ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল : পর্ব ৩৯


    শ্রীজাত (September 23, 2024)
     

    আকাশবাণী ও দেবাশিসদা

    একেবারে ছোটবেলা থেকে আমার ছিল একা থাকার অভ্যেস। মা হয় সারাদিন গানের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত, নয়তো এ-দেশ ও-দেশ অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছে, আর বাবার তো দিন নেই-রাত নেই কেবল অফিস আর অফিস। ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দফতর বলে কথা! সেখানে নিয়মও নেই, গাফিলতিও নেই। তা এহেন দম্পতির একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি খুব ছোটবেলাতেই বুঝে গেছিলাম, অনেকখানি সময় একলা কাটাতে হবে। তাতে অবশ্য একদিক থেকে সুবিধেই হয়েছিল। ওই কম বয়স থেকেই নানা কিছু জড়ো করে নিজের চারপাশে একখানা একার দুনিয়া বানিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম, যার মধ্যে নিজের মতো থাকতে পারাটাই ছিল আনন্দের।

    তবে একেবারে কি একা থাকতাম? সেই দুনিয়াতেও আমার সঙ্গীসাথী ছিল বইকি। যেমন ছিল গুচ্ছের গল্পের বই, যাদের পড়ে শেষ করতে-না-করতে বাবা আরেক গুচ্ছ এনে ফেলতেন, আর এক ছিল রেডিও। সে কখনও ফুরিয়ে যেত না। পিঠের গোপন খাপে ব্যাটারি পোরা থাকলে কাকভোর থেকে মাঝরাত সে গান গেয়ে চলত, কথা বলে চলত, গল্প শুনিয়ে চলত। আর সে ছিল আমার ওই একলা দুনিয়ার অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী। BUSH কোম্পানির রেডিও ছিল সে, বয়সে আমার চেয়ে বড় যদিও, আমার জন্মের দু’বছর আগে সে এসেছিল আমাদের বাড়ি। তাই মনে-মনে তাকে সমীহ করেই চলতাম আমি। তার গায়ে পরানো থাকত চামড়ার একখানা কালো ঢাকনা, আর খুব দরকার হলে তার একদিকের কাঁধ থেকে ডানার মতো উঠে আসত সরু অ্যান্টেনা।

    রেডিওতে যখন নাটক শুনতাম, গানবাজনা শুনতাম, চাষিভাইদের আসর শুনতাম, আমি ভাবতাম, কোন সুদূর থেকে এইসব তরঙ্গ শব্দ আর সুর হিসেবে এসে পৌঁছচ্ছে আমাদের কাছে? কোথায়, কারা বসে-বসে ভোর থেকে রাত এইসব তদারকি করছেন? ‘রেডিও স্টেশন’ কথাটা তখন বেশ কয়েকবার শোনা হয়ে গেছে বাবা-মার দৌলতে, কেননা মা সেখানকার বাঁধা শিল্পী। এমনও হয়েছে, রাত এগারোটায় মা সরাসরি রেডিওর স্টুডিওতে বসে গাইছেন আর আমি বাড়িতে আমার সঙ্গী রেডিওর বুক থেকে সে-গান বেরিয়ে আসতে শুনছি। সে যে কী আশ্চর্য এক উত্তেজনা! মা, যিনি নাকি পাশের ঘরেই গানবাজনা করেন, তিনি কত দূরের একটা ঘরে বসে গাইছেন, আর আমি সেই পাশের ঘর থেকেই সে-গান শুনছি, এ-জিনিসের বিস্ময় আজ আর ঠিক বলে বোঝাবার নয়।

    সে যা হোক, আমি একবার বায়না ধরলাম, পরের রেকর্ডিং বা লাইভ সেশনে আমাকে নিয়ে যেতেই হবে রেডিও স্টেশনে। ‘আকাশবাণী’ নামটাও সব ঘোষণা শুনে-শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে ততদিনে। এবং এও জেনেছি যে, সে-নাম স্বয়ং রবি ঠাকুরের দেওয়া, যিনি নাকি ‘সহজ পাঠ’ও লিখেছেন। এর আগেও এ-বায়না অনেকবারই করেছি, নেহাত ছোট বলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাছাড়া স্টুডিওতে, যেখানে গানবাজনা হয়, সেখানে ছোটদের ঢোকা নিষেধ। ফলে মা তার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সেখানে ঢুকে গেলে একা-একা আমি অত বড় বাড়িটায় কী করব, এ-ভেবেও ওঁরা আমাকে নিতে রাজি হলেন না।

    এবার অবশ্য দেবদূত হিসেবে দেখা দিল দেবাশিসদা। মায়ের একনিষ্ঠ ছাত্র, সব অনুষ্ঠান বা রেকর্ডিং-এ মায়ের ঠিক পিছনে তানপুরা নিয়ে বসা এবং মায়ের গানের মাঝে গলা লাগানো তার বাঁধা কাজ। সে এবার এগিয়ে এল স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। চমৎকার তার আইডিয়া, এবারে আরও একজন ছাত্রী সঙ্গে যাবে, যে দেবাশিসদার বদলে মায়ের সঙ্গে তানপুরায় বসবে, কেননা রেডিওয় তো ছাত্রছাত্রীদের সুর লাগানোর দস্তুর নেই, যিনি শিল্পী, তিনিই কেবল গাইবেন। দেবাশিসদাও যাবে, কিন্তু সে বাইরে থাকবে আমাকে নিয়ে, ঘুরে-ঘুরে দেখাবে আমাকে, আকাশবাণীর বিরাট বাড়িখানা। এ-প্রস্তাবে সায় দেওয়া ছাড়া মা আর বাবার সামনে অন্য কোনও রাস্তা আর খোলা ছিল না। অতএব একদিন আমিও কালো হলুদ ট্যাক্সিতে দু’খানা তানপুরার মাঝে আনন্দে চ্যাপটা হয়ে চললাম রেডিও স্টেশন দেখব বলে।

    দেবাশিসদার বাড়িতে ফোন নেই, আমরা জানতাম। আমাদের বাড়িতেও ফোন নেই তখন। সুতরাং সরাসরি যোগাযোগের কোনও উপায়ও নেই। কুদঘাটে থাকে, এইটুকু আমরা জানি, কিন্তু কী যে তার ঠিকানা, সে তো জানি না। তাই হাজির হয়ে খোঁজ নেবার রাস্তা বন্ধ। বাবা-মা দু’জনেই খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন, আমারও মন ভাল নেই।

    সেদিন ছিল দুপুর-দুপুর রেকর্ডিং। মা তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে স্টুডিওতে ঢুকে যাবার সময়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দুষ্টুমি করবে না কিন্তু, কথা শুনে চলবে।’ এটা এক ধরনের বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, কেননা মা ভালই জানতেন দুষ্টুমি করবার পাত্র আমি মোটেও নই। সেদিন দেবাশিসদা সত্যিই আমার হাত ধরে ওই অত্ত বড় আকাশবাণী বাড়িটার এ-বারান্দা সে-বারান্দা ঘুরিয়েছিল। আর তারপর, অনেকখানি দেখা শেষ হলে, বিরাট এক ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে কেক আর গরম কোকো খাইয়েছিল। কী যে মজা পেয়েছিলাম সেদিন, সে আর বলার নয়।

    এর পরের পুজো শেষ হয়ে গেলে দেবাশিসদা হঠাৎ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিল। সাধারণত বিজয়াতেই আসে, এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে। সে তো এলই না, পুজোর পর দু’হপ্তা পেরিয়ে গেলেও এল না। দেবাশিসদার বাড়িতে ফোন নেই, আমরা জানতাম। আমাদের বাড়িতেও ফোন নেই তখন। সুতরাং সরাসরি যোগাযোগের কোনও উপায়ও নেই। কুদঘাটে থাকে, এইটুকু আমরা জানি, কিন্তু কী যে তার ঠিকানা, সে তো জানি না। তাই হাজির হয়ে খোঁজ নেবার রাস্তা বন্ধ। বাবা-মা দু’জনেই খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন, আমারও মন ভাল নেই। দেবাশিসদা এলেই আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটায়, সেই সঙ্গটুকুর অভাব বোধ করছিলাম ওই ক’দিনেই।

    খোঁজ শেষমেশ পাওয়া গেল। একদিন, মা যখন বাইরের ঘরে ক্লাস নিচ্ছেন আর বাবা সবে অফিস থেকে ফিরেছেন, এক অচেনা বিষণ্ণ যুবক আমাদের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। পরিচয়ে জানালেন, তিনি দেবাশিসদার বন্ধু। এও জানালেন, দেবাশিসদা আর নেই। দশমীর রাতে মারা গেছে। তিনখানা তানপুরা একসঙ্গে থেমে গেলে মনে হয় কারও শ্বাস বুঝি রুদ্ধ করে দেওয়া হল। তেমনটাই ঘটল মায়ের ক্লাসঘরে। বাবা এসে দাঁড়ালেন। আমি দরজার আড়াল থেকে শুনছি সবটা। দশমীর রাতে বন্ধুদের সঙ্গে সিদ্ধি খাওয়া হচ্ছিল। দেবাশিসদার সিদ্ধিতে কেউ একজন তামার পয়সা ঘষে দিয়েছিল খুব করে। মাঝরাত থেকে বমি শুরু হয়। ভোরের দিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তখন আর প্রাণ নেই।

    মা আর বাবা খুব শক্ত মানুষ। মাকে দেখলাম ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতে, বাবা চুপ করে ঘরের এক কোণে বসে পড়লেন। আমি তখনও জানি না, সিদ্ধি কী, তাতে তামার পয়সা কেনই-বা ঘষে, ঘষলে কী হয়। কেবল এটুকু বুঝলাম, দেবাশিসদাকে আর কোনওদিন দেখতে পাব না। নিজের বিছানায় শুয়ে খুব জোরে আমার সঙ্গী রেডিওটা চালিয়ে দিয়ে আমিও কেঁদেছিলাম সেই রাতে। তার পর অনেকগুলো দিন মায়ের ক্লাস বন্ধ ছিল, বেশ কিছু অনুষ্ঠানও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমি এমনিই চুপচাপ ছিলাম, আরও চুপ হয়ে গেলাম।

    আজ যখন নিজের কোনও অনুষ্ঠানে আকাশবাণী যাই, বুঝতে পারি, সেদিনের চেয়ে খুব বেশি বদলে যায়নি বাড়িটা। বাইরের দুনিয়াটা বদলে গেছে অনেকখানি। আমার মধ্যেকার সেই একার দুনিয়াটা অবশ্য থেকে গেছে এক কোণে, যে আজও আকাশবাণীর ক্যান্টিনে কিছুতেই ঢুকতে চায় না। পাছে দেবাশিসদার কথা মনে পড়ে যায় তার!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook