জাফনা, সমাধি, এলটিটিই
৪২ ডিগ্রি গরম, ঠা ঠা রোদ। বলে কিনা জুতো খুলে ঢুকতে হবে। না, কোনও মন্দির-মসজিদ-গির্জার ঠান্ডা পাথরের মেঝে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে না। সামনে গেটের ওপারে বিশাল সমাধিক্ষেত্র। সার-সার সমাধিফলকের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে চওড়া পিচের রাস্তা। সেখান দিয়ে হেঁটে ঘুরতে হবে পুরোটা। এটাই নিয়ম, কারণ এখানে শায়িত আছেন এলটিটিই শহিদেরা। এ এক আশ্চর্য সমাধিক্ষেত্র। জাফনার কোপায় সিমেট্রি। তথাকথিত ‘অটোওয়ালা’র নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলতে হচ্ছে আমাদের। অগত্যা অটোর ভিতর জুতো খুলে নামলাম।মাটি তেতে আছে। পিচের দিকে তাকিয়ে টুপি পরে নিই। পা না হোক, মাথা তো বাঁচুক! ক্যামেরাম্যানের মাথায় তোয়ালে। এরপর শুরু হল হাঁটা। একরকম দেখতে সব সমাধি, যত্ন করে সাজানো, মাঝে মাঝে ফুলের কেয়ারি। জাফনায় সব দ্রষ্টব্যেরই তৈরি, ধ্বংস, পুনর্গঠনের ইতিহাস আছে। এই সমাধিক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। জানা গেল, এই সমাধিক্ষেত্র ১৯৯১ সালে তৈরি; ’৯৫-তে ধ্বংস করে দেয় সেনাবাহিনী, আবার এলটিটিই-র হাতেই ২০০২ সালে এর পুনর্নির্মাণ। মৃতদেরও তবে পুনর্জন্ম হয়!
শায়িত বিদ্রোহীদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন অটোচালক ভদ্রলোক। ক্যামেরাম্যান লেন্সে চোখ রেখে কাজে ডুবে গেছে। কিন্তু আমার পায়ে যেরকম ছ্যাঁকা লাগছে আর পরের অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়ে যেরকম বুক ধুকপুক করছে, তাতে আমি খুব একটা মন দিতে পারছি না ওঁর ধারাবিবরণীতে। তবু জানা গেল, প্রতি বছর ২৭ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার তামিলেরা শহিদ স্মরণে উদযাপন করেন মহাবীরার নাল। যেসব এলটিটিই যোদ্ধা প্রাণ দিয়েছেন ‘হোমল্যান্ড’-এর দাবিতে, তাঁদের জন্য মোমবাতি জ্বালানো হয়; শুধু শ্রীলঙ্কায় নয়, পৃথিবীর নানা দেশে। আর শ্রদ্ধা জানানো হয় ফুল দিয়ে, যার নামটা খটমট। নভেম্বরে ফোটে এই ফুল। পরে দেখেছি নেট সার্চ করে, নাম গ্লোরিওসা সুপার্বা। লিলি জাতীয় এই ফুল একদিকে যেমন বাত থেকে ক্যান্সার, বহু রোগের ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে— অন্যদিকে এই ফুল নাকি বিষাক্ত, মুখে গেলে সর্বনাশ। এমন রহস্যময় ফুলের একটা চমৎকার নাম রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ,‘অগ্নিশিখা’। আগুনরঙা বলেই বোধহয়।
আগুনের ফুল দেখার সৌভাগ্য হয়নি বটে, তবে অগ্নিপথে হেঁটে পায়ে ফোস্কা পড়েছে দেখে আমার চোখে জল এল। এদিকে পুরো সমাধিক্ষেত্রটা নাকি ঘুরতে হবে। খুব বেশি না হলেও আরও কিছু লোক, এমনকী পরিবার নিয়েও, ঘুরছিল। আলতোভাবে একটু উঁচু করে পা ফেলে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম, এরাও তো খালি পায়ে হাঁটছে, কিন্তু কীভাবে? আসলে আবেগ যখন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন এসব গায়ে লাগে না হয়তো। যে-তীব্র বিশ্বাস বুকে নিয়ে সুইসাইড স্কোয়াডে নাম লেখায় আঠেরোর তরুণ-তরুণী, তাতে এই গরম পিচের রাস্তা তো কিছুই না!
আসল জায়গায় যাওয়ার পালা তার পরে। ততক্ষণে জেনে গেছি, প্রভাকরণের দেখা আমরা পাব না। তবে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠতম সহযোদ্ধাদের একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন আমাদের সঙ্গে কথোপকথনের। অটোয় বসে এ-গলি, ও-গলির ভুলভুলাইয়ায় (আমার ধারণা, পথটা অত জটিল ছিল না আসলে, গুলিয়ে দেওয়ার জন্য পাক খাওয়ানো হচ্ছিল) ঘুরতে-ঘুরতে জানলাম, তাঁর নাম ভেলুপিল্লাই কুমারু পঞ্চরত্নম। এলটিটিই-তে জর্জ মাস্টার নামে বেশি পরিচিত। আসলে ইংরেজি ভাল না-জানা প্রভাকরণের অনুবাদকের কাজ করেন ইনি। তাই বিদেশি সাংবাদিক সাক্ষাৎকার চাইলে বেশির ভাগ সময়ে জর্জ মাস্টার তাদের মুখোমুখি হন। ভাবছিলাম, যে-কোনও সন্ত্রাসী সংগঠনের নেটওয়ার্ক কি এরকমই জোরালো হয়? জাফনায় ঢোকার চেকপয়েন্ট থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা আমাদের মতো সাধারণ সাংবাদিকদের একেবারে জালবন্দি করে রাখার নিখুঁত পরিকল্পনা, সুপ্রিমো পর্যন্ত খবর চলে যাওয়া, সাক্ষাৎকারের মঞ্চ সাজানো, এসব কি খেলা কথা!
ভাবতে-ভাবতে বিরাট এক বাড়ির সামনে দাঁড়াল অটো। গাড়িবারান্দার নীচে এ কে ফর্টি সেভেন উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছে এলটিটিই-র পোশাক-পরা রক্ষীরা। এই পরিস্থিতিতে ক্যামেরাম্যান ফিসফিস করে বলল, ‘স্টার্ট পি টু সি (‘পিস টু ক্যামেরা’ অর্থাৎ ক্যামেরার সামনে যে-গৌরচন্দ্রিকা করে তবে আসল খবর বা সাক্ষাৎকারে ঢুকতে হয়) দিতে ভুলো না। এখন দিলেই ভাল, ন্যাচারাল লাইট আছে।’ কী মুশকিল, শুরুর আগেই এসব ভ্যানতারা করলে যদি আসল কাজটা কেঁচে যায়! আবার ভাবলাম, পরে অন্ধকার হয়ে গেলে যদি ছবি ভাল না ওঠে, কিংবা পরে হয়তো এমন পরিস্থিতি হল যে পালাতে পারলে বাঁচি! কিন্তু এরকম সুরক্ষিত একটা জায়গায় না জিজ্ঞেস করে কি ক্যামেরা অন করা উচিত? আপাতত অটোচালক ছাড়া আর তো কারোকে দেখছি না অনুমতি নেওয়ার মতো। ওঁকেই বিষয়টা বুঝিয়ে বললাম। প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। তারপর শর্ত দিলেন, কোনওভাবেই যেন বাড়িটার ছবি না ওঠে। ক্যামেরাম্যান ফ্রেম দেখাল, একদম টাইট, ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা প্রবেশপথ আর থাম ছাড়া কিছুর আভাস নেই। এরপরে হল ভাষা নিয়ে সমস্যা। বাংলায় বলা শুরু করতেই উনি বাধা দিলেন, কী বলবে সেটা আগে ইংরেজিতে জানাও। বেশ, তাই হল। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ক্যামেরার সামনে বলতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে যাচ্ছিল, এমনভাবে বন্দুক তাক করে রয়েছে এলটিটিই ল্যান্ড টাইগার্স।
সেখান থেকে বিদায় নিলেন আমাদের এতক্ষণের গাইড অটোচালক। তবে পরে দেখেছিলাম, বিদায়টা সাময়িক। কারণ আমাদের আরও কিছু দেখানো বাকি ছিল। সে-প্রসঙ্গ পরে। বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন সেনা ইউনিফর্ম পরা টাইগার্সরাই। বিশাল গোল হল, তার চারপাশ ঘিরে ঘর, সবক’টার দরজা পর্দা-ঢাকা। হলে আসবাব নেই, গুনে-গুনে তিনটি চেয়ার ছাড়া। দুটো পাশাপাশি, একটা তার মুখোমুখি। আমাদের বসতে ইঙ্গিত করা হল পাশাপাশি চেয়ারে। অপেক্ষা টেনশনের। প্রতিটি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে এ কে ফর্টি সেভেনের নল। এই হলঘরের দিকেই তাক করা। একটু পরে এলেন জর্জ মাস্টার। মুখটা প্রায় পুরোটাই ঢাকা মাওবাদী স্টাইলে। ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা রেডি করতে যেতেই উনি হাত তুলে বারণ করলেন। কিছু রেকর্ড করা যাবে না। সে কী! আমি মরিয়া বলেই হয়তো গলা থেকে একটু হলেও জোরে কথা বেরোল, ‘তাহলে তো এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে মিডিয়াতে। সবাই বলবে বানানো গল্প।’ জর্জ মাস্টার কী ভাবলেন কে জানে! বললেন, শুধু অডিও রেকর্ড করা যেতে পারে। ঠিক হল, ক্যামেরার লেন্স মেঝের দিকে তাক করা থাকবে, তোলা যাবে না, ওভাবেই সাক্ষাৎকার চলবে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার এখানে লেখার প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয়, ২০০৯ সালে এলটিটিই সুপ্রিমো প্রভাকরণের নাটকীয় মৃত্যুর পর এত বছরে অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে মানুষের আগ্রহ। ১৯৮৩ সালে যে-লড়াই শুরু হয়েছিল ‘তামিল মাতৃভূমি’র দাবিতে, তা থেমেছিল শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর হানায়। দীর্ঘ দু’দশক ধরে গলায় সায়ানাইড ক্যাপসুল ঝুলিয়ে রাখা কাজে লাগেনি প্রভাকরণের, সাঁজোয়া গাড়িতে চেপে পালানোর পথে প্রাণ দিতে হয়েছিল সেনাদের হাতে। পরদিন শ্রীলঙ্কা সরকারকে মিডিয়াতে প্রভাকরণের মৃতদেহের ছবি প্রকাশ করে বিশ্বকে বিশ্বাস করাতে হয়েছিল, টাইগার চিরঘুমে। ঝড় উঠেছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। প্রভাকরণের সঙ্গে আর কার-কার অন্তিমকাল ঘনাল, বউ-ছেলে কীভাবে মারা গেছে, কে-কে পালাতে পেরেছিল বাচ্চার থেকে, কে-কে আত্মসমর্পণ করল— এই আলোচনায় মুখর ছিল টিভির পর্দা থেকে চায়ের দোকান। সেই ২০০৫ সালে মুখ না-দেখা যাওয়া সত্ত্বেও জর্জ মাস্টারের সোজাসাপটা সাক্ষাৎকার যে-টিআরপি দিয়েছিল চ্যানেলকে, এখন পুনঃপ্রচারিত হলে যে তার ধারেকাছে পৌঁছত না, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। যাই হোক, এটুকু বলব, ১৯৯১ সালের রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে আমার প্রশ্ন বেশ উত্তেজিত করে তুলেছিল এলটিটিই নেতাকে। চোদ্দো বছর পরও রাগ কমেনি দেখলাম। কী অপরাধ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর? তিনি ১৯৮৭ সালে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়েছিলেন গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কায়। এই প্রসঙ্গে উঠল ব্ল্যাক টাইগার্সের কথা। যে-কোনও চরমপন্থী গোষ্ঠী যে ‘ক্যাচ দেম ইয়ং’নীতি নিয়ে চলে, অর্থাৎ কমবয়সি ছেলেমেয়েদের ব্রেন ওয়াশ করে তাদের হিংসায় দীক্ষিত করা, এলটিটিই-ও তার ব্যতিক্রম নয়। ষোলো-সতেরো-আঠারোর, বিশেষ করে কিশোরীদের টার্গেট করে দলে টেনে আনা হত, তারা ছিল অকুতোভয় সুইসাইড স্কোয়াড। মনে আছে নিশ্চয়ই, এরকমই একজন মালা পরানোর অছিলায় উড়িয়ে দিয়েছিল রাজীব গান্ধীকে। এরকম মেজর অপারেশনের আগে এই ছোট-ছোট ছেলেমেয়েগুলো কী পেত জানেন? না টাকাপয়সা, না পরিবারের নিরাপত্তা। ‘জয়যাত্রায় যাও’বলার আগে প্রভাকরণ নিজে ব্যক্তিগত ডিনারে ডাকতেন তাদের। সেটাই নাকি ছিল তাদের কাছে ‘স্বপ্নপূরণ’, অধরা দেবতার মুখোমুখি বসে ভোজ। এরকাছে মৃত্যুও তুচ্ছ!
ল্যান্ড টাইগার্স, সি টাইগার্স, অবিকল যে-কোনও দেশের আর্মি-নেভির মতোই আলাদা বাহিনী এলটিটিই-র। আকাশে বিশেষ সুবিধা প্রভাকরণ করতে পারেননি সম্ভবত ফাইটার প্লেন এবং প্রশিক্ষিত বাহিনীর অভাবে। একেবারেই যে পারেননি, তা বলব না, কারণ এর দু’বছর পর কলম্বোতে হাড়-হিম-করা এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল এই প্রতিবেদকের। সেটা পরের এপিসোডের জন্য তোলা থাক। আপাতত সাক্ষাৎকারপর্ব সেরে অটোচালকের প্রত্যাগমন ও তার হাত ধরে মেলায় যাওয়ার গল্প বলি। মেলাই বটে! এলটিটিই বাহিনী সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ দেখে জর্জ মাস্টার বললেন, ‘এলটিটিই-র একটা মেলা হচ্ছে কাছেই। দেখে যেয়ো।’ মেলায় গিয়ে দেখি, বিভিন্ন স্টলে এলটিটিই-র পোশাক-পরা ক্যাডাররা পোস্টার, সিডি, প্রভাকরণের ব্লো আপ, কত কী বিক্রি করছে! পৃথিবীর বহু দেশে নিষিদ্ধ একটা সংগঠনের এরকম খুল্লাম-খুল্লা মেলা জাফনাতেই সম্ভব। এই দ্বীপ প্রভাকরণের খাসতালুক বললে কম বলা হয়। খাতির করে আমাদের সিডি, ক্যালেন্ডার আর প্রভাকরণের পোস্টার উপহার দিল। তামিল ভাষায় লেখা বলে বুঝলাম না। অটোচালক জানালেন, এগুলো ট্রেনিং-এর সিডি, একটা ল্যান্ড আর অন্যটা সি টাইগার্সদের। সেসব দেশে নিয়ে যেতে পারব কিনা, পরে দেখা যাবে। ব্যাগে ভরে হোটেলের পথে পা বাড়ালাম।
পরদিন সকাল হতেই জাফনা ছেড়ে রওনা। আবার সেই একই পদ্ধতিতে এলটিটিই-র ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্ট পেরিয়ে, আসার সময়ের কাগজপত্র জমা দিয়ে, ছবি মিলিয়ে শ্রীলঙ্কা মেনল্যান্ডে ঢোকার ছাড়পত্র। সে-যাত্রায় কলম্বোয় শেষদিনটা নির্বিঘ্নে কাটলেও, ২০০৭ সালে ওই শহরেই মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছিল। সে-গল্প পরের এপিসোডে। ও হ্যাঁ, এলটিটিই-র দেওয়া পোস্টার, সিডি কলকাতা পর্যন্ত আনতে পেরেছিলাম, নির্বিঘ্নে।
ছবি সৌজন্যে : লেখক