তরঙ্গনাথ – এগারো
সদ্যোজাত কন্যাকে অভ্যর্থনা জানাবেন কি, তরঙ্গনাথ তো জেরবার হয়ে আছেন নানা ভাবনায়। একদিকে নিজের অশক্ত শরীর এবং অন্যদিকে যুদ্ধের বাজার। এ তো একেবারে ঘরে-বাইরে লেগে যাওয়া বিশ্বযুদ্ধ! ইতিহাসবইয়ে পড়া, সেই রাজায়-রাজায় যুদ্ধ এবং জয়-পরাজয় শেষে রে-রে করে দখলদারি, তা তো নয়; এ-যুদ্ধ লেগেছে জোটবাঁধা দেশগুলির মধ্যে; Allied এবং Axis Power Politics. পলিটিক্স ব্যাপারটা ব্রিটিশদের একেবারে মজ্জাগত। একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায় যে, ঘরে-বাইরের পলিটিক্সে কী নিখুঁত পরিকল্পনা তাদের। ‘যুদ্ধের বাজার’ এই সন্ত্রাস বাইরে ছড়িয়ে সব থেকে বেশি ফায়দা লুটছে তারাই; সবটাই দেখছে তাদের মুনাফা লোটার স্বার্থে। তরঙ্গনাথ এখন যে-পদে আছেন, সেখানে শুধু আর জেল-হাজত-ধরপাকড় নয়, তাঁকে দেখতে হয় লাইসেন্স বিভাগের কাগজপত্রও। তা থেকেই তিনি বুঝতে পারেন যে, অস্ত্র এবং মদের ব্যবসায় কতখানি দরাজ হয়ে আছে এই সাহেব-সরকার। দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে একদল লোককে তারা পেটোয়া বানাচ্ছে, লোভীকে আরও লোভী করে দিয়ে। খুব সূক্ষ্মভাবে মিলিয়ে-মিশিয়ে চালাচ্ছে আর্মি এবং পুলিশের সহাবস্থান। পুলিশকে সামনে রেখে যে প্রশাসন চালাচ্ছে, সেখানে সিস্টেম এমন নিখুঁত যে ‘জাস্টিস’ ছাড়া আর কিছু যেন ধোপেই টিঁকবে না; আর এই প্রশাসনের ভাষা বোঝে রাজা-মহারাজা, জমিদার এবং শহুরে শিক্ষিতরাই; ফলে আদিবাসী বা ‘ট্রাইবাল’দের জন্য তাদের দাওয়াই একেবারে অন্য। বিশেষত বর্ডার এরিয়ায় যারা দল বেঁধে থাকে এবং কোনও কিছুর জন্যই যারা ব্রিটিশদের কাছে হাত পাততে বা রফা করতে আসবে না। তাদের জন্য কিছুটা ছাড় দিয়ে স্বায়ত্তশাসনের সুবিধে দিচ্ছে; কিন্তু বর্ডার এলাকা থেকে তাদেরই বেচ্ছে নিচ্ছে যুদ্ধ-শ্রমিক হিসেবে। শুধু যে এক-এক প্রদেশে এক-এক নীতি তাই নয়, একই প্রদেশের নানা অঞ্চলে বিবিধ নীতি চালাচ্ছে তারা। পুলিশকে মানুষ যত ভয় পায়, ‘আর্মি’কে ততটা নয়। কারণ সাধারণ মানুষ তাদের চেনেই না। স্বদেশিরাই বা এটা কতটা কী বুঝতে পারছে, সে-ব্যাপারেও তরঙ্গনাথ খুবই সন্দিহান। পুলিশের উচ্চপদে না বসলে এত সূক্ষ্ম চালগুলো তো বোঝাই যাবে না। স্তরে-স্তরে বিভেদ পরিকল্পনাই তাদের আসল ট্রিকস। তরঙ্গনাথের দৃঢ় ধারণা যে, যুদ্ধ লাগার ফলে তাদের দুটো সুবিধে হবে; একদিকে এদেশের মাথাদের কাছে সমর্থন চেয়ে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে দেখিয়ে একটা ভিন্ন ইমেজ গড়বে সাহেবরা। অন্যদিকে সমর্থনের প্রশ্নে একটা বড় রকমের বিভেদও তৈরি করা যাবে স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে। হয় ব্রিটিশ, নয় জার্মানি— একটার জায়গায় দ্বৈরথ এবার দু-দুটো বিদেশিশক্তির প্রশ্নে। তরঙ্গনাথের সব থেকে দুঃখের কারণ হল, তাঁর নিজের পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতা। কেস, কোর্ট, কাছারি, শাস্তি, জেল এবং গুপ্তহত্যা— এসবে অনুমোদন দিতে হবে তাঁর নিজের দেশের মানুষগুলোর বিচারেই। তরঙ্গনাথ মনে করতে পারেন না, সিভিল আইনে ধরে কোনও সাহেবকে তিনি হাজতবাস করিয়ে বেত মেরে কথা আদায় করেছেন বা কোর্ট অবধি নিয়ে যেতে পেরেছেন বলে!
এসব বিষয় ভাবতে বসলেই প্রথমেই তাঁর মনে পড়ে হরুর কথা। তার একটা অনুসন্ধিৎসু মন আছে। সতেজ পাপড়িগুলো না ছিঁড়েও ফুলের মধ্যে পোকাটা সে সহজেই দেখতে পায়। আবার একইসঙ্গে বিষণ্ণও হয়ে পড়ে না সহজে। উদার স্বাধীনতার খোঁজে সে নিয়ত যুক্ত রেখেছে নিজেকে। সংসারেও জড়িয়ে আছে একটু আলগা ভাবেই। ফলে তার নিজস্ব ভুবনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে বাধা কোথায়? তরঙ্গনাথের মনে আসে, ভূতেশের কথাও। তার পরিবারের যে-একাংশ পড়ে আছে সোদপুরে, সেখানে যুদ্ধের বাজার নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। ঘরের অনটনে যেন ঘরই ভরসা। কিন্তু দুই মেয়ে এবং পরিবার নিয়ে বাকি যে-অংশ, সে তো আছে তার শ্বশুরবাড়িতে। এদিকে আবার ভূতেশের ট্রান্সফার হয়েছে দিল্লিতে; ‘যুদ্ধের বাজারের’ আঁচ সবচাইতে বেশি তো সেখানেই। নিশির কাছে খবর আছে যে, ভূতেশ খুব দক্ষ হাতেই সব সামলে চলেছে। তরঙ্গনাথের পারিবারিক দুর্বিপাক, পুলিশের উচ্চপদ এবং নিজের মনের সঙ্গে ক্রমাগত সমঝোতায় তিনি একেবারে ক্লান্ত বোধ করছেন। তরু কাছে আছে বলেই ছোট বাচ্চাদের নিয়ে সামলে-সুমলে চলে যাচ্ছে। তবে আবার বদলির সময় হয়ে গেছে মনে হয়। ‘ইন্ডিয়ান’দের বেশিদিন এক জায়গায় রাখতে সাহেবরাও ভয় পায়। বিহারের শিক্ষিত-বাঙালি এবং অবাঙালিদের মধ্যে সুসম্পর্ককেও ওদের ভয়। অবিশ্বাসই ওদের চালিকাশক্তি। মনে এবং স্বভাবে ওরা হল এদেশের জমিদার এবং লন্ডন-পুলিশের এক জবরদস্ত মিশেল। ভোগ এবং ধরপাকড়ে মনে হয় সবচাইতে আনন্দ পায় ওরা। তরঙ্গনাথ আন্দাজ করতে পারছেন না, এবার কোথায় বদলি হবে তাঁর! মি. অগাস্ট অবসর নিয়ে ফিরে যাবার পর তেমন সখ্য ভাব আর গড়ে ওঠেনি অন্য এক জায়গায় ওপরওয়ালা সাহেবদের সঙ্গে। মনে-মনে ভাবলেন, দেখা যাক! অর্ডার হাতে না আসা অবধি তো চলুক।
২
পদ উচ্চ হল ঠিকই কিন্তু জায়গাটা একেবারেই জঙ্গল। পরিবার নিয়ে থাকতে পারবেন কি না এমন সংশয়ও যে মনে এল না, তা নয়! এবার আর বিহারের মধ্যেই নয়, একেবারে উড়িষ্যা। কোনারক যেতে পড়ে যে গোপ থানা, সেখানেই চলে যেতে হবে তাঁদের। একে সুপারিশ নেই, তার ওপর তোষামুদে নন; ফলে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি কি! বড় দুই মেয়ে ঠাকুমা-দাদুর কাছে বড় হচ্ছে। আর ছোট দুটো এখানকার ইশকুলে গিয়ে হিন্দি-ইংরেজি ভালই শিখছে। বাংলা তো বলতেই চায় না। ‘গোপ’ এমন এক জঙ্গুলে এলাকা, যেখানে বাঘ-ভালুক আর আদিবাসী ছাড়া আর প্রায় কিছুই নেই। খোকা-খুকি এবার ওড়িয়া শিখবে। অসুস্থতার কারণে এক মাস সময় দিতে চেয়েছিলেন সাহেব অফিসার। কিন্তু ওখানে জয়েন করলেই একটা জিপ পাওয়া যাবে শুনে, কালক্ষয় না করে সত্বর গোপ থানায় জয়েন করে যাওয়াই মনস্থ করলেন তরঙ্গনাথ। এখান থেকে পুরী যাওয়া তো কম পথ নয়! ধকলের কথা ভেবে তরু একেবারে বেঁকে বসল। ব্রেকজার্নি করে, সোদপুরে দিন পাঁচেক কাটিয়ে হাওড়া থেকে পুরী যাওয়াই সঠিক হবে; তরুর তাগাদায় তথাস্তু বলে বাবাকে চিঠিও লিখে দিলেন তরঙ্গনাথ।
পরমপূজনীয় বাবা, বাঁকিপুর-বিহার ২১ সেপ্টেম্বর ১৯১৯
এখান হইতে বদলি হইয়া, কোনারকের নিকট ‘গোপ’ নামক এক জায়গায় যাইতে হইতেছে। তাহার অগ্রে রিলিজ লইয়া, সপরিবার বাড়ি যাইতেছি; মনে হয় দিন পাঁচেক থাকিতে পারিব। তরুর একান্ত অনুরোধ যে, মা যেন খুকির মুখে প্রসাদ দিবার নিমিত্ত যৎসামান্য আয়োজন করিয়া রাখেন। বাড়ির বাহিরে আর কাহাকেও নিমন্ত্রণের প্রয়োজন দেখি না। অতি অবশ্যই রাঁধুনি এবং জোগাড়ের ব্যবস্থা রাখিবেন। বিমি, ইলা এবং রাণীর জন্য তিনখানি শাড়ি, খোকার জামা, খুকির চেলি-নূপুর এবং ঠাকুর-নাপিতের ধুতি-গামছা সবই তরু এইখান হইতে লইয়া যাইতেছে। বাদবাকি যাহা লাগিবে, তাহার সময়োচিত ব্যবস্থা করিয়া লইতে অসুবিধা হইবে না।
আমার শরীর অনেকটাই সুস্থ; তাহাদের মা-সহ বাচ্চারাও ভাল আছে। অযথা চিন্তা করিবেন না।
পুনঃ আপনাদের দেওয়া খুকির যাবতীয় নাম ব্রহ্মাণি, ঊষা, শান্তিময়ী, ধীরা— এ-সবই নাকচ করিয়া দিয়া খোকা তাহার বোনের নাম রাখিয়াছে ‘লাল খুকি’; কারণ সে-ও জন্মিয়াছে ভোরের সূর্যের মতোই, আকাশে লাল রং ছড়াইয়া। মাঝে মাঝে আবার তাহার প্রিয় পোষ্য ‘ভেলো’র সহিত মিলাইয়া তাহাকে ‘লেলো’ বলিয়াও ডাকে। আপনাদের সম্মতি থাকিলে, ধীরা নামটিও তাঁহার ক্ষেত্রে সুপ্রযোজ্য হইবে মনে হয়।
মাকে প্রণাম জানাইয়া
চির অবনত
ইতি
তরু।
যাবার আগের দিন সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। ‘খোঁকা’-‘খুঁকি’ আর ‘মাইজী’র জন্য কেঁদেই আকুল সেই আরদালি আর কয়েদির দল; এমনকী তরুর সঙ্গে দেখা করে গেল দুর্যোগের রাতে আসা সেই দেহাতি ধাই এবং তার ভূত তাড়ানোর শাগরেদটিও; শীতলা মন্দিরের পণ্ডিত ছোট একটা পেতলের ঘড়ায় করে নিয়ে এলেন গঙ্গা আর শোন নদ— এই ‘দ্বি-বেণী সঙ্গম’-এর পবিত্র জল, মাটির খুরিতে বসানো রাধা-তুলসী এবং কৃষ্ণ-তুলসীর চারা আর লাল শালুতে মোড়া এক বাণ্ডিল যষ্টিমধু; আরদালিকে দিয়ে কোন এক বিশেষ নিম গাছ থেকে পাড়িয়ে, তরু নিয়েছে মস্ত এক গোছা নিমের দাঁতন; আর কর্তাকে লাগাতার তাগাদা দিয়ে-দিয়ে কিনিয়েছে অসম্ভব সুন্দর নকশায়, এখানকার জেলের কয়েদিদের বোনা, সিল্কের দুখানা ঘরজোড়া শতরঞ্জি এবং ওই একই নকশা ও রঙে বোনা, খান ছয়েক বসবার আসন; একেবারে বনজঙ্গল থেকে উঠে আসা সব রং— লাল, হলুদ, আকাশি ও সবুজ। খোকার পোষা ভেলো কুকুরটাকে গলায় চেন পরিয়ে গাড়িতে তুলল চরকু। তার আর এক পোষ্য মটরি ছাগলটা একবার মাত্র ব্যা করে ডেকেই আবার ঘাস খেতে লাগল যে-কে সেই; তরুর যত চিন্তা ওকে নিয়েই। তার ধারণা যে, দেখভালের দায়িত্বে যার হাতেই দিয়ে আসবে তাকে, সেই-ই ওকে কেটে খাবে। শেষে তরঙ্গনাথ বললেন যে, ভেলো যদি যেতে পারে, মটরিই বা বাদ যাবে কেন! শুধু খোকা নয়, খুশিতে লাফাতে লাগল চরকুর সঙ্গে ভেলোও।
তরঙ্গনাথ একবার তাকালেন তাঁর বড় প্রিয়, সাদা ফুলে ভরা সেই গাঢ় সবুজ গাছটার দিকে। Gordonia— নিশ্চয়ই কোন বিদেশি ফুল। এমন গাছ এখানে এই একটাই। ওর ডালে-ডালে কুঁড়ি ধরা মানেই শরৎকাল এসে গেল। চার-পাঁচটা সাদা পাপড়ির মধ্যে উজ্জ্বল হলুদ রঙের একটা বড় ফোঁটা; সাহেবরা বলে, Fried Egg Flower! সাহেবদের দেওয়া এই ডাক নামটা শুনেই তরু বলেছিল, ‘মরণ দশা! ফুল দেখেও নোলা সকসক— এগ পোচ!’ রাতের বেলা ঘন অন্ধকারে সব কিছু ঢেকে গেলেও, সাদা ফুলগুলোর গায়ে আঁধারের কালো লাগে না। যেন বুদ্ধের চরণতলে জ্বলে থাকা সহস্র প্রদীপ। দিনের বেলা সূর্যের আলো এসে পড়লেও পাতাগুলো কিন্তু গাঢ় সবুজই দেখায়; শেড কার্ড মিলিয়ে একেবারে— Hooker’s Green!
মটরি ও ভেলোকে নিয়ে, মালপত্রের সঙ্গে চরকু তো আগেই পুরী পৌঁছে গেছে। তরঙ্গনাথ সপরিবার পুরী পৌঁছনোমাত্র একটা জিপ এসে তাঁদের রিসিভ করল। খাতির দেখে তরুলতারও আর বুঝতে বাকি রইল না যে, কতখানি পদোন্নতি হয়েছে তার স্বামীর। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গোপের পথ ধরতেই, সকলের চোখ এড়িয়ে তরঙ্গনাথকে প্রণাম করল তরুলতা; আড়ষ্ট তরঙ্গনাথ গভীর দৃষ্টিপাতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন তরুলতার দিকে। অবাক বিস্ময়ে সকলেই তাকিয়ে দেখতে লাগল, উত্তাল তরঙ্গে সমুদ্রের আছড়ে পড়া আর জলরাশির বিস্তার। তরঙ্গনাথ এই প্রথম মনে-মনে প্রার্থনা করলেন যে, বদলি নিয়ে খুব সত্বর যেন তিনি পুরীতেই পোস্টিং পান। বুকের মধ্যে যেন একটা সাড়া জেগে উঠল আশ্বাসের।
চন্দ্রভাগা বিচ, রামচণ্ডীতলা, কুশভদ্রা, কউখাই, চিত্রপলা— এমন সব নদী চোখ তো জুড়িয়েই দেয়; পুরী যেমন জগন্নাথের, এ-অঞ্চলটা আবার বলরামের। সাহেবদের নজর পড়েছিল নানা কারণে। বাণিজ্যপোত, লাইট হাউস বানিয়ে কালেক্টরেট বসিয়ে শাসনের চিহ্ন কায়েম করেছিল তারা। চাষিবাসী হিন্দুপ্রধান যে-অঞ্চলের মানুষ পুজো পাঠ করে, যেখানে ব্রাহ্মণী-বৈতরণি এমন সব নামের নদী-অববাহিকা, যেখানকার মানুষ সুখ পায় রসবলি, পটালি পিঠা, মগজা-লাড্ডু, ছেনাক্ষীরি, দইপাখালা এমন সব সুস্বাদু খাবার বানিয়ে, সেখানে নিজেদের স্বার্থে নজরদারি বসিয়ে তাদেরই চোর-ডাকাত ঠাওরাতে চায় সাহেবি শাসন। তরঙ্গনাথের এমনও মনে হল যে, এইসব অঞ্চলের রাজাদের খাজনায় কামড়ও বসাতে চায় তারা। সেই সঙ্গে চায় ‘ভিতর কণিকা’র মতো জঙ্গল-সম্পদকেও নিজেদের তাঁবে রাখতে। সমস্ত অরণ্যচারীই তাদের চোখে বিপজ্জনক। স্থানমাহাত্ম্যে তরঙ্গনাথ জেনেছেন যে, তীর্থযাত্রার সময়ে জাজপুরের কাছে এসে, লোকমুখে শুনে, ললিতাগিরি গুহায় থাকা অত্যাচারী ‘কাণ্ডারা’ অসুরকে ধাওয়া করে, বলরাম তাকে বধ করেন, তাঁর হাল এবং মুষল দিয়ে। যেখানে অসুরবধ হয়েছিল, সে-জায়গার নাম রাখেন ‘কাণ্ডারিপাধী’; ওই অসুরকন্যা তুলসীর ইচ্ছেতে, তাকে বিয়ে করে, ‘তুলসী ক্ষেত্র’ নামে একটি নতুন এলাকা চিহ্নিত করেন বলরাম। যেহেতু এই এলাকায় আত্মগোপন করে থাকতেও ভালবাসতেন বলভদ্র তাই এখানকার আর এক নাম ‘গুপ্ত ক্ষেত্র’। ‘গুপ্ত’ শব্দটাই নাড়িয়ে দিল তরঙ্গনাথকে। এমন জঙ্গল আর নদীঘেরা এলাকায় নিশ্চয়ই দানা বেঁধে উঠছে উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই কেন্দ্রাপাড়ার একদিকে সমুদ্র আর অন্যদিকে তুলনায় শহুরে জেলা— ভদ্রক, জাজপুর, কটক এবং জগৎসিংহপুর। আর আছে লুনা, কারাণ্ডিয়া, গোবারি, বিরূপা, কানি, হান্সুয়া, পাইকা এবং খরস্রোতা নামের অজস্র ছোট-বড়-মাঝারি নদী। বলতে গেলে জলে কুমির এবং ডাঙায় বাঘ সামলে বাণিজ্য; এবং একইসঙ্গে দল পাকিয়ে গজিয়ে ওঠা স্বদেশি বাহিনীদের দমন। ফলে জেল এবং পুলিশের সাহায্য ছাড়া সাহেবরা এঁটে উঠবে কী করে!
৩
১৯১৯। কী যে এক ভয়ংকর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল সাহেবরা। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সামলাতে এমনিতেই তারা ক্রমাগত পাশ করে যাচ্ছিল স্বাধীনতার পরিপন্থী বিস্তর সব আইন; অথচ যুদ্ধশেষে, ভারতীয়রা প্রত্যাশা করেছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে সাহেবদের কৃতজ্ঞ নজর; মন্টেগু-চেমসফোর্ড সাহেবদের ১৯১৮-র রিপোর্টের ভিত্তিতে বিস্তর আটঘাট বেঁধে আগামী দশ বছরের জন্য নাম-কা-ওয়াস্তে স্বায়ত্বশাসনের অনুমোদন চেয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশও করা হল, ‘Government of India Act’। বদলে কিনা এদেশেই জারি হয়ে গেল Rawlat Act নামে এক দমননীতি! আন্দোলনে ফুঁসে উঠল এখানকার লোকজন এবং কংগ্রেস দল। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এ-আইনের প্রয়োগ-কৌশলের বিরোধিতা করায় আবার শুরু হল দল ভাগাভাগির রাজনীতি ধরপাকড় এবং স্ট্রাইক। এমন উত্তাল অবস্থায় ডায়ার সাহেব দায়িত্ব পেলেন পরিস্থিতিকে বশে আনার; অমৃতসরের এক ধর্মীয় জমায়েতে গুলি চালাবার নির্দেশ দিয়ে মুহূর্তে মেরে ফেলা হল শয়ে-শয়ে নিরপরাধ মানুষদের। অমানবিক হত্যা-কেলেঙ্কারিরও এক নতুন নজির এবং ইতিহাস তৈরি করল ব্রিটিশ সরকার। তরঙ্গনাথ খবর পেলেন যে এই নৃশংস ঘটনা প্রকাশ পাওয়ামাত্র প্রতিবাদ হিসেবে, রবি ঠাকুর ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের ‘Sir’ উপাধি এবং ‘Nighthood’ সম্মান।
তরঙ্গনাথের ইচ্ছে হল আরও কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে। ১৯১৫। অ্যানি বেসান্তের ডাকা ‘হোম রুল’ আন্দোলনের জেরে প্রায় হাজারখানেক ছাত্রের জেল এবং দ্বীপান্তর হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ হয়েছে মিটিং-মিছিল; জেল হয়েছে অ্যানি বেসান্ত এবং তাঁর আরও দুই সহকর্মীর; ১৯১৭, সদ্য আমেরিকাফেরত বছর ছাপান্ন-র রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রতিবাদপত্র বেরোল The Bengali কাগজে। অ্যানি বেসান্তের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে টাউন হলে মিটিং আয়োজন করতে দিল না সরকার; তখন রামমোহন লাইব্রেরি হলে সেই মিটিঙে রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনালেন তাঁর লেখা ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ প্রবন্ধটি; দিন কয়েক পর এ-উপলক্ষে মদনমোহন মালব্য তাঁকে অনুরোধ করেন এমন একটি গান লিখতে, যার আবেদন হবে বিশ্বব্যাপী। রবি ঠাকুর লিখলেন এবং গাইলেন সেই গান। কিন্তু যখন কোনও হলেই বক্তৃতা দেবার সরকারি অনুমতি পাওয়া গেল না, এগিয়ে এলেন ১৯১০ সালে তৈরি হওয়া, কলেজ স্ট্রিটের অ্যালফ্রেড থিয়েটার হলের পারসি মালিক জামশেদজি ফার্মজি মদন। রবি ঠাকুরের বক্তৃতার আগে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ‘বিচিত্রা দল’ এই গানটি গাইলে, সে-গানে পাখোয়াজ সঙ্গত করেন নাটোরের রাজা জগদীন্দ্রনাথ।
এ-গানের সুরটা তরঙ্গনাথের তেমন ভাল করে তোলা না হলেও, কয়েক কলি লিরিক কিন্তু তাঁর মনে একেবারে গেঁথে গেছে।
‘দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী
আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি’
******************************
‘দিন আগত ওই, ভারত তবু কই?
দৈন্যজীর্ণ কক্ষ তার, মলিন শীর্ণ আশা
ত্রাসরুদ্ধ চিত্ত তার, নাহি নাহি ভাষা॥’
আমি তরঙ্গনাথ। পাটনা এবং বাঁকিপুরের পর এমন এক জায়গায় পোস্টিং হল যে নিজের ওপরেই ধিক্কার আসছে। যদিও খোকা এবং খুকি দুজনেই বেশ মজায় আছে। ইশকুল যাওয়ার বালাই নেই। সঙ্গী বলতে চরকু, মোটরি আর ভেলোর সঙ্গে ব্যারাকের সব পুলিশরা; আমি আর তরু এখনও কেউই তেমন ওড়িয়া বলতে পারিনি; বাচ্চারা কিন্তু দ্রুত শিখে ফেলছে একেবারে অ্যাক্সেন্টসমেত। খোকা আবার বায়না ধরেছে যে, তাকে আর তার বোনকে খোকা-খুকি না বলে ওড়িয়াদের মতো ‘পুয়ো’ আর ‘ঝিও’ বলে ডাকতে; ওদের মতোই শুরু করেছে মাকেও ‘বৌ’ বলে ডাকা; ‘আসছি’ না বল্ সারা দিয়ে বলে, ‘আইজ্ঞা!’ জিপ একখানা থাকলেও রাস্তা এমন সরু যে ঘোড়া চড়তেই হয়। ব্যারাকিদের উৎসাহে খোকার জন্য এসেছে বাহাদুর আর খুকির জন্য মেয়ে-ঘড়ী শালমৌরী। খুকি বছর সাত হতে-না-হতেই তরু তার ঘোড়ায় চড়া বন্ধ করেছে। খোকা একেবারে বীর পুঙ্গবের মতো দাপিয়ে ঘোড়া ছোটায়; কত রকম বিপদও বাধিয়ে আসে থেকে থেকেই; ঘোড়ায় তবু সে চড়বেই। শালমৌরীকে তার মালিক এসে নিয়ে গেলে খুকির সে কী কান্না! তরুর কাছে শুনলাম যে, তাকে শান্ত করতে গেঁয়ো আরদালি নাকি দুটো বেড়ালবাচ্চা নিয়ে এসে তাদের দু-ভাইবোনকে দিয়েছে। কিন্তু সেই বেড়ালদুটোকে দেখামাত্রই নাকি ভেলো আর মোটরি পরিত্রাহী চেঁচাচ্ছে এবং কিছুতেই নিজেদের কোন ছেড়ে বেরোচ্ছে না। ছুটির দিন অবসর পেয়ে, সে ছানাদুটোকে নেড়েচেড়ে দেখি যে, তারা একেবারে জাত বাঘের বাচ্চা। দিন পনেরো ধরে ন্যাকড়ার পলতে দিয়ে তরু তাদের দুধও খাইয়েছে। খোকা-খুকি-তরু কারোরই সায় নেই ওদের কোলছাড়া করবার। শেষে সেপাইদের দিয়ে দুটো হরিণের বাচ্চা আনিয়ে বাঘের সেই ছানাদুটোকে জঙ্গলে পাঠাবার ব্যবস্থা করলাম।
বাড়ির চারপাশে যে জঙ্গল সেখানে তো ভরে আছে বড়-বড় বিষাক্ত মাকড়সা, সাপ, বিছে এবং পোকা। রাতের বেলা মাঝে মাঝে বাঘ এসে উঠোনে শুয়েও থাকে। টিমটিমে ইলেকট্রিকের আলোয় ভাল ঠাওর হয় না বলে হ্যাজাকও জ্বালাতে হয়। টর্চ ছাড়া বেরোলেই বিপদ। শুনেছি ডাকাত পড়াও কিছু বিচিত্র নয়।
বিয়ের পর ইচ্ছে ছিল ফুলশয্যার রাতে উপহার হিসেবে তরুকে একটা রিভলবার দেবার; বিয়েটাই হল এমন এক ডামাডোলের মধ্যে যে, উপহার দেওয়া মাথায় উঠল। নতুন মোড়কে ওটা রাখাই ছিল আমার ‘জংলিশা’ ট্রাঙ্কে। এখনই যথার্থ সময় ওটা উপহার দেওয়ার; একটু শিখিয়ে দিলেই যে তরু ওটা চালাতে পারবে— এ-ভরসা আমার আছে।
খোকা-খুকিকে পাশের ঘরে ঘুম পাড়িয়ে, আমার খাটে এসে বসে, পানের ডিবে খুলে পান বার করার আগেই তরুকে বললাম, ‘এই নাও।’
তরু বলল, ‘কী এনেছ গয়না?’
‘খুলে দেখো; কেমন গয়না!’
বাক্সটা খুলে চামড়ার কেস থেকে বের করেই, সোজা সেটা আমার দিকেই বাগিয়ে ধরল সে!
উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চাইল, ‘কবে শেখাবে? এ-জঙ্গলে এটাই দরকার।’
বললাম, ‘এই না হলে আমার বউ! বিপদ বুঝলেই গুলি ছাড়াই ফাঁকা আওয়াজ করবে; ওই ঢিসুম শুনেই ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে; সে বাঘ বা ডাকাত যেই হোক না কেন!
ভাগ্যিস ওই অস্ত্রটা সেদিন তরুর কাছে ছিল! রাতের ধরপাকড় সেরে থানায় বসেই শুনলাম ঢিসুম ঢিসুম ঢিসুম…। আওয়াজটা যেন কোয়ার্টারের দিক থেকেই এল! মশাল জ্বেলে ক্যানেস্তারা বাজিয়ে কোয়ার্টার ঘিরে ফেলতেই ধরা পড়ল জনা চারেক দুর্ধর্ষ ডাকাত। দুজন সেপাইকে পিছমোড়া করে বেঁধে, ঝোপের ধারে ফেলে দিয়ে বাড়িতে ঢোকবার চেষ্টা চালিয়েছিল। পিছনের দিকে ঠুকঠাক শব্দ এবং ভেলোর চিৎকারে কিছু একটা আন্দাজ করে তরু জানলা ফাঁক করে রিভলবারের নলটা বার করেই ট্রিগার টিপে দেয়। পর পর তিনবার টেপার পর একটা আর্ত চিৎকার বাড়ির কাছে থেকে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে যেতেই তরু বুঝতে পারে যে, ওই গুলিতে কেউ একজন আহত হয়েছে বলেই পালিয়েও যাচ্ছে তারা।
লোকলস্কর নিয়ে, সোরগোল করে বাড়ি ফিরে দেখি কিছুতেই কেউ দরজা খুলছে না। অনেকক্ষণ পর খোকা আর চরকু এসে দরজা খুলে দিয়েই কাঁদতে কাঁদতে বলল যে, ভীষণ ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তরু।
এ-ঘটনায় একটা মস্ত লাভ হল যে, সাতদিনের মধ্যেই আমি বদলি পেলাম প্রথমে সাক্ষীগোপাল এবং তার ছ-মাসের মাথায় একেবারে পুরী।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র