ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ: পর্ব ৩৬


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (August 13, 2024)
     

    তরুলতা – তিন

    এরই মধ্যে আবার গর্ভবতী হল তরুলতা; তরুর বাবা তাকে জলপাইগুড়ি নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে এ বাড়িতে চিঠি দিয়েছেন; কিন্তু ওই চিঠির কথা শাশুড়িমায়ের কাছে শোনামাত্র সে আপত্তি জানিয়েছে; তা সত্ত্বেও শ্বশুরমশায় তাঁদের সম্মতি জানিয়ে তরুর বাবাকে জানিয়েছেন যে, তাঁদের কাছে গেলে তরু তো ভাল থাকবেই এবং তাঁরাও নিশ্চিন্ত বোধ করবেন। সবদিক বিবেচনা করে তরু যে চিঠি তার বাবাকে লিখেছে, সেই ইনল্যান্ড লেটারটা সরাসরি ডাকে না দিয়ে, তার শাশুড়িমায়ের হাতে দিয়ে সে বলেছে— ‘বাবা’কে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তবে ডাকে পাঠাতে বলবেন। গিন্নির কাছ থেকে চিঠিখানা পেয়ে, দু-লাইন পড়েই সজল হয়ে এল তরুর শ্বশুরমশায়ের  দু’চোখ; তিনি পড়ে শোনাতে লাগলেন তাঁর গিন্নিকে; তরু লিখেছে,  

    পরমপূজনীয়  বাবা,                                                             ২০ অগাস্ট, ১৯১৬

                                                                                            সোদপুর

    এ-সময়ে জলপাইগুড়ি গিয়ে আপনাদের কাছে আমি থাকলে মায়ের মন যে শান্ত হত, সে কথা আমি ভালই জানি। কিন্তু  এখানকার বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকাই আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। এখানে আমার যত্নের অভাব হবে না। সেদিকে শাশুড়িমায়ের দৃষ্টি সদা-সজাগ। কাজের সুবিধার জন্য ‘উনি’ও চরকু নামে আরও একজন হাত-নুটকো চাকরও পাঠিয়ে দিয়েছেন। ডেকেহেঁকে সবসময় খোঁজ নেয় আমার তিন জা। বিমি আর ইলাকে বাড়ি এসে পড়িয়ে যান দেওয়ানবাড়ির বি এ পাশ ছেলে। খোকা তো ঠাকুমা-দাদু আর দিদিদের কোলে কোলেই বড় হচ্ছে। তিন নাতি-নাতনিকে ওঁরা তো চোখে হারান। কিন্তু এ বাড়িতে যে আরও একজন আছে; সে হল আমার ননদ রাণী। সে অভাগী তো আমাকে ছাড়া আর কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দেয় না। তাই এখন সে আর শুধু আমার ননদ নয়— সন্তানতুল্য। তাকে আমি কার হাতে দিয়ে যাব?     

    পুত্রশোকে কাতর এবং কন্যার দুর্ভাগ্যে মুহ্যমান শ্বশুরমশায় ও শাশুড়িমাকে ঝি-চাকরদের ভরসায় রেখে, নিজের তিন সন্তান নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়া— এমন সিদ্ধান্তে আমার মন যেন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। নানা গোলযোগে ‘উনি’ও এখন এমন ব্যস্ত যে খুব কম সুযোগ পান ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবার। আমি জলপাইগুড়িতে গিয়ে থাকলে ওঁকে তখন দু’দিকে ছুটতে হবে; আমাদের দেখভাল করতে জলপাইগুড়ি  যাবেন, না বাবা-মা এবং রাণীকে দেখতে বাড়ি আসবেন? আমার স্বামীর ওপর অযথা যে চাপ সৃষ্টি হবে তাতে আমিও কি ভাল থাকব? সবদিক বিবেচনা করেই এ চিঠি লিখছি। এ বাড়ির গুরুজনদের সায় থাকলেও আমি যেতে পারব না। আশা করি আমার এ অক্ষমতা আপনারা নিজগুণে মার্জনা করবেন।   

    মনে মনে আমিও কাতর আপনাদের কাছে গিয়ে থাকবার জন্য; মা, কাকিমা, কাকামণি, ভাই এবং বোনেদের কথা সবসময়েই মনে পড়ে। কিন্তু আমার সংসারের সংকট এবং দুর্বিপাক একেবারেই ভিন্ন। ফলত এই আমার একান্ত কামনা যে, মাকে আপনি নিজে বুঝিয়ে বলবেন।  

    আপনার কাছে এই নিবেদন যে, প্রতিবারের মতো এবারেও প্রসূতির-সেবন নিমিত্ত সেই হোমিওপ্যাথি ওষুধগুলি পাঠিয়ে দেবেন। তাতে শরীর ভাল থাকে। বাচ্চাদের হাম-কাশির ওষুধও একটু পাঠিয়ে দেবেন। ঘরে থাকলে নিশ্চিন্তি বোধ হয়।

    পূজ্যপদে প্রণামপূর্বক
    ইতি
    আপনার চরণাশ্রিত
    তরুলতা   

    চিঠি পড়া সমাপ্ত হলে রাণীর তালাবন্ধ ঘরটার দিকে তাকিয়ে, উদাস হয়ে বসে থাকলেন তরুর শাশুড়িমা। রাণী এ সময়টা ঘুমিয়ে নিয়ে সারারাত জেগে থাকে। তালা খুলে, চরকুকে নিয়ে ওই ঘরে গিয়ে ঝাঁটমোছ করিয়ে ঘরখানা পরিষ্কার করিয়ে দেয় তরুলতা। বেরিয়ে তালাবন্ধ করার সময়ে ওই দরজাটায় একটা সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে প্রণাম করে, একটা ফুলও ফেলে দেয়। এটাই তার প্রতিদিনের প্রার্থনা। রাণীর জন্য সুজির পাক, বার্লি, সাবুর খিচুড়ি, দুধ-মিছরি দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ, ঘি-মরিচ এসবও তরু নিজের হাতে করে। আর করে, খোকার খাবারটা। শ্বশুর-শাশুড়িমায়ের রাতের খাবারের খইটা নিজে বেছে, তবে দুধে দেয়। সকালের ভাতের একথালা চাল শাশুড়িমায়ের বসার জায়গায় নিয়ম করে তরু রেখে যায়; বিমি আর ইলা তার থেকে কিছুটা চাল দুটো ছোট থালায় দুজনে নিয়ে, ঠাকুমার সঙ্গে বসে যায় চাল বাছতে। তরুর নির্দেশে স্নানের আগে শ্বশুরমশায়ের ঘাড়ে, পিঠে, পায়ে তেল মাখিয়ে দেয় চরকু। শাশুড়িমাকে তেল মাখাতে আসে সরি-নাপিতিনি। এটুকু যত্নেই ওঁদের বাতের ব্যথায় অনেকটা উপশম হয়েছে। শাশুড়ির নির্দেশে আবার তরুকেও আসন্ন প্রসূতির উপযোগী মালিশ করা ধরেছে সরি। তারই মধ্যে বজায় আছে শ্বশুরমশায়ের চিঠি লেখার নেশা এবং শাশুড়ি-বউয়ের জমিয়ে ক্রুশ বোনা ও বই পড়ার আয়োজনও। তরু আর ভাবতেই চায় না যে, কী হলে কী হত! কারণ সে বুঝে নিয়েছে যে, পুলিশের বউ মানেই যখন-যেমন, তখন-তেমন। কিছু একটা মনে মনে ধরে বসে থাকলেই সমূহ বিপদ।      

    তরুর কান্নাকাটিতে ঠিক হল যে, পরদিন সকালেই তরু এবং তার খোকাকে নিয়ে পাটনা রওনা দেবেন তরঙ্গনাথের আরেক খুড়তুতো ভাই, অবিবাহিত সমরেন্দ্র এবং হরুর মা, মানে তার সেজোমাসিমা আর সেই বাচ্চা-চাকর চরকু।

    নমো নমো করে সাত মাসের সাধভক্ষণ করালেন তরুর শাশুড়ি। ন’মাসের সাধ দিতে এ-বাড়িতেই এলেন তরুর বাবা-মা এবং কাকিমা। ঠিক হয়েছে যে খোকার মতোই, এবারেও বাড়িতেই প্রসব হবে তরুর; এমনকী একজন অ্যাংলো নার্সেরও ব্যবস্থা করে রেখেছেন তরঙ্গনাথ। তনুর বাবার পায়ের ফুসকুড়িটা যে আসলে কার্বাঙ্কলের একটা মুখ, প্রথমে সেটা মাথায় আসেনি  কারোর। ক্রমে সেটা ফেটে বাড়াবাড়ি হওয়ায় ইঞ্জেকশন-ওষুধ করে সামাল দেওয়া গেছে; হাসপাতাল নিয়ে যেতে হল না। চেনাজানা থাকায় ব্যারাকপুর সদর হাসপাতালের এক ডাক্তার এবং নার্স মিলে বাড়িতেই অপারেশন করে সারিয়ে তুলতে লাগল সেই ঘা। কিন্তু এ সময়ে তাঁর হেঁটেচলে বেড়ানো প্রায় বন্ধ রাখতে হল। ওই ঘায়ের ড্রেসিং করতেই অ্যাংলো নার্সের আসা-যাওয়া ঘটেছে। সে এসেই খানিক আবোলতাবোল বকে চার বছরের দুরন্ত খোকাকে আদর  জানায়; তারপর বিমি আর ইলার সঙ্গে গপ্পো জোড়ে ইংরেজিতে; অন্যদের সঙ্গে অবশ্য ভালই বাংলা বলে; ড্রেসিং করে সে চলে গেলে শ্বশুরমশাই হাসতে-হাসতে বলেন, একঢিলে দুই পাখি কাত— তাঁর কার্বাঙ্কল এবং বিমি-ইলার বাংলা-শিক্ষা। কিন্তু এরই মধ্যে বিনামেঘে একেবারে বজ্রপাত। পাটনা থেকে তার এল যে, ঘোড়ায় টানা ‘টমটম’ গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে, অজ্ঞান অবস্থায় পাটনার পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তরঙ্গনাথকে। শোনামাত্র এমন অস্থির হয়ে  পড়ল তরু যে, তখন তাকে সামলানোই দায়। শাশুড়িমা ভয় পেলেন যে ভরা মাসে, এই উদ্বেগেই না সময়ের আগেই সন্তান জন্মে যায় তরুর। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলে গেলেন যে, তেমন ভয়ের কিছু নেই;  কারণ ব্যথা ওঠবার সময় তখনও হয়নি। মা এবং বাচ্চা দুজনেই সুস্থ আছে।     

    তরুর কান্নাকাটিতে ঠিক হল যে, পরদিন সকালেই তরু এবং তার খোকাকে নিয়ে পাটনা রওনা দেবেন তরঙ্গনাথের আরেক খুড়তুতো ভাই, অবিবাহিত সমরেন্দ্র এবং হরুর মা, মানে তার সেজোমাসিমা আর সেই বাচ্চা-চাকর চরকু। পাটনা পৌঁছে জানা গেল যে, সাহেবদের জন্য কোয়ার্টার অকুলান হওয়ায় তরঙ্গনাথকে তখন থাকতে বলা হয়েছে বাঁকিপুরে; পরিবারের কেউ সঙ্গে থাকে না; ফলে তরঙ্গনাথ একা মানুষ। বাঁকিপুরের মাধুনিয়া কুঁইয়ার নামে এক জায়গায় খুব বড় একটি বাগান দেওয়া বাড়িকেই তাঁর কোয়ার্টার বলে চিনিয়ে দেওয়া হল। দেওর সমরেন্দ্র এবং মাসিশাশুড়ির সঙ্গে চার বছরের খোকার হাত ধরে, সেই খালি বাড়িতে এসে ঢুকল তরু। আরদালি, চাকরের অভাব না হলেও,‌ দেখা গেল যে ওই বাড়ি থেকে হাসপাতাল খুব দূরে না হলেও ঘণ্টা-আধেকের পথ; খোকাকে চরকু-সমেত মাসিশাশুড়ির কাছে রেখে, যে গাড়িতে পাটনা স্টেশন থেকে তারা এসেছিল, সমরেন্দ্রকে নিয়ে সেই গাড়িতেই তরু চলে গেল হাসপাতালে; সাহেব ডাক্তারকে বুঝিয়ে, বন্ডে সই করে তরঙ্গনাথকে বাড়ি নিয়ে এল তরু। বলে-কয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে এল হাসপাতালের সেই রেলিং দেওয়া খাটখানিও। বাড়ি এসেই সবচেয়ে প্রশস্ত ঘরখানিতে হসপিটাল-বেডে সুন্দর করে বিছানা করে দিল তরু; স্ট্রেচারে শোয়ানো তরঙ্গনাথকে সেই খাটে শুইয়ে দিতেই, লজ্জায় চোখ বুজে রইলেন তিনি; ওই ঘরেই একটা বড় চৌকি পেতে তরুর শোবার জায়গা; পাশের ঘরে খোকাকে নিয়ে মাসিমা ; এবং গেস্ট রুমে সমরেন্দ্র। সবকিছু গোছগাছ সেরে চরকুর সাহায্য নিয়ে তরঙ্গনাথকে ভাল করে গা স্পাঞ্জ করে,  ঘরে পরার ফতুয়া দিয়ে দিল তাঁর গায়ে। ধুতিটা দু ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো জড়িয়ে দিল তাঁর নিম্নাঙ্গে। দুপুরের রান্না এবং সেইমতো বাজারের নির্দেশ আরদালিকে দিয়ে, চরকুকে বলল, পাতা ভিজিয়ে কয়েক কাপ-চা  করে, ট্রেতে সাজিয়ে তরঙ্গনাথের ঘরে নিয়ে আসতে। ধীরে-ধীরে ঘরে এলেন সমরেন্দ্র এবং খোকাকে নিয়ে মাসিমা; এই প্রথম দিনের বেলা বাবাকে খাটে শোয়া দেখে খোকা যেন একটু ঘাবড়ে গেছে; শান্ত ছেলেদের মতো মাসিদিদুর আঁচল ধরে তাঁর পায়ে-পায়ে ঘুরছে। ঝটপট করে স্নান সেরে নিয়ে, তরুও এসে চা নিয়ে বসল সবার সঙ্গে। তরঙ্গনাথের বেডের ব্যাক রেস্টটা সমরেন্দ্র উঁচু করে দিতেই, স্বস্তি করে চায়ে চুমুক দিলেন তরঙ্গনাথ। চা-পর্ব শেষে নিজের পানের কৌটোটা খুলে তরু তা এগিয়ে দিল তরঙ্গনাথের দিকে। সাজা পানের একটা খিলি ডিবে থেকে নিয়ে,  নিজের মুখে গুঁজে তরুর দিকে চেয়ে তরঙ্গনাথ বললেন, ‘এই ওষুধেই ভাল হয়ে যাব।’ তরু শুধু সলজ্জ হাসল। হাসলেন মাসিমাও; কারণ ওই পানের ডিবের ওপরে লেখা, ‘সুখে থাক— তরু/তনু’। তনু আর তরুর এ-এক নিভৃত প্রেম। এক ডিবে থেকে পান খাওয়া; এবং কাছাকাছি থাকলে, একে অপরকে দিয়ে খাওয়া। খোকার অন্নপ্রাশনের বাসনের সঙ্গে, ডিবের ওপর ওই লেখাটি এনগ্রেভ করিয়ে তরুকে উপহার দিয়েছিলেন তরঙ্গনাথ। রুপোর এই ডিবেটাই যেন তাঁদের প্রেম-ভালবাসার সিগনেচার! রুপোর ডিবেতে পানের ওই খিলিগুলো যেন শ্যাওলা সবুজ প্রবাল আলোর ছটা! বন্ধ ডিবে ভেদ করেও যা দ্যুতি ছড়ায়। 

    বাড়ির কর্তাই যে আপাতত শয্যাশায়ী, বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। একটু সুস্থ হয়ে উঠতেই, হুইল চেয়ারে করে বাইরে এনে বসিয়ে দেওয়া হয় তরঙ্গনাথকে; হাঁটুর ওপর একটা খাকি শাল চাপা দিয়ে, ঊর্ধ্বাঙ্গে পুলিশের শার্ট পরে বসে বসেই, তিনি অফিস শুরু করে দেন সকাল থেকে। এ জায়গাটা পাটনা থেকে মিনিট কুড়ির পথ। কাছেই বাঁকিপুর জেল। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের মধ্যে যারা তুলনায় শান্ত, তাদের মধ্যে থেকেই কয়েকজনকে বেছে নিয়ে, সকালের দিকে এ বাড়িতে পাঠানো হয়। বাগান নিড়নো, রাস্তা ঝাঁট, কুয়ো থেকে জল তুলে বড়-বড় বালতি ভরে রাখা— এসবের জন্য। মাঝে মাঝে খোকাবাবুকে কোলেপিঠে নিয়ে বারান্দায় বসে খেলাও করে তারা। তরুর তো কোনও দিনই ভয়ডরের বালাই নেই; উলটে, অসীম মমতায় সে পেট ভরে খাইয়ে দেয় তাদের। তবে কখনোই কোনও গল্পগুজব করে ভাব জমায় না ওদের সঙ্গে।    

    মাসিমাকে বলা তরঙ্গনাথের গল্প থেকে সে জেনেছে যে, বাঁকিপুরের এ জায়গাটা জঙ্গলে ঘেরা। ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের পরে, হেস্টিংসের নির্দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার জন গার্স্টিন নামে এক সাহেব এখানে একটা মস্ত গোলা তৈরি করেন। সময়টা ১৭৮৬। স্থানীয় পাথর দিয়ে তৈরি এই আশ্চর্য গোলঘরটি তরঙ্গনাথ দেখেও এসেছেন। কোনও পিলার ছাড়াই একশো মিটার উঁচু যেন একটা স্তূপ; এ জন্যই এর নাম ‘গোলঘর’। প্রায় এগারো-বারো ফুট মোটা তার দেওয়াল এবং ভেতরটা গোলাকৃতি হলেও বিশাল বড়; বাইরে দিয়ে গেঁথে তোলা, একশো পঁয়তাল্লিশটা ধাপের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠলে, স্তূপের মাথায় একটা বড় গর্ত। নীচে থেকে খাবার নিয়ে এসে, ধাপে-ধাপে তুলে, ওপর থেকে তা ওই গর্ত দিয়ে ফেলে-ফেলে মজুত করা হত। আর এর মাথায় উঠলে গঙ্গা সমেত শহরটাকেও ভারী সুন্দর দেখা যায়। এই ‘গোলঘর’ নাকি স্থাপত্যের মতোই সুন্দর।      

    আর স্থানীয় লোকেরা যাকে বলে ‘কুঁইয়ার’ তার আসল নাম ‘আগম কুঁয়া’। সম্রাট অশোকের তৈরি; সন্দেহভাজনদের চরম শাস্তি দিতে এই কুয়োয় ফেলে দেওয়া হত; এই কুয়ো নাকি সরাসরি গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত। তখন অবশ্য তিনি ‘ধর্মাশোক’ হননি; একেবারেই ‘চণ্ডাশোক’। আকবর এটির সংস্কার করেছিলেন। এই মস্ত কুয়োতে ঢোকা-বেরনোর জন্য আট দিকে আটটি দরজা আছে। মনের আশা পুরোতে, হিন্দু, মুসলমান, জৈন, আদিবাসী সকলেই পয়সা ও ফুল ফেলে এই কুয়োতে; এটাও দেখে এসেছেন তরঙ্গনাথ। খোঁজ নিয়ে এ-ও জেনেছেন যে, গ্রাম গ্রামান্তরের মানুষ এখানে এসে পুজো দেয় পাশের শীতলা মন্দিরে; যার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দ্বারী ‘যক্ষ’। এ ছাড়াও আছে পিণ্ডদানের জন্য সপ্তমাতৃকার মূর্তি। যে হেতু গঙ্গার সঙ্গে যোগ আছে, তাই এই কুয়োর জলকেই পবিত্র মেনে হিন্দুদের নানা শুভকাজে ব্যবহারও করা হয়। বছর কুড়ি আগে, পুরাতত্ত্বের গবেষক লরেন্স ওয়াড্ডেল নামে এক স্কটিশ সাহেব এটি চিহ্নিত করেন। ১৮৮০ সালে লেখা ক্যানিংহাম সাহেবের রিপোর্ট পড়েই যে তরঙ্গনাথ এসব জেনেছেন, সে কথাও বলেছেন তিনি। তবে তাঁর ধারণা যে অতশত মূর্তি-মাহাত্ম্য সাহেবরা তেমন বোঝেনি; কিন্তু লোকজনের কথা থেকে প্রাচীন এই স্থান-মাহাত্ম্য আন্দাজ করেছেন তিনি। এমন সব গপ্পোগাছা এবং কাছেই দ্বারভাঙার মহারাজের প্রাসাদ এ খবর জেনেই তরু এবং মাসিমা তো দারুণ উত্তেজিত। সমরেন্দ্র উদগ্রীব ‘পাঁচ পাহাড়ির’ পথ ধরে উঁচু টিলার ওপর সূর্যমন্দির এবং প্রায় বাড়ির হাতায় গুলজারবাগ রেল স্টেশন দেখবার জন্য। তরঙ্গনাথ হাসতে-হাসতে বললেন, ‘এমন সুন্দর এক অঞ্চল, আশেপাশে এত বৌদ্ধ বিহার, জৈন মন্দির! অথচ সাহেবরা কেবলই এখানে জেলের পর জেল বানিয়ে চলেছে! বাঁকিপুর ছাড়াও খুব কাছেই আছে ‘বেওর’ নামে আরও এক জেল। কোর্ট-কালেক্টরেট-জেল বসিয়ে এই অঞ্চলটাকেও প্রশাসনিক এলাকা করে গড়ে তুলতে চাইছে তারা। আবার এখানেই রাজা রামমোহন রায়ের নামে ইংরেজি ইস্কুল খুলেছে একটি ব্রাহ্ম ছেলে। তার থেকেও আশ্চর্য যে, বছর খানেক আগে এখানেই কংগ্রেসের বাৎসরিক মিটিং-ও হয়েছে। স্বাধীনতার প্রশ্নে ইংরেজ বিরোধিতায় বিহারও যে এখন ফুঁসছে।      

    সোদপুরের বাড়ির জন্য দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও, তনুর সান্নিধ্যে এবং মাসিমার যত্নে ভালই কাটছে তরুর দিনগুলো। প্রসবের সময় এগিয়ে আসছে বলে আজকাল তার শরীরটা যেন একটু বেশিই আনচান করে; তবে প্রসব নিয়ে চিন্তা নেই, কারণ পাটনা সদর হাসপাতালে সব ব্যবস্থাই পাকা করা আছে। তরুর প্রসব না-হওয়া অবধি মাসিমা এবং সমরেন্দ্রও এখানেই থাকবেন। তবু তরু যে কত কী গুছিয়ে রাখছে তার যেন আর ইয়ত্তা নেই! কিছু না হোক, দিন-তিনেক তো তাকে বাড়ি ছেড়ে হাসপাতালে কাটাতেই হবে!  

    আমি তরু, তরুলতা। সন্তানের জন্ম দেওয়ার অভিজ্ঞতা কি আর নতুন কিছু! এর আগে তিনবার যে মা হয়েছি, সে তো একেবারে স্বাভাবিকভাবেই। প্রসবযন্ত্রণার সময়টুকু থেকে নাড়িকাটা অবধি যা একটু কষ্ট! তবে এবারে যেন সবকিছু আলাদা ঠেকছে। শাশুড়িমা, রাঙাদি, সরি-দাই, এরা কেউই কাছে নেই বলেই কি? কেন মনে হচ্ছে, যদি আর না বাঁচি! প্রসব হতে গিয়েই কিছু যদি হয়ে যায়! ভাগ্যিস জলপাইগুড়ি যাইনি! খোকার বাবার যে কী হত ভাবতেই আতঙ্ক হয়!

    ফাল্গুন মাস; তবু ঝড় এল, বাতাস উড়িয়ে। সেইসঙ্গে বৃষ্টি আর মেঘের গর্জন; সকালবেলাতেই  যখন একটু-একটু ব্যথা উঠছিল, তখনই হাসপাতাল চলে যাওয়া উচিত ছিল। কাউকে কিছু বুঝতে না দেওয়ায় বিপদ ঘনিয়ে এল। সন্ধের জো লাগতে না লাগতেই, আছাড়ি-পিছাড়ি ব্যথা আর সেইসঙ্গে ঘর-ভাসানো-বমি। বৃষ্টি দেখে ড্রাইভারকেও তো ছুটি করে দেওয়া হল। এখন উপায়! আর এইরকম ঝড়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়াও কি যেত?  মাসিমা তো একনাগাড়েই সেঁক-তাপ করে চলেছেন তরুর কোমরে; অস্থির তরঙ্গনাথ ডাকাডাকি করে তিনজন আরদালিকেই দরজার বাইরে এককাট্টা করেছেন। কিন্তু কাকে ডাকতে, কোথায় যাবে তারা! এদিকে আমার তখন হাঁড়েফাড়ে অবস্থা। অন্যদিকে খোকাকে নিজের বিছানায় শুইয়ে পাথরের মতো বসে আছেন তার বাবা। বুঝতে পারছি যে, আমার এই প্রবল জলভাঙার পরেই ভূমিষ্ট হতে চাইবে সে। সে প্রস্তুত হলেও আমিই তো প্রস্তুত হতে পারিনি। আপনা থেকেই বমি বন্ধ হয়ে, নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। কানে যাচ্ছে, আরদালিকে সঙ্গে দিয়ে সমরেন্দ্রকে যেন কোথায় একটা পাঠাচ্ছেন মাসিমা; কর্তার ক্ষমতা নেই যে, বিছানা থেকে নেমে এসে আমার হাতটুকুও ধরবেন। ঘরের মধ্যেই আমার চারপাশটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে বড়-বড় চাদর দিয়ে; পায়ের দিকে একটু দূরে রাখা আছে আঙরাখার আগুন। মাসিমা শান্ত হয়ে বসে ভরসা দিচ্ছেন আমাকে; আর সমানেই বলে চলেছেন, ‘আর একটু বেগ দাও বউমা… কোনও ভয় নেই… এই তো, এই তো হয়ে এল…।’   

    বৃষ্টি আর বাজের শব্দে ভীষণ ভয় করছে আমার। রাধাকান্ত! রাধাকান্ত! বাঁচিয়ে রাখো আমাকে!

    মনে হল যেন সমরেন্দ্রর গলা পেলাম! সে কি ফিরে এল কোনও ব্যবস্থা নিয়ে! ঘড়ির ঢং শুনে বুঝলাম যে, রাত দুটো। কার যেন  হাতের স্পর্শ পেলাম না! মাসিমার সঙ্গে কীসব কথা বলাকওয়া চলছে; একজন মেয়েমানুষ দেহাতি ভাষায় কীসব বলে যাচ্ছে; আমার পা-দুটোকে টেনে শক্ত করে ধরে কিসের সঙ্গে যেন বেঁধে দিল। হাতদুটো নিয়ে আছাড়ি-পিছাড়ি ব্যথায় কাতরাতে-কাতরাতে আমি শুধু শুনছি ‘অওর থোড়া— অওর থোড়া— হিম্মৎসে’। যোনিদ্বারে এসে থেমে গেছে জন্মস্রোত। আরেকজনের গলাও পাচ্ছি; কীসব মন্ত্র আওড়াতে-আওড়াতে সে শুধু বলছে, ‘ভাগ ভাগ— ভাগ হিঁয়াসে!’    

    চরম দাপাদাপির পর খুকি হল। তখন, কোথায় বৃষ্টি আর কোথায় বাজ! আকাশ আলো করে সূর্য উঠছে। নাড়ি কেটে, ন্যাকড়ায় মুড়ে্, শিশুটিকে আমার মুখের কাছে নিয়ে এসে, শক্তসমর্থ এবং মাঝবয়সি অচেনা এক দেহাতি মেয়ে আমাকে বলল, ‘লে লে, তোর খোঁকিকে দেখ লে’। প্রায় ওইরকমই চেহারার আরও একজন পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘বাঁধ দিয়া— এ লকড়িসে সব কুছকো বাঁধ দিয়া— ডরো মৎ বেটি…।’   

    শাশুড়িমায়ের মতো ধপধপে গায়ের রং পেয়েছে খুকি; আর পেয়েছে মাথাভরা চুল…

    একটু গরম দুধ খাইয়ে দিতেই, অবসন্ন ভাবটা কেটে ঘুম এসে গেল আমার। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম জড়ানো চোখে দেখলাম, খুকিকে কোলে নিয়ে মাসিমা বসে আছেন।  সারারাত জেগেও এতটুকু ক্লান্তি নেই তাঁর বসার ভঙ্গিতে। তাঁর কোলে শোয়া খুকিকে ঘিরে জানলা দিয়ে ঢুকে আসছে ভোরবেলার রাঙা রঙের আলো।

    আওয়াজ পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখি, দরজার কাছে হুইল চেয়ারে বসে কর্তা এসেছেন। আঁতুড় বলে ঘরে ঢোকেননি; আর তাঁর পিছনেই দাঁড়িয়ে সমরেন্দ্র। ওখান থেকেই কর্তা বললেন, ‘বাড়িতে তার করে দিয়েছি, খুকি হয়েছে বলে।’

    আমি তখনও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, ‘খোকা? সে তো আমার বিছানায় দিব্যি ঘুমুচ্ছে।’

    গতকাল রাতের সেই উপশ্রান্ত বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কি এবার ঝরে পড়তে লাগল আমার দু-চোখ বেয়ে! আমি তো এত সহজে কাঁদি না! আজ আমার এ কী হল!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook