো এই বছর দুয়েক আগে, যখন এই ঘরেই গান গাইতে এসেছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় নামে এক গাইয়ে মনে পড়ছে, আগের দিন থেকেই জ্যাঠামণি আর জ্যাঠাইমার সেই প্রবল ব্যস্ততা এবং তোড়জোড়   

    আজ যেন সেই ছবিটাই আমার চোখের ওপর ভাসছে। ওদের দোতলার বসবার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো তাঁর আঁকা ছবিগুলো অদলবদল করে দিচ্ছেন জ্যাঠামণি। বেছে-বেছে কাচ-বাঁধানো কিছু ছবিগুলোই টাঙিয়ে দিচ্ছেন, দোতলা থেকে তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির দেওয়ালেও। তিনতলার সিঁড়ির পাশে চওড়া সাদা পিলারটার ওপর, কালো পাথরের বড় মুখ যে-ঘড়াটা রাখা থাকে, সেটাও পরিষ্কার করে জল ভর্তি করা হয়েছে; সাজানোর জন্য পাশেই রাখা আছে ফুলের সঙ্গে কিছু পাতাও। ঘড়াটার চারপাশে অ্যালা আর গেরি মাটির রঙে কী সুন্দর একটা আলপনাও এঁকে রেখেছেন জ্যাঠামণি। বারকয়েক মুছে-মুছে ঝকঝকে করা হয়েছে, তিনতলায় তাঁর স্টুডিয়োঘরটাও। মাঝখানে থাকা ইজেলটাকেও সরিয়ে দিয়েছেন ওই ঘরেরই অন্য এক কোণে; ছবি ছাড়াও দেওয়ালে সাজানো হয়েছে আরও সব কত কারুকাজ; কোনওটা কাঠের ফ্রেমে, কোনওটা কাপড়ের আবার কোনওটা-বা পেতলের। দক্ষিণের দেওয়ালজুড়ে গাইয়ে-বাজিয়েদের বসবার ব্যবস্থা। বড় একখানা মোটা শতরঞ্চির ওপর চাদর পেতে, তার ওপর আবার কার্পেটের বদলে পাতা হয়েছে গাঢ় সবুজ সিল্কের ওপর বাহারি নকশায় বোনা একটা আসন; একে নাকি বলে ‘সম্বলপুরী-গালিচা’। পাশেই পাতা হয়েছে ওই একই রকম নকশায় বোনা আরও চারটি ছোট-ছোট আসন; সেগুলির রং অবশ্য নীল, লাল, হলুদ, সবুজ। সেগুলো পাতা হয়েছে, দুজন সহশিল্পী আর তবলিয়াদের বসার জন্য। মাইকের সামনেই মাটিতে রাখা সাদা পাথরের যে-বগি থালাটা, তাতেই গোল করে সাজানো হয়েছে মোটা-মোটা খানকয়েক জুঁই আর টগরফুলের গোড়ে। মালা রাখা হয়েছে, ঘরের কোণে-কোণেও। কোনওটা রাখা লম্বা পিলসুজের ওপর তামার টাটে। কোনওটা আবার সাদা পাথরের প্লেট বা কালো পাথরের বাটিতে। ঘরজুড়ে মেঝেতে পাতা হয়েছে যে বিশাল একটা শতরঞ্চি, সেটাও মুড়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটা সাদা চাদর দিয়ে। বারান্দাতে ঘরলাগোয়া যে বসার ব্যবস্থা, সেখানে বিছানো হয়েছে ওদের নিজেদের ব্যবহার করা কাচা কিছু বেডকভার আর ছোট মাপের শতরঞ্চি ও মাদুর। এমনকী টেবিল-চেয়ার পেতে নীচে যে টিকিট-কাউন্টারটা হয়েছে, সুন্দর একটা টেবিলক্লথ পেতে, তার ওপর ফুলদানি রেখে সেটাও সাজিয়ে দিয়েছেন জ্যাঠাইমা। সারা বাড়িতেই ব্যবস্থা করা হয়েছে বাড়তি আলোরও। সুগন্ধা মানে ঝিনি বলেছে যে, আজ একতলা থেকে তিনতলা সব নাকি ‘একশো পাওয়ার’।

    ঠিক যেন বিয়েবাড়ি; দোতলাটাও জমজমাট; ঝিনির ঠাকুমা তো বারে বারেই সিন্দুক খুলছেন, আর একটু তেঁতুল ঘষে আর একটু মেজে নেওয়ার জন্য, সমানেই নামিয়ে চলেছেন, পেতল-কাঁসার যাবতীয় যত পুরনো বাসন; জ্যাঠামণি তাঁকে শুধু একবার বললেই হল! জ্যাঠাইমা মানে ঝিনির মা ছুটে বেড়াচ্ছেন, তিনতলা থেকে একতলা জুড়ে। সুগন্ধার ছোটপিসি তো ওর বাবার সঙ্গেই ঘর সাজাচ্ছেন; আর মেজো পিসিমা তদারকি করছেন রান্নাঘরে। গান শেষ হলে নাকি, লুচি-মাংস আর পোলাও খাবেন শিল্পীরা। এসেছেন ঝিনির দাদু-দিদা এবং মামা-মাসিরাও; এসেছেন বালেশ্বর, কটক এবং রাঁচিতে থাকা বন্ধুরা ছাড়াও কলকাতায় থাকা জ্যাঠামণির আরও কয়েকজন বন্ধুও। আসতে পারেননি শুধু ঝিনির বড় পিসিমা এবং সেখানে থাকা তাঁর সহকর্মী-বন্ধুরা; আরও কারা-কারা সব যেন এসেছেন, যাঁদের আমি কেন ঝিনিও নাকি চেনে না। তাঁরা সবাই শুয়েবসে চা খাচ্ছেন আর গপ্পো করছেন, ওপাশের বসবার ঘরটায় হাত-পা ছড়িয়ে। সুগন্ধার পিসতুতো দাদা-দিদিরাও প্রায় সকলেই এসে গেছেন, তাঁদের বেশ কিছু বন্ধুদের নিয়ে। এঁরা সকলেই তাঁদের মামাবাড়ির ভক্ত; নাচ-গান এবং অভিনয় ছাড়াও, আরও অনেক কিছুই তাঁরা পারেন। সকলেই অবশ্য, বয়সে অনেকটাই বড় আমাদের থেকে; সবাইকেই যেহেতু চা দেওয়া হবে, তাই আরও দু’একজনের সঙ্গে হাত লাগিয়ে, দোতলার বারান্দাতেই রাখা এক ঝুড়ি মাটির ভাঁড় ধুতে বসে গেছি আমরাও। একটুও আওয়াজ হলেই জ্যাঠামণি যে ভীষণ বকবেন! কাজ করতে-করতে তাই কথাও বলা যাবে না হ্যাহ্যা-হিহি করে। তবুও ঝিনি আর আমি তো আজ ছাড়া গরু। 

    বিকেল হতেই, ঝিনিদের দুই বোনের সঙ্গে আমাকেও সাজিয়ে দিলেন জ্যাঠাইমা। নিজে পরলেন, বাটিকের নকশায় জ্যাঠামণিরই বানিয়ে দেওয়া, লাল-কালোপাড়ের সাদা একটা শাড়ি। এরই মধ্যে কার কাছ থেকে কে জানে, ঝিনি আবার নিজের চোখে মোটা করে কাজল এবং গালে-ঠোঁটে এক পোঁচ রুজ-লিপস্টিকও লাগিয়ে এল! কিন্তু জ্যাঠামণির চোখে পড়াতেই, কাঁদতে-কাঁদতে তা তো তক্ষুনি মুছে ফেলতেও হল ঝিনিকে। কোনও গোলমাল সে-যাতে আর না পাকাতে পারে, আমাকেও তিনি তাই বসিয়ে রাখলেন, শতরঞ্জি-পাতা স্টুডিয়োঘরের এক কোণে; অস্থির-দুরন্ত ঝিনির সঙ্গেই একেবারে ‘বৈঠকি’ দিয়ে; দেখতে-দেখতে অত বড় ঘর, বারান্দা এমনকী তিন-চারটে সিঁড়িও ভরে উঠল লোকে। সুন্দর করে বলা, জ্যাঠাইমার দু’একটা কথার পরেই, শুরু হয়ে গেল সেদিনের অনুষ্ঠান; আর তাতেই জানলাম যে মোটাসোটা ওই মানুষটির নাম ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়; কিন্তু তাঁর পাশেই যিনি বসেছেন, তিনি তো জ্যাঠামণির বন্ধু— ঝিনিদের সুবিমল কাকা; জ্যাঠামণি অবশ্য তাঁকে ডাকেন— ‘সদারং’ বলেই। ইনি তো মাঝে মাঝেই আসেন জ্যাঠামণির কাছে। শুরুতেই জ্যাঠাইমার ওই বলে দেওয়াতে বুঝলাম যে, এই সুবিমলকাকাই নিয়ে এসেছেন তাঁর গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়কে।  

    সারারাত গান হল; ওখানে বসেই ঘুমিয়ে পড়ায়, আমাদের দুজনকেই মনে হয় তুলে এনে, সামান্য কিছু খাইয়ে, বারান্দার শতরঞ্জিতে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। আলো ফুটি-ফুটি ভোরে ঘুম যখন ভাঙল, তখনও গান চলছে। ভিড় কমে গেলেও স্টুডিয়োঘরটা তখনও ভরে আছে লোকে। বারান্দায় বসা মানুষদের মধ্যে অনেকেই তখন সেখান থেকে উঠে এসে বসেছেন ওই ঘরে; দু’একজনের আলোচনায় শুনলাম যে, রাতের খাওয়া ভুলে গুরুজি তখন ‘রামকেলি’ ধরেছেন। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এ-জীবনে যা আর কক্ষনো হয়নি; মনে হয় ঝিনিরও বোধহয় তাই!


    ঝিনির সঙ্গে প্রথম ছাড়াছাড়ি হয়, ঝিনি যখন হস্টেলে চলে যায়। তবু আবার যোগাযোগ হল, হস্টেল ছেড়ে সে যখন একা এসে থাকতে লাগল জ্যাঠামণির সঙ্গে। কিন্তু সেই ঝিনি আর ফিরে এল না। আসলে ঝিনিও তো আর ফিরে পেল না মা-বাবা-ঠাকুমা আর বোনকে নিয়ে তাদের সেই জমজমাট বাড়িটা। হারিয়ে গেল দুজনে মিলে ভোরবেলার সেই ফুলচুরি, মেলাতলায় গিয়ে নাগরদোলা চড়া, বিকেল হলেই মাঠ দাপিয়ে খেলে চলা গাদি-ধাপসা-চু-কিতকিত; ফুরিয়ে গেল গঙ্গায় স্নান আর বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে ছাদজুড়ে শিল কুড়নোটাও; জ্যাঠামণি চলে যাবার পর সেই যে ঝিনি কলকাতায় চলে গেল, একেবারেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল আমাদের। ওদের সব জিনিস যখন লরিতে উঠছে, আমাকে নিয়ে ছাদে উঠে, শ্মশানের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে সে শুধু বলেছিল, ‘সেদিনও নিভে গিয়েছিল চিতাটা।’ ওদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই সে আবারও বলেছিল, ‘বাবা, চলে যাবার আগে কোনওদিন খেয়ালই করিনি, ছাদের এই দিকটা দাঁড়ালেই যে এমন করে দেখা যায়; মনে হয় যেন গরম তাপ লাগছে গায়ে; চোখ যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কালো ধোঁয়ায়।’

    ‘দেখছিস কেন ঝিনি? মা বলেছে যে, শ্মশানের দিকে নাকি তাকাতেই নেই!’

    ‘জানি তো! কিন্তু আমি এখন তাকিয়ে থাকি

    ‘কেন ঝিনি? কেন শুধু ওইদিকেই তাকিয়ে থাকিস তুই?’

    ‘ছবিতে আঁকব বলে; অন্ধকার আকাশে যে-চাঁদ এবং রাশি রাশি তারার আলো, তার থেকেও সুন্দর ওই চিতার আগুন

    ‘কী যেসব আবোল-তাবোল বকছিস! ঝিনি তুই কিন্তু শেষে পাগলই হয়ে যাবি!’

    ‘তুই-ই বা দেখতে পাস না কেন! চিতার আগুনে যে কখনওই কোনও ছায়া পড়ে না! অথচ তার চারপাশের অন্ধকারটা কেমন একটু ফিকে হয়ে গিয়ে সবজেটে দেখায়? কালো অন্ধকার আর লাফিয়ে ওঠা আগুনের লাল- লাল ফুলঝুরিগুলোর মাঝখানে একফালি যে কালচে সবুজের অজস্র-রিং— ওটাও কিন্তু হুকার’স গ্রিন

    ‘হুকার’স গ্রিন! সেটা আবার কী?

    ‘বাবার প্রিয় রং! প্যালেটেও লেগে আছে; আঙুল ডোবালে কিছুদিন আগেও চটচট করত; এখন অবশ্য শুকিয়ে গেছে

    সেদিন একরকম জোর করেই নীচে নামিয়ে এনেছিলাম ঝিনিকে; সহজ-স্বাভাবিক মুখে নেমে আসা ঝিনিও আর কোনও কথা বলেনি, গাড়িতে উঠে তাদের সেই কলকাতা চলে যাবার সময়ে

    এরপরেও শুনেছি যে, ঝিনিরা সোদপুরে এসেছে; এবং মাঝে মাঝেই আসে; কিন্তু থাকে ওদের মামার বাড়িতে -বাড়িটা যেন একেবারেই অচেনা হয়ে গেছে ঝিনির আগে, জ্যাঠামণির নাম বললেই যে-কোনও অচেনা লোকও খুঁজে পেয়ে যেত বাড়িটাকে; এখন সবাই এ-বাড়িটাকে চেনে ভাড়াটেদের বাড়ি বলে তিনতলাটায় ভাড়া নেই বলে, সবসময়ে অন্ধকার ওদিক দিয়ে আসা-যাওয়া করলেই আমার ইচ্ছে করে একবার ঢুকে পড়ে স্টুডিয়োঘরটা দেখে আসতে ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠলেই, যেন শুনতে পাই জ্যাঠামণির গলায় সেই হাঁক— ‘ঝিনি’

    ঝিনির সঙ্গে আরও একবার দেখা যে হয়েছিল, সেও এক বড় অদ্ভুত পরিস্থিতিতে; ওর ঠাকুমা মারা যেতে, এখান থেকে ওরা চলে যাবার প্রায় পাঁচ-ছ’বছর পর। ঝিনির জোরাজুরিতে নাকি, কলকাতা থেকে নিয়ে এসে, এখানকার শ্মশানেই দাহ করা হয় তাঁকে; কারণ, ঝিনি জানত, এখানে থাকবার সময়ে তার ঠাকুমা ওই শ্মশানে প্রতিদিন এসেই যে প্রণাম করে যেতেন, ঝিনির দাদু এবং বাবাকে মনে করে। ওদের গাড়িটা শ্মশানের গেটে এসে দাঁড়াতেই, খুব অবাক হয়ে দেখেছিলাম যে, একটা বড় গাড়ির ভেতর বসে আছে ঝিনি, তার ঠাকুমার মৃতদেহটা নিজের কোলের ওপর শুইয়ে। শববাহী কোনও কাচের গাড়ি করে বা মড়া নিয়ে যাবার খাটে শুইয়ে একটা ম্যাটাডোরে করেও আনা হয়নি তাঁকে। দাহকাজ সেরে, ওরা সবাই যখন কলকাতায় ফিরে যাচ্ছে, রিনিকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, ‘ওইভাবে কোলে শুইয়ে কেন আনা হল রে!’

    ‘দিদার কোলে আমি তো অনেক শুয়েছি, তাই!’

    ‘মৃতদেহ কেউ ওইভাবে আনে নাকি!’

    ‘বাবা যখন নেই, তখন কাঁধ দেবে কে?’

    ‘কেন তোর পিসতুতো দাদারা? সবাইকেই তো দেখলাম!’

    ‘কেউ তো আপত্তিও করল না, কোলে শুইয়ে নিয়ে যাব বলাতে! তবে শ্মশানে আনার পর চিতায় তোলার আগে বুঝলাম যে অসুবিধেটা কোথায়। ট্রলি বা খাট না থাকায় ঠাকুমাকে শুইয়ে রাখা হল বাঁধানো একটা রকে। ডেডবডিটা পোড়ানোর ফাঁকে-ফাঁকে, যেখানে বসে ডোমেরাই বিশ্রাম নেয়। এ-ছাড়া আমার বেশ ভালই লাগল; সবাই কাঁধে করে আসে, ঠাকুমার শেষযাত্রাটা হল কেমন আমারই কোলে শুয়ে!’


    ঝিনি যে বলত, চোখের ওপর ছবিগুলো বদলে গেলে, ধীরে-ধীরে নাকি বদলে যায়, আমাদের মনটাও। হয়তো তাই! কলকাতার গঙ্গাটাকে নাকি একেবারেই অচেনা লাগে তার; ভাল লাগে না খোলা মাঠের বদলে সাজানো-গোছানো পার্ক। ভাল লাগে না সারাদিন গাড়ির আওয়াজ আর শহরজুড়ে নিয়ন আলো। ভাল ইশকুল-কলেজে পড়ে, বেশ মোটা মাইনের চাকরি করেও বিয়েটা সুখের হল না ঝিনির। সে-তুলনায় পাড়ার ইশকুল-কলেজে পড়ে, পাড়ার ছেলেকেই বিয়ে করে শান্তিতে ঘরসংসার তো করছি আমি! ঝিনির খবরও পাই, যার বেশিটাই নিন্দে এবং সমালোচনা। আমি জানি ঝিনি যে কেন এমন হয়ে গেল! যুক্তি দিয়ে হয়তো বলে বোঝাতে পারব না; কিন্তু আমি জানি। এ-ও জানি যে, ঝিনি আসলে খুঁজে বেড়ায় লিনসিড তেল, একরাশ কৌটোয় রাখা গুঁড়ো রং আর চারমিনার সিগারেটের গন্ধভরা স্টুডিয়োঘরটাকেই; আর খোঁজে জ্যাঠামণির শাসন আর ঝিনিকে ঘিরে সেই পাগলামিগুলোকেই। কে জানে এখন আর ছবি আঁকে কি না ঝিনি!

    নকশালদের বাড়াবাড়িতে ওই বাড়ির সব ভাড়াটেরা উঠে পালিয়ে গেলে, অনেকদিনই একটা যেন ভূতের বাসা হয়েই পড়েছিল বাড়িটা। সেসব ঝামেলা মিটে গেলে, ওই খালি বাড়িটা একটা কোম্পানিকে দিয়ে দিলেন জ্যাঠাইমা। একতলা থেকে তিনতলার খোলা জানলা, বারান্দা আর ছাদে তখন শুধু সারি-সারি দড়ি; আর, তাতে শুকোচ্ছে জামা-প্যান্ট-গেঞ্জি এবং আন্ডারওয়ার। সিঁড়ির ঘরটায় গাদাগাদি করে রাখা সাইকেল-স্কুটার। জ্যাঠামণির স্টুডিয়োঘরসমেত পুরোবাড়িটাই মেসবাড়ি হয়ে গেল; হয়ে গেল, টিটাগড়ের একটা মাড়োয়ারি কোম্পানিতে কাজ করা, সাধারণ চাকুরেদের আস্তানা। জনা কুড়ি-পঁচিশ লোকের নিয়মিত আসা-যাওয়া-থাকার একটা ঠেক। কুয়োপাড়েও তখন সবসময়ে জল ঢালার আওয়াজ। কোম্পানির এমন মেসবাড়িও তো এপাড়ায় এই প্রথম! এসবে বিরক্ত হয়ে, ঝিনিদের তিনতলার ঘর থেকে ছাদে যাওয়ার দু’দিকের দুটো দরজাই উপড়ে ফেলে, পাঁচিল তুলে একেবারে বন্ধ করে দিলেন ওই বাড়ির অন্য শরিকরা। তবে, আমার বরের কাছে শুনেছি যে, ওই কোম্পানি থেকে নাকি ভালই ভাড়া আসে জ্যাঠাইমার হাতে। তবে, ঝিনিই বলেছে যে, ওই ভাড়া থেকে তার ভাগের কোনও অংশই সে কক্ষনো নেয়নি তার মায়ের কাছ থেকে। কেন নেয়নি, জানতে চাইলে হাসতে-হাসতেই সে বলেছিল,  ‘ওটা নাকি আসলে, মা-কে দিয়ে যাওয়া, তার বাবার over-due হাত খরচ।’

    সেই প্রথম রুনা বুঝেছিল যে, সে আর ঝিনি— একে অপরের প্রাণের বন্ধু হলেও, আসলে কিন্তু তারা এক নয়। কেন যে এক নয়, পরে সেটা সে বুঝতে পারলেও একটা ব্যাপার কিন্তু আজও রুনা জানে না যে, ঝিনির মা কেন তাকে নিজের মেয়ের মতো টানতেন! এটাও জানে না যে, ঝিনির বাবা মারা যাবার পর, কেনই-বা সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন ঝিনির মা! 

    মেসবাড়ির কন্ট্রাক্টটা আর রিনিউ না করে, জ্যাঠাইমা শেষে বিক্রিই করে দিলেন বাড়িটা। বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাওয়ার আগে, ঝিনি অবশ্য একবার এসেছিল; এবং আগে থাকতে আমাকে খবর দেওয়ায়, আমিও দেখা করেছিলাম তাদের ওই বাড়িতে গিয়ে। ওই ঘরে ঢুকতেই দেখেছিলাম যে, সার-সার জানলার সব ক’টা পাল্লা খুলে দিয়ে, গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছে ঝিনি; স্টুডিয়োঘরের জানলার কাঁথে চুপ করে বসেছিল সে। কী যে সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে! আমাকে দেখেই বসতে বলল। এরপর নিজে উঠে দাঁড়িয়ে, ঘরের মাঝখানে এসে নাচতে শুরু করল। নিজেই কবিতা বলছে, আর নেচে যাচ্ছে। এদিন সে পরেছিল নীল তাঁতের শাড়ির সঙ্গে ঘন সবুজ রঙের একটা ব্লাউজ; উঁচু করে বাঁধা খোঁপাতে লাগানো ফুলটা একটু নেতিয়ে গেছে; আঁচলটা কোমরে জড়ানো; তার দু’পায়ের গোছায় পরাছিল আঁজি-আঁজি সুতোর মতো পেতলের নূপুর। কী জানি কোথা থেকে যে এমন সুন্দর করে সাজতে শিখেছে ঝিনি! এমন নাচই বা কবে শিখল সে! পেরেকের গর্তে ভরে থাকা দড়ির টানা দেওয়া দেওয়ালগুলো একটু-একটু করে যেন চাপা পড়ে যেতে লাগল, তন্ময় হয়ে ঝিনির বলা সেই কবিতা আর নাচে।

    নাচ শেষ করেই সে বলল, ‘বাবাকে দেখতে এসেছিলাম, একরাশ কষ্ট নিয়ে; কিন্তু আজ আমি ফিরে যাব উৎসবের আমেজ মেখে আমি যেখানেই থাকি না কেন, নাচমাখা এই ঘরটা তো আমার সঙ্গেই থাকবে আমাকে ছেড়ে থাকতে ওর যে খুব কষ্ট হয়! সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে আমিই বলি, ‘বাকি দুটো শেয়ার কিনে নিয়ে, বাড়িটা তো তুই রেখে দিতেই পারিস! বা তোর অংশটার ভাগ নিয়ে মাঝখানে একটা পার্টিশন তুলে দিয়ে!’ এর উত্তরে ঝিনি বলেছিল, ‘মা অবশ্য এ-দুটো প্রস্তাবই দিয়েছিলেন; আসলে, আমিই এর কোনটাই যে ভাবতে পারিনি রে! বাড়ি আবার ভাগ হয় নাকি!’

    ‘তাহলে তো তোকে কষ্টই পেতে হবে; মেনে নিতে হবে যে এটা আর তোদের বাড়ি নয়

    ‘ঠিক তাই! কষ্ট পাওয়াটাই বেস্ট অপশন; কারণ আমার বাবা ছাড়াও, তাতে যে জড়িয়ে থাকবেন বাবার দাদু-ঠাকুমা, অকালে চলে যাওয়া বাবার সেই পিসিমা ফুলরাণী, একমাত্র কাকা বদু বা অদ্রিনাথ; জড়িয়ে থাকবেন আমার ঠাকুমা-ঠাকুরদা সেই তরুলতা আর তরঙ্গনাথও

    ‘কেউ কি আর বুঝবে তোর এইসব ভাবনা! তোকে কিন্তু একেবারে উন্মাদ-পাগলই ভাববে সকলে; দেখে নিস যে আমার কথাটাই ঠিক হয় কি না!’

    ‘দেখ, দোতলাটা বাদ হয়ে গেলে, আমার মনকেমন করবে, দোতলার সাদাঘর, কালোঘর, লালঘর আর সাদাকালো বারান্দাটার জন্য আবার একতলাটা ছেড়ে দিলে, আমার মন পড়ে থাকবে— কুয়োপাড়, তুলসীমঞ্চ আর বাইরের রকদুটোতে আর ওই তিনতলা? অসম্ভব! বাবার ওই ঘরে আমি? মা-কে বাদ দিয়ে বাবার স্টুডিয়োসমেত তিনতলা শুধু আমারই নামে? খেপেছিস! এ তুই ভাবলিই বা কী করে? তার থেকে অনেক সহজ, আমার ভাগটা একেবারে লিখিত-পড়িতভাবে মা-কেই দিয়ে দেওয়া

    বুঝলাম যে, আরও বেজায় দুঃখ তোলা আছে ঝিনির কপালে কিন্তু ওকে দেখে, বিশেষত আজ ওর ওই নাচ দেখে মনে হল, ঝিনি যেন আঁচ পেয়েছে এমন এক জীবনের, একদিন-না-একদিন যেখানে ঠিক পৌঁছে যাবেই সে  

    আজ কোথায় রুনা আর কোথায় সেই সুগন্ধা বা ঝিনি! রুনা স্থির হয়ে আছে তার সংসারজীবনে; এদিকে সুগন্ধা একদিকে যেমন গড়ে উঠেছে, তার থেকে বেশিই যেন ঠুকে-ঠুকে সে ভেঙেছে নিজেকেই। অথচ একটা সময় ছিল, মানে তাদের ওই বারো-তেরো বছর অবধি, যখন ঝিনির মা সব কিছুতেই টেনে আনতেন রুনাকে। সে-সময়ে তাদের সেই নার্সারি ইশকুলে ভর্তি হয়ে, সব কিছুতেই সকলের থেকে এগিয়ে থাকত ওই রুনাই। ইশকুলের স্পোর্টস বা পরীক্ষার রেজাল্ট— সবেতেই তো রুনা ফার্স্ট এবং ঝিনি সেকেন্ড। পাঁই-পাঁই করে সাইকেল চালানো বা গঙ্গায় সাঁতার— এসবেতেও একটু পিছিয়ে থাকত ঝিনি। ঝিনির মায়ের জন্যই কত জায়গায় সে বেড়াতে গেছে তাদের সঙ্গে। কতবার ঝিনির সঙ্গে গিয়ে সে তো থেকেও এসে ঝিনির মায়ের কলকাতার বাসায় বা বোলপুরে ওর পিসির কোয়ার্টারে। ঝিনির বাবার আঁকা জামাও পরেছে পুজোর সময়ে। কিন্তু হস্টেলে যাবার সময়ে, রুনাকেও যখন সেখানে ভর্তি করতে বলেছিল ঝিনি, তাদের দুজনের মা-ই তো চুপ করেছিলেন। সেই প্রথম রুনা বুঝেছিল যে, সে আর ঝিনি— একে অপরের প্রাণের বন্ধু হলেও, আসলে কিন্তু তারা এক নয়। কেন যে এক নয়, পরে সেটা সে বুঝতে পারলেও একটা ব্যাপার কিন্তু আজও রুনা জানে না যে, ঝিনির মা কেন তাকে নিজের মেয়ের মতো টানতেন! এটাও জানে না যে, ঝিনির বাবা মারা যাবার পর, কেনই-বা সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন ঝিনির মা! কেনই-বা ওই রুনা, রাতারাতি তাঁর চোখে হয়ে দাঁড়াল, সোদপুরের মতো এক মফস্‌সলে বড় হওয়া আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতোই যে-কোনও একজন কেউ!

    রুনা না জানলেও, ঝিনি জানে; মানে, অনেক পরে সে জেনেছে। জেনেছে যে, রুনার মা এবং তার বাবার বিয়ের কথা নাকি একেবারে পাকা হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু ঝিনির মায়ের সঙ্গে আলাপ হবার পরেই সে বিয়ে ভেঙে যায়। ঘটনাচক্রে, ঝিনিদের বাড়ির কাছেই অন্য একটা বাড়িতে বিয়ে হয় রুনার মায়ের। চোখের সামনে প্রতিদিন তিনি দেখেছেন যে, তাঁর সেই ভালবাসার মানুষটিই কেমন করে সংসার করছেন আর একজনের সঙ্গে। কোনওদিন কোনও নালিশ করেননি তিনি; দোষারোপও করেননি কাউকে। কোনও এক অপরাধবোধ থেকেই হয়তো, রুনাকেও তাই কাছে টেনে গেছেন ঝিনির সঙ্গে সমান করেই। স্বামী মারা যেতেই, সে-দায়বোধ থেকে ধীরে-ধীরে গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। ঝিনির এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে, তার বাবার মৃত্যুমুহূর্তে ওই ঘরে সেদিন রুনার মা কুসুম কাকিমাকে দেখে। তার বাবার পায়ের কাছে বসে, সমানেই পাখার বাতাস করে যাচ্ছেন তিনি; আর এর কিছুক্ষণ পরেই ধীরে-ধীরে চিরনিদ্রায় চলে গেলেন, ঝিনির বাবা, রণেন। ঝিনির চোখের ওপর এখনও ভেসে-ভেসে ওঠে সেই ছবি— পাখা হাতে শুধুই বাতাস করে যাওয়া, বাক্‌রুদ্ধ কুসুম কাকিমা।  

    রুনাও তো চোখ বন্ধ করলে আজও দেখতে পায়, ঝিনি নাচছে; একা-একাই নেচে চলেছে, নিজের বলে চলা একটা কবিতার সঙ্গে। কী করে যে ঝিনির আজও মনে আছে, সেই দশ বছর বয়সে তার বাবার কাছে শেখা, ‘তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে!’

    ঝিনি যে তখন বলেছিল, ‘চোখের ওপর দৃশ্যগুলো বদলে গেলে সবই কেমন মুছে যায়…!’

    রুনা জানে যে, সেই ঝিনি থেকে ক্রমে সুগন্ধা হয়ে ওঠা এই মেয়েটা, আজ আর সে কথা বলবে না। কারণ মুছে যায় না কোনও কিছুই! একটু শুধু চাপা পড়ে থাকে, ঘনশ্যাওলার পিছল সবুজে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র     

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook