ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং : পর্ব ৫৯


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (August 23, 2024)
     

    বেনোজল হইতে সাবধান

    আন্দোলন, সে যেমনই হোক, বেনোজল ঢুকবেই। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের সময়েও ঢুকেছিল, ৩০১৭ সালে ‘রোবট-মানুষ অসবর্ণ বিবাহ মানতে হবে মানতে হবে’ বিদ্রোহেও ঢুকবে। স্বৈরাচারীর পতনের পর কিছু লোক তার বাড়ি থেকে এসি গেঁড়িয়ে দেবে, কিছু লোক বিপ্লবের সুযোগে টিভির দোকান থেকে ৫৫ ইঞ্চি বেছে চুরি করবে। এ-বছরের ১৪ অগাস্ট রাত্রে বাংলাজুড়ে ঐতিহাসিক জনসমাবেশে— যেখানে একটা ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে অরাজনৈতিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত সংখ্যক মানুষ সমবেত হলেন যে পুলিশ পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গেল— সেখানেও কিছু লোক এসেছিল সেরেফ মজা চাখতে, তারা নারীমুক্তি ব্যাপারটাকে তামাশা-ভাণ্ড ছাড়া কিছু ভাবে না। মিছিলের দাবি ছিল দোষীদের অবিলম্বে শাস্তি দেওয়ার, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। নিশ্চয় তার সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা ও নারীর সার্বিক সম্মান বৃদ্ধির দাবিও মেশানো ছিল। কিন্তু অনেকেই এসেছিলেন সরকারের ওপর প্রকাণ্ড রাগ উগরে দিতে। এবং অবশ্যই, এই ঘটনা আরও অনেক অনাচারের স্মৃতি উসকে দিয়েছে, তার মধ্যে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে ধর্ষিতাকে মিথ্যাবাদী চিহ্নিত করা থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাড়িতে ডাঁই করা টাকার পাহাড়ের চিত্র অবধি সবই রয়েছে, শাসকদের যতটা আন্দাজ সাধারণের স্মৃতি তার চেয়ে কিছু বেশিই বিস্তৃত। বহু দোষীকে প্রশ্রয় দেওয়া-পোষণ করা-তোষণ করার অভিযোগ এই সরকারের বিরুদ্ধে আছে, আর সরকার ভোটে জেতার ফলে অন্ধ হয়ে ভাবতেও পারেনি, এতখানি রাগ তলে-তলে সাধারণ মানুষের মনে জমা হয়ে ছিল। কিন্তু তা বলে মূলত নারীর সম্মান রক্ষার্থে যে-আন্দোলন, তাতে যখন টাইট-জামা-পরা নারীর প্রতি দেঁতো-টিটকিরি-গজানো মানুষ যোগ দেয়, তখন ধন্দ লাগে। এটা ছিল মূলত মেয়েদের মিছিল। মেয়েদের দ্বারা আয়োজিত, মেয়েদের জন্য, মেয়েদের মুক্তির বিষয়ে। সেজন্য অনেকে ভেবেছিল, এটা মেয়ে দেখার চমৎকার জায়গা, চোরাগোপ্তা ভাবে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ারও সুযোগ থাকবে, বাইক নিয়ে এক-আধজনকে কোণঠাসা করা গেলেও মন্দ হবে না। তারা কখনও সফল হয়েছে, কখনও ধোলাই খেয়েছে। নিশ্চয়ই এরা সংখ্যায় খুব বেশি নয়, বেশিরভাগ লোক বরং এসেছিলেন সচেতনতার আঁচ পোয়াতেই। এতেও সন্দেহ নেই, কিছু ভেজাল ঢুকে পড়েছে বলে একটা তীব্র গনগনে আন্দোলন ভ্রষ্ট হয়ে যায় না, তার আবেদন ও অবদান এতটুকু কমে না। কিন্তু এই সত্যটা না-ভোলা দরকার, এই আন্দোলনে অনেক লোক আছে, যারা শুধু খার ও প্রতিহিংসা বমন করছে, আদত ব্যাপারটায় যারা একমত নয়। শহরের রাস্তায় মেয়েরা হুল্লোড় মচাতে-মচাতে রাত তিনটেয় হাঁটলে যারা মনে করবে, সমাজ পরিপূর্ণ গোল্লায় গেছে।

    নৈতিক ঠিকতা তো সহজ ব্যাপার নয়, মিছিলের অনেকেই ক্যামেরার সামনে বললেন, যদি পুলিশ দোষীকে শাস্তি দিতে না পারে, পাবলিকের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক, আমরা দেখে নেব। কেউ বলছেন, ফাঁসি দিলে হবে না, আরও কষ্ট দিয়ে মারা হোক। নিকৃষ্টতম অপরাধীরও যে মানবাধিকার আছে এবং বিচারের সময়ে তা মাথায় রাখতে হবে, তা এঁদের বোধের অন্তর্গত নয়। অবশ্যই চারটে শুকনো পণ্ডিত দিয়ে আন্দোলন চলে না, কিন্তু গুচ্ছ গণধোলাইকামী মানুষ হা-রে-রে রবে নেমে পড়লে, আদত সমস্যাটা একেবারে এড়িয়ে গিয়ে শুধু চারটে লোকের বিরুদ্ধে লাগামহীন খিস্তি দেওয়ার আনন্দে ভেসে গেলে, একটু মুশকিল ঘটে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে প্রতিটি মিছিল মুখরিত, কারও হাতে মশাল ও কারও হাতে বাড়িতে লেখা আঁকাবাঁকা প্ল্যাকার্ড দেখে গণপ্লাবনের স্বভাবপ্রেরণার আভাস পাওয়া যায়, কিন্তু জাস্টিস এ-কথাও বলে: যে-লোক এখনও তদন্তকারী সংস্থার দ্বারা দোষী ঘোষিত হয়নি, সে যত জঘন্য লোক হোক, তাকে তুমি ইতিমধ্যেই নিশ্চিত দোষী ঠাউরে মাইকের সামনে কথা বলতে পারো না। কিন্তু সাধারণ মানুষের এত বোঝাবুঝির দায় নেই, তাই সে নিজ সন্দেহকে একেবারে প্রতিষ্ঠিত সত্য ভাবতে ও বলতে অনর্গল। তার ফ্যান্টাসির দোসর বেপরোয়া বুলডোজার, যা অভিযুক্তের ভিটেমাটি উপড়ে দেবে, কিংবা ভোরের দিকে এনকাউন্টার, যেখানে পুলিশ পিছমোড়া বাঁধা কয়েদিকে বলবে ‘পালা’, আর পিঠে পিস্তল তাক করবে।

    এ-বছরের ১৪ অগাস্ট রাত্রে বাংলাজুড়ে ঐতিহাসিক জনসমাবেশে— যেখানে একটা ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে অরাজনৈতিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত সংখ্যক মানুষ সমবেত হলেন যে পুলিশ পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গেল— সেখানেও কিছু লোক এসেছিল সেরেফ মজা চাখতে, তারা নারীমুক্তি ব্যাপারটাকে তামাশা-ভাণ্ড ছাড়া কিছু ভাবে না।

    অনেকেই এখন বলছে, দফায়-দফায় যে-মিছিলগুলো বেরোচ্ছে, তার অনেকগুলোয় এমন লোককে দেখা যাচ্ছে, যারা নিজেরা মেয়েদের নিগ্রহকারী হিসেবে চিহ্নিত, বা অভিযুক্ত। অভিযুক্ত হলেই দোষী— তার অর্থ নেই, যতক্ষণ না দোষ প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ অবধি তাকে নির্দোষ ধরতে হবে। কিন্তু যে-লোকটা আগেই নিগ্রহকারী হিসেবে চিহ্নিত, সেই লোকটা আজকে হঠাৎ নারী-নিগ্রহের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে ক্যামেরার সামনে যদি মিছিলে হাঁটে, বিসদৃশ লাগে বইকি। সে অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থনে বলতেই পারে: আমি অধুনা সংশোধিত, বুঝেছি যে নারীদের নিগ্রহ করা উচিত নয়, সেই জন্য নূতন সংস্কৃত হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ হিসেবে মিছিলে এসেছি। কিন্তু যে-মেয়েরা (বা ছেলেরা) তাকে নিগ্রহকারী হিসেবে চিনেছে, যে-মেয়েরা নিগৃহীতা হয়েছে, তারা কোন প্রাণে তার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবে? তাদের ঘৃণা তো তাদের সপাট ঘুসি মেরে বলবে, পালাও! কারণ নিগ্রহকারীর এই আত্মশোধনের গাওনা তো খুব সম্ভব ভণ্ড, ধৃষ্ট। ঝামেলা হচ্ছে, মিছিলে তো গেট নেই, গেট-পাসও নেই। তাই যে-পুরুষ সংগীত-পরিচালক গায়িকাদের ভোগ করে তবেই সুযোগ দিয়েছে, যে-পুরুষ চলচ্চিত্র-প্রযোজক ছবিতে নামা নতুন নায়িকাকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে যেন এই ধর্ষণ চুক্তির আবশ্যিক অঙ্গ, তারাও বুক ফুলিয়ে ধর্ষণবিরোধী মিছিলে সুবিচার চাইতে পারে। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মিছিলে হাঁটতে-হাঁটতে হয়তো আপনি চমকে খেয়াল করলেন, মুসলিম-পেটানো মস্তান পেশি উঁচিয়ে শামিল। তখন আপনার গলা দিয়ে দৃপ্ত স্লোগানের শেষাংশের সঙ্গে একটা তিরিক্ষি তেতো স্বাদ নেমে যাবে না?

    কিছু লোক আবার মিছিলে এমন স্লোগান তুলছেন, যা আদতে নারীবিরোধী, কিন্তু সেই জ্ঞান তাঁদের নেই। পুলিশ থানা ঘেরাও করে তাঁরা বলছেন (এবং তাঁদের মধ্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ উৎসাহ ও উল্লাস সাংঘাতিক): ‘পুলিশ তুমি চুড়ি পরো!’ ‘পুলিশ তুমি শাঁখা পরো, সিঁদুর পরো!’ যার মানে হচ্ছে, অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তোমার রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই, তুমি শিরদাঁড়া বিকিয়ে সরকারের পদলেহন করে চলেছ। আরজি কর-এ নিষ্ক্রিয় হয়ে দেখছ দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব করছে, যুবভারতীর সামনে প্রভুর আদেশে নিরীহ ফুটবল-সমর্থকদের লাঠিপেটা করছ। সোজা কথা, তুমি অপদার্থ, মিনমিনে। এখানে নারীদের যে চূড়ান্ত অপমান করা হল, যারা চুড়ি-শাঁখা-সিঁদুর পরে তাদের দ্বারা কিস্যু হয় না এই কথাই যে আপ্তবাক্যের মর্যাদা পেল, তা এই স্লোগানুয়ারা বুঝতে অবধি পারলেন না, কারণ তাঁরা তো এমনিতে নিত্যদিন হুবহু এই থিমেই বেজে ওঠেন, যে-কোনও নতমাথা ভীরু পালিয়ে-বাঁচা মানুষকে তাঁরা তো নারী (নির্বীর্য) বলেই বিদ্রুপ করেন, আজ একটা মিছিলে এসেছেন বলে তো এত সহস্র দিনরাত্রির মনোভঙ্গি হুট-ন্যাকড়ায় মুছে যাবে না। যে-আন্দোলন নারীর শক্তি বুঝে নেওয়ার, নারীর শক্তি আছে বুঝিয়ে দেওয়ার, নারীশক্তিকে আরও বৃদ্ধি করার আন্দোলন, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি যদি নারীকে সর্বাধিক শক্তিহীন-ক্ষমতাহীন-মেরুদণ্ডহীন প্রাণী ঘোষণা করি, তাহলে পুলিশ বা সরকারের চেয়ে বেশি নারীকেই আছড়ে অপমান করলাম— তা বোঝার মগজহীন লোকেরা পেল্লায় ডেসিবেলে বিদ্রোহ বিবৃত করতে করতে চলেছেন। হুতোম থাকলে এঁদের মধ্যে থেকে সঙ খুঁজে নিতেন, আন্দাজ।

    এখন মিছিলে যাওয়া প্রায় একটা বাধ্যতা হয়ে গেছে (নইলে ফেসবুকে মুখ দেখানো যাবে না), তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্রোধ প্রকাশের উপায় হিসেবেও প্রকৃষ্ট, কারণ এ-পরিস্থিতিতে সত্যি-সত্যি প্রশাসনিক প্রহারের ভয় নেই, ফিরতি-থাবড়ার সম্ভাবনা নেই, দিব্যি নিরাপদে নিজেকে বিপ্লবী ঠাউরে নেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আদতে পুংতন্ত্রের যে-জগদ্দল শিলাশ্লোক উপড়ে ফেলতে এই উদ্দাম ধাক্কা— তারই সমর্থক পিলপিলে ধারণা ও আবেগওয়ালা লোকেরা যদি হুড়িয়ে ঢুকে পড়ে, যাদের মধ্যে শিক্ষা-বোধ-নীতির ভয়াবহ অভাব এবং আত্মসমীক্ষার কণামাত্র নেই তারা যদি শুধু বিষোদ্গারের আমোদে মেলা দেখতে আসে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধ স্বনাশী হতে পারে। এ শুধু নারীদের নয়, (অত্যন্ত জাগ্রত নারীদের উদ্যোগেই) অন্য বহু প্রান্তিক মানুষেরও সংগ্রাম, যাঁদের যৌন পছন্দ বা আত্মপ্রকাশের ধরনকে সমাজ লাগাতার মুখ ভেংচায়। সেইজন্যই, যারা হিজড়ে দেখলেই মুখচাপা দিয়ে খ্যালখ্যাল হাসতে আরম্ভ করে, মেয়েলি ধরনের হাত-নাড়া ছেলে দেখলেই ‘ছক্কা’ টিপ্পনি কেটে ঢিল ছোড়ে, তারা এই আন্দোলনে ঢুকে নিশ্চয় সংখ্যা বাড়াতে পারে, গতি ও গুরুত্ব বাড়াবে কি না, ভেবে দেখার। ভুললে চলবে না, এ সেই রাজ্য, যেখানে বছর-কয়েক আগে একজন মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে তার ছেলেবন্ধুর সঙ্গে হাঁটছিল বলে বেপাড়ার পুরুষদের হাতে মার খেয়েছিল। এখনও যেখানে লেক বা পার্কে যুগলরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলে মস্তান গোছের তিন-চারটে লোক গিয়ে গালাগাল উগরে খেদিয়ে দেয়। যেখানে ধর্ষণ-বিরোধীরা সরকারপক্ষের নারী-উকিলদের ধর্ষণের হুমকি দেয়। তাই নারীর বা অন্য যে-কোনও মানুষের একেবারে নিজস্ব ধরনে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকার ও কাজ করার স্বাধীনতা আদায়ের যে-গণবিক্ষোভ— সেখানে যাঁরা সমর্পিত হয়ে হাঁটছেন, তাঁদের সতর্ক হয়ে চারপাশটা ক্রমাগত দেখেও নিতে হবে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook