১৭১৫ সালের মার্চ মাসের এক সকালবেলায় লন্ডন শহরের সালিসবারি কোর্টের কাছে ফ্লিট স্ট্রিটের একটা দোকানে বেজায় ভিড়। সে কোনও কচুরি, সিঙাড়া কি হট-কেকের দোকান নয় যে সক্কাল-সক্কাল লোকে অমন লাইন লাগাবে। তাও আবার হেঁজিপেঁজি লোকজন নয় সব। যাঁদের বলে লন্ডনের শিক্ষিত সম্প্রদায়, তাঁরাই ঠেলাঠেলি করছে দাঁড়িয়ে। তরুণ বৈজ্ঞানিক থেকে গুঁফো গল্পকার, সকলকেই দেখা যাচ্ছে। এমনকী স্বয়ং সম্রাটের সভাসদদের দু-একজনকেও দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারখানা কী?
এই দোকানের নাম ‘দ্য গ্লোব’। মালিকের নাম জন সেনেক্স— বিখ্যাত কার্টোগ্রাফার, মানে মানচিত্রবিশারদ। আগের বছরই গোটা একটা ইংরেজি অ্যাটলাস প্রকাশ করে হইচই ফেলেছিলেন ইংল্যান্ডে। সদ্যপ্রয়াত রানি অ্যানের ব্যক্তিগত পরিসরে তাঁর আসা-যাওয়া ছিল। সেই সেনেক্স সাহেব আজ এমন এক আশ্চর্য জিনিস এনেছেন যে, তা নেওয়ার জন্যই এই হুড়োহুড়ি। একখানা কাগজের উপর ইংল্যান্ডের মানচিত্র। তবে শুধু মানচিত্রই নেই; নীচ থেকে উপরদিকে কোনাকুনি ভাবে তাতে রয়েছে একটা মোটা ধূসর দাগ। ঠিক মধ্যিখানে, যেখানে লন্ডন, তার উপরে কিছুটা জায়গা আবার একটা উপবৃত্তাকার অংশে গাঢ় কালচে রং করা। ম্যাপের নীচের অংশ জুড়ে আবার কী সমস্ত হিজিবিজি লেখা রয়েছে। আর সবশেষে ম্যাপ নির্মাতার নাম লেখা বড়-বড় হরফে— এডমন্ড হ্যালি।
হ্যালিকে আমরা কমবেশি সকলেই চিনি। তাঁর নামাঙ্কিত ধূমকেতুর দৌলতে। উপরে যে ‘ইংলিশ মর্নিং’-এর কথা বলছিলাম, তার বছর দশেক আগেই সেই বিখ্যাত ধূমকেতুর গতিপথ বের করে ফেলেছেন আঁক কষে। আর তারও অনেক বছর আগে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে (যেখানে আর ঠিক একশো বছর পর নির্বাসিত হবেন সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট), এক ঘাঁটি গেড়ে দূরবিনে চোখ লাগিয়ে আর বড়-বড় অঙ্ক কষে, খাতার পাতা ভরিয়ে বের করেছেন সূর্যের চারদিকে মঙ্গলের গতিপথ। অতএব, এডমন্ড হ্যালি যে একজন নিতান্ত ম্যাপ আঁকিয়ে তা বলা যায় না। আর সেইজন্যই শহরের গণ্যমান্যের দল সেই আজব ম্যাপ হাতে পাওয়ার জন্য লাইন লাগিয়েছেন সক্কাল-সক্কাল।
কিন্তু ইংল্যান্ডের উপর ওই কালো ছায়া কীসের? কেনই বা হ্যালি সাধ করে কালিমালিপ্ত করতে যাবেন তাঁর দেশকে?
মানচিত্রের উপরে লেখা রয়েছে দুটো লাইন— A description of the passage of the shadow of the moon, over England, in the total eclipse of the sun, on the 22nd day of April 1715 in the morning.
আর নীচে যে-কথাগুলো লেখা রয়েছে, সেগুলোর বাংলা তরজমা করলে কতকটা এরকম দাঁড়ায়:
সূর্যগ্রহণ বিষয়টা নিয়ে মানুষের মনের অন্ধকার দূর করার জন্য দু-কথা বলা অনুচিত হবে না বলেই মনে করলাম। দিনমানে হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে, রাতের আকাশের মতো তারা ফুটে উঠবে— এমন অশৈলী ব্যাপারস্যাপার যে আসলে আমাদের নতুন সম্রাট মহামতি জর্জের উপর শয়তানের কালোছায়ার একটা রূপ— তা আপনাদের মনে আসা খুবই স্বাভাবিক। তাই আগে থেকে বলে রাখি, এ একেবারেই প্রাকৃতিক একটা ঘটনা। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে চাঁদ এসে সূর্যকে আড়াল করে দিয়ে এমন কাণ্ডখানা ঘটিয়ে থাকে। অতএব মাভৈঃ…
এরপর হ্যালি এ-ও লিখে দিয়েছেন যে, ২২ এপ্রিল সকাল ন-টা পাঁচ মিনিট থেকে এগারো মিনিট ধরে চলবে এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। আর ওই যে ধূসর দাগ আঁকা, ওই অঞ্চল বরাবর এই গ্রহণ দেখা যাবে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে মানুষ সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণকে শয়তানের কারসাজি মনে করত, সেই সময়ে একজন আগে থেকেই বলে দিচ্ছেন যে, কবে-কোথায়-কখন গ্রহণ হবে; আর শুধু তা-ই নয়, তার একখানা আস্ত মানচিত্রও প্রকাশ করে দিচ্ছেন; সুতরাং তা হস্তগত করার জন্য অমন লাইন পড়বে নাই-বা কেন? শুধু তা-ই নয়, ঘটনাক্রমে, সে-বছরই ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে ঘটে গেছে বেশ কিছুটা রদবদল। রানি অ্যানের মৃত্যু ঘটেছে বেশ কয়েক মাস আগে। তার কিছু বছর আগে ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ড মিলিত হয়ে জন্ম হয়েছে দ্য গ্রেট ব্রিটেনের। অ্যানে ছিলেন এই যুক্তরাজ্যের প্রথম রানি। তাঁর মৃত্যুর পর কে বসবেন সিংহাসনে, সেই নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই নতুন যুক্তরাজ্য পরিকাঠামোতে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব। হুইগ এবং টোরি দলের মধ্যে মতবিরোধ ছিলই এ-নিয়ে— তার সঙ্গে যুক্ত হয় স্কটল্যান্ডের স্বার্থ; তাদের বাণিজ্যপথের উপর ইংল্যান্ডের দাদাগিরি নিয়ে ক্ষোভ ইত্যাদি… অতএব রাজনৈতিক অবস্থা ছিল যাকে বলে ‘পুঁদিচ্চেরি’। এহেন অবস্থায় হ্যানোভারের জর্জ যখন টোরিদের সমর্থনে রাজা হলেন, বিরোধীরা জনগণের কাছে নানারকম বিরুদ্ধপ্রচার চালাতে লাগলেন রাজার নামে। এমতাবস্থায় যদি অমন দিনের বেলায় সূর্য মুখ ঢাকে, জনগণের মনে ব্রিটিশ সূর্যের অবস্থা নিয়ে ওঠা সংশয় একটা পাকাপাকি জায়গা তৈরি করে নিতে পারা অসম্ভব কিছু নয়! অতএব, হ্যালির এই মানচিত্র দেখে রাজাও যে বেশ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন, তা বলাই বাহুল্য।
সূর্যগ্রহণ নিয়ে কৌতূহল মানুষের মনে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মধ্যে তা একটা অজানা ভয়ের জন্ম দিত বটে, কিন্তু বেপরোয়া কিছু মানুষ সমস্ত যুগেই থাকেন। যে-ঘটনার ব্যাখ্যা নেই, তাঁরা তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার জন্য প্রাণ অবধি বিসর্জন দিতে পিছপা হন না। অতএব, সূর্যগ্রহণের মতো এমন একটা ‘মেগা ইভেন্ট’-এর কারণ অনুসন্ধান যে হ্যালির অনেক আগে থেকেই অনেকে করে গেছেন সেটা বলা বাহুল্য। সেই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার সময় থেকে এ-নিয়ে নানাবিধ চর্চা চলেছে। কিন্তু সমস্যা ছিল সঠিক গণনার। অষ্টাদশ শতকে বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অনেক দূর। যে-সময়ে হ্যালি তাঁর গবেষণা চালাচ্ছেন, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের তথা ইউরোপের আকাশে তারকার ছড়াছড়ি। জোহান কেপলার আগেই দিয়ে গেছেন গ্রহ-উপগ্রহের গতিপথ সংক্রান্ত ধারণা। স্বয়ং আইজাক নিউটন প্রকাশ করে ফেলেছেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা’, সেখানে বলবিজ্ঞানকে বেঁধে ফেলেছেন গাণিতিক সূত্রে। আবিষ্কার করে ফেলেছেন মহাকর্ষের সূত্র, যা কিনা গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল বস্তুর ক্ষেত্রে অভিন্ন। জটিল গতিবিজ্ঞানের হিসাবের সুবিধার জন্য তৈরি করেছেন গণিতের নতুন এক ধারার— যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ফ্লাক্সিঅন। একই সময়ে জার্মান দার্শনিক তথা বৈজ্ঞানিক গটফ্রেইড উইলহেলম লিবনিজও অনুরূপ এক পদ্ধতি বের করে তার নাম দিয়েছেন ক্যালকুলাস। এই নিয়ে এই দুই মহান বৈজ্ঞানিকের মধ্যে যে একটা প্রবল দ্বন্দ্ব হয়েছিল, তা এক আলাদা কাহিনি। এ ছাড়াও, ইংল্যান্ডের বুকে আর এক মহান বৈজ্ঞানিক তথা নিউটনের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রবার্ট হুক। গুজব আছে, রবার্ট হুকের একমাত্র তৈলচিত্র নাকি তাঁর মৃত্যুর পর নিউটন হাপিশ করে দেন; জনগণের মন থেকে হুককে ‘আনহুক’ করে দেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কি না জানি না। কিন্তু তাঁদের মধ্যেকার গন্ডগোলও সর্বজনবিদিত। সে যাই হোক না কেন, মোদ্দা কথা হল, এডমন্ড হ্যালি যে-সময়ে এই সূর্যগ্রহণের দিনক্ষণ নিরূপণ করার হিসাব করার জন্য খাতা খুলেছেন, সে-সময়ে নানাবিধ ‘এক-সে-বঢ়-কর-এক’ বিজ্ঞানীরা নিজ-নিজ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সব আবিষ্কার করে ফেলেছেন, বা করে চলেছেন। অতএব প্রাচীন যুগের পর্যবেক্ষণনির্ভর বিজ্ঞানের থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বনির্ভর বিজ্ঞান যে হ্যালির গণনাকে আরও সূক্ষ্মতর করে তুলবে তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু হ্যালির হিসাবেও রয়ে গেছিল অল্প গোলমাল।
এই মানচিত্র প্রকাশ করার পর হ্যালি উৎসাহী মানুষজনকে বলেছিলেন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গা থেকে এই গ্রহণের সময় এবং স্থায়িত্ব কতক্ষণ তার তথ্য নথিবদ্ধ করতে। গ্রহণ শেষে সেসব মিলিয়ে দেখা গেল, হ্যালির মানচিত্রের থেকে সূর্যগ্রহণের প্রকৃত গতিপথ সরে গেছে প্রায় কুড়ি মাইল। আর স্থায়িত্বর হিসাবে চার মিনিটের গরমিল।
হ্যালি যখন নিউটনের তত্ত্বের উপর নির্ভর করে গ্রহণের গতিপথ অনুমান করছেন, তখন এই একই কাজ করছিলেন আরেক বৈজ্ঞানিক জন ফ্ল্যামস্টিড। ফ্ল্যামস্টিড নিউটনের গতিতত্ত্বকে অবশ্য ব্যবহার করেননি। বরং নিজস্ব কিছু তত্ত্বের ভিত্তিতে চাঁদের গতিপথ নিরূপণ করার একটা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। নিউটনের প্রবল প্রতিপত্তির ঠেলায় ফ্ল্যামস্টিডের তত্ত্ব কোণঠাসা হয়ে গেলেও, ইংল্যান্ডের ওল্ড রয়্যাল ন্যাভাল কলেজের হলের ছাদে এখনও ফ্ল্যামস্টিডের ছবি বর্তমান। হাতে একটা কাগজ, তাতে লেখা ২২ এপ্রিল ১৭১৫; সঙ্গে গ্রহণলাগা সূর্যের একখানা ছবি। ন্যাভাল কলেজের ছাদে এই ছবিটা আঁকা হয় ১৭১৪ সালে। অতএব ফ্ল্যামস্টিডের তত্ত্বও যে সূর্যগ্রহণের দিনটা অন্তত ভুল অনুমান করেনি, সেটা বোঝা যায়। যদিও সময় বা স্থান নিয়ে তাঁর কিছু অনুমান ছিল কি না, সেটা সঠিক জানা যায় না— প্রতাপান্বিত বৈজ্ঞানিককুল সেসব প্রকাশ্যে আনতেই দেননি। কিন্তু ফ্ল্যামস্টিডের তত্ত্বে নিউটনের গতিতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে বৈজ্ঞানিক উইলিয়াম হুইস্টোন সূর্যগ্রহণের আরেকটা ম্যাপ তৈরি করেন। এবং হ্যালির মানচিত্রের সঙ্গে-সঙ্গে সেটাও জন সেনেক্স প্রকাশ করেছিলেন। হুইস্টোনের মানচিত্রর সঙ্গে হ্যালির মানচিত্রের পার্থক্য এটাই ছিল যে, হ্যালি চেষ্টা করেছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার, তাই কোনও জটিল বৈজ্ঞানিক শব্দবন্ধ ব্যবহার করেননি। হুইস্টোন অত সাতপাঁচ না ভেবে তাঁর ম্যাপের বর্ণনা করেছিলেন বৈজ্ঞানিকভাবে, টেকনিক্যাল শব্দবন্ধ প্রয়োগের মাধ্যমে। ফলে, হ্যালির ম্যাপের কাছে হুইস্টোন হেরে গেছিলেন জনপ্রিয়তার নিরিখে (সঙ্গে নিউটনের পৃষ্ঠপোষকতাও একটা কারণ বই কী!)। একটা সূর্যগ্রহণের প্রায়ানুমান যে ইংল্যান্ডের রাজনীতি থেকে সমাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে— সেটা বুঝেছিলেন হ্যালি। আর সেইজন্য ২২ এপ্রিলের সেই সূর্যগ্রহণ ফ্ল্যামস্টিড বা হুইস্টোনের না হয়ে নামাঙ্কিতই হয়ে গেছে তাঁর নামে— হ্যালি’স এক্লিপ্স।
পুনশ্চ: ১৭৫২ সালের আগে ইংল্যান্ডে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার মানা হত না— ইংলিশ জীবন চলত পুরনো রোমান ক্যালেন্ডারে। ফলে, আজকের হিসাবে ‘হ্যালি’স এক্লিপ্স’ হয়েছিল ৩ মে— হ্যালি প্রাচীন পঞ্জিকামতে লিখে গেছিলেন ২২ এপ্রিল। এই লেখাতে সেই সময়কার ক্যালেন্ডারের হিসাবই বজায় রাখা হল।