ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বন্ধু হাত, শত্রু হাত


    সুভাষ দে (June 18, 2022)
     

    ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার কারণে মাত্র দু-বছর বয়সে আমার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ চলে যায়। সেই বছরই আবার আমার বাবা-মা দুজনেই অসুখে মারা যান। আমি মূলত দিদিদের কাছে মানুষ। আমি যে একজন দৃষ্টিহীন, সেটা নিয়ে ছোটবেলায় খুব একটা যে ভাবতাম, তা কিন্তু নয়; ছোট ছিলাম বলেই হয়তো অসুবিধেগুলো নিয়ে তেমন গা করতাম না। যেমন একটা ঘটনার কথা বলি— আমি পাইকপাড়ায় যেখানে থাকতাম, সেই পাড়ায় একটা কালীমন্দির ছিল। ছোটবেলায় সেই মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ শুনে-শুনে আমি ঘণ্টার দড়িটা ধরার চেষ্টা করতাম। অথচ তখন বুঝতেই পারতাম না, ঘণ্টা যেখানে আছে দড়ির সেখানে থাকার কথা না; তা থাকবে খানিক দূরে। বোকার মতো কিছুক্ষণ চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিতাম। পরে যখন একটু-একটু করে বড় হচ্ছি, তখন এক সময়ে বুঝতে পারলাম যে, এই জগতের সব কিছুই আমাকে ছুঁয়ে-ছেনে দেখতে হবে। আর সেটাই আমার ‘দেখা’। যা কাছে পেতে চাই, নিজের আয়ত্তে আনতে চাই, তা আমাকে করতে হবে দুটো হাতের সাহায্যেই। সেই থেকে হাত আমার পরম বিশ্বস্ত বন্ধু! 

    যখন কেউ আমাদের স্পর্শ করে, যদি সে আমার পূর্বপরিচিত হয়, অর্থাৎ তাকে যদি আমি আগে বহুবার ছুঁয়ে থাকি, আমার কিন্তু তাকে চিনে ফেলতে কোনও অসুবিধেই হয় না। শুরুর দিনগুলোয় অন্যান্য অনেক ইঙ্গিতের পাশপাশি আমি ছুঁয়ে-ছুঁয়ে মানুষ মুখস্থ করার কাজটা করতাম। কার হাতের নখ বড়, কার হাত মসৃণ, কে হাতে আংটি পরে— এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের স্মৃতি হাতের তালুতে বয়ে নিয়ে বেড়াতাম। আজও যেমন বেড়াই! যারা আমাদের ধরছে, তারা হয়তো বুঝতে পারে না, কিন্তু প্রত্যেকের ছোঁয়ার মধ্যে তাদের এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য আছে। আমরা সেটা টের পাই। সেই সঙ্গে আরও একটা জিনিস আমরা বুঝতে পারি— ভাল স্পর্শ এবং খারাপ স্পর্শ। আমরা এই যে রাস্তায় বের হই, সেও তো মানুষের ভরসাতেই বের হওয়া! চক্ষুষ্মানরা আমাদের রাস্তা পার করালেও, তাদের চোখের ভাষা কী আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু সে যখন আমাদের ধরছে, ওই ধরা দেখে আমরা বুঝতে পারি, হয়তো আজ তার মনটা বিক্ষিপ্ত; বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে কিংবা অন্য কিছু। আমাদের হাত এই তথ্যটা আমাদের জানায়। তখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, এই হাত ধরে রাস্তা পার হব কি না। যেখানে সেই মানুষটা নিজেই বিভ্রান্ত, সেখানে তার ওপরে কি ভরসা করা যায়? হাতের ওপর হাত রাখা, অনেক সময়ই হয়তো ততটা সহজ হয়ে ওঠে না! যদিও অসহায়তায়, অভাবে, বহুবার সেসব হাত ধরে ফেলি। এমনও হয়েছে, মাঝরাস্তায় লোকে ‘একটু দাঁড়ান এখানটায়’ বলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ফিরে আসেনি আর। 

    স্কুলে যখন ভর্তি হই, সেখানে আমি আমার মতোই আরও অনেক দৃষ্টিহীন সঙ্গী পেলাম এবং সেইখানে আমরা প্রত্যেকেই ছোঁয়ার ব্যাপারে আরও একটু জড়তামুক্ত হলাম। স্পর্শগুলো আরও প্রখর হল আমাদের। নিজেদের মধ্যে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে তৈরি হল কথা বলার ভাষা। একজন সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারবে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমরা দৃষ্টিহীনরা কীভাবে কথা বলে যেতে পারি, শুধু ছুঁয়ে থেকে। এখন থিয়েটার করার সুবাদেও দেখি, ‘টাচ থেরাপি’-কে নিয়ে কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। নৈঃশব্দের ভেতর থেকেও যে অনবরত কথার স্রোত চলে, তা এক শরীর থেকে অন্য শরীরে চালনা করা যায়। আমার বিশ্বাস, মন তাতে আরামও পায় খানিক।

    ‘আমি বলছি, তুই লেখ’— এইটা বলা মানেই লেখকের ওই আড়ালটা কোথাও চলে গেল। পাতার পর পাতা পাঞ্চ করে যেতে আমাদের কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু যদি অন্য কাউকে দিয়ে নিজের কবিতা লেখাই বা গল্প লেখাই, কষ্ট কিছু কম হবে বলে মনে তো হয় না!

    স্কুলে যে পড়াশোনার পদ্ধতি দেখলাম, অর্থাৎ যে-মাধ্যমে পড়ানো হয়, তা হল ব্রেইল পদ্ধতি। এই ব্রেইল আবিষ্কার করেছিলেন, লুই ব্রেইল (১৮০৯-১৮৫২), যাঁর নামানুসারে এই পদ্ধতির নাম। তিনি নিজেও একজন দৃষ্টিহীন ছিলেন। শোনা যায়, নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনীতে নাকি ১২টা বিন্দু দিয়ে ‘নাইট রাইটিং’ বা ‘রাতের লেখা’ বলে এক ধরনের লেখার চল ছিল, যেখানে অন্ধকারে সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় তাঁদের কথার আদান-প্রদান করতেন। লুই ব্রেইল এখান থেকেই তাঁর ওই লিখনপদ্ধতির জন্ম দিয়েছিলেন। ছোট্ট একটা তফাত ছিল কেবল, উনি ১২টা বিন্দুর জায়গায় করলেন ৬টা বিন্দু। কেন তিনি বিন্দুগুলো কমালেন? কমালেন তার একটাই কারণ, আমরা তর্জনীর যে উপরিভাগ দিয়ে স্পর্শ করে-করে পড়ি, তাতে ১২টা বিন্দু একেবারে ধরা সম্ভব না। তাই তিনি বিন্দুসংখ্যা কমান। আর নকশা-বৈচিত্র তৈরি করে-করে এক-একটা অক্ষরের ধারণা দেন। আমরাও যখন লেখাপড়া করেছি, ওই আঙুলের ডগা দিয়েই বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্বসাহিত্যের নানা গলি-গলতায় ঢুকে পড়েছি। আহ্লাদিত হয়েছি। তবে অসুবিধা একটাই; ব্রেইল প্রেসের অভাবে সব বই যেহেতু পাওয়া যায় না, তাই এখন আমরা অনেকেই অডিও-বুক শুনি। কিন্তু নিজের লেখালিখি? সেক্ষেত্রে ব্রেইল পদ্ধতিই একমাত্র আশ্রয়। আমি নিজে যখন কবিতা লিখি, নাটক লিখি, তখন ব্রেইলেই লিখি। কেননা যে-কোনও লেখকই লেখার মুহূর্তে সম্পূর্ণ একা থাকতে পছন্দ করেন। ‘আমি বলছি, তুই লেখ’— এইটা বলা মানেই লেখকের ওই আড়ালটা কোথাও চলে গেল। পাতার পর পাতা পাঞ্চ করে যেতে আমাদের কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু যদি অন্য কাউকে দিয়ে নিজের কবিতা লেখাই বা গল্প লেখাই, কষ্ট কিছু কম হবে বলে মনে তো হয় না!

    আমাদের জীবনে আয়নার কোনও ধারণা নেই। হাতই আমাদের কাছে আয়না। তালুতে অত কিছু না হলেও, আঙুল কিন্তু ব্রেইল থেকে শুরু করে মানুষের মন পর্যন্ত পড়ে নিতে পারে। তবে এমনও অনেকের দেখেছি, কোনও নির্দিষ্ট কারণে স্পর্শবোধ যদি হাতে না তৈরি হয়ে থাকে বা কিছুটা দেরিতে তৈরি হয়, তখন তারা আর পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারে না। আমারই অনেক ছোটবেলার বন্ধুরা আজ যেমন এই করে হারিয়ে গেছে। হাত এক্ষেত্রে তাদের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। যেমন অনেক সময়ই বন্ধু হয় না অন্যের হাত। ধরা যাক, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিতে গেছি একজন অন্য মানুষকে সঙ্গে করে, যিনি আমার হয়ে লেখাটা লিখে দেবেন। কিন্তু তাঁর হাতের লেখা ভাল কি না আমি তো জানি না, কিংবা সে নিজের মতো করে কিছু বাদ দিয়ে যাচ্ছে কি না সেসবও জানি না! এরকমও হয়, আমার জানা উত্তর সত্ত্বেও শুধু তাঁর গতি কম বলে উত্তরটা লেখা হয় না। এই আক্ষেপ আমাদের থাকে। অন্যের হাত তখন আমাদের শত্রু। 

    এখন যখন আমার ন-বছরের ছেলের হাত ধরে নতুন করে এদিক-ওদিক যাই, ওর চোখ দিয়ে দুনিয়াটাকে চেনার চেষ্টা করি, হাতের মুঠোটা শক্ত হয়ে আসে। ছেলের মুখ তো দেখতে পাই না, শুধু টের পাই, ও আরও আঁকড়ে ধরছে আমায়। দুটো হাতের বন্ধুত্বে, মাথার ওপরের আকাশটা বড় হতে থাকে তখন।          

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook