ভূতেশ – আট
উঁচুপদে প্রোমোশন হওয়াতে, সিমলা-দিল্লি করার সুযোগ পেল ভূতেশ; মানে একসঙ্গে দুটো জায়গায় থাকবার ফলে তার হেফাজতে এখন দুটো কোয়ার্টারও। ময়ূর-টিয়া-ওড়া গাছপালা ঘেরা দিল্লিতে থাকলেও, সে-জায়গাটা আসলে রাজপথের শহর; দ্রুত বেড়ে ওঠা ব্রিটিশদের ইমারতি রাজধানী আর সেই সঙ্গে বেজায় গরম। পরিশ্রমী জাঠরা এই গরম সহ্য করে টিকে আছে; আর আছে সেই পুরনো সময় থেকে স্থানীয় মুসলমানেরা; গরমের কারণে তাদের বাড়িগুলিও বেশ অন্যরকম করেই বানানো; তবু ভয়ংকর গরমের জন্যই দিল্লি-সোর নামে এক ধরনের ‘পোড়া-ঘা’ এদের চামড়ায় হলেও, এরা সেসব নিয়েই বেঁচেবর্তে আছে এক অদ্ভুত স্মৃতিকাতরতায়। মুস্কিল হয়েছে সাহেব, বিশেষত তাদের মেমদের। বরফের জোগানই-বা কত আর বাড়ানো যায়! গরমে কলকাতা পালানোর ব্যবস্থা থাকলেও, একে তা বেজায় দূর এবং সেখানেও বা গরম থেকে পরিত্রাণ কই! ফলে একদিকে যেমন বরফ বানানোর তোড়জোড় করেছে, অন্যদিকে তেমন তালাশ লাগিয়েছে এই তামাম দেশটার কোথায় কোথায় শৈলাবাস বানিয়ে আরামে একটু জুড়ানো যায়! মোগল রাজাদের মতোই যেন সেই ‘হাওয়া-মহল’। আর কোথায় না পড়েছে সাহেবদের নজর! বাংলায় রাজধানী থাকার সময়ে যেমন হাত বাড়ালেই দার্জিলিং ছিল, তেমনই তাদের রাজধানী দিল্লিতে টেনে এনেই তারা খুঁজে বার করল এই সিমলা। কেয়ন্থালের মহারাজা এবং পাতিয়ালার রাজার মালিকানায় থাকা ছোট্ট এই শৈলশহরে লোকে আসত শরীর সারাতে। মূলত গোর্খা-নেপালিরাই এখানকার অধিবাসী; আর কিছু আদি পাঞ্জাবি পরিবার। জায়গাটার সন্ধান পেতেই ব্রিটিশরা শুরু করে দিল দখলদারি। রাজাদের সঙ্গে চুক্তি, নেপালিদের সঙ্গে যুদ্ধ— সবেতেই তাকত দেখিয়ে জিতে গেল তারা। ভূতেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে ভাবে যে, প্রশাসন জানে বটে এই সাহেবরা! Assistant Political Agent in the Hill States— এমন একটা পদও কি এদের আগে কেউ ভাবতে পেরেছিল? AGENT— এই শব্দটা তো তাদেরই আমদানি, একেবারে সেই কোম্পানি আমল থেকে। প্রায় একশো বছর আগে, মুগ্ধ Ross সাহেব এখানে একটা কাঠের ঘর বানান। মেরেকেটে খান-পনেরো কাঠের বাড়ি আর বলতে গেলে আঞ্চলিক ‘পাহাড়ি’দের এক জঙ্গুলে জীবন— এই তো ছিল সিমলা। কয়েক বছরের মধ্যেই পাকা ঘর হল, যখন Ross-এর পরে-পরেই, সেই স্কটিশ সাহেব Pratt Kennedy এখানে এসে, মজবুত একখানা বাংলো বানালেন। ব্যাস! নামও হয়ে গেল ‘কেনেডি কটেজ’। শুরু হয়ে গেল বন কেটে বসতের তোড়জোড়। ‘কসৌলি’, ‘সানজৌলি’, ‘লক্কড় বাজার’ ‘চৌরা ময়দান’ এমন সব নামকে গিলে খেয়ে, যাবতীয় যত নাম হয়ে গেল, ইংরেজ পদাধিকারী বা তাদের মেমেদের নামে; নয়তো তাদের পছন্দের স্কটল্যান্ড-ইংল্যান্ডের কোনও অঞ্চলের নামে। তাদের চোখে অনায়াসেই কেমন ভাগ হল, ‘ছোটা সিমলা’, Upper-Middle-Lower Bazar এমন সব ভাগে; যার মূল কথা সাহেব এবং নেটিভ আস্তানার চিহ্ন। উঁচাবাজার অঞ্চলটাতে আগুন লাগিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার হতেই সেখানকার লোকেরা দুদ্দাড় করে সরে এল, উপত্যকা ছেড়ে আর একটু পাথুরে এলাকা নীচাবাজারে। এমন জাঁকিয়ে বসল এই সাহেবরা যে, রাজারাজড়াদের বাড়ির খাস লোকেদেরও অনুমতি লাগত তাদের নিজেদের বাড়ি ঘরে ঢুকতে বা হাওয়া-বদলে বেড়াতে আসতে হলে। রেললাইন বসিয়ে, ব্রিজ বানিয়ে একেবারে দারুণ সুবিধেজনক এক বিলাসবহুল সাহেবি এলাকা গড়ে ফেলল তারা। এই অঞ্চলকে এলাকাবাসীরা তখন উল্লেখ করতে লাগল, ‘কোম্পানি-কা-বাগ’ বলে।
ভূতেশ খুবই কৃতজ্ঞ হয়ে স্মরণ করে, এই চার্লস প্রাট নামের ‘কেনেডি’ পদবীধারী সাহেবটিকে। স্কটল্যান্ডের Dumfriesshire-এর একটা সাব-ডিভিশন হল অ্যান্নানডেল। ফলে সেই সুন্দর উপত্যকার নামেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে গেল ‘Annandale’; ভূতেশ এটাও লক্ষ করেছে যে, এ-সময়ে স্কটল্যান্ডের সাহেবরাই এদেশে আসত বেশি সংখ্যাতেও। অনেকে আবার বলে যে, প্রাটের প্রণয়ী অ্যানার (Anna) নামেই এর নাম আসলে ‘Annadale’; সাহেবের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে, যে একা ফিরে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। এই প্রণয়ী প্রসঙ্গে ভূতেশের মনে পড়ে গেল আর একটা মজার নাম— ‘Scandal Point’। পাতিয়ালার রূপবান মহারাজা ভূপিন্দর সিংয়ের প্রেমে পাগল হয়ে গেল একেবারে খোদ ভাইসরয়ের যুবতী কন্যা। সাহেবরা তো জানামাত্রই তার ঢোকা বন্ধ করে দিল সে-তল্লাটে; তবে সেও তো মহারাজা, সহজে কি ছেড়ে দেবে? ‘চালি’ বলে এক দূরের গ্রামে, ঘর বেঁধে থাকতে শুরু করল সেই মহারাজা। শেষে ইলোপ; ভূতেশ আর জানতে চায়নি পরে তাদের কী হল। এটুকুই জানার যে, যেখান থেকে সেই ইংরেজ রমণীকে ইলোপ করা হয়েছিল, সে-জায়গাটার নাম হয়ে গেল ‘Scandal Point’। হাসিঠাট্টার মধ্যে কেউ-কেউ এমনও অবশ্য বলেছে যে, ওই রাজা আসলে ভূপিন্দর নয়, তার বাবা রাজিন্দর; মেমসাহেবকে বিয়ে করে তার নাকি একটা ছেলেও হয়েছিল। তবে, ছেলেসমেত সেই মেমসাহেবের খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। তবে ভূপিন্দরকে নিয়ে গল্প এই যে, তার নাকি ৩৬৫ জন রানির আলাদা-আলাদা প্রাসাদ ছিল পাতিয়ালায়। প্রতিদিন সেখানে ৩৬৫টা প্রদীপ জ্বালানো হত। এই মহারাজাই বোধহয় এদেশে প্রথম, যে একটা এরোপ্লেন কিনেছিল ১৯১০ নাগাদ ব্রিটেনে গিয়ে। সে যাই হোক, ভূতেশ যেটা ভেবে পায় না যে, এত প্রেমে পড়ার কী আছে! সাহেবদের মধ্যে রোমান্স একটু কম বলেই বোধহয়, ওদের ঘরের মেয়েরা এ-দেশীয়দের মধ্যে সেটাই খোঁজে। আর নিজেদের ঘর-গেরস্থালি বজায় রেখেও সাহেবরা ওঠা-বসা শুরু করে দেয় এখানকার প্রাণোচ্ছল এবং রূপবতী পাহাড়ি মেয়েদের সঙ্গে। তবে ওই পর্যন্তই। বেশির ভাগ সাহেবদের মনের গঠন এমন যুক্তিবাদী বলেই না সাহেবরা এত করিতকর্মাও বটে! এ-জায়গাটার আবহাওয়াকে বেশ ‘English Weather’ মনে হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কেমন ঝটপট বানিয়ে ফেলল, Viceregal Lodge, Town Hall, Club, Church, Mall, Peterhof; আর সব ক’টা সরকারি অনুষ্ঠান এক জায়গায় করবার জন্য ‘Ridge’ নামে একটা এলাকা! ধর্ম, বিলাস, লেখাপড়া, Commission, Convention, Treaty— সব কিছু মিলিয়ে-মিশিয়ে, নিরাপত্তায় মোড়া একটা সামগ্রিক জীবন— এ তো ওরাই যাপন করতে জানে। ঠিক যেন ‘Mini England’। থিয়েটার, লাইব্রেরি, ডগ-শো, ফ্লাওয়ার-শো, আইস স্কেটিং এসবের আয়োজন দেখে কে বলবে যে ওদের আসল নজর হল— জমির আদান-প্রদান, ব্রিটিশ সরকারের মালিকানা, প্রশাসন, আর্মি এবং ঘরে-বাইরে যুদ্ধ!
তবে ভূতেশের কৃতজ্ঞতা দুটো কারণে; এক হল সিমলায় শৈলনিবাস করেই, আর্মির জন্য সেখানে একটা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা করা; আর দ্বিতীয় হল এই ক্যান্টনমেন্ট এলাকার খুব কাছেই Lady Irwin School তৈরি করা। ফলে পরিবার নিয়ে এখানে থাকতে তার আর কোনও অসুবিধেই নেই। ভূতেশ মনস্থির করে ফেলল এই শৈলশহরে থেকে জীবনকে উপভোগ করবার। মিরাট বা দিল্লির আর্মি কোয়ার্টারে হিন্দুদের থেকেও মুসলিমদের উপস্থিতি বেশি। সেদিক থেকে দেখলে, এ-অঞ্চলে থাকা মানে শুধুমাত্র খাস সাহেবদের সঙ্গে ওঠা-বসা। কিছু পারসি এবং পাঞ্জাবি বাদে, বাদবাকি তো সব ‘পাহাড়ি’; যারা গোলমাল পাকিয়েও সাহেবদের সঙ্গে এঁটে উঠে খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। একেবারে নতুন এক সাহেবি শহর; স্মৃতি বলতে বনজঙ্গলের প্রাচুর্য; জঙ্গলের গাছপালা-পশু-পাখিরা তো আর দল বেঁধে মুক্তি চাইতে আসবে না! ফলে কী ছিল, আর কী হল— সেই একঘেয়ে চর্বিতচর্বণ থেকে একেবারেই মুক্তি।
২
ভূতেশ ও পরির সংসার ইতিমধ্যে যেমন বেড়েছে তেমন বদলও হয়েছে বিস্তর। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে খুবই সম্পন্ন ঘরে। মেজো মেয়েও প্রায় বিবাহযোগ্য। সেজোজন মিতাকে সিমলার Lady Irwin School-এ ভর্তি করে দেওয়ায় সে তো ভীষণ খুশি। ‘Defence Colony’-র কোয়ার্টার থেকে একটু হাঁটা পড়ে ঠিকই; কিন্তু আবহাওয়া এত ভাল যে, সহজে কাহিল বোধ আসে না। একজন পাহাড়ি চাকর তাকে আনা-নেওয়া করে। ভূতেশ বোধহয় এই প্রথম, বাড়ি ফিরে মেয়ের পড়ার খোঁজ নেয়। মিতাও অপেক্ষা করে থাকে, বাবা এসে কখন তাকে অঙ্ক করাবে, গল্প বলে-বলে পড়িয়ে দেবে ইতিহাস-ভূগোল; আর রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে চিনিয়ে দেবে কালপুরুষ, সপ্তর্ষি মণ্ডল আর ধ্রুবতারা। মালদায় থাকতে ছোট্ট মিতা কিছুদিন একটা ইশকুলে পড়লেও, সিমলায় এসে একবারে সিক্সে ভর্তি হয়েছে। ভূতেশের সঙ্গে ইশকুলের গল্প করে মিতা; গল্প করে তার প্রিয় সেই পারসি টিচার মিস দোয়ারার কথাও; তিনি নাকি তাঁর বব-কাট চুলে, ফুলের বদলে দুটো চেরি ফল লাগিয়ে আসেন, ক্লিপ দিয়ে। সিডার, ওক, দেওদার, প্রুস, সিলভার, ফার— এখানকার সব গাছেদের নাম, ইশকুল থেকেই শিখে এসেছে মিতা। ওইসব গাছগুলোর স্থানীয় নাম যে রাউ, চিল, কাইল, মারু, খারসু— এসবও সে জেনে নিয়েছে ইশকুলে আসা-যাওয়ার পথে ওই নেপালি চাকরের কাছ থেকে। রডোডেনড্রন ফুল তো উপচে ফুটে থাকে, পাহাড়ি পথের দু’ধারে এক আশ্চর্য বাহার জাগিয়ে। মিতা মাঝে মাঝে তুলে এনে তার মাকে দেয়। ইশকুল থেকে শিখে এসে, এখানে ফুটে থাকা চেনা করবীকে সে বলে ‘অলিয়েন্ডার’, নয়নতারাকে ‘পেরিউইঙ্কলে’ আর টগরকে বলে ‘ক্রেপ জেসমিন’। মিতাকে ঘিরে ভূতেশের পরিবারে ইংরেজিয়ানার বাতাস ঢুকতে শুরু করেছে। মিতার পরে আর যে দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে, তারা এখনও বাড়িতেই থাকে। খেলে বেড়ায়। মিতা তেমন মিশুকে নয়। বই নিয়ে বসে থাকতে ভালবাসে। অফিস লাইব্রেরি থেকে Rudyard Kipling সাহেবের লেখা দু’খানা বই নিয়ে এসে, ভূতেশ মেয়ের হাতে দিলে সাগ্রহে পাতা ওলটায় মিতা— through the mysterious dusk, full of the noises of a city below the hillside and the breath of a cool wind in deodar-crowned Jakko, shouldering the stars. যেটুকু যা পড়ে, তা সে বাবাকেই বলে। ভূতেশ মেয়েকে বলেছে, একদিন তাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনবে কিপলিং সাহেবের বাড়িটা। এখানে তিনি নাকি বছর পাঁচেক ছিলেন। কিপলিং সাহেবের প্রথম আস্তানা ‘Tendril’-এর হদিশ না জানলেও, North Bank Lodge— এই ঠিকানাটা ভূতেশের কোয়ার্টার থেকে খুব দূরে নয়। তবে, ভূতেশের প্রস্তাবে সে বলেছে যে, যাবে না; কারণ ওখানে নাকি ভূত আছে; বলেছে যে, সে-কথা নাকি সাহেব নিজেই লিখে গেছেন।
মিতার একটা নোটবুক দেখে ভূতেশ একটু অবাকই হয়ে গেছে। সিমলায় এসে নতুন কী-কী দেখেছে সেসবের কথা লিখে রেখেছে মেয়ে। ওদের ইশকুলে, রোজ ডায়েরি লেখা নাকি বাধ্যতামূলক। ট্যানেল, দুজন মানুষে মিলে টানা তিন চাকার লোহার রিকসা, আপেল বন, পাহাড়— এ-সমস্ত ছাপিয়ে পাতার পর পাতা সে লিখে গেছে, বরফে ঢেকে যাওয়া রাস্তাঘাট, জানলায় জমে থাকা বরফের শিকলিতে ঠিকরে পড়া রোদ্দুর আর সবসময়ে গরম জামা আর মোজা পায়ে দিয়ে থাকবার কথা; লিখেছে, টানেল বসানোর সময়ে অ্যালুমুনিয়ম পাইপ দেখে দেহাতি লেবাররা নাকি ভেবেছিল যে, একশো ফুট লম্বা একটা সাপ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে! মেয়ে মিতার চোখ দিয়ে ভূতেশ যেন এক অন্য জগতের নাগাল পায়; অপেক্ষা করে থাকে, কাজ থেকে ফিরে কখন সে মেয়ের সঙ্গে বসতে সময় পাবে ওই ছোট্ট পড়ার টেবিলটায়। ভূতেশ তার নিজের পড়ুয়া সত্তাটাকেই যেন দেখতে পায় মিতার মধ্যে। ভূতেশ বুঝতে পারে যে, মিতা তার দুই দিদি বা মায়ের মতো সুন্দরী না হলে ব্যক্তিত্বে বোধহয় সবাইকে ছাপিয়ে যাবে।
এই ইংলিশ মিডিয়াম ইশকুলে মিতার প্রথম পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড দেখে, ভূতেশ তো দারুণ খুশি। যেসব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে, সেগুলোর জন্য পেয়েছে সার্টিফিকেট এবং একটা করে চটি বই। তাতে আবার একটা Rudyard Kipling-ও আছে; আছে বাইবেল। ওদের ইশকুলের কোনও ইউনিফর্ম নেই। জুতো-মোজার সঙ্গে সুন্দর একটা ফ্রক পরে, সোয়েটার গায়ে দিয়ে মিতা যখন ইশকুল যায়, ওকে দেখেও তো মেম-বাচ্চা বলেই মনে হয়। সব ছেলেমেয়েদের জন্য গরম জামা আনিয়ে দিলেও, মিতার জন্য একটা ফারের কোট আনিয়ে দিয়েছে ভূতেশ। এরকম একটা কোট পরির জন্যেও আনিয়ে দিয়েছিল ভূতেশ; পরি তো হেসেই মরে! ভূতেশ মাঝে মাঝে দেখে যে, সেই লেডিস কোটখানা বদলা-বদলি করে গায়ে দিচ্ছে কখনও বড় দাদার ছেলে, আবার কখনও-বা তার দুই মাসতুতো ভাই। কোনও কিছু নিয়েই প্রতিক্রিয়া দেখায় না ভূতেশ। যে যেমন বোঝে; তবে কে যে কী বুঝছে, সেদিকে কিন্তু খুবই সজাগ দৃষ্টি ভূতেশের।
ভুতেশ যেখানেই যায়, সে-বিষয়ে একটা সম্যক ধারণা নিয়ে যায়। ফলে সিমলায় আসবার আগেই সে জেনে নিয়েছে যে, এ-জায়গাটার আদি নাম বোধহয় ‘শ্যামালয়া’; কারণ কোনও এক ফকির নাকি ‘জাকু’ পাহাড়ের মাথায়, নীল পাথর দিয়ে একটা আস্তানা বানিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করে। আবার অনেকে মনে করে যে, কালো রঙের কালি মন্দিরকেই এই সাহেবরা ‘বাড়ি-কালি’র ‘ব্লু লেডি’ বলছে। যাই হোক, সৌন্দর্য নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামালেও, ভূতেশেরও চোখে পড়েছে এখানকার নীল বনরাজি এবং মেঘ-মেঘ আচ্ছাদনে ঢাকা আকাশের রং। তবে ভূতেশের সবচেয়ে মনে ধরেছে তিন বাঙালির উদ্যোগ। অবশ্য এ-কথাও সে ভেবেছে যে, লেখাপড়া, গানবাজনা আর হাতের কাজ— এর বাইরে গিয়ে কীই-বা করতে পেরেছে বাঙালি! যাই হোক! অমৃতলাল ব্যানার্জী, এন এন সরকার এবং সতীশ রঞ্জন দাস— এই তিন সরকারি চাকুরে, গভর্নর আরুইনের কাছে গিয়ে যদি না আর্জি জানাতেন তো, মিতারও আর এমন এক ইশকুলে পড়া হত না। লর্ড আরুইন নিমরাজি হলেও, লেডি আরুইনের উৎসাহেই ইশকুলটা হয়েছে বছর দশেক হল।
ভূতেশ জানে না যে, কতদিন কী এখানে থাকতে পারবে সে! তবে এটা বুঝেছে যে, এখানে থাকতে তার ভাল লাগছে; আর ভাল লাগছে রূপবতী-পাহাড়ি মেয়েদের টুকটাক সঙ্গ। পরি মাঝে মাঝে সন্দেহ করলেও, ভূতেশ সেটা সামলে নিতে জানে। সংসারকে বঞ্চিত করে তো সে কিছু করছে না! তাই তার কখনওই মনে হয় না যে, প্রভাকে সে ঠকাচ্ছে। আর প্রভার রাগটাও ক্ষণিকের; তার পরেও তারা মিলিত হবে এবং না চাইলেও বেড়ে চলবে সন্তানের সংখ্যা। সাত সন্তানের পর, এখনই তো প্রভা আবার গর্ভবতী। কী করা যাবে! ভূতেশ মনে-মনে বলে, ‘One of the Best Stupid Woman.’
৩
মিতার ইশকুল থেকে গারডিয়ান-কল হওয়ায় একটু যেন ঘাবড়ে গেল ভূতেশ। মিতাকে জিজ্ঞেস করাতে, মাথা নামিয়ে নির্বাক হয়ে রইল সে; পরিকে জিজ্ঞেস করা বৃথা বলে, মেয়ের সম্পর্কে ভূতেশও কিছু জানতে চাইল না পরির কাছে। নির্দিষ্ট সময়ে ইশকুলে যেতেই পারসি হেডমিস্ট্রেস ভূতেশকে আপ্যায়ন করে বসালেন। মিতাকে ক্লাস থেকে ডেকে আনা হলে, সে যা জানাল তাতে বিস্মিত হয়ে গেল ভূতেশ। পরির বাপের বাড়ি থেকে তার ভাই-বোন এবং আরও কিছু আত্মীয়স্বজন সিমলায় তাদের কাছে বেড়াতে আসাতে, সকলে মিলে ‘জাকু’ পাহাড় যাবার পরিকল্পনা করে তারা। ভূতেশের অনুমতি ছাড়াই সেই সঙ্গে জুটেছিল তার দুই মাসতুতো ভাই এবং দাদার ছেলেও; সকলকে যেতে দেখে, মিতাও বায়না ধরে যাবে বলে। কারণ, তখনও কেউ ইশকুল যায় না বলে তার ছোট-ছোট ভাই-বোনেরাও যাচ্ছে। কিন্তু মিতাকে এক রকম জোর করেই ইশকুল পাঠানো হয়। ক্লাস চলাকালীন দুপুরের দিকে, দূর থেকে মিতা দেখতে পায় তার বাড়ির লোকেদের; পাহাড়ের ওপরে ইশকুল হওয়ায়, নীচে থেকে ঘুরে-ঘুরে ওঠা পাহাড়ি পথে তো দেখাই যায়। তার ওপর তারই বাড়ি থেকে আসা অত বড় একটা দল; টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার-দাবার নিয়ে বেড়েতে চলেছে ‘জাকু’ পাহাড়। কাউকে কিছু না বলে, মিতাও ইশকুল থেকে বেরিয়ে এসে গুটি গুটি সেই দলে মিশে যায়। পরি তা দেখে হেসেই খুন; ইশকুল পালিয়ে চলে এসেছে বলে, মিতা দেখল যে, তার মা তো বেশ মজাই পেয়েছে। জাকু পাহাড়ের বাঁদরের দল কিছু খাবার তাদের হাত থেকে কেড়েও নিয়েছে; এমনকী ছোট ভাইয়ের হাতে থাকা বিস্কুটের প্যাকেটটাও। সন্ধে নামার আগেই ফিরতি পথে ওই ইশকুলের সামনে দিয়ে নামার সময়ে, দারোয়ান মিতাকে দেখতে পেয়েই হেডমিস্ট্রেসের ঘরে নিয়ে যায়। তিনি সব শুনে মিতাকে ছেড়ে দেন এবং ভূতেশকে ডেকে পাঠান ইশকুলে।
ভূতেশ যে কী বলবে ভেবে পায় না। পরির এই উদাসীনতা কি বোঝানো যাবে বাইরের লোকদের!
আমি ভূতেশ। আমার সংসারে এখন তিন রকম স্রোত একইসঙ্গে বইছে। একদিকে আমার চাকরি এবং বেজায় দায়িত্ব; অন্যদিকে আমার বুদ্ধিমতী মেয়ে রমিতার পড়াশুনো এবং পরীক্ষায় উত্তরোত্তর ভাল ফল করে ক্লাসে ওঠা; আর এ–দুয়ের মাঝখানে অযৌক্তিক নানা কিছু নিয়ে পরির মেতে থাকা এবং ক্রমাগত সন্তান সম্ভাবনা। সিমলায় এসে অবধি গাছগাছালি নিয়ে মেতে থাকবার নেশাটা পরির একেবারেই গেছে; তার কারণ মনে হয় ঠান্ডা এবং বরফ-পড়া মাটি; তবে তার জায়গায় সে এখন মেতে থাকে রান্না নিয়ে। এখানে থাকা মেমসাহেব বা দিশি সাহেবদের গিন্নিদের সঙ্গে তো মেশার ঝোঁক তার একেবারেই নেই। যত রাজ্যের পাহাড়ি ঝি–চাকর আর লেবারদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে, সে শিখে ফেলেছে এখানকার সব রান্না; ওসবে আমার রুচি নেই, কিন্তু আমি জানি সবই। রাজমা আর নানা রকমের বিন একসঙ্গে মিশিয়ে রগরগে তরকারি ‘মাদ্রা’; শুকনো আনার দিয়ে মুরগির রসা ‘চিকেন আনারদানা’; দই দিয়ে বানানো ভেড়ার মাংসের থকথকে ঝোল ‘ছা–গোস্ত’; আমার দোকান থেকে মাঝে মাঝেই যে এটা–সেটা দামি জিনিসপত্র সরে যায়, তার কারণ পরি। না বলে নিয়ে গিয়ে, আয়োজন করে রেঁধে, দুই দেওর আর ভাসুরপোকে জুটিয়ে, প্রায় রোজই তাদের পিকনিক। তবে ওর বানানো ‘বাব্রু’ মিষ্টিটা আমি খাই। শুকনো মালপোর মতো, কিন্তু রস চিটচিটে নয়।
অবিমিশ্র শান্তি— এ বোধ হয় আমার জীবনে নেই। কারণ মোহনদাস গান্ধী এবার লোক খেপিয়ে তুলেছে অহিংস পথে। জেল-হাজতের ভয় তো নেইই, উলটে থেকে থেকেই অনশনে বসে যায়। তারই সঙ্গে জুটেছে ভয়ানক মন্বন্তর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আয়োজন। চীনকে সহযোগ দিতে গিয়ে শত্রু হয়ে উঠছে জাপান। গান্ধীকে বিরোধিতা করে নেতা হয়ে উঠছে সুভাষ বোস নামে কলকাতার সম্পন্ন ঘরের উচ্চশিক্ষিত এক ছেলে। সাহেবদের ঘরে আগুন লাগা মানেই আমার সংসারও পুড়ল। ফলে, বিপদ বুঝে সিমলা থেকে পরিবারকে সরিয়ে নিয়ে আবার রেখে আসতে হল মালদায়। মেজো মেয়ে চলে গেল সোদপুরের বাড়িতে, বড়খুকির কাছে থাকবে বলে। পরির সঙ্গে মালদায় থেকে গেল রমিতা-সমেত বাকি ছয় ছেলেমেয়ে। সিমলার অমন সুন্দর ইশকুল ছেড়ে রমিতাকে ইশকুল-ফাইনাল পরীক্ষা দিতে হল মালদা ইশকুল থেকে।
সব কিছু শান্ত হলে আবার সকলে ফিরে এল দিল্লি। বাকি ছেলেমেয়েরা এখানকার সাহেবি ইশকুলে ভর্তি হলেও মেয়ে মিতা কিন্তু একেবারে বদলে গেল। রেডিয়ো কানে নিয়ে সায়গন স্টেশন থেকে প্রচার পাওয়া সুভাষ বোসের বক্তৃতা শোনে সে; দিল্লি ময়দানে গিয়ে শুনে আসে গান্ধীর বক্তব্য। খদ্দরের লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়। সে একেবারে স্থির করে ফেলেছে যে, হয় সে পড়তে যাবে ‘শান্তিনিকেতন’, নয়তো গুজরাটে গিয়ে যোগ দেবে গান্ধীর সেবা–গ্রামে।
কোনওটাতেই রাজি হতে পারিনি বলে, আজকাল সে আমাকে সাবধানে এড়িয়ে চলে। সেদিন মিতার একটা ডায়েরি হাতের কাছে পেয়ে, পাতা উলটে দেখি সে লিখে রেখেছে, ‘আমার মা খুব দুঃখী। সব থেকেও সে নিঃস্ব। ঠিক আমাদের এই পরাধীন দেশটার মতোই।’
আজ অনেকাল পরে মনে হল, কতদিন চিঠি লিখিনি কাউকে। আর কাকেই-বা কী নিয়ে লিখব!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র